বিজ্ঞানী ডঃ বিজন কুমার শীল একজন নির্মোহ সন্ন্যাসী, তবুও বাংলাদেশে বিতর্ক । ডঃ বিজন কুমার শীল-এর মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞানী বাংলাদেশে খুব কমই জন্মেছেন। এই মহান বিজ্ঞানীকে পৃথিবীর অন্যতম উন্নত রাষ্ট্র সিঙ্গাপুর- সমাদরে আমন্ত্রণ জানিয়ে নাগরিকত্ব দিয়ে, নিজেদের ধন্য মনে করেছে। ডঃ বিজন কুমার শীলের মেধা কাজে লাগিয়ে, সিঙ্গাপুর ও চীন সার্স ভাইরাস প্রতিরোধ করেছে। অথচ তিনি নিজ জন্মভূমি বাংলাদেশে উপেক্ষিত, অহেতুক বিতর্কিত।
‘স্বদেশে পূজ্যতে রাজা
বিদ্বান সর্বত্র পূজ্যতে।”
― মহামতি চাণক্য
বিজন কুমার শীল বলেছেন,”বাংলাদেশে আমার জন্ম; বাংলাদেশ আমার মাতৃভূমি। বাংলাদেশের সাধারণ কৃষক পরিবারে আমার জন্ম। বাংলাদেশের কাদা মাটি জল হাওয়ায় আমার বেড়ে ওঠা। মানুষ হিসেবে আমি অতি সাধারণ। নিজেকে পণ্ডিত মনে করি না।
যেহেতু বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা ও গবেষণা করেছি, আমার সৌভাগ্য এজন্য যে,আমি পৃথিবীর বিখ্যাত কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা ও গবেষণার সুযোগ পেয়েছি। বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীদের সঙ্গে মতবিনিময় করার সৌভাগ্য হয়েছে।
বিশেষ পরিস্থিতিতে আমি সিঙ্গাপুরের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছি। সেখানে কাজ করেছি। কিন্তু, এর অর্থ এই নয় যে, আমি বাংলাদেশকে ভুলে গেছি কিংবা বাংলাদেশ আমার জন্মস্থান নয়। কারা, কী উদ্দেশ্যে আমার নাগরিকত্ব নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে- আমি ঠিক জানি না।
কলেজে পড়ার সময় বাবার সঙ্গে মাঠে কৃষিকাজ করেছি। এক জীবনে বেঁচে থাকার জন্যে যা যা দরকার, এখন হয়ত আমার সবই হয়েছে। আমি সিঙ্গাপুরে কাজ করেছি। যদি অর্থের দিক দিয়ে বিষয়টি বিবেচনা করা হয়, অনেক উচ্চ বেতনে সেখানে কাজ করেছি।
২০০৬ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত আমেরিকায় কাজ করার সময় যে বেতন ও আর্থিক সুবিধা পেয়েছি, সেসব বিবেচনায় বাংলাদেশে কাজ করে তার ১০ ভাগের এক ভাগ সুবিধাও পাচ্ছি না। তাহলে প্রশ্ন আসে, কেন এখানে কাজ করছি? আমি বিনয়ের সঙ্গে বলতে চাই যে, সিঙ্গাপুর, আমেরিকাসহ বিশ্বের অনেক ধনী ও উন্নত দেশে কাজ করার সুযোগ আমার এখনো আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।
আমার কাজের কারণেই থাকবে। সাধারণ পরিবারে জন্ম নিয়ে আজ আমি মানুষের ভালোবাসা পাচ্ছি। অর্থের পেছনে ছোটার মানসিকতা আমার কখনোই ছিল না এবং এখনো নেই। যা আছে, তা হচ্ছে— দায়িত্ববোধ। বাংলাদেশ ও স্বদেশবাসীর প্রতি আমার দায়বদ্ধতা। মাতৃভূমির জন্য আমার অনেক কর্তব্য রয়েছে; সেই ভাবনা থেকেই বাংলাদেশে ফিরে এসে গরিবের সেবায় নিজেকে নিযুক্ত করেছি।”
