বাংলাদেশে হিন্দুবিদ্বেষী ও ভারত বিরোধী মিথ্যা

বাংলাদেশে হিন্দুবিদ্বেষী ও ভারত বিরোধী মিথ্যা প্রোপাগাণ্ডায় হিন্দুরা আতঙ্কিত – কৃত্তিবাস ওঝা

বাংলাদেশে হিন্দুবিদ্বেষী ও ভারত বিরোধী মিথ্যা প্রোপাগাণ্ডায় হিন্দুরা আতঙ্কিত।একটি বহুল প্রচারিত বাংলা পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে প্রাপ্ত তথ‍্য অনুযায়ী- বাংলাদেশে সরকারি হিন্দু চাকুরীজীবী ৩ শতাংশেরও কম। ৬৪টি জেলায় মাত্র ৩ জন জেলা প্রশাসক হিন্দু। ৮২ জন সচিবের মধ্যে মাত্র ৬ জন হিন্দু।

সেনাবাহিনীর কোনও গুরুত্বপূর্ণ পদে একজনও হিন্দু নেই। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর সর্বোচ্চ পদে কোনও হিন্দু নেই। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যের তালিকায় একটি হিন্দু নামও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এছাড়াও আমি ব্যক্তিগতভাবে বাংলাদেশের উচ্চ, মধ‍্যম ও নিম্নপদস্থ বেশ কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করেছি যে, তাদের অফিসে কর্মরত হিন্দুর সংখ্যা কতজন। তারা প্রত্যেকেই বলেছেন যে, তাদের অফিসে কর্মরত হিন্দুর সংখ্যা দুই থেকে তিন শতাংশের বেশি হবে না।

 

অথচ বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রভাবশালী মহল থেকে তীব্র হিন্দুবিরোধী মিথ্যা অপপ্রচার চালানো হচ্ছে যে, বাংলাদেশে সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে নাকি ৩০ শতাংশ হিন্দু। সচিবালয়সহ বাংলাদেশের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ অফিস-আদালত নাকি ইসকন-পন্থী হিন্দুদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। এমনকি টকশোগুলোতে পর্যন্ত এই ধরনের হিন্দুবিদ্বেষী পরিকল্পিত মিথ্যাচার চালানো হচ্ছে। ইসকন গৌড়ীয় বৈষ্ণবধারার একটি নিরামিষভোজী নিরীহ সংগঠন। সনাতন ধর্মের মূলধারার সঙ্গে এই সংগঠনের যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে, যে কারণে হিন্দুদের মধ্যে এই সংগঠনটির প্রভাব অত্যন্ত ক্ষীণ। বাংলাদেশে বসবাসকারী দেড় কোটি হিন্দুর মধ্যে ইসকনের সদস্য সংখ্যা মাত্র ৩৫ হাজার। ১১১ কোটি হিন্দু জনসংখ্যার ভারত রাষ্ট্রে, ইসকন-এর বলতে গেলে গ্রহণযোগ্যতাই নেই। যে ইসকন হিন্দুদেরই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, সেই সংগঠনটি কিভাবে একটি ইসলামী রাষ্ট্রের মন্ত্রণালয় সমূহ কিংবা অফিস-আদালত নিয়ন্ত্রণ করবে!

 

ভারত বিরোধী
ভারত বিরোধী

ডানপন্থী পত্রিকাগুলোতে হিন্দুরা সব নিয়ে গেল, হিন্দুরা ভারতের দালালী করছে, সংখ্যানুপাতের তুলনায় হিন্দুরা বহুগুণ বেশি সহকারী পদে অধিষ্ঠিত, ইসকন মুসলমান ছাত্র-ছাত্রীদের কৌশলে নাপাক প্রসাদ খাওয়াচ্ছে- ইত্যাদি আজগুবি মিথ্যা সাম্প্রদায়িক প্রোপাগাণ্ডা চালানো হচ্ছে অহর্নিশি।

 

জাতির বিবেক বলে পরিচয় দেওয়া বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা,পত্রিকায় জ্বালাময়ী প্রবন্ধ লিখে কিংবা টেলিভিশন টকশোতে বজ্রকন্ঠে ভাষণ দিয়ে, সম্পূর্ণ কাল্পনিক ও ভিত্তিহীন তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করার মধ্য দিয়ে- ভারতবিরোধী ও হিন্দুবিদ্বেষী বিষোদগার করে বেড়াচ্ছে। তাদের ভাষায়, দশ লক্ষ অবৈধ ভারতীয় নাকি বাংলাদেশে উচ্চ বেতনে চাকরি করছে এবং বাংলাদেশ নাকি ভারতের চতুর্থ বৃহত্তম রেমিটেন্স সরবরাহকারী দেশ।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, দশ লক্ষ ভারতীয়ের কর্মসংস্থান করার মতো মৌলিক কল-কারখানা কি বাংলাদেশে আছে? বাংলাদেশের প্রধান প্রধান ইন্ডাস্ট্রিগুলো বিদেশ থেকে কাঁচামাল আমদানি করে, বিভিন্ন ধরনের প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে মূল্য সংযোজন করে। বাংলাদেশে যদি যথেষ্ট মৌলিক শিল্প-কারখানাই থাকতো, তাহলে প্রায় এক কোটি বাংলাদেশি অত্যন্ত নিম্ন বেতনে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মানবেতর জীবন-যাপন করতে বাধ্য হতো না।

ভারত পৃথিবীর সর্ববৃহৎ রেমিটেন্স আরোহণকারী দেশ। ভারতের মতো বিশাল অর্থনীতির রাষ্ট্রকে,চতুর্থ বৃহৎ রেমিটেন্স সরবরাহ করার সক্ষমতা অর্জন করা- বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্র অর্থনীতির পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়। যেখানে ভারতের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৫৪১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার; পক্ষান্তরে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ মাত্র ৩৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ সহ পৃথিবীর কোন নির্ভরযোগ্য আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রদত্ত পরিসংখ্যানে, কোথাও ভারতের রেমিটেন্স সরবরাহকারী শীর্ষ দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম নেই।

 

বাংলাদেশের সোশ্যাল মিডিয়ায় মধ্যযুগীয় বর্বরোচিত, উগ্র সাম্প্রদায়িক ও সনাতন ধর্ম অবমাননাকারী একতরফা অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। কোন হিন্দু যদি যথাযথ তথ্য ও যুক্তি উপস্থাপন করে প্রতিবাদ জানায়, তাহলে তাদের আইডি হ্যাক করে বিতর্কিত পোস্ট দিয়ে – ইসলাম অবমাননার অভিযোগ তুলে, সঙ্ঘবদ্ধ সাম্প্রদায়িক হামলা চালিয়ে- একের পর এক হিন্দু-জনপদ নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হচ্ছে।

 

সম্প্রতি বাংলাদেশের একজন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা, সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিও বার্তার মাধ্যমে ঘোষণা দিয়েছে যে,অচিরেই বাংলাদেশ থেকে ২০ লক্ষ কর্মক্ষম হিন্দুকে ভারতে ঠেলে পাঠিয়ে দিয়ে, মুসলমানদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা হবে। উল্লেখ্য, পার্টিশনের সময় বাংলাদেশ তথা সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দু জনসংখ্যা হার ছিল ৩৫ শতাংশ। পরিকল্পিত সাম্প্রদায়িক হামলা,শত্রু সম্পত্তি ও অর্পিত সম্পত্তি আইন, গণহত্যা, ডাকাতি,লুন্ঠন, নারী নির্যাতন প্রভৃতি কারণে বাংলাদেশে হিন্দু জনসংখ্যা হার কমতে কমতে এখন মাত্র ৮ শতাংশ-এ নেমে এসেছে।

 

বর্তমানে বাংলাদেশে যেভাবে হিন্দুবিদ্বেষী অপপ্রচার চালানো হচ্ছে, তার ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মনোজতে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে- সেই সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প-এর মধ্যে বসবাসকারী অসহায় সংখ্যালঘু হিন্দুদের জীবন হয়ে উঠেছে বিষময় এবং তাদের ভবিষ্যৎ হয়ে পড়েছে অনিশ্চিত।

 

লেখক-কৃত্তিবাস ওঝা,ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক।
লেখকের আরো লেখা……