সাইকোলজি’-র (Psychology) প্রতিশব্দ হিসাবে বাংলাষ মনােবিজ্ঞান, মনস্তত্ত্ব, মনােবিদ্যা প্রভৃতি শব্দ প্রচলিত। সাইকি’ {304?!ele) এবং ‘লােগস’ (doyos)—এই দুটি গ্রীক শব্দের সমন্বয়ে সাইকোলজি’ শব্দের উৎপত্তি। সাইকি মানে আত্মা, লােগস’ মানে জ্ঞান। অতএব, ব্যুৎপত্তির দিক থেকে সাইকো
লজি’-র অর্থ আত্মা সংক্রান্ত জ্ঞান’ বা ‘আত্মতত্ত্ব’।
এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই যে দীর্ঘদিন ধরে ‘সাইকোলজি’-কে মূলত এই অর্থে ই গ্রহণ করা হয়েছে : আত্মা সংক্রান্ত দার্শনিক বা তত্ত্বগত আলোচনাই মনােবিদ্য বলে বিবেচিত হয়েছে, মনােবিদ্যা হয়ে থেকেছে দর্শনেরই অঙ্গমাত্র।
কিন্তু মােটের উপর বলা যায়, আধুনিক মনােবিজ্ঞানীরা সাইকোলজি’ শব্দটি প্রত্যাখ্যানা করলেও তার উপরােক্ত অর্থ বর্জন করেছেন। আমাদের দেহের অভ্যন্তরে আত্মা বলে সূক্ষ্ম ও স্বতন্ত্র কিছু একান্তই আছে কিনা এবং থাকলে তার স্বরূপ কী— ইত্যাদি প্রশ্ন দার্শনিকদের পক্ষে অবান্তর না হলে ও আধুনিক মনােবিজ্ঞানে তার স্থান নেই।
কেননা, মনােবিজ্ঞান আর দর্শনের অঙ্গ বলে বিবেচিত নয়—আধুনিক মনোবিজ্ঞানীরা দর্শনের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে মনােবিজ্ঞানকে একটি স্বতন্ত্র ও সুনির্দিষ্ট বিজ্ঞানে পরিণত করতে চান।অবশ্যই মনােবিজ্ঞানকে স্বতন্ত্র ও স্বাধীন এক বিজ্ঞানে পরিণত করার এই প্রয়াস অপেক্ষাকৃত সাম্প্রতিক এবং তার সার্থকতাও সম্পূর্ণ তর্কাতীত নয়। তবুও আধুনিক মনােবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ প্রসঙ্গে এই কথাটিই সর্বপ্রথম উল্লেখযোগ্য : মনােবিজ্ঞান আসলে একটি বিজ্ঞান, অতএব তার দৃষ্টিকোণও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ ।।
বিজ্ঞানকে সাধারণত দু’ভাগে ভাগ করা হয় : জ্ঞান-নিষ্ঠ (Positi1 o) এবং আদর্শনিষ্ঠ (Normativo)। কোন বিষয় আসলে ঠিক কী রকম—জ্ঞান-নিষ্ঠ বিজ্ঞানে তারই সুশৃঙ্খল আলােচনা। যেমন, পদার্থবিজ্ঞান বা জীববিজ্ঞান। অপরপক্ষে, কোন বিষয় ঠিক কী রকম হওয়া উচিত তারই সুশৃঙ্খল আলােচনাকে বলা মনােবিজ্ঞান হয় আদর্শ-নিষ্ঠ বিজ্ঞান।
যেমন, নীতিবিজ্ঞান বা তর্কবিজ্ঞান। মনােবিজ্ঞান জ্ঞান-নিষ্ঠ বিজ্ঞান ; আদর্শ-নিষ্ঠ বিজ্ঞান নয়। আবার জ্ঞান-নিষ্ঠ বিজ্ঞানের মধ্যে জ্যামিতি প্রভৃতি গণিতবিজ্ঞানে কয়েকটি মূলসূত্র থেকে শুরু করে অবরােহ-পদ্ধতি (Deductive Method) অনুসারে অগ্রসর হবার আয়ােজন। অপরপক্ষে, পদার্থবিজ্ঞান প্রভৃতিতে পর্যবেক্ষণ (Observation) ও পরীক্ষার (Experiment) সাহায্যে—অর্থাৎ, অভিজ্ঞতামূলকভাবে—উপাদান সংগ্রহ করে আরােহ-পদ্ধতি (Inductiv) Method) অনুসারে অগ্রসর হবার আয়ােজন।
আধুনিক মনােবিজ্ঞানীরা মনােবিজ্ঞানকে এই দ্বিতীয় প্রকার বিজ্ঞানেই পরিণত করতে চান। অবশ্যই পদার্থবিজ্ঞান প্রভৃতির ক্ষেত্রেও গাণিতিক হিসাব প্রভৃতির স্থান আছে ; তবুও বিজ্ঞান গুলি প্রধানতই অভিজ্ঞতামূলক। তেমনি মনােবিজ্ঞান থেকেও গাণিতিক বিচার প্রভৃতি বর্জন করার প্রশ্ন না-উঠলেও মনােবিজ্ঞানকে প্রধানতই অভিজ্ঞতামূলক বিজ্ঞানে পরিণত করতে হবে-—অর্থাৎ, মনােবিজ্ঞানেও প্রধানত পরিদর্শন ও পরীক্ষার উপরই নির্ভর করতে হবে।
আধুনিক মনােবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণকে এই অর্থে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ বলে গ্রহণ করলেও প্রশ্ন উঠবে, মনােবিজ্ঞানের বিষৰবস্তু কী হবে? মনােবিজ্ঞান নাম থেকে সহজেই মনে হয়, তার আলােচ্যবিষয় হল ‘মন’। বস্তুত অনেকেই এই কথা বলে থাকেন। কিন্তু কথাটি সর্ববাদীসম্মত নয়। আসলে, আধুনিক মনােবিজ্ঞানীরা নানা সম্প্রদায়ে বিভক্ত এবং সম্প্রদায়গুলির মধ্যে বহু মৌলিক প্রশ্নেও মতভেদ আছে।
