দুর্গাপূজা

দুর্গাপূজা: দেবীর জন্ম কিভাবে হয়েছিল? নবদুর্গা সম্পর্কিত ৯ টি তথ্য জেনে নিন।

দুর্গাপূজা: দেবীর জন্ম কিভাবে হয়েছিল? নবদুর্গা সম্পর্কিত ৯ টি তথ্য জেনে নিন। সবাই জানে নবরাত্রির গুরুত্ব। এই বিশেষ দিনগুলি হিন্দু ধর্মে দুর্গার পূজার জন্য খুবই শুভ, কিন্তু আপনি কি জানেন দেবী দুর্গার জন্ম কখন হয়েছিল, এর সাথে কি বিশ্বাস আছে এবং কেন দুর্গার পূজা করা হয়?

নবরাত্রি অর্থাৎ সেই ৯ দিন যখন শক্তির পূজা করা হয় যা দেবী হিসাবে স্বীকৃত। মূলত দেবতাদের নারী রূপে এই শক্তি দেখা যায়। হিন্দু শাস্ত্র দুর্গার জন্ম থেকে যুদ্ধে তার বিজয় পর্যন্ত শক্তির অনেক রূপের কথা বলে। কিন্তু আপনি কি জানেন নবরাত্রি সম্পর্কে ? আমরা দুর্গাপূজা করি, তেব কেন কুমারী পূজা হয় সেটা কি জানি? দেবী কিভাবে জন্মগ্রহণ করেন এবং দুর্গা কেন সিংহে চড়েন?  আসুন এই উত্তর গুলোই আজ আমরা জানব।

১। দেবী কিভাবে জন্মগ্রহণ করেছিলেন?

দুর্গার দেবীর প্রথম রূপ বলে মনে করা হয়, যিনি মহিষাসুর দানবকে হত্যা করার জন্য জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং এজন্য তাকে মহিষাসুর মর্দিনীও বলা হয়। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, মহিষাসুর দেবতাদের তাড়িয়ে  স্বর্গ দখল করেছিলেন, তারপর সমস্ত দেবতারা একসাথে ত্রিমূর্তিতে কাছে গিয়েছিলেন। ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং শিব তাদের দেহের শক্তি থেকে একটি আকৃতি তৈরি করেছিলেন এবং সমস্ত দেবতারা তাদের শক্তিকে সেই চিত্রের মধ্যে রেখেছিলেন। এজন্য দুর্গাকে শক্তি দেবীও বলা হয়। দুর্গার মূর্তি ছিল খুবই মৃদু , আকর্ষণীয় এবং তার অনেক হাত ছিল।

কারণ সমস্ত দেবতারা একত্রে তাকে ক্ষমতা দিয়েছিলেন, তাই তাকে সবচেয়ে শক্তিশালী দেবী বলে মনে করা হয়। তিনি শিবের ত্রিশূল, বিষ্ণুর চক্র, ব্রহ্মার পদ্ম, সমস্থ শক্তি পেয়ে তিনি দুর্গা রুপ পেয়েছিলেন। তার পর তিনি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন।

দুর্গার ক্ষমতা সম্পর্কে ঋকবেদের শ্লোক 10.125.1 থেকে 10.125.8 দেবী সূক্তে পড়তে পারেন।

২। শুধুমাত্র 9 দিনের জন্য পূজা কেন হয়?

দুর্গা বা দেবী যখন মহিষাসুরকে আক্রমণ করেছিলেন এবং একের পর এক অসুরদের হত্যা করতে শুরু করেছিলেন, তখন মহিষাসুরকে বধ করতে 9 দিন লেগেছিল, যিনি মহিষের রূপ নিয়েছিলেন। এই কারণেই নবরাত্রি 9 দিনের ধরে উদযাপিত হয়। এর সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য গল্প আছে যেমন নবরাত্রি দুর্গার 9 টি রূপের সাথে যুক্ত এবং বলা হয় যে প্রতিদিন দেবী যুদ্ধে ভিন্ন রূপ ধারণ করেন। তাই ৯ দিন বিভিন্ন রুপে দেবীর পূজা করা হয়। প্রতিদিন একটি ভিন্ন রঙের সাথেও যুক্ত থাকে।

নবরাত্রি, দুর্গাপূজা, হিন্দু, ধর্ম, পুরাণ

দুর্গাপূজায় দুর্গার  এই রুপ টি পূজিত হয়

দুর্গার দেবীর বাহু কয়টি ?

