হিন্দুদের জাত-পাত ও ভেদ-বৈষম্যের বোকামি, বিলুপ্তির কারণ হয়ে উঠবে ।প্রায় অর্ধ-শতাব্দীকাল আগের ঘটনা। পাড়ার স্কুল মাঠে দাঁড়িয়ে সিনিয়র কিশোরদের খেলা দেখছিলাম। কিশোররা দু’দলে ভাগ হয়ে খেলছিল। তারা সবাই হিন্দু। খেলা শেষে সন্ধ্যাবেলা উভয় দলের মধ্যে সামান্য কথা কাটাকাটির জেরে- পরাজিত দলের কয়েকজন পেশাগত মধ্যবর্ণের কিশোর, বিজয়ী দলের একমাত্র বংশানুক্রমিক ব্রাহ্মণ কিশোর সদস্যটিকে আক্রমণ করে বসলো।
ব্রাহ্মণ কিশোরটি তার দলের অন্যান্য সদস্যদের প্রতি সাহায্যের আবেদন জানাল,কিন্তু কেউ এগিয়ে এলো না। কিল,ঘুষি ও লাথি দিয়ে ব্রাহ্মণ কিশোরটিকে কাবু করে, একপর্যায়ে মধ্যবর্ণের সেই কিশোররা ব্রাহ্মণ কিশোরটির গলায় গামছা পেচিয়ে দু’দিক দিয়ে টানতে লাগলো। এক পর্যায়ে ব্রাহ্মণ কিশোরটির অবশ শরীর মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। ব্রাহ্মণ কিশোরটি মারা গেছে মনে করে, আক্রমণকারী মধ্যবর্ণের কিশোররা ছুটে পালিয়ে গেল। সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে সেই দৃশ্য দেখছিল।
কেউ আক্রান্ত ব্রাহ্মণ কিশোরটিকে সামান্য সাহায্য করা তো দূরের কথা, কেউ মৌখিক সহানুভূতিটুকু পর্যন্ত প্রদর্শন করলো না। উল্টো তারা ব্রাহ্মণদের উদ্দেশ্যে যা-তা গালিগালাজ করছিল। বেশ কিছুক্ষণ পরে ব্রাহ্মণ কিশোরটি অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়ালো। আমি জীবনে প্রথম প্রত্যক্ষ করলাম, ব্রাহ্মণ বিদ্বেষ। ওই ব্রাহ্মণ বালকটি ছিল একজন দরিদ্র পুরোহিতের পুত্র। সেই পুরোহিতের আরেকটি ছেলে ছিল, রুগ্ন ও সহজ সরল প্রকৃতির। গ্রামের মধ্যবর্ণের কিশোর ও যুবকরা, প্রায়ই স্কুলে-বাজারে-রাস্তাঘাটে সেই পুরোহিত পুত্রকে উলঙ্গ করে যে অপমান ও নির্যাতন করতো, তা ভাষায় প্রকাশযোগ্য নয়।
কয়েক বছর পরের ঘটনা। পাড়ার সেই স্কুল মাঠে বন্ধুদের সাথে খেলছিলাম। বলা নেই কওয়া নেই, হঠাৎ পেশাগত মধ্যবর্ণের এক বালক, দাম করে ঘুসি মেরে বসলো এক ব্রাহ্মণ বালকের নাকের উপর; রক্তে ভেসে গেল ব্রাহ্মণ বালকটির সারা শরীর। ব্রাহ্মণ বালকটির অপরাধ, সে মধ্যবর্ণের বালকটিকে ক্লিন বোল্ড করেছে; কিন্তু মধ্যবর্ণের বালকটি বোল্ড হওয়ার অপমানের বদলা নিয়েছে ঘুসি মেরে। ব্রাহ্মণ বালকটির তার চেয়েও বড় অপরাধ, এলাকায় ব্রাহ্মণদের সংখ্যা খুবই কম, আর মধ্যবর্ণের হাতে সমাজের নিয়ন্ত্রণ। আরোও কয়েকটি ব্রাহ্মণ বালক খেলার মাঠে উপস্থিত ছিল। তাদের মধ্য থেকে একটি বালক প্রতিবাদ জানালো। খেলার মাঠে উপস্থিত মধ্যবর্ণের বালকরা, ওই প্রতিবাদকারী ব্রাহ্মণ বালকটির দিকে তেড়ে তো গেলোই, রবাহুতো একজন পেশাগত মধ্যবর্ণের পথচারী যুবক- যেকিনা ঘটনার আদি-অন্ত কিছুই জানেনা; সে পর্যন্ত এসে প্রতিবাদকারী ব্রাহ্মণ বালকটিকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ শুরু করে দিল।