যেমন, একটি সম্প্রদায়ের মত আচরণবাদ (Behaviorism) নামে খ্যাত। এই মতে, ‘মন’ বলে আসলে কিছুই নেই—আত্মার মতাে মনও প্রাচীন দার্শনিক সংস্কারের স্মারকমাত্র ; তথাকথিত মন বা মানসিক অবস্থাগুলি দৈহিক প্রক্রিয়াবিশেষ। অন্যেরা অবশ্য এ-জাতীয় চরম মত গ্রহণ করেন না। কিন্তু মন বা মানসিক অবস্থা প্রভৃতি অস্বীকার না-করলেও তারা অনেকেই মনােবিজ্ঞানকে মন সংক্রান্ত বিজ্ঞান বলতে সম্মত নন।
কেননা, মন কিংবা চিন্তা-চেতনা ও ভাব-আবেগ প্রভৃতি মানসিক অবস্থাগুলির প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা সম্ভব নয় ; অতএব মনােবিজ্ঞানকে মন সংক্রান্ত বিজ্ঞান বললে তা আর অভিজ্ঞতামূলক হবে না। কিন্তু মন বা মানসিক অবস্থার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা না হলেও আচরণ (behaviour) অভিজ্ঞতা সাপেক্ষ।
অতএব, আধুনিক মনােবিজ্ঞানীদের মধ্যে অনেকেই বলছেন, এই আচরণই মনােবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু। যেমন, আমরা জানি একটি মানুষের অভ্যন্তরে নানা ঘটনা ঘটে চলে ; এগুলিকে আমরা সাধারণভাবে মানসিক ঘটনা বলে উল্লেখ করি। যথা : চিন্তা-চেতনা, ভাব-আবেগ ইত্যাদি। এ-জাতীয় ঘটনা সংক্রান্ত নির্ভরযােগ্য
মনােবিজ্ঞানের স্বরূপ, বিষয়বস্তু ও পদ্ধতি
অনুমানও সম্ভব হতে পারে। কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে কখনই আমরা এগুলিকে জানতে পারিনা। প্রত্যক্ষভাবে জানতে পারি শুধুমাত্র তার আচরণটুকু : লােকটি যা বলছে, যা করছে, যা লিখছে ইত্যাদি। এবং এ-জাতীয় আচরণ সংক্রান্ত অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করেই আমরা তার আভ্যন্তরীণ ঘটনাগুলি অনুমান করতে পারি।
যে মানুষ কথা বলতে পারেনা, লিখতে পারেনা, শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পরিচালনা করতে পারেন। তারও অভ্যন্তরে চিন্তা-চেতনা বা ভাব-আবেগ জাতীয় ঘটনা ঘটা অসম্ভব নয় ; কিন্তু মনােবিজ্ঞানীর কাছে সেগুলি সম্পূর্ণ অজ্ঞাত থাকবে। কেননা শুধুমাত্র আচরণ সংক্রান্ত অভিজ্ঞতাকে অবলম্বন করেই তিনি মানুষের আভ্যন্তরীণ ঘটনাগুলি অনুমান করতে পারেন। |
এইভাবে আচরণ সংক্রান্ত বিজ্ঞান হিসাবে স্বীকৃত হলে মনােবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য সুস্পষ্ট হবে। মনােবিজ্ঞানী শান্ত ও নির্লিপ্তভাবে বিভিন্ন ব্যক্তির আচরণ পর্যবেক্ষণ করেন এবং যথাসম্ভব নির্লিপ্তভাবেই নিজের আভ্যন্তরীণ অবস্থা প্রভৃতিও বােৰাবার চেষ্টা করবেন। কিন্তু শুধুমাত্র নিজের আভ্যন্তরীণ অবস্থা পর্যালোচনা করে কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হলে সে-সিদ্ধান্ত তার ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যর দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে।
এই কারণে তিনি অন্যান্য ব্যক্তির আচরণ পর্যবেক্ষণের উপরই প্রধান গুরুত্ব আরোপণ করতে চান। অতএব, মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে এ-কথা অস্বীকার করার প্রয়ােজন নেই যে ব্যক্তিতে-ব্যক্তিতে পার্থক্য আছে ; সমস্ত মানুষই ছাঁচে-ঢাল। বহু একই রকমের নয়। কিন্তু এই পার্থক্যের দিকটিই একমাত্র সত্য হলে মনােবিজ্ঞানীর পক্ষে কোন সার্বিক বা সাধারণ সত্যে উপনীত হবার ও সম্ভাবনা থাকেনা।
