নিষিদ্ধ হচ্ছে গোহত্যা

শ্রীলঙ্কায় সনাতন সংস্কৃতির মহাউত্থান : বোরখার পর নিষিদ্ধ হচ্ছে গোহত্যা – কৃত্তিবাস ওঝা

শ্রীলঙ্কায় সনাতন সংস্কৃতির মহাউত্থান : বোরখার পর নিষিদ্ধ হচ্ছে গোহত্যা। শ্রীলঙ্কায় বোরখা নিষিদ্ধ ঘোষণার পর,এবার গোহত্যা নিষিদ্ধ হবে। শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, শ্রীলঙ্কায় গোহত্যা পুরোপুরি ভাবে নিষিদ্ধ করা হবে। গতকাল তিনি পার্লামেন্ট গ্রুপে এ-বিষয়ে আইন জারি করার প্রস্তাব রাখেন। এই প্রসঙ্গে তিনি এ কথাও জানিয়েছেন যে, গোহত্যা নিষিদ্ধ হলেও শ্রীলঙ্কায় গোমাংস আমদানিতে কোনও নিষেধাজ্ঞা জারি থাকবে না।

শ্রীলঙ্কার ৯৯ শতাংশ মানুষ প্রাণিজ প্রোটিন খায়। তবে সংখ‍্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ ও হিন্দুরা গোমাংস খায় না। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর ধর্মানুভূতির কথা মাথায় রেখে, শ্রীলংকার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সদ্য-নির্বাচিত সরকার গোহত্যা নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এরআগে ২০১৯ সালে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসব ইস্টার সানডে’র দিন গির্জা এবং ট্যুরিস্টপূর্ণ হোটেলে,আরব‍্য সম্প্রসারণবাদীরা ভয়াবহ বোমা হামলা চালায়।

 

ঐ হামলায় নিহত হন কমপক্ষে ২৫৩ জন নিরীহ মানুষ। শ্রীলঙ্কা সেই বর্বরোচিত বোমা হামলার দায় স্বীকার করে জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস)৷ এরপরেই শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট অর্ডিন্যান্স জারি করেন যে, ‘‘জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে দেশের কেউ এমনভাবে বোরখায় মুখ ঢাকতে পারবে না, যাতে তার পরিচয় গোপন থাকে৷”

বৌদ্ধ পুনর্জাগরণবাদী অনাগরিক ধর্মপাল (১৮৬৪-১৯৩৩) সর্বপ্রথম ব্রিটিশ শাসিত শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্টে গোহত্যা নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব রেখেছিলেন। অনাগরিক ধর্মপাল খ্রিস্ট ধর্ম থেকে ধর্মান্তরিত হয়ে বৌদ্ধ সমাজে এসেছিলেন। অনাগরিক ধর্মপাল কর্তৃক প্রবর্তিত বৌদ্ধ নবজাগরণকে বহুক্ষেত্রে রক্ষণশীল বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। কারণ তিনি ভারতে বৌদ্ধ সমাজের অবলুপ্তির জন্য সরাসরি মুসলিম শাসকদের দায়ী করে, যথেষ্ট সাহসিকতার স্বাক্ষর রাখেন।

 

খ্রিস্ট ধর্ম থেকে আগত এই ধর্মগুরুর বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অভিযোগ রয়েছে যে,তিনি গৌতম বুদ্ধ ও তার দর্শনকে গোষ্ঠীস্বার্থে সঙ্কীর্ণ গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ রাখতে চেষ্টা করেছিলেন। তাছাড়া তার বৌদ্ধ মতাবলম্বীদের হিন্দু-প্রভাবমুক্ত করার প্রচেষ্টা- হিন্দু ও বৌদ্ধদের মধ্যকার সম্পর্কে বিরাট ফাটল সৃষ্টি করেছে।

ভারতের সাথে শ্রীলঙ্কার কেবল ভৌগোলিক নৈকট্য-ই নয়, প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই উভয় দেশের মধ্যে রয়েছে ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও নৃতাত্ত্বিক অভিন্নতা। একসময় শ্রীলঙ্কায় শৈব মতালম্বী হিন্দু তামিলদের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। পশ্চিমবঙ্গের সিংভূম এলাকার সেনানায়ক বিজয় সিংহের নেতৃত্বে একদল বাঙালি সৈন্য শ্রীলঙ্কা দখল করে নেয়। ধীরে ধীরে সেখানে বাঙালির আধিপত্য বাড়তে থাকে।