এরপরে কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। আমার থেকে অধিক বয়সী মধ্যবর্ণের এক বন্ধুর বিয়ে উপলক্ষ্যে গ্রামে নিয়েছি। বৌভাতের আগের দিন সারা গ্রামে মহাবিতর্ক- গ্রামের অল্প কয়েক ঘর ব্রাহ্মণ বাসিন্দা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তারা ওই বন্ধুর বৌভাত অনুষ্ঠান বর্জন করবে। দরিদ্র দুর্বল সংখ্যালঘু ব্রাহ্মণদের অভিযোগ- বন্ধুর পরিবারের পক্ষ থেকে প্রকাশ্যে বাজারে, গ্রামের ব্রাহ্মণদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করা হয়েছে। বন্ধুর পরিবার অকপটে ব্রাহ্মণদের গালিগালাজ করার কথা স্বীকার করল।
তাদের অভিযোগ, গ্রামের কুলোপুরহিতকে তারা বিবাহে পৌরহিত্যে-বাবদ একশত টাকা দক্ষিণা দিয়েছে; কিন্তু পুরোহিত মহাশয় বাড়তি আরো পঞ্চাশ টাকা দাবি করে বসেছে। বন্ধুর পরিবারের সদস্যদের ভাষায়- ব্রাহ্মণদের লোভ অত্যাধিক বেড়ে গেছে, এদের কোন লজ্জা শরম নাই, এরা ইতর অসভ্য ইত্যাদি। গ্রামের সবাই জানে, আমি হিন্দুত্ববাদী, বর্ণভেদ মারিনা; নিরপেক্ষ মানুষ- তাই সবার সাথে সুসম্পর্ক বিদ্যমান। তাই যারা বিবাদমান পক্ষ দু’টির মধ্যে আপোষ মিমাংসার চেষ্টা করছিল,তারা আমাকে সালিশ বৈঠকে নিয়ে গেল।
সভায় ব্রাহ্মণরা ভীষণ কোণঠাসা। সমাজ-নিয়ন্তা মধ্যবর্ণের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ জানাচ্ছে। তারা বলছিল- ব্রাহ্মণরাই সমাজটাকে শেষ করে দিয়েছে, এদের হিংসা-বিদ্বেষ ও ছুৎমার্গের কারণে হিন্দুজাতি ঐক্যবদ্ধ হতে পারছে না। আমি একটা প্রস্তাব দিলাম। পেশাগত ব্রাহ্মণদের সংখ্যা এক শতাংশেরও কম। এরা গরীব, সমাজে এদের কোন প্রভাব-প্রতিপত্তি নেই। আপনাদের যখন এতই আপত্তি,আপনারা এই এক শতাংশ ব্রাহ্মণদের সমাজ থেকে বাদ দিয়ে দিন। আপনারা পূজা-পার্বণ-বিবাহ প্রভৃতি অনুষ্ঠানে আর ব্রাহ্মণ-পুরোহিত ডাকবেন না; পৌরহিত্যের কাজ নিজেরাই সম্পাদন করুন; ল্যাটা চুকে গেল। বংশগত ব্রাহ্মণরা অন্য কাজ-কারবার করে জীবিকা নির্বাহ করুক। সবাই সহাস্য বদনে করতালি দিয়ে আমার প্রস্তাব সমর্থন করলো এবং আমাকে বাহবা দিল। আমি তাদের বললাম, আমার পুরো কথা শেষ হয়নি। আমার পুরো কথা শুনুন,তার পরে মতামত দিন।
আমি পুনরায় বলতে লাগলাম, আপনাদের ভাষ্য অনুযায়ী আপনারা সবাই হিংসা-বিদ্বেষ-ছুৎমার্গ ইত্যাদির বিরোধী; সর্বোপরি আপনারা হিন্দু ঐক্যের পক্ষে। সুতরাং হিন্দু সমাজের নমঃশূদ্র ও দলিত- যাদের সংখ্যা মোট হিন্দুর ষাট ভাগেরও বেশি, তাদের সঙ্গে বসে আগামীকাল বৌভাত অনুষ্ঠানে আপনাদের সবার পানভোজন করতে হবে, হিন্দু ঐক্যের স্বার্থে।