অর্থাৎ, মনােবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে পার্থক্য স্বীকৃত হলেও সকলের মধ্যে মৌলিক সাদৃশ্যও স্বীকারযােগ্য। একই অবস্থায় সকলে মােটের উপর একইভাবে আচরণ করে, একই পরিবেশের সঙ্গে সকলে মােটের উপর একইভাবে নিজেদের খাপ খাইয়ে নেবার চেষ্টা করে, একই সমস্যা সকলে মােটের উপর একইভাবে সমাধান করতে চায়। বস্তুত মনােবিজ্ঞানীর দৃষ্টিকোণ থেকে সকলের মধ্যে আচরণের এ-জাতীয় মৌলিক সাদৃশ্য।
স্বীকৃত বলেই তিনি শুধু যে কয়েকটি সার্বিক সত্যে উপনীত হবার প্রয়াস পান তাই নয়, তার পক্ষে ব্যবহারিকভাবেও অন্যান্য ব্যক্তিকে সাহায্য করা সম্ভব হয়। নিজেদের জীবনে বাধাবিঘ্ন ও সমস্যার প্রতি মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব আরােপণের প্রবণতা অনেকেরই হতে পারে ; ফলে কোন ব্যক্তি কল্পনা করতে পারে যে তার মতো সমস্যার সম্মুখীণ আর কাউকেই হতে হয়নি। এ-জাতীয় কল্পনার ফলে সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে ব্যক্তিটি আরো হতাশই হয়ে পড়বে। কিন্তু মনােবিজ্ঞানী তাকে
দেখাতে পারেন, আরাে বহু ব্যক্তি মােটের উপর একই সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে এবং সে-সমস্যার সমাধানও করেছে। এইভাবে বিভিন্ন ব্যক্তির মধ্যে মৌলিক সাদৃশ্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে মনােবিজ্ঞানী আলােচ্য ব্যক্তিটিকে বিশেষ সাহায্য করতে পারেন।মনােবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ অনুসারে শুধু যে পরিণত বয়সের সমস্ত মানুষের মধ্যে সাদৃশ্য বর্তমান তাই নয়, বস্তুত সমগ্র প্রাণীজগতে আচরণের বহুবিধ সাদৃশ্য স্বীকার যােগ্য। কেননা,
উন্নততর মস্তিষ্ক প্রভৃতির অধিকারী হিসাবে উন্নততর প্রাণী হলেও মানুষ শেষ পর্যন্ত প্রাণীজগতেরই অন্তর্ভুক্ত। অতএব, প্রাণী হিসাবে অন্যান্য প্রাণীর সঙ্গে তার আচরণের বহুবিধ সাদৃশ্যও বর্তমান। বস্তুত এই স্বীকৃতির উপর নির্ভর করে আধুনিক মনােবিজ্ঞানীরা নানা প্রাণীর আচরণ পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা করে অনেক সময় মানব-আচরণের মূলসূত্র ও অনুসন্ধান করে থাকেন।
তবুও মনােবিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে মানুষের আচরণ নিছক একটি প্রাণীর আচরণমাত্র নয়। কেননা, মানুষ মূলতই সামাজিক প্রাণী ; তাই তার আচরণের একটি সামাজিক দিকও বর্তমান। যেমন, মনােবিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে মানুষের কথা কওয়া শুধুই তার স্বরযন্ত্রের প্রক্রিয়া নয়,অন্যান্য মানুষের সঙ্গে চিন্তা আদানপ্রদানের কৌশলও।। | মনােবিজ্ঞানীর দৃষ্টিকোণের আর একটি বৈশিষ্ট্য এই যে তিনি কোন ব্যক্তিরই অতীতকে সম্পূর্ণভাবে বর্জন করতে সম্মত নন। তার দৃষ্টিতে শৈশব থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত মানব-আচরণের মধ্যে ধারাবাহিকতা বর্তমান।
কেউ হয়ত ভাবতে পারেন, ‘কিছুদিন আগে আমি নেহাতই ছেলেমানুষ ছিলাম, কিংবা, এখন আমি সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছি, নতুন মানুষ হয়ে গিয়েছি’, ইত্যাদি। কিন্তু শৈশবকে সত্যিই সম্পূর্ণভাবে বর্জন করা সম্ভব নয়। পরিণত বয়সের মানুষ নানান নৃতনদিকে নৃতনভাবে আত্মনিয়ােগ করতে পারে; কিন্তু মনােবিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে ব্যক্তিত্বের সূত্রপাত শৈশব থেকেই। বস্তুত, জন্ম থেকে মানুষের ব্যক্তিত্ব কীভাবে বিকশিত হয় আধুনিক মনােবিজ্ঞানে তার আলােচনা বিশেষ প্রাধান্য পেয়েছে।
মনােবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ প্রসঙ্গে আরাে বক্তব্য এই যে অন্যান্য বিজ্ঞানের মত মনােবিজ্ঞানও কার্য-কারণ বাদের উপর প্রতিষ্ঠিত। কোন ঘটনাই অকারণে ঘটেনা, প্রতিটি ঘটনারই সুনির্দিষ্ট কারণ বর্তমান।
তাই মনােবিজ্ঞানী বলেন, প্রত্যেক আচরণেরই বিশিষ্ট কারণ স্বীকার্য। অনেকে হয়ত বলেন, লােকটাকে এমনিই খারাপ লাগে’, ‘হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ল’, ‘অকারণেই মেজাজটা খারাপ লাগছে, ইত্যাদি। যেন এ-জাতীয় মানসিক ঘটনার কোন সুনির্দিষ্ট কারণ নেই। কিন্তু মনােবিজ্ঞানী তা অস্বীকার করেন। কোন মানসিক ঘটনা আপাতদৃষ্টিতে যত মনােবিজ্ঞানের স্বরূপ, বিষয়বস্তু ও পদ্ধতি তুচ্ছ, অর্থহীন বা
অবান্তর মনে হােক না কেন, মনােবিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে তার নির্দিষ্ট কারণ থাকতে বাধ্য এবং অনুসন্ধানের সাহায্যে কারণটি সনাক্ত করাও সম্ভব। এই দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করেই মনঃ-সমীক্ষণ (TPsychoanalysis) নামের একটি আধুনিক সম্প্রদায়ের মনােবিজ্ঞানীরা দৈনন্দিন ভুলচুকের মত তুচ্ছ ও আপাত অকারণ আচরণেরও সুনির্দিষ্ট কারণ আবিষ্কারের দাবি করেন।
২। মনােবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু (The subjeet-matter of Psycho logy) আধুনিক মনােবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন সম্প্রদায়ে বিভক্ত ; সম্প্রদায়গুলির মধ্যে মনােবিজ্ঞানের স্বরূপ, পদ্ধতি প্রভৃতি নানা মৌলিক প্রসঙ্গে মতভেদ আছে। অতএব, মনােবিজ্ঞানের বিষৰ স্তু সংক্রান্ত কোন সর্বদসম্মত মত প্রত্যাশা করা যায় ।
তবুও, আধুনিক মনােবিজ্ঞানীদের মধ্যে একটি বড় অংশ মনােবিজ্ঞানকে আচরণ সংক্রান্ত বিজ্ঞান বলে গ্রহণ করতে চান। আচৰণ বলতে কী বােঝায় ? সংক্ষেপে, ব্যক্তি ও তার পারিপার্ষিকের মধ্যে পারস্পরিক আদানপ্রদান বা পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াকে আচরণ বলা হয়।
একটি দৃষ্টান্ত দেখা যাক :
সামনে একটা সাপ দেখলাম—অর্থাৎ, প্রাকৃতিক পরিবেশ আমাকে এভাবে প্রভাবিত করল : প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে এক প্রকার আলােক-তরঙ্গ আমার চোখে এলে, ফলে আমার চোখ ও মস্তিষ্কের মধ্যে একরকম পরিবর্তণ ঘটল এবং আমার অভ্যন্তরে দেখা’ বা ‘জানা বলে এক অবস্থার সৃষ্টি হল। আভ্যন্তরীণ অবস্থাটিকে আমরা মানসিক আখ্যা দিই। কিন্তু শুধু ‘জানা বলে মানসিক অবস্থা নয়। সাপ দেখে আমি ভয় পেলাম ; অর্থাৎ সাপ সংক্রান্ত জ্ঞান আমার মধ্যে আরো একরকম আভ্যন্তরীণ পরিবর্তণ ঘটালো, তাকে বলা হয় অনুভূতি।
এই অঞ্চভূতির ফলে আবার আরো একরকম আভ্যন্তরীণ পরিবর্তণ ঘটল ; অর্থাৎ আমার কর্মপ্রবৃত্তি জাগলো— আমি একটা লাঠি এনে সাপটা মেরে ফেললাম। অতএব, আমার পারিপার্শ্বিক পৃথিবীতেও আমি এক ধরণের পরিবর্তন আনলাম : পারিপার্শ্বিক পৃথিবী আমাকে একভাবে প্রভাবিত করেছিল, প্রত্যুত্তরে আমিও পারিপার্শ্বিক পৃথিবীকে একভাবে প্রভাবিত করলাম। অনেকের মতে মনোবিজ্ঞানের আলােচ্য বিষয় বলতে প্রধানত ঐ আভ্যন্তরীণ ঘটনাবলীই, যেগুলিকে সাধারণত মানসিক আখ্যা দেওয়া হয়।
এ-জাতীয় ঘটনাবলীকে প্রধানত তিনটি ভাগে ভাগ করার প্রথা আছে ; চিন্তন (Thinkirg), | অনুভূতি ( Fooling) ও সংকল্প (willing)। কিন্তু এই আভ্যন্তরীণ বা মানসিক ঘটনাবলী সংক্রান্ত প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা সম্ভব নয়। অপরপক্ষে, পারিপার্শ্বিক জগৎ
