হিজাব বিরুদ্ধে আন্দোলন: ইরানের হাজার হাজার নারী হিজাবের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছে। কট্টরপন্থী মুসলিম দেশ ইরানে হিজাবের বিরুদ্ধে নারীদের ক্ষোভ ফুটে উঠেছে। নারীরা চুল কেটে, হিজাবে আগুন লাগিয়ে, হিজাবের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেছে।
আসুন দেখি মূল ঘটনা সুত্রপাত কিভাবে হলো
ইরানে হিজাবের নামে এক মেয়েকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। 22 বছর বয়সী মহাসা আমিনির জীবন পুলিশ কেড়ে নেওয়া।
13 সেপ্টেম্বর মহাসা আমিনি তার পরিবারের সাথে তেহরানে বেড়াতে আসেন। নৈতিকতা রক্ষা পুলিশ যখন আমিনিকে গ্রেপ্তার করে, তখন হিজাবের তলা দিয়ে তার কিছু চুল দেখা যাচ্ছিল বলে অভিযোগ করা হয়।
একটি আটক কেন্দ্রে তাকে নিয়ে যাবার অল্পক্ষণ পরই মাশা আমিনি অজ্ঞান হয়ে যান এবং কোমায় চলে যান। তিন দিন পর তিনি হাসপাতালে মারা যান।
পরিবারে অফিযোগ অফিসাররা তার মাথায় লাঠির বাড়ি মেরেছে এবং তাদের একটি গাড়িতে মিজ আমিনির মাথা ঠুকে দিয়েছে, যা পুলিশ অস্বীকার করেছে।
মহাসা আমিনির মৃত্যু ইরানী নারীদের ক্ষুব্ধ করেছে, প্রতিবাদ হিসেবে কেউ কেউ চুল কেটে ফেলে, আবার কেউ কেউ তাদের হিজাবে আগুন ধরিয়ে দেয়।
এই বিক্ষোভ দমনে ইরানের পুলিশ সব ধরনের উপায় অবলম্বন করছে। লাঠিচার্জ, জল কামান, গ্রেফতার, সবই করা হচ্ছে। এর পরও হিজাবের বিরুদ্ধে চলমান বিক্ষোভ থামছে না। সর্ব শেষ খবর অনুযায়ী ৩১ জন মারা গিয়েছে।
গাশ্ত-ই এরশাদ নামে বিশেষ এই নজরদারি পুলিশ বাহিনীর একজন অফিসার নাম পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে বিবিসিকে দেয়া একটি একান্ত সাক্ষাৎকারে ওই বাহিনীতে তার কাজ করার অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন।
“তিনি বলেন যে নারীদের রক্ষা করার লক্ষ্যে আমরা পুলিশের এই নৈতিকতা রক্ষা বাহিনীতে কাজ করছি,”
“কারণ নারীরা যদি ঠিকমত পোশাকআশাক না পরে, তাহলে পুরুষরা উত্তেজিত হবে এবং ওই নারীদের ক্ষতি করবে।”
তিনি আর বলেন, তারা ছয় জনের দলে কাজ করেন। দলে থাকেন চারজন পুরুষ এবং দুজন নারী পুলিশ।
যেসব এলাকায় মানুষ পায়ে হেঁটে বেশি চলাচলা করে এবং যেসব এলাকায় মানুষের ভিড় বেশি হয়, সেসব এলাকার ওপর তারা বেশি নজর রাখেন।
“ব্যাপারটা অবশ্য একটু অদ্ভুত। কারণ আমাদের কাজের লক্ষ্য যদি হয় মানুষকে নির্দেশগুলো বোঝানো, সেগুলো মানতে বলা, তাহলে আমরা কেন জনাকীর্ণ এলাকাগুলো বেছে নিচ্ছি?
প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে কি আমরা এমন জায়গা বেছে নিচ্ছি যেখানে বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করা যাবে?”