এবার মধ্যবর্ণের সমাজপতিদের মুখ চুপসে গেল। সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ নমঃশূদ্র ও দলিত সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি- যারা সালিশ বৈঠকে, নীরব দর্শক হিসেবে উপস্থিত ছিল, তারা সরব হয়ে আমার প্রতি দৃঢ় সমর্থন ব্যক্ত করলো; ব্রাহ্মণরাও তাদের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলালো। দুই পক্ষ একত্রিত হয়ে জানিয়ে দিল,তারা সমাজে মধ্যবর্ণের মাতব্বরি মেনে নেবে না। গভীর রাত পর্যন্ত আলোচনা শেষে সাব্যস্ত হল- পরবর্তী দিনের বৌভাত অনুষ্ঠানে, ব্রাহ্মণ-দলিত-নমঃশূদ্র-মধ্যবর্ণ সবাই একসাথে মিলে পানাহার করবে।
মহাভারত-এ আছে সমস্ত জগৎ ব্রহ্মার সৃষ্টি এবং সমস্ত মানুষ আদিতে ব্রাহ্মণ ছিল। সমস্ত হিন্দু কোন না কোনো ব্রাহ্মণ ঋষির বংশধর। বর্ণ এসেছে পেশা থেকে এবং বর্ণ পরিবর্তনযোগ্য। ব্রাহ্মণ শব্দের অর্থ ব্রহ্মজ্ঞানী। ব্রহ্মজ্ঞান বা জগত-সম্পর্কিত জ্ঞান বাদ দিলে, হিন্দুর আর থাকবেটা কী! কিন্তু প্রতিটি হিন্দুর পূর্বপুরুষ ব্রাহ্মণ হওয়া সত্ত্বেও এবং প্রতিটি হিন্দুর পুনরায় ব্রাহ্মণ-সমাজে ফিরে আসার অবাধ সুযোগ থাকা সত্ত্বেও- সমাজে এত ব্রাহ্মণ বিদ্বেষ কেন! অনেকে বলে থাকে, ব্রাহ্মণরা যে শাস্ত্র তৈরি করেছে,সেই শাস্ত্র থেকেই ভেদ-বিদ্বেষ এসেছে। এই ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল। যারা এই কথা বলে বেড়ায়, তারা প্রকৃত ইতিহাস জানে না।
বৃহদারণ্যক উপনিষদ ও মহাভারত থেকে জানা যায়, ব্রাহ্মণ থেকে সর্বপ্রথম ক্ষত্রিয় বর্ণের উদ্ভব ঘটেছিল। ধর্মগ্রন্থ ‘বেদ’- এর নির্দেশ হচ্ছে, প্রজারা যোগ্যতম ব্যক্তিকে জনমতের ভিত্তিতে রাজা নির্বাচিত করবে। কিন্তু লোভী রাজারা পরিবারতন্ত্র কায়েম করতে গিয়ে, পেশার ভিত্তিতে বংশানুক্রমিকভাবে হিন্দু জাতিকে নানান জাতপাত-এ বিভক্ত করে ফেলেছে। রাজার নির্দেশ ও ইচ্ছায় ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা শাস্ত্র রচনা করেছে- ঠিক যেভাবে দলিল লেখকরা অর্থের বিনিময়ে ক্রেতা ও বিক্রেতার নির্দেশ ও ইচ্ছায় দলিল লিখে দেয়। ব্রাহ্মণদের হাতে কখনো রাষ্ট্রক্ষমতা ছিলনা, যে নিজের ইচ্ছায় শাস্ত্র রচনা করে সমাজ বদল করবে।
হিন্দু জাতির মধ্যে কৌশলে ব্রাহ্মণ-বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিয়েছে মুসলিম শাসকরা। তখনকার বহুধা বিভক্ত, জ্ঞান-বিমুখ পরাধীন হিন্দু জাতির মধ্যে,যা একটু-আধটু বিদ্যাচর্চার প্রচলন ছিল কেবল ব্রাহ্মণদের মধ্যে। এই বিদ্যার জোরেই ব্রাহ্মণ সমাজের মধ্য থেকে উঠে এসেছিলেন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু, রাজা রামমোহন রায়, হরিচাঁদ ঠাকুর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, গুরুচাঁদ ঠাকুর-এর মতো মহামানব ও যুগনায়ক। এই প্রাতঃস্মরণীয় মহামানব ও যুবনায়কগণ জাতপাতের ঊর্ধ্বে হিন্দুজাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন।