মনোবিজ্ঞান
আমাদের কীভাবে প্রভাবিত করে এবং প্রত্যুত্তরে আমরা পারিপার্শ্বিক জগৎকে কীভাবে প্রভাবিত করি শুধুমাত্র সেটুকুরই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা সম্ভব। এই পারস্পরিক প্রভাবকে আচরণ বলে। আধুনিক মনােবিজ্ঞানীরা অনেকেই বলবেন, এই আচরণই মনােবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু এবং এই আচরণকে অবলম্বন করেই উক্ত আভ্যন্তরীণ অবস্থাগুলি অনুমিত হতে পারে। যথা, উপরােক্ত দৃষ্টান্তে আমার জ্ঞান, ভয় প্রভৃতি আভ্যন্তরীণ অবস্থাগুলি সম্বন্ধে মনােবিজ্ঞানীর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা সম্ভব নয়।
তার পরিবর্তে সাপ দেখে আমি চিৎকার করেছি, দৌড়ে গিয়ে লাঠি এনে সাপটা মেরে ফেলেছি—শুধুমাত্র এ-জাতীয় আচরণগুলি সম্বন্ধেই তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ঘটে। তাই মনােবিজ্ঞানকে অভিজ্ঞতামূলক অন্যান্য বিজ্ঞানের সমগােত্রীয় একটি বিজ্ঞানে পরিণত করতে হলে এ-জাতীয় আচরণকেই তার বিষয়বস্তু বল। বাঞ্ছনীয় ।
কিন্তু শুধুমাত্র আচরণ সংক্রান্ত বিজ্ঞান বললেই মনােবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু সম্পূর্ণভাবে ব্যক্ত হয়না। কারণ, আচরণ সংক্রান্ত বিজ্ঞান বলতে মনােবিজ্ঞান ছাড়াও আরাে দুটি বিজ্ঞান বর্তমান। একটি হল শরীরবিজ্ঞান (Physiology) এবং অপরটি হল সমাজবিজ্ঞান (Sociology)। অতএব, মনােবিজ্ঞানের বৈশিষ্ট্য বােঝবার জন্য এই দুটি বিজ্ঞানের সঙ্গে তার সম্পর্ক ও পার্থক্য বােঝা দরকার।
আমাদের সমস্ত আচরণ একাধারে শারীরিক প্রক্রিয়াও। সামনে সাপ দেখলাম— পারিপাশ্বিক জগৎ আমাকে একভাবে প্রভাবিত করল, আমি সাপের অস্তিত্ব জানলাম। কিন্তু তার জন্য চোখ বলে শরীরের অঙ্গটির এবং স্নায়ুতন্ত্রের—বিশেষত মস্তিষ্কের–প্রক্রিয়া প্রয়োজন। শরীরের এই অঙ্গগুলির প্রক্রিয়া ছাড়া পারিপার্শ্বিক জগৎ আমাকে প্রভাবিত করতে পারতাে না, আমার অভ্যন্তরে চিন্তন নামের মানসিক অবস্থা ঘটত না। তেমনি, আমরা পরে দেখবাে, সাধারণত যে-আভ্যন্তরীণ ঘটনাকে ভয় নামের অনুভূতি বলা হয় তার জন্য শরীরের স্বতঃক্রিয় স্নায়ুতন্ত্রের {Autonomic Nervous system) এবং কয়েকটি গ্রন্থির (Gla}}d) প্রক্রিয়া। প্রয়ােজন।
চিংকারের ক্ষেত্রে শরীরের স্বরযন্ত্র সক্রিয় ; দৌড়ে যাওয়া, লাঠি আনা প্রভৃতির ক্ষেত্রে শরীরের পেশী গুলি সক্রিয়। এইভাবে যে-কোন আচরণের মুলেই কতকগুলি শারীরিক প্রক্রিয়া বর্তমান। এবং শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কীভাবে কাজ করে তার আলােচনা শরীরবিজ্ঞানে। অর্থাৎ, শরীরবিজ্ঞানী দেহের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ক্রিয়া বিচার করেন ; দেখবার সময় চোখের মধ্যে কী ঘটে, কথা বলার সময় স্বরযন্ত্রে কী ঘটে, কীভাবে কাজ করে শরীরের বিভিন্ন পেশী, ইত্যাদি, এবং এই সমস্ত অঙ্গের ক্রিয়া কীভাবে স্নায়ুতন্ত্রের সাহায্যে সুসংবদ্ধ সমগ্রতায়
মনোবিজ্ঞানের স্বরূপ, বিষয়বস্তু ও পদ্ধতি।
পরিণত হয়,তারই আলােচনা শরীরবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু। অতএব, শরীরবিজ্ঞান ছাড়া মনােবিজ্ঞান সম্ভব নয় ; মনােবিজ্ঞান শরীরবিজ্ঞানের উপর একান্তভাবে নির্ভরশীল। |