কোথাও কোথাও বলা হয় দেবী দুর্গার আটটি বাহু রয়েছে। কিছু শাস্ত্রে এটি 10 ​​বাহু আছে বলেও বলা হয়। বাস্তুশাস্ত্রে 8 টি গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশ রয়েছে, তবে অনেক জায়গায় 10 টি কোণ বা দিকনির্দেশের কথা বলা হয়েছে। এগুলি হল প্রাচী (পূর্ব), প্রতিচি (পশ্চিম), উদীচি (উত্তর), আভাচি (দক্ষিণ), ইশান (উত্তর -পূর্ব), অগ্নিয়া (দক্ষিণ -পূর্ব), নৈরিত্য (দক্ষিণ -পশ্চিম), বায়ু (উত্তর -পশ্চিম),উর্ধ্ব ( আকাশ দিকে), ভিত্তি (পাতালের দিকে)। অনেক জায়গায় শুধুমাত্র 8 টি দিক বিবেচনা করা হয় কারণ আকাশ এবং পাতাল দিক নির্দেশনার মর্যাদা দেওয়া হয় না। হিন্দু ধর্মগ্রন্থ অনুসারে, বিশ্বাস করা হয় যে দেবী দুর্গা তার ভক্তদের প্রতিটি দিক থেকে রক্ষা করেন এবং এই কারণেই তার ১০টি বাহু রয়েছে যা ১০টি দিকে নির্দেশ করে।

দেবী দুর্গা সিংহের উপর বসা কেন?

দুর্গার বাহন হল সিংহ এবং এটি অতুলনীয় শক্তির সঙ্গে যুক্ত। এটা বিশ্বাস করা হয় যে সিংহের উপর চড়ে দুর্গা মা দুঃখ ও অশুভের অবসান ঘটায়।

৫। দুর্গাকে কেন ত্রিম্বকে বলা হয়?

দুর্গাকে ত্রিম্বকে বলা হয় অর্থাৎ তিন চোখের অধিকারী। শিবকে ত্রিম্বকেও বলা হয় যার তিনটি চোখ রহয়েছে। দুর্গা শিবের অর্ধেক রূপ হিসাবে বিবেচিত হয় যাকে শক্তিও বলা হয়। দুর্গার তিনটি চোখ অগ্নি, সূর্য ও চন্দ্রের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত।

৬। দুর্গার পূজার জন্য কেন ১০৮ মন্ত্র জপ করা হয়?

নবরাত্রি দুর্গাপূজা নামেও পরিচিত। কথিত আছে যে ভগবান রাম দেবী দুর্গার পূজা করেছিলেন, যাকে রাম মহিষাসুর মর্দিনী বলে সম্বোধন করেছিলেন। এই পূজা রাবণের সাথে যুদ্ধের আগে করা হয়েছিল এবং তাই রাবণকে হত্যা করার দিন নবরাত্রি শেষে দশেরা উদযাপন করা হয়। এটা বিশ্বাস করা হয় যে ভগবান রাম দুর্গাপূজার সময় দুর্গাকে ১০৮ টি নীলকমল অর্পণ করেছিলেন এবং সেজন্যই ১০৮ টি শুভ বলে মনে করা হয়।

৭। পিতৃপক্ষের শেষে নবরাত্রি পালন করা হয় কেন?

পিতৃপক্ষের পূর্বপুরুষদের পূজার পর, এটি বিশ্বাস করা হয় যে ঘরটি পবিত্র হয় এবং তার পরে দেবী পক্ষ অর্থাৎ নবরাত্রি আসে এবং তারপরে সমস্ত ধরণের উৎসব শুরু হয়। বিশ্বাস করা হয় যে দেবী পক্ষের প্রথম দিন মা দুর্গা তার সন্তানদের নিয়ে পৃথিবীর দিকে যাত্রা শুরু করেন।

৮। দুর্গা পূজা করতে পতিতালয়ের মাটি কেন লাগে?

যৌনপল্লীর মাটি ছাড়া দুর্গা প্রতিমা অসম্পূর্ণ। এর পিছনে বেশ কয়েকটি কারণ বিদ্যমান।

প্রকৃতির বিশেষ একটি অংশই নারী। এই নারী মানেই মা, এই নারী মানেই কন্যা। এরা কখনও অশুচি, অপবিত্র হ’তে পারেন না। এদের পতিতাবৃত্তির মূলেই রয়েছে পুরুষের লোভ ও লালসাপূর্ণ লোলুপ দৃষ্টি। এই পবিত্র নারীজাতিকে বিপথে চালিত করার পিছনে রয়েছে সীমাহীন পুরুষের কামাভিলাস।

পুরাণ মতে, একবার ঋষিবর বিশ্বামিত্র ইন্দ্রের সমান ক্ষমতাধর হওয়ার জন্য কঠোর তপস্যায় ব্রতী হয়েছিলেন। ইন্দ্র কোনোভাবেই তাকে বিরত করতে পারছিলেন না। বাধ্য হয়েই তিনি স্বর্গের অপ্সরাকে পাঠালেন। কঠোর তপস্যা রত বিশ্বামিত্রের ধ্যান ভঙ্গ হলো। কামাতুর বিশ্বামিত্র মেনকায় লুব্ধ হল। ইন্দ্রের ইচ্ছা পূর্ণ হল।