তাছাড়া, বিদেশি মুসলমান দখলদারদের কবল থেকে ভারতভূমি উদ্ধার করার জন্য, সর্বপ্রথম ঐতিহাসিক স্বাধীনতা যুদ্ধ করেছিলেন এক ব্রাহ্মণ সেনানায়ক- হেমচন্দ্র বিক্রমাদিত্য। যার দীর্ঘ ধারাবাহিকতায় আরেক ব্রাহ্মণ সেনাপতি বাজিরাও বল্লাল ভট্ট, ভারতভূমির অধিকাংশ অঞ্চল মুসলিম শাসনমুক্ত করেছিলেন। এই সমস্ত কারণে মুসলিম থিঙ্ক ট্যাংক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, হিন্দুজাতির মধ্যে ব্রাহ্মণ-বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিয়ে,এই জাতিকে যদি জ্ঞান-বিমুখ করে তোলা যায়, তাহলে হিন্দুজাতির ধ্বংস অনিবার্য।
দ্বিখণ্ডিত স্বাধীন ভারতে বর্ণভিত্তিক সংরক্ষণ বলবৎ করে, হিন্দুজাতিকে স্থায়ী ভাবে বিভক্ত করে ফেলা হয়েছে। যেহেতু সরকারি সুযোগ-সুবিধার প্রশ্ন জড়িত, কাজেই ভারতে জাত-পাতহীন হিন্দু ঐক্যের কথা বলা অপ্রাসঙ্গিক। একটা আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, ধর্মনিরপেক্ষতার নামে বর্ণভিত্তিক সংরক্ষণ প্রথার মাধ্যমে, হিন্দুজাতিকে কিভাবে টুকরো টুকরো ও দুর্বল করে ফেললো- সেটা যেকোনো সভ্য মানুষের চিন্তার বাইরে। ভারতের সেক্যুলার শাসকরা, আরব সম্প্রসারণবাদীদের প্ররোচনায়, ভারতকে ইসলামিক রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্যে- হিন্দুজাতির মধ্যে এই সংরক্ষণের বিভক্তি এনেছে।
হিন্দুদের সদা-সর্বদা মনে রাখতে হবে, বর্ণভিত্তিক সংরক্ষণের মধ্য দিয়ে সেক্যুলাররা যে ‘দলিত-মুসলিম’ ঐক্যের আওয়াজ তুলেছে, এটা হিন্দু জাতিকে ধ্বংস করে ফেলার গভীর ষড়যন্ত্র। ‘দলিত-মুসলিম’ ঐক্যের আদর্শে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু কার্যসিদ্ধির পর, মুসলমানরা পাকিস্তানে দলিতদের বেঁচে থাকতে দেয়নি। সুতরাং ‘দলিত-মুসলিম’ ঐক্যের ধূম্রজালে মুসলমানরা যদি ভারতের রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারে, তাহলে তথাকথিত নিম্নবর্ণের হিন্দুদের একেবারে কচুকাটা করে ফেলবে- যেভাবে তারা পাকিস্তানকে দলিত-মুক্ত করেছিল। নিম্নবর্ণের হিন্দুরা অগনিত জাত-পাতে বিভক্ত; যে কারণে তারা কখনোই মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে পারবে না।
হিন্দুদের জাত-পাত ও ভেদ-বৈষম্যের, হিন্দুদের জাত-পাত ও ভেদ-বৈষম্যের হিন্দুদের জাত-পাত ও ভেদ-বৈষম্যের