কিন্তু প্রশ্ন ওঠে, মনবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু বলতে যদি আচরণ বােঝায় এবং আচরণ যদি প্রধানত শরীরেরই বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ক্রিয়া হয় তাহলে শরীরবিজ্ঞান ছাড়াও মনােবিজ্ঞান বলে একটি স্বতন্ত্র বিজ্ঞানের সুযোেগ কোথায় ? উত্তরে বলা হয়, আচরণ সংক্রান্ত আমরা যা জানতে চাই তা শুধুমাত্র শরীরবিজ্ঞান থেকেই জানা সম্ভব নয়।
কেননা, একটি মানুষ বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের যােগফলমাত্র নয় ; পক্ষান্তরে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিশিষ্ট মানুষটির এক সামগ্রিক ব্যক্তিসত্তাও বর্তমান। সেই ব্যক্তি মানুষটি, উডওয়ার্থ (Wood vorth) যেমন বলছেন, ভালবাসে বা ঘৃণা করে, সাফল্য অর্জন করে বা অকৃতকার্য হয়। তাকে সম্পাদন করতে হয় দায়িত্ব, সমাধান করতে হয় সমস্যা। আশপাশের অন্যান্য মানুষের সঙ্গে সে মানিয়ে চলতে পারে, বা হয়ত পারে না। পারিপার্শ্বিক জগতের সঙ্গে এই মানুষটি এক বিচিত্র ও জটিল সম্পর্কজালে জড়িত। অবশ্যই তার দেহের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের প্রক্রিয়া বাদ দিয়ে এই সম্পর্কজালটি বােঝা সম্ভব নয়।
কিন্তু অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলির প্রক্রিয়া জানলেই পুরাে মানুষটির—ব্যক্তিটির–সম্পূর্ণ পৰিচয় পাওয়া যায় না। সে-পরিচযের জন্য শরীর বিজ্ঞান ছাড়াও মনােবিজ্ঞানের প্রয়ােজন।
আবার, কোন মানুষই পৃথিবীতে একা-একা বঁাচে না। বাঁচবার জন্য আদিম যুগ থেকেই মানুষ অন্যান্য মানুষের সঙ্গে মিলিত হয়েছে, গড়েছে নানারকম সম্পর্ক। এই কারণে বলা হয়, মানুষ একান্তভাবেই সামাজিক জীব। এবং সামাজিক জীব হিসাবে তার আচরণ দলগত, ব্যক্তিগত নয়। এই দলগত আচরণই সমাজবিজ্ঞানের আলােচ্য বিষয়। | যেহেতু সামাজিক পরিপ্রেক্ষাবাদ দিয়ে কোন মানুষের আচরণ বৈজ্ঞানিকভাবে বােঝা সম্ভব নয় সেইহেতু মনোবিজ্ঞানীর পক্ষে সমাজবিজ্ঞানকেও উপেক্ষা করা অসম্ভব।
কিন্তু মনােবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের মধ্যে পার্থক্যটুকুও উপেক্ষণীয় নয়। সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টি মানব-আচরণের সমাজগত দিকটির উপরই একান্তভাবে আবদ্ধ , কিন্তু মনােবিজ্ঞানী মানব-আচরণকে বােঝবার জন্য তার সামাজিক পরিপ্ৰেক্ষাকে অগ্রাহ্য না-করলেও এই সমাজগত আচরণের উপরই একান্তভাবে দৃষ্টি আবদ্ধ রাখেন না—অর্থাৎ, তার আচরণের ব্যক্তিগত দিকটির উপরও বিশেষ গুরুত্ব আরােপণ করেন।
অতএব, সংক্ষেপে, আচরণ সংক্রান্ত বিজ্ঞান বলতে প্রধানত তিনটি :
মনােবিজ্ঞান শরীরবিজ্ঞান, মনােবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান। শরীরবিজ্ঞানে শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলির প্রক্রিয়া আলােচিত হয়, সমাজবিজ্ঞানের আলােচ্য বিষয় মানুষের সমাজগত বা সমষ্টিগত আচরণ। মনােবিজ্ঞানের বৈশিষ্ট্য এই যে একদিকে তা দৈহিক প্রক্রিয়া বলীকেও অগ্রাহ্য করেন, আবার অপরদিকে সামাজিক পটভূমি বাদ দিয়েও মানব-আচরণের ব্যাখ্যা খোজে না; কিন্তু এইভাবে শরীরবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেও মনােবিজ্ঞানী তার বিশিষ্ট বিষয়বস্তু হিসেবে অন্যান্য মানুষের সঙ্গে সম্পর্কিত পুরাে মানুষটির বা ব্যক্তিটির আচরণ বিশেষভাবে আলােচনা করেন।