এখানে মেনকা যদিও অষ্টসতীর কেউ নন, তবুও তিনি নারীজাতির প্রতিনিধি তো বটে। ঋষির লোভাতুর কামুক দৃষ্টিই তাকে সর্বনাশের পথে এগিয়ে দিল। মেনকা নিষ্কলুষ অবস্থায় স্বর্গে চলে গেলেন।

শাস্ত্র বলে সেই আদলকে ফুটিয়ে তুলতে কয়েকটি জিনিস আবশ্যক ৷ যেমন, গাভীর মূত্র, গোবর, ধানের শিস, পবিত্র গঙ্গার জল আর নিষিদ্ধপল্লীর মাটির মিশ্রণে তৈরি হবে দেবীমূর্তি ৷ আর সেই কারণেই সেই পুরাকাল থেকে আজও দেবীর মূর্তি তৈরিতে দরকার হয় বেশ্যালয়ের মাটি ৷

কিন্তু কেন এই রীতি ? সমাজে যাঁদের দূরে ঠেলে দিয়েছে, অবজ্ঞা আর বঞ্চনার পাহাড় জমে উঠেছে যাঁদের দেওয়াল বেয়ে, ঘৃণা আর নোংরা দৃষ্টি ছাড়া যাঁদের ভাগ্যে আর কিছুই জোটেনি তাঁদের ঘরের মাটিই আবার দেবীমূর্তির অপরিহার্য অঙ্গ, কিন্তু কেন ? বলা হয়, পুরুষ মানুষ পতিতালয়ে গিয়ে যখন বারাঙ্গনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হন, তখন তিনি জীবনে সঞ্চিত সমস্ত পুণ্য সেখানেই ফেলে আসেন ৷ আর সংগ্রহ করেন ঘড়া ভর্তি পাপ ৷

চিরাচরিতভাবে মানুষ বিশ্বাস করেন যে, মানুষের মধ্যে যে কামনা, বাসনা, লালসার বাস। পতিতারা তা নিজেদের মধ্যে নিয়ে নেন। তাঁরা নিজেদের অশুদ্ধ, অপবিত্র করে সমাজকে শুদ্ধ রাখতে চান। পবিত্র রাখতে চান। ফলে হাজার হাজার পুরুষের পুণ্যে বেশ্যাদ্বারের মাটি হয়ে ওঠে পবিত্র ৷ সে কারণেই এই মাটি দিয়ে গড়তে হয় দেবী মূর্তি ৷

এই আচার থেকে বোঝানো হয় যে, নারী মায়ের জাতি। নারীর ওরসেই পুরুষের জন্ম। নারীকে পতিতা বানায় পুরুষরাই। তাই ঐ পুরুষরাই অপবিত্র। মায়ের প্রতিমা তৈরীতে পতিতালয়ের মাটি দিতে হয় অর্থাৎ যাঁরা এই পরিস্থিতির শিকার তাঁদের সন্মান করতে হবে। নারী কোখনো অপবিত্র হতে পারে না এই ধারণাটিই লুকিয়ে থাকে এই রীতির আড়ালে ৷

৯। কুমারী পূজা কেন করা হয়?

শাস্ত্রমতে কুমারী পূজার উদ্ভব হয় কোলাসুরকে বধ করার মধ্য দিয়ে থেকে। গল্পে বর্ণিত রয়েছে, কোলাসুর এক সময় স্বর্গ-মর্ত্য অধিকার করায় বাকি বিপন্ন দেবগণ মহাকালীর শরণাপন্ন হন। সে সকল দেবগণের আবেদনে সাড়া দিযে় দেবী পুনর্জন্মে কুমারীরূপে কোলাসুরকে বধ করেন। এরপর থেকেই মর্ত্যে কুমারী পূজার প্রচলন শুরু হয়।

কুমারী পূজা হলো তন্ত্রশাস্ত্রমতে অনধিক ষোলো বছরের অরজঃস্বলা কুমারী মেয়ের পূজা। বিশেষত দুর্গাপূজার অঙ্গরূপে এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়াও কালীপূজা, জগদ্ধাত্রীপূজা এবং অন্নপূর্ণা পূজা উপলক্ষে এবং কামাখ্যাদি শক্তিক্ষেত্রেও কুমারী পূজার প্রচলন রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে 1901 সালে বেলুড় মঠে স্বামী বিবেকানন্দ এই পূজা শুরু করেছিলেন। 

আর পড়ুন…..