ডঃ বিজন কুমার শীল ২০০২ সালে সিঙ্গাপুর সিভিল সার্ভিস-এ বিজ্ঞানী হিসেবে নিযুক্ত হন। শুরুতে তাকে ডেঙ্গু নিয়ে গবেষণার দায়িত্ব দেওয়া হয়। সেখানে এক বছর ডেঙ্গু নিয়ে গবেষণা করেন। তারপর পৃথিবীতে শুরু হয় সার্স ভাইরাসের তাণ্ডব।
সার্স ভাইরাস সম্পর্কে গবেষণার দায়িত্ব দেওয়া হয় বিজন কুমার শীলকে। সিঙ্গাপুরের অত্যাধুনিক ল্যাবে শুরু করেন গবেষণা। ২০০৩ সালে সফলভাবে উদ্ভাবন করেন সার্স ভাইরাস শনাক্তের কিট- যা দিয়ে সিঙ্গাপুর ও চীন সার্স ভাইরাস মোকাবিলা করে। সিঙ্গাপুর, চীনসহ আন্তজার্তিক অঙ্গনে নাম ছড়িয়ে পড়ে ডঃ বিজন কুমার শীল-এর।
২০০৬ সালে আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া-ভিত্তিক একটি বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান ‘এমপি বায়োকেমিক্যালস এশিয়া প্যাসিফিক প্রাইভেট লিমিটেড’- থেকে ডঃ বিজন কুমার শীল-এর কাছে ‘গবেষণা পরিচালক’ হিসেবে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব আসে। সুযোগ হয় আরোও বিস্তৃত পরিসরে গবেষণা করার। এই সময় তিনি ‘মাল্টিশিয়র হেপাটাইটিস-সি র্যাপিড টেস্ট পদ্ধতি’ উদ্ভাবন করেন।
প্রচলিত পদ্ধতির পরীক্ষায় হেপাটাইটিস-সি নেগেটিভ বা পজিটিভ শনাক্ত করা যায়। ডঃ বিজন কুমার শীল উদ্ভাবিত পদ্ধতিতে নেগেটিভ বা পজিটিভ জানার পাশাপাশি, রোগটি কোন পর্যায়ে রয়েছে তা নিরূপণ করা যায়। ফলে রোগের সঠিক চিকিৎসা দেওয়া সহজতর হয়।
ডঃ বিজন কুমার শীল কিছুদিন গবেষণা করেন ভারতের সাইন্স ক্যাপিটাল বেঙ্গালুরুতে। এরপর ফিরে আসেন সিঙ্গাপুরে। গবেষণা কনসালটেন্সি করতে থাকেন। তার নামের সঙ্গে যুক্ত হয় ১৪টিরও বেশি পেটেন্ট। আন্তর্জাতিক বাজারে তার উদ্ভাবিত পাঁচটি কিট রয়েছে, যা ইউরোপিয়ান কমিশন কর্তৃক অনুমোদিত।
২০১৯ সালে বিএমআরসির একটি সেমিনারে আমন্ত্রিত হয়ে সিঙ্গাপুর থেকে বাংলাদেশে আসেন ডঃ বিজন কুমার শীল। মাতৃভূমির প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বরূপ,তিনি বিদেশে বিশাল অর্থ ও সুখ্যাতি অর্জনের সুযোগ এবং আরাম-আয়েশপূর্ণ জীবনের মোহ ত্যাগ করে, সামান্য বেতনে বাংলাদেশের গণবিশ্ববিদ্যালয়ে অনুজীব বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবে যোগদান করেন।
অধ্যাপনার পাশাপাশি বৈজ্ঞানিক গবেষণাও অব্যাহত রাখেন। ডঃ বিজন কুমার শীল-এর ভাষায়,”করোনাভাইরাস আমার কাছে যেহেতু নতুন নয়, ফলে আমরা চার জনের গবেষক দল, অল্প সময়ের মধ্যেই অ্যান্টিজেন ও অ্যান্টিবডি কিট উদ্ভাবন করতে সক্ষম হলাম। সিঙ্গাপুরে সার্স ভাইরাস সনাক্তকরণে যে কিট উদ্ভাবন করেছিলাম,এটা তারই ধারাবাহিকতা।”