আচরণ-সংক্রান্ত এই তিনটি বিজ্ঞানের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়ের উদ্দেশ্যে উড ওয়ার্থ একই দেশের তিন রকম মানচিত্র রচনার উপমা ব্যবহার করেছেন। কোন মানচিত্রে দেশটির বিভিন্ন গ্রাম ও নগরকে খুটিয়ে বর্ণনা করবার আয়ােজন,—যেমন শরীর বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলির প্রক্রিয়া খুঁটিয়ে বিচার করা হয়। কোন মানচিত্রে আবার দেশটির স্থান মূলতই এক মহাদেশের অংশ হিসেবে,যেমন সমাজ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মানুষের ব্যক্তিগত আচরণের দিক উপেক্ষা করে সমাজগত আচরণের উপরই ঐকান্তিক গুরুত্ব আরােপণ করা হয়।
এছাড়াও দেশটির একটি মাঝারি ধরণের মানচিত্র রচনা করা যায়—যে-মানচিত্রে দেশটির গ্রাম ও নগরকে খুটিয়ে বর্ণনা করবারও আয়ােজন নেই, আবার দেশটিকে শুধুমাত্র এক মহাদেশের অংশ হিসেবেও দেখাবার প্রয়াস নয়। মনােবিজ্ঞানে যেন মানব-আচরণের এই জাতীয় একটি মাঝারি ধরণের মানচিত্র রচনার প্রয়াস করা হয়। অর্থাৎ, মনােবিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে মানব-আচরণ শুধুমাত্র দেহের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের প্রক্রিয়া নয়,
তার পরিবর্তে সামগ্রিকভাবে ব্যক্তিটির আচরণই তিনি বিচার করেন ; এই ব্যক্তি অবশ্যই সামাজিক জীব, কিন্তু তবুও মনােবিজ্ঞানী তার আচরণের ব্যক্তিগত দিক উপেক্ষা করে শুধুমাত্র সমাজগত বা দলগত আচরণের উপরই দৃষ্টি আবদ্ধ রাখেন না।
৩। আচরণের ব্যাখ্যাসূত্র।
ব্যক্তি ও তার পারিপার্শ্বিক জগৎ
পারিপার্শ্বিক জগৎ এবং ব্যক্তির মধ্যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াকে আচরণ বলা হয়। এই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বলতে কী বােঝায় তা বিচার করা যাক। | মানুষ অবশ্যই তার পারিপার্শ্বিক অবস্থার উপর নানাভাবে নির্ভরশীল। পারিপার্শ্বিক অবস্থা উপযুক্ত নাহলে মানুষের পক্ষে জীবনধারণ করাই সম্ভব নয়। যেমন অসহ শীতে বা অসহ্য গরমে আমরা বাঁচতে পারিনা; পারিপার্শ্বিক পৃথিবী থেকে খাদ্য ও অক্সিজেন সংগ্রহ করতে হয় ; ইত্যাদি, ইত্যাদি।
কিন্তু পারিপার্শ্বিক মনােবিজ্ঞানের স্বরূপ, বিষয়বস্তু ও পদ্ধতি জগতের উপর নির্ভরশীল হলেও মানুষ নিষ্ক্রিয় নয় ; পারিপার্শ্বিকের প্রভাবকে সে প্রতিরােধ ও করে এবং প্রয়ােজন মতাে পারিপার্শ্বিক অবস্থাকে পরিবর্তনও করে। অর্থাৎ, একদিকে যেমন পারিপার্শ্বিক জগৎ মানুষের উপর নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করে, অপরদিকে তেমনি মানুষ নিজেও পারিপার্শ্বিক জগতের উপর প্রভাব বিস্তার করে এবং এই পারিপার্শ্বিক জগৎকে পরিবর্তিতও করে। পরিবর্তিত পারিপার্শ্বিক জগৎ আবার তার উপর নূতনভাবে প্রভাব বিস্তার করে ; ফলে মানুষও আবার নূতনভাবে পারিপাশ্বিক জগৎকে প্রভাবিত করে।
এইভাবে পরিপাশ্বিক জগতের সঙ্গে মানুষের আদানপ্রদান চলে। উড ওয়ার্থ সাংকেতিক সূত্রের সাহায্যে এই আদান প্রদানের ব্যাখ্যা দিতে চেয়েছেন। পারিপার্শ্বিক জগৎ বা World অর্থে y অক্ষর ব্যবহার করে এবং দেহ ধারী জীব হিসেবে মানুষ বা Organism অর্থে ০ অক্ষর ব্যবহার করে বলা যায়| W-0- y. এই সাংকেতিক সূত্রের সাহায্যে পারিপার্শ্বিক জগতের সঙ্গে মানুষের সক্রিয় আদানপ্রদানের সম্পর্ক নির্দিষ্ট হতে পারে। ⇒0; অর্থাৎ, পারিপার্শ্বিক জগৎ সক্রিয়ভাবে মানুষকে প্রভাবিত করে। আবার 0-9V ; অর্থাৎ, মানুষও সক্রিয় ‘ভাবে পারিপাশ্বিক জগৎকে প্রভাবিত করে। এইভাবে, w০-w-908••• …. অবিরাম পারস্পরিক প্রভাব ঘটে চলেছে। একটি দৃষ্টান্ত দেখা যাক।
