মহাপ্রতিভাধর বিনয় মজুমদার-এর ব্যর্থ প্রেম ও করুণ পরিণতি। বিনয় মজুমদার ( ১৯৩৪ – ২০০৬ খ্রিঃ) আধুনিক বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে শক্তিমান কবি এবং বিশ্বমানের গণিতশাস্ত্রবিশারদ। তিনি ছিলেন তুখোড় মেধাবী ছাত্র। শিবপুর কলেজ থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছেন রেকর্ড নম্বর নিয়ে। গণিতশাস্ত্রে তার ছিল অগাধ দখল। গণিতের নানা কঠিন সমস্যার সমাধান দিয়ে গেছেন তিনি।
বিনয় মজুমদারের গাণিতিক সূত্রগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি ইংল্যাণ্ডের বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যসূচীতে অন্তর্ভুক্ত। এই অতুলনীয় মেধাবী মানুষটি প্রেমে ব্যর্থ হয়ে, তার জীবনের দুই-তৃতীয়াংশ সময় কাটিয়েছেনে মানসিক অসুস্থতায়, অসহ্য যন্ত্রণায়। একাধিকবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। আটবারের বেশি তাকে ভর্তি হতে হয়েছে মানসিক হাসপাতালে। একত্রিশবার তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে দেওয়া হয়েছিল ইলেকট্রিক শক! নিজেই ব্যঙ্গ করে বলতেন- ‘‘পশ্চিমবঙ্গের পাগলাগারদসমূহের পরিদর্শক আমি।”
বিনয় মজুমদার ঘনিষ্ঠ অনেকের কাছেই স্বীকার করেছেন যে, ছাত্রজীবনে তিনি এক কিশোরীর প্রেমে পড়েছিলেন। সেই কিশোরী-ই পরবর্তী সময়ের মার্কিন প্রবাসী বিখ্যাত দার্শনিক ও কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক – যার প্রতি সেই ব্যর্থ প্রেম, বিনয় মজুমদার আজীবন বয়ে বেড়িয়েছেন। তবে সেই প্রেম ছিল একতরফা। নিজের ভালো লাগার কথা তিনি গায়ত্রীকে জানতে পারেন নি।
বিনয় মজুমদার বলেছেন, “আমি যখন ইডেন হিন্দু হোস্টেলে ছিলাম তখন গায়ত্রীর বাবা ছিলেন সুপারিনটেনডেন্ট, জনার্দন চক্রবর্তী, দাদার নাম প্রসূন চক্রবর্তী। তখন ওর বয়স বারো কি তের হবে। আমার থেকে দু’-তিন ইঞ্চি লম্বা। একটু আধটু কথাবার্তা যা হতো,কবিতা নিয়ে। কবিতা লিখেছি কবে, দু’জনে চকিত চেতনায়’— এবার বুঝলে তো! তারপর ভালো ছাত্রী হওয়ার ফলে সহকারী অধ্যাপিকা হিসেবে ২৩ বছর বয়সে গায়ত্রী আমেরিকায় চলে গেল। বিদেশী কৃষ্ণাঙ্গকে বিয়ে করে খ্রিষ্টান হয়ে গেলো। আমি তিনটি বই তাকে উৎসর্গ করেছি।….”
“গায়ত্রীকে কি তুমি ভালোবাসতে?
– আরে ধ্যুৎ, আমার সঙ্গে তিন-চারদিনের আলাপ, প্রেসিডেন্সি কলেজের নামকরা সুন্দরী ছাত্রী ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের, তারপর কোথায় চলে গেলেন, আমেরিকা না কোথায়, ঠিক জানি না।
– তাহলে ওকে নিয়ে কবিতা কেন?
কাউকে নিয়ে তো লিখতে হয়—আমগাছ, কাঁটাগাছ, রজনীগন্ধা নিয়ে কি চিরদিন লেখা যায়!