“মনে হতে পারে আমরা শিকারের সন্ধানে যাচ্ছি।”
এই পুলিশ অফিসার বলেন, পোশাক বিধি লংঘন করছে এমন যথেষ্ট সংখ্যক মানুষকে ধরতে না পারলে তাকে তার ঊর্ধ্বতন কমান্ডারের তিরস্কারের মুখে পড়তে হয়, বা শুনতে হয় সে, দায়িত্ব ঠিকমত পালন করছে না।
তিনি আরও বলেন মানুষকে গ্রেপ্তার করার সময় যখন তাদের বাধার মুখে পড়তে হয়, সেটা তার জন্য বিশেষ সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
“লোকেরা জানে আটক করে আমরা তাদের জোর করে পুলিশের ভ্যানে ওঠাব। এ কাজ করার সময় বহুবার আমার চোখে পানি চলে এসেছে।
“আমি তাদের বলতে চেয়েছি আমি ঠিক ওদের একজন নই। আমরা বেশিরভাগই সাধারণ সৈনিক- আমাদের বাধ্য হয়ে দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। এর জন্য আমার খুবই খারাপ লাগে।”
১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের পরপরই। ওই বিপ্লবের একটা বড় লক্ষ্য ছিল নারীদের খোলামেলা সাজপোশাক বন্ধ করা।
শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলাভিকে ক্ষমতাচ্যুত করার আন্দোলনের আগে তেহরানের রাস্তায় নারীদের খাটো স্কার্ট পরে এবং মাথা না ঢেকে চলাফেরা করতে দেখা যেত।
তার স্ত্রী ফারাহ, যিনি প্রায়শই পশ্চিমা পোশাক পরতেন, তাকে ইরানে আধুনিক নারীর একজন আদর্শ হিসাবে মনে করা হতো।
ইরান ইসলামী প্রজাতন্ত্রে পরিণত হবার কয়েক মাসের মধ্যেই শাহ-এর শাসনামলে নারীদের অধিকার সুরক্ষিত করে যেসব আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল সেগুলো তুলে নেবাার প্রক্রিয়া শুরু হয়।
আয়াতোল্লাহ খোমেইনি ১৯৭৯ সালের ৭ই মার্চ ডিক্রি বা নির্দেশনামা জারি করেন যে, সব নারীকে তাদের কর্মক্ষেত্রে বাধ্যতামূলকভাবে হিজাব পরতে হবে এবং নারীরা মাথা না ঢাকলে তার বিচারে সেইসব নারী ”নগ্ন” বলে গণ্য হবেন।
এরপর ১৯৮১ সালে নারী ও কিশোরীদের ইসলামি রীতি অনুযায়ী আব্রু রক্ষা করার উপযোগী পোশাক পরা আইনত বাধ্যতামূলক করা হয়।
এর অর্থ হল নারীদের চাদর পরতে হবে অর্থাৎ তাদের পা অবধি পুরো শরীর ঢাকা ঢিলা পোশাক পরতে হবে এবং তার সাথে পারলে নিচে ছোট একটা স্কার্ফ পরতে হবে।
অথবা পুরোদস্তুর হিজাব এবং তার সাথে লম্বা হাতা ওভারকোট দিয়ে শরীর ঢাকতে হবে। তবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে বাধ্যতামূলকভাবে হিজাব পরার বিরুদ্ধে লড়াই চলতেই থাকে।
পার্লামেন্ট ১৯৮৩ সালে সিদ্ধান্ত নিল যেসব নারী প্রকাশ্যে মাথা ঢাকবে না, তাদের শাস্তি হিসাবে ৭৪ বার বেত্রাঘাত মারা হবে।
তবে এরপরেও তখন থেকেই এই আইন পুরোপুরি কার্যকর করতে কর্তৃপক্ষকে বেগ পেতে হয়েছে। সব বয়সের নারীকেই প্রায়ই দেখা যাচ্ছে রাস্তাঘাটে বা প্রকাশ্যে সীমানা লংঘন করে আঁটোসাঁটো জামা বা উরু পর্যন্ত ঝুলের খাটো কোট পরতে।
২০০৪ সালের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা তৎকালীন তেহরানের অতি রক্ষণশীল মেয়র মাহমুদ আহমেদিনিজাদ কিন্তু এ বিষয়ে তার প্রচারণায় অনেক প্রগতিশীল অবস্থান নেন। “প্রত্যেক মানুষের রুচি আলাদা, এবং সকলের সেবা করার জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে,” সেসময় টেলিভিশনে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন।