রাত্রে ঘরে শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে গেল ; অর্থাৎ, পাবিপাক্ষিক জগৎ সক্রিয়ভাবে আমাকে প্রভাবিত করল। একে বলব : ১)। ফলে, উঠে পড়ে আমি আলাে জালালাম—অর্থাৎ, পারিপার্শ্বিক জগৎকে আমি প্রভাবিত করলাম। একে বলব : (0\y । আলো জ্বলতে দেখলাম, ঘরে চোর ঢুকেছে ; পারিপার্শ্বিক জগৎ আবার সক্রিয়ভবে আমাকে প্রভাবিত করল। একে বলব : 40। চোর দেখে আমি চিৎকার করে সকলের ঘুম ভাঙিয়ে দিলাম—অর্থাৎ, পারিপার্শ্বিক জগতে নতুন করে পরিবর্তন আনলাম। একে বলব : (0-w; ইত্যাদি, ইত্যাদি। এইভাবে পরপর ঘটনাবলী বিচার করে গেলে দেখা যাবে একদিকে আমার উপর পারিপার্শ্বিক জগতের প্রভাব বা w০ এবং অপরদিকে পারিপার্শ্বিক জগতের উপর আমার প্রভাব বা
গ্রাহক ও কারক (৫eeeptor and Effector): কিন্তু বহির্জগং বা পারিপার্শ্বিক পৃথিবী ব্যক্তির উপর কীভাবে প্রভাব বিস্তার করে এবং ব্যক্তিই বা কীভাবে পারিপার্শ্বিক পৃথিবীর উপর প্রভাব বিস্তার করে? কয়েকটি দৃষ্টান্ত বিচার করা যাক। চোখে দেখলাম মেঘ জমেছে, কানে শুনলাম মেঘ ডাকছে ; ইত্যাদি, মনোবিজ্ঞান ইত্যাদি। বহির্জগৎ আমার উপর প্রভাব বিস্তার করল। অর্থাৎ, w০। কিন্তু কী করে করল ? পদার্থবিজ্ঞানে জেনেছি, কোন বস্তু থেকে আলােক-তরঙ্গ আমার চোখে এলে বস্তুটি দেখতে পাই ; শব্দ-তরঙ্গ কানে এলে শুনতে পাই। আমার দেহে কয়েকটি অঙ্গ আছে যেগুলি
এইভাবে বহির্জগৎ থেকে-আসা প্রভাব গ্রহণ করে। এগুলিকে বলে গ্রাহক বা ইন্দ্রিয় (Receptors বা Sense Organs)। যথা : চোখ দিয়ে আলােক-তরঙ্গ গ্রহণ করি, কান দিয়ে শব্দ-তরঙ্গ গ্রহণ করি, ত্বক বা চামড়া দিয়ে পারিপার্শ্বিকের তাপ ইত্যাদি গ্রহণ করি, নাক ও জিভ দিয়ে গ্রহণ করি নানারকম রাসায়নিক প্রভাব। অর্থাৎ, এই গ্রাহক বা Roceptor গুলির মধ্যস্থতাতেই পারিপার্শ্বিক জগৎ আমাদের উপর প্রভাব বিস্তার করে। আবার, আমাদের দেহে কয়েকটি অঙ্গ আছে যার সাহায্যে আমরা পারিপার্শ্বিক জগতের উপর প্রভাব বিস্তার করি। এগুলিকে বলা হয় কারক বা Effector। কারক বলতে প্রধানতই নানাপ্রকার পেশী : হাত-পা পরিচালনা প্রভৃতি সমস্ত ক্রিয়া শরীরের পেশীর সাহায্যে সম্পাদিত হয় এবং এ-জাতীয় ক্রিয়ার ফলেই আমরা পারিপার্শ্বিক জগতে পরিবর্তন আনতে পারি।
কারক বা Effecto? হিসাবে অবশ্য শরীরের পেশী ছাড়াও নানা গ্রন্থি বা Glanck আছে। উদ্দীপক ও প্রতিবেদন ( stimulus and Response): বহির্জগৎ থেকে আমাদের উপর যে-প্রভাব এসে গ্রাহক বা loceptor-গুলিকে উদ্দীপিত করে সেগুলিকে বলা হয় উদ্দীপক (Stimulus)। চোখে আলাে অসে, কানে শব্দ আসে,~-এই আলাে, শব্দ প্রভৃতিকে বলা হয় উদ্দীপক। কিন্তু মনে রাখা দরকার, অধিকাংশ উদ্দীপকের উৎস বহির্জগ হলে ও আমাদের শরীরের অভ্যন্তর থেকেও নানান উদ্দীপকের উদ্ভব হতে পারে।
যেমন, ক্ষুধা-তৃষ্ণা বােধের সময় উদ্দীপক বাইরে থেকে আসে না, শরীরের অভ্যন্তর থেকেই তা পাওয়া যায়। উদ্দীপক পেলে আমরা যেন নানাভাবে সেগুলির প্রতি সাড়া দিই; অর্থাৎ, উদ্দীপকগুণিী পাবার ফলে আমরা নানাভাবে সক্রিয় হই। এই সাড়া বা সক্রিয়তাকে বলা হয় প্রতিবেদন (Response)—-অর্থাৎ, উদ্দীপক হল কারণ, প্রতিবেদন কার্য।
মনোবিজ্ঞান Free E-book এখানে
মনোবিজ্ঞান
দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, এম. এ. ( কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবর্ণপদকপ্রাপ্ত)
অধ্যাপক, সিটি কলেজ, কলিকাতা
দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, এম. এ. ( কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবর্ণপদকপ্রাপ্ত)
অধ্যাপক, সিটি কলেজ, কলিকাতা