এমিলি শেঙ্কল এর মাথায় সিঁদুর পরিয়ে সনাতনী রীতিতে বিয়ে করছিলেন

নেতাজি মাথায় সিঁদুর পরিয়ে সনাতনী