 

স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনের মধ্য দিয়ে রক্তের সম্পর্ক স্থাপিত হয়; সেই সঙ্গে স্থানীয় ভাষা ও সংস্কৃতির মিলনে যে নতুন মিশ্র জাতিসত্তার সৃষ্টি হয়, সেটাই আজকের সিংহলি জাতিসত্তা নামে পরিচিত। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্বীপদেশ সুমাত্রা,জাভা থেকে শুরু করে ফিলিপাইন পর্যন্ত বিস্তৃত হিন্দু সভ্যতার সঙ্গে সিংহলিরা বানিজ্য ও সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের নিবিড় সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে- অত্যন্ত উন্নত পর্যায়ের হিন্দু সভ্যতা গড়ে তুলেছিল। ভারতের বৌদ্ধ-সম্রাট অশোকের পুত্র মহেন্দ্র ও কন্যা সংঘমিত্রা, শ্রীলঙ্কায় গিয়ে বৌদ্ধ দর্শন প্রচার করেন।

 

বিভেদকামীদের দীর্ঘ প্রচারণার ফলে, মানুষের মনে বদ্ধমূল ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যে, ‘হিন্দু’ ও ‘বৌদ্ধ’- বুঝি দু’টি পৃথক ধর্ম। প্রকৃতপক্ষে ‘হিন্দু’ বা ‘বৌদ্ধ’ কোনটাই ধর্ম নয়। ধর্ম একটাই, তা হচ্ছে ‘সনাতন ধর্ম’। হিন্দু হচ্ছে জাতি- যারা আফগানিস্তান থেকে ইন্দোনেশিয়ার পর্যন্ত বসবাসকারী ভূমিসন্তান এবং যারা ধর্মান্তরিত হয়নি। আর ‘বৌদ্ধ’ হচ্ছে- গৌতম বুদ্ধ উদ্ভাবিত ‘জীবন-দর্শন’। ‘ত্রিপিটক’ বা ‘ধম্মপদ’- কোথাও গৌতম বুদ্ধ নতুন কোন ধর্ম সৃষ্টি করার কথা বলেননি। নতুন কোনও ঈশ্বর সৃষ্টি করা তো দূরের কথা, ঈশ্বর-বিশ্বাস সম্পর্কেও গৌতম বুদ্ধ ছিলেন নীরব। পৃথিবীর যে কোনো ধর্মের মূল তত্ত্বই হচ্ছে ঈশ্বর বিশ্বাস। 

বৌদ্ধ দর্শনে যেহেতু ঈশ্বর বিশ্বাস নেই, তাই ‘বৌদ্ধ দর্শন’-কে ‘ধর্ম’- বলা কোন বিচারেই যুক্তিগ্রাহ্য নয়। ‘ধম্মপদ’-এ গৌতম বুদ্ধ সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, তাঁর ধর্মের নাম ‘সনাতন ধর্ম’। তাছাড়া ‘ধম্মপদ’ ও ‘ত্রিপিটক’ থেকে জানা যায়,গৌতম বুদ্ধ হিন্দুদের প্রচলিত দেব-লোক ও পরকালে বিশ্বাস করতেন এবং নিজেকে মহর্ষিগণের জ্ঞানগত-উত্তরসূরি মনে করতেন।

 

বিদেশি দখলদাররা শ্রীলঙ্কার তামিলভাষী নিম্নবর্ণের হিন্দুদের ধর্মান্তরিতকরণের মধ্য দিয়ে, বিভেদের বীজ বপন করে। তথাকথিত নিম্নবর্ণের হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত খ্রিস্টধর্মাবলম্বী ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণের নেতৃত্বে, ‘এল টি টি’- নামক একটি সশস্ত্র বাহিনী গঠন করে, তামিল ও সিংহলি জনগোষ্ঠীকে মুখোমুখি দাঁড়া করিয়ে দেওয়া হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলিরা দায়িত্বশীলতার পরিচয় না দেওয়ায়, তিন দশক স্থায়ী এই সংঘর্ষে কেবল যে অগনিত নিরীহ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে, তা হয়- শ্রীলঙ্কা থেকে উচ্ছেদ করে দেওয়া হয়েছে অধিকাংশ তামিলদের। 