তবে পরের বছর নির্বাচনে তিনি জেতার মাত্র কিছুদিন পরই আনুষ্ঠানিকভাবে গঠন করা হয় গাশ্ত-ই এরশাদ বাহিনী। এর আগে পর্যন্ত নারীদের ইসলামি পোশাক পরার ওপর অনানুষ্ঠানিকভাবে নজরদারি করত দেশটির অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী এবং আধাসামরিক ইউনিটগুলো।
হিজাব বিরুদ্ধে আন্দোলন: নতুন দমননীতি
বর্তমান প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত কট্টরপন্থী ধর্মীয় নেতা ইব্রাহিম রাইসি ১৫ই অগাস্ট একটি নির্দেশে স্বাক্ষর করেন, যেখানে নতুন তালিকাভুক্ত বিধিনিষেধ বলবতের ঘোষণা দেয়া হয়।
এতে বলা হয় নারীরা কী ধরনের পোশাক পরে প্রকাশ্যে বেরুচ্ছে তা পর্যবেক্ষণের জন্য ক্যামেরা বসানো হবে।
মি. রাইসির নতুন বিধিনিষেধের কারণে নারীদের গ্রেপ্তারের ঘটনা বেড়ে গেছে। কিন্তু পাশপাশি সামাজিক মাধ্যমে নারীদের হেডস্কার্ফ না পরা ছবি ও ভিডিও পোস্ট করার সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য রকম বেড়ে গেছে। আর আমিনির মৃত্যুর পর সেই সংখ্যা আরও তীব্র হয়েছে।
২০১৫ সালে ইরানের নাগরিকদের বায়োমেট্রিক কার্ড তৈরি করা হয়। এটাকে আপনি ইরানের আধার কার্ড মনে করতে পারেন। এই কার্ডের তথ্য ফেসিয়াল রিকগনিশন প্রযুক্তিতে যুক্ত করা হয়েছে।
ইরানের প্রায় সব সরকারি অফিস, বাস, ট্রেন, রেলস্টেশন এবং পাবলিক প্লেসে ফেসিয়াল রিকগনিশন প্রযুক্তি সহ ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে।
হিজাব ছাড়া কোনো নারীকে দেখা গেলেই তার তথ্য চলে আসে সরকারি প্রতিষ্ঠানে। এর পর হিজাবের নিয়ম লঙ্ঘনকারী নারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
নতুন নিয়ম অনুযায়ী, কোনো নারী হিজাব ছাড়া ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করলে তাকে চাকরিচ্যুত করা হবে।
সরকারি সুযোগ-সুবিধা বন্ধ হয়ে যাবে। কারাদণ্ড 10 দিন থেকে 2 মাস পর্যন্ত হতে পারে। 50 হাজার থেকে 5 লাখ ইরানি রিয়াল পর্যন্ত জরিমানা এবং 74 বেত্রাঘাতের শাস্তিও দেওয়া হবে।
ডিসেম্বর 2017 নাগাদ হিজাব নিয়ে অনেক ধরনের প্রতিবাদ শুরু হয়। এ কারণে ইরানের পুলিশ হিজাবের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত নারীদের বিরুদ্ধে পতিতাবৃত্তি ও দুর্নীতির অভিযোগ এনেছে। এই অভিযোগে ১০ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।
মজার ব্যাপার হল, 1979 সালের ইসলামী বিপ্লবের আগে, কিছু ইরানী নারী সেই সময়ের সরকারে বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য হিজাব পরতেন। অর্থাৎ হিজাব সেখানে রাজার বিরোধিতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। কিন্তু ঐ সময়ে এই নারীরাও কখনো ভাবেননি যে ইসলামী বিপ্লবের পর তাদের ওপরও একই হিজাব চাপিয়ে দেওয়া হবে।
উল্লেখ্য, 1936 সালে, ইরানের রাজা শাহ পাহলভি বোরকা এবং হিজাব নিষিদ্ধ করেছিলেন। যদিও এর আগে ইরানের কলেজ ও স্কুলে হিজাব পরা নিষিদ্ধ ছিল। হিজাব বিরুদ্ধে আন্দোলন হিজাব বিরুদ্ধে আন্দোলন
- অমৃতানন্দময়ী, যার হাত ধরেই নির্মাণ হলো এশিয়ার বৃহত্তম বেসরকারি মাল্টি স্পেশালিটি হসপিটাল।
- চীন-তাইওয়ান উত্তেজনা: চীন-তাইওয়ান বিরোধ থেকে ভারতের জন্য কী সম্ভাবনা রয়েছে?
- ব্রিটেনের কোম্পানি: এই 10 টি কোম্পানি ছিল ব্রিটেনের গর্ব, এখন সব ভারতীয়।
- হিজাব বিরুদ্ধে আন্দোলন হিজাব বিরুদ্ধে আন্দোলন হিজাব বিরুদ্ধে আন্দোলন