সাভারের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে এক রুমের একটি ছোট্ট কোয়ার্টারে ডঃ বিজন কুমার শীল থাকেন। কোয়ার্টারের ব্যালকনিটি তার খুব পছন্দের। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তার সময় কাটে বিশ্ববিদ্যালয়ে-ল্যাবে-গবেষণায়। গভীর রাতে কোয়ার্টারে ফিরে এসে তিনি তার প্রিয় ব্যালকনিতে ধ্যানে বসেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে তার সম্পর্কে একটি কথা প্রচলিত হয়ে গেছে যে, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই বিজ্ঞানী, নির্মোহ সন্ন্যাসীর জীবন-যাপন করছেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে।
এহেন মহান ব্যক্তিত্বকে নিয়েও বাংলাদেশে চলছে প্রচণ্ড বিতর্ক। জানা যায়, সিঙ্গাপুরে দ্বৈত নাগরিকত্বের সুযোগ নেই, এজন্য ডঃ বিজন কুমার শীল ২০০২ সালে বাংলাদেশের পাসপোর্ট-সমর্পণ করে সিঙ্গাপুরের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। ২০০২ সালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সংখ্যালঘুদের জন্য মোটেও নিরাপদ ছিল না। বিএনপি-জামায়াত ক্যাডাররা যে এলাকায় ১৩ বছরের কিশোরী পূর্ণিমা রানী শীল-এর উপর সারা দিনরাত পাশবিক যৌন নির্যাতন চালিয়েছিল- সেই এলাকা থেকে বিজন কুমার শীল-এর বাড়ি থেকে খুব বেশি দূরে নয়।
বিজন কুমার শীল সিঙ্গাপুরের ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে অবস্থান করছেন। গত ১২ ফেব্রুয়ারি সাভার গণবিশ্ববিদ্যালয়ে ৩ বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত হন ডঃ বিজন কুমার শীল। তার ভিসার মেয়াদ গত শেষ হয়েছে গত ১৬ মে। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, ডঃ বিজন কুমার শীল গণস্বাস্থ্যের এক শীর্ষ কর্মকর্তাকে ভিসা নবায়ন করতে দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই কর্মকর্তা ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার এক সপ্তাহ পরে, নবায়নের জন্য সেই পাসপোর্ট জমা দেন।
সেই কর্মকর্তার গাফিলতির কারণেই বিজন কুমার শীলের ভিসা নবায়ন হয়নি। এরপর গণবিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে কয়েক দফা নাগরিকত্ব সনদের প্রমাণ দিতে বলা হয় এবং তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এই ঘটনা থেকে সহজেই প্রতীয়মান হয় যে, গণবিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রভাবশালীগোষ্ঠী ডঃ বিজন কুমার শীলকে তার জন্মভূমি থেকে তাড়ানোর জন্য গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।
নব্য মুসলিম লীগাররা বাংলাদেশের কোথাও কোন হিন্দুকে মাথা তুলে দাঁড়াতে দেয় না; কিন্তু বিজ্ঞানী বিজন কুমার শীল তার জন্মভূমিতে ফিরে এসেছিলেন- স্বজাতিকে সেবা করার উদ্দেশ্যে।
বিজ্ঞানী ডঃ বিজন কুমার শীল বিজ্ঞানী ডঃ বিজন কুমার শীল বিজ্ঞানী ডঃ বিজন কুমার শীল বিজ্ঞানী ডঃ বিজন কুমার শীল