আরে আমি তো ছিলাম শিবপুর কলেজের ইঞ্জিনিয়ারিং এর ছাত্র। সেখান থেকে মেকানিক্যালে হলাম ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। আর গায়ত্রী প্রেসিডেন্সি থেকে ইংরেজিতে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। যেই জানলাম- অমনি মনে হলো, এ মেয়েও তো আমার মতো ডুবে যাবে। কেননা এই রেজাল্টের পর আমারও তো পতন হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে তাকে নিয়ে কবিতার বইটি লিখে ফেললাম।”
শক্তি-সুনীল-বিনয় আধুনিক বাংলা কবিতার দিকপাল এই ত্রয়ী এক স্বরে উচ্চারিত হয়। এই তিন কালজয়ী কবি ছিলেন,পরস্পরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বিনয় মজুমদার ত্রিপুরা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অধ্যাপনার চাকরি ছেড়ে, দুর্গাপুরে স্টিল প্রোজেক্টে চাকরিরত অবস্থায় বন্ধু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও শক্তি চট্টোপাধ্যায়-কে চিঠি লিখে বলেছিলেন, গায়ত্রী চক্রবর্তীর খোঁজ নিতে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সম্ভবত বিরক্ত হয়েছিলেন; তবে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় খোঁজ নিয়ে জানান- গায়ত্রী চক্রবর্তী আমেরিকায় গিয়ে ১৯৬০ সালে ট্যালবট স্পিভাককে বিয়ে করেছেন। অবশ্য কিছুকাল পরেই গায়ত্রী চক্রবর্তীর বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটে। অনেকের ধারণা, আমেরিকায় স্থায়ী নাগরিকত্বের জন্য ট্যালবট স্পিভাককে বিয়ে করেছিলেন গায়ত্রী চক্রবর্তী- কারণ ছাড়াছাড়ির পরেও তিনি নিজের নাম থেকে স্পিভাক পদবি বাদ দেননি।
বিনয় মজুমদারের এক সহপাঠীর বোন শ্যামলী ঘোষের সঙ্গে তার গভীর প্রেম ছিলো। হিন্দু সমাজের অমানবিক বর্ণভেদ প্রথার কারণে এই প্রণয় বিবাহের পরিনতি পায় নি। সেই ঘটনা গভীর দাগ কেটে যায় কবির অতিসংবেদনশীল হৃদয়ে। অনেকবার খেদোক্তি করেছেন,”আমি নমঃশূদ্র বলে অবহেলার শিকার।” তবে শ্যামলী ঘোষ বিনয়-কাব্যে অনুচ্চারিত; বর্ণ-বিভাজনের অপমানে হয়তো। ওই প্রসঙ্গে কিছু জিজ্ঞেস করলে কবি বিরক্ত বোধ করতেন।
বিনয় মজুমদার তার বাবা ও বড় ভাইয়ের বারংবার নিষেধ সত্ত্বেও সরকারি চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে,শুধু কবিতা নিয়ে দিন-রাত্রি কাটানোর সংকল্পে লক্ষ্যহীন,উপার্জনহীন-অনিশ্চিত জীবন-স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। জার্মানির বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতের অধ্যাপনার আমন্ত্রণ কিংবা জাপান থেকে উচ্চ বেতনে ইঞ্জিনিয়ারিং-এর চাকরির অফার ভ্রুক্ষেপই করলেন না। দেখতে দেখতে তার মধ্যে মানসিক ব্যাধির লক্ষণ প্রকট হয়ে ওঠে।