 

নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করতে শ্রীলঙ্কার শাসকগোষ্ঠী জনগণের মধ্যে অহেতুক ভারত-বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিয়েছে। শ্রীলঙ্কার শাসকরা ভারতের প্রভাবমুক্ত হওয়ার আশায়, বৌদ্ধ-বিদ্বেষী কনফুসীয় চীনের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল। সুযোগ বুঝে চীন শ্রীলঙ্কাকে এমন ঋণের জালে ফাঁসিয়ে দিয়েছে- চীন কর্তৃক প্রতারিত শ্রীলঙ্কা আবার ভারতমুখী হতে বাধ্য হয়েছে।

বিভেদকামীদের হাজার বছরের প্রচেষ্টায়, বিশ্বের ১১৫ কোটি হিন্দু এবং ৫৪ কোটি বৌদ্ধ আজ পুরোপুরি আলাদা। শ্রীলঙ্কার প্রভাবে ভারতের আশপাশ অঞ্চলে বসবাসকারী বৌদ্ধদের মধ্যে ভারত-বিদ্বেষ বিদ‍্যমান থাকলেও, পৃথিবীর সিংহভাগ বৌদ্ধ ভারতপন্থী। বৌদ্ধরা মহাযান, হীনযান, তন্ত্রযান প্রভৃতি মতাদর্শে পরস্পর বিভক্ত। তাদের কারো সাথে কারো তেমন সুসম্পর্ক নেই। বৌদ্ধদের মধ্যে মহাযানরা সংখ‍্যায় বেশি; মহাযান বৌদ্ধদের অধিকাংশ ক্ষমতাহীন সংখ্যালঘু হিসেবে চীনে বাস করে। চীনে বসবাসকারী বৌদ্ধদের সংখ্যা ২৫ কোটি। চীনের সংখ্যাগরিষ্ঠ কনফুসীয় হান জাতির নির্যাতনে, চীনে বসবাসকারী সংখ্যালঘু বৌদ্ধদের অস্তিত্ব বিপন্ন। চীনের সংখ্যাগরিষ্ঠ কনফুসীয় হানরা যতটা ভারত-বিদ্বেষী, সেখানকার নিপীড়িত সংখ্যালঘু বৌদ্ধরা ততটাই ভারত-সমর্থক।

 

থাইল্যান্ডের বৌদ্ধরা সম্প্রতি চীনের বিরাট ভারত বিরোধী ষড়যন্ত্র ‘ক্রা ক‍্যনেল প্রজেক্ট’- বাতিল করে দিয়েছে। যার ফলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীনের প্রভাব-প্রতিপত্তি যথেষ্ট খর্ব হয়েছে। বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ পৃথিবীর বৃহত্তম দুই রাষ্ট্র, থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারের চিন্তা-নায়কগণ বিশ্বাস করেন যে, রক্তপিপাসু মরু দস্যুদের আগ্রাসন মোকাবেলায়, হিন্দু ও বৌদ্ধদের মধ্যে সুদৃঢ় ঐক্য স্থাপন অত্যন্ত জরুরী। 

তাছাড়া শক্তিশালী হিন্দু-ভারতের উপস্থিতি ব্যতীত, ভারতীয় ভাষা ও সাংস্কৃতির দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় বৌদ্ধ অধ্যুষিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর নিরাপত্তা সুরক্ষিত নয়। আশার কথা হচ্ছে, বিলম্বে হলেও শ্রীলঙ্কার শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষরা উপলব্ধি করতে পেরেছে, হিন্দু-ভারতের ছত্রছায়ার বাইরে চলে গেলে, আরব সম্প্রসারণবাদীরা তাদের গ্রাস করে ফেলবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঘোষণা দিয়েছেন, চীনের আগ্রাসন মোকাবেলায়, তিনি ভারতীয় ধর্ম,ভাষা ও সংস্কৃতির বৌদ্ধ রাষ্ট্রগুলোর সমন্বয়ে একটি শক্তিবলয় গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন।

 

নিষিদ্ধ হচ্ছে গোহত্যা নিষিদ্ধ হচ্ছে গোহত্যা নিষিদ্ধ হচ্ছে গোহত্যা নিষিদ্ধ হচ্ছে গোহত্যা
লেখক-কৃত্তিবাস ওঝা,ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক।
লেখকের আরো লেখা……