যদিও তার জিন-বাহিত স্কিৎসোফ্রেনিয়া ব্যধি উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত। মানসিক হাসপাতালের অসহ্য জীবন থেকে অনেক প্রচেষ্টায় নিষ্কৃতি পেয়ে, তিনি বাড়ি ফিরে এসে দেখেন, তার বাড়িতে হয়ে গেছে ডাকাতি,কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। অভাব,ব্যর্থ প্রেম, নিকট জনদের কাছ থেকে পাওয়া উপর্যুপরি মানসিক আঘাতে তার কোমল হৃদয়ে এক শিশুসুলভ অভিমান – তার বেঁচে থাকাকালীন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি আলাপচারিতায় প্রতিভাত হয়। কবি বলেছেন, “টাকার অভাব আমার বিয়ে না করার কারণ। সারাদিন টাকার চিন্তায় আমার সময় কাটে। অর্থের অভাবেই আমার জীবন মরুভূমি হয়ে গেলো। আমার অতি পরিচিতরাই আমাকে ঠকিয়েছে। আত্মীয়দের থেকে মানসিক রোগীর যোগ্য প্রয়োজনীয় সহানুভূতি পাইনি।”
অশ্লীল কবিতা পাঠের অভিযোগে বিনয় মজুমদার-কে গোর্কি সদন থেকে বের করে দেওয়া হয়। পুলিশের হেডকোয়ার্টার লালবাজার থেকে নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়, বিনয় মজুমদারের ‘বাল্মীকি কাব্য’ ও ‘ভুট্টা সিরিজ’ কবিতার বই বিক্রির উপর। শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ কবিবন্ধু মিলে চাঁদা তুলে, বিনয় মজুমদার-কে সাহায্য করতেন। বছর দেড়েক পরে সে সাহায্য বন্ধ হয়ে যায়। ঘোরতর দুর্দিনে সবসময় পাশে ছিলেন, প্রখ্যাত সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসুর কন্যা মীনাক্ষী দত্ত ও তার স্বামী জ্যোতির্ময় দত্ত। তাদের কলকাতার বাড়িতে বিনয় মজুমদারের আশ্রয় জোটে। মানসিক অসুস্থতা বেশিমাত্রায় বেড়ে গেলে, সেখানে থাকা সম্ভব হয়ে ওঠেনা। বিনয় মজুমদারের বাবা পূর্ব পাকিস্তান থেকে উদ্বাস্তু হয়ে এসে, ঠাকুরনগর রেল স্টেশন সংলগ্ন শিমুলপুর গ্রামে একখণ্ড জমি কিনে বাড়ি করেছিলেন। সেই জরাজীর্ণ নির্জন বাড়িটি হয়ে ওঠে বিনয় মজুমদারের শেষ আশ্রয় স্থল।
একসময় বিনয় মজুমদার বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন। রাস্তায় দিগ্বিদিক ঘুরে বেরিয়ে বিড়বিড় করে অসংলগ্ন কথাবার্তা বলতেন, থুতু ছিটিয়ে দিতেন, উত্ত্যক্তকারীদের খামচি দেওয়ার চেষ্টা করতেন। দুষ্ট বালকেরা তার গায়ে পাথর ছুড়ে মারতো। ঠাকুরনগর,গোবরডাঙ্গা,বনগাঁ-র স্থানীয় তরুণ সাহিত্যসেবী ও কবিবন্ধুদের প্রাণান্ত প্রচেষ্টায়, রাজ্যের তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার, বিনয় মজুমদারের চিকিৎসার দায়িত্ব নেয় এবং প্রতিমাসে ৬০০ টাকা করে ভাতা প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়। শিমুলপুর গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারের উপর অর্পিত হয় বিনয় মজুমদার-কে দেখাশোনা করার দায়িত্ব।
খাবার জুটত কোন বেলা পান্তা ভাতের সাথে কাঁচা লঙ্কা, অন্য বেলা সামান্য শাকপাতা নয়তো আলুসিদ্ধ। চিকিৎসায় সাড়া দেওয়া সত্ত্বেও বিনয় মজুমদারের দুই হাত,দুই পা ও ঠোঁট অস্বাভাবিক রকম থর থর করে কাঁপত। ওই অবস্থাতেই প্রতিবেলা নিজহাতে টিউবওয়েল চেপে এঁটো থালা পরিষ্কার করতে হতো। তিনি এক কবি-বন্ধুকে চিঠি লিখেছিলেন,”সারা জীবনে আমার তেমন বিয়ের নেমন্তন্ন খাওয়ার সুযোগ হয়নি। ইচ্ছে করে কোন বিয়েতে নেমন্তন্ন পেলে,গিয়ে ভালো খাওয়া-দাওয়া করতে।”
“আমি যদি কেঁদে উঠি অনির্বাণ আঘাতে আহত
তখনই সকালে ভাবে,শিশুদের মতোই আমার
ক্ষুধার উদ্রেক হলো,বেদনার কথা বোঝে না তো!”
বিনয় মজুমদার-কে নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মাণ করা হয়েছিল। অধ্যাপিকা গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক
দীর্ঘদিন বাদে কলকাতা বেড়াতে এসে জানতে পারেন, বিনয় মজুমদারের বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘ফিরে এসো চাকা’-তাকে নিয়ে লেখা। তিনি একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বিনয় মজুমদার-কে ‘দান্তে’-র সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। সংবাদপত্রের পাতায় পৌঢ়া গায়ত্রী চক্রবর্তীর স্পিভাক-এর ছবি দেখে ২০০৩ সালে বিখ্যাত একটি কবিতা লিখেছিলেন বিনয় মজুমদার ―
“আমরা দুজনে মিলে জিতে গেছি বহুদিন হলো। তোমার গায়ের রঙ এখনো আগের মতো,তবে
তুমি আর হিন্দু নেই, খৃষ্টান হয়েছো।
তুমি আর আমি কিন্তু দুজনেই বুড়ো হয়ে গেছি।
আমার মাথার চুল যেরকম ছোটো করে ছেঁটেছি এখন
তোমার মাথার চুলও সেইরূপ ছোটো করে ছাঁটা,
ছবিতে দেখেছি আমি দৈনিক পত্রিকাতেই; যখন দুজনে যুবতী ও যুবক ছিলাম
তখন কি জানতাম বুড়ো হয়ে যাব?
আশা করি বর্তমানে তোমার সন্তান নাতি ইত্যাদি হয়েছে।
আমার ঠিকানা আছে তোমার বাড়িতে,
তোমার ঠিকানা আছে আমার বাড়িতে,
চিঠি লিখব না।
আমরা একত্রে আছি বইয়ের পাতায়।”
বিনয় মজুমদার ছিলেন ছয় ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট। প্রতিটি ভাইবোন ছিলেন মেধাবী এবং প্রতিষ্ঠিত; কিন্তু প্রত্যেকেই বড় কঠিন স্বভাবের। একমাত্র সর্বজ্যেষ্ঠ অনিল বরণ মজুমদার ছাড়া, কোনো ভাইবোনের সাথে বিনয় মজুমদারের সম্পর্ক ছিলনা। সহজ-সরল কুসুম-কোমল হৃদয়ের কবি, ভাইবোনদের ইচ্ছাকৃত দূরত্ব রক্ষা ও তাচ্ছিল্যে ভীষণ ব্যথিত ছিলেন।
মাধু নামের একটি প্রতিবেশী মেয়ে কবির শেষ জীবনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এসে পরিচর্যা করত। এই মাধুর পীড়াপীড়ির ফলেই বিনয় মজুমদার ধূমপানের নেশা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ২০০৬ সালের ১১ ডিসেম্বর জীবন্মৃত কবির জীবনের শেষ দিনটিতে, অন্যান্য দিনের মতো মাধু ভোরবেলা গিয়ে স্টেশন থেকে চা এনে, চলৎশক্তিহীন কবিকে উঠিয়ে চেয়ারে বসিয়ে চা পান করালো। কবির মুখে কেমন একটা খুশি খুশি ভাব। অস্ফুট স্বরে জানতে চাইলেন,”বড়দা কখন আসবে?” আশা ছিল জীবনের অন্তিম মুহূর্তে আপনজন কেউকে পাশে দেখতে। পাশ থেকে আরেকজন বলে উঠল,”কাকু আজ আপনাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে। আপনি সুস্থ হয়ে উঠবেন, একদম চিন্তা করবেন না।”
হাসপাতাল শব্দটি শুনে কবি আঁতকে উঠলেন; তার দু’চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল। তিনি হাসপাতাল ভীষণ ভয় পেতেন।
“…আমি ফের জন্মাব…
মানুষেরা গাছেরও বিয়ে
অথচ আমাকে বিয়ে দিলো না মানুষেরা…
মাধু পরের জন্মে তুমি আমার মেয়ে হয়ে এসো
আমি তোমাকে দোলনা কিনে দেব
ভালো করে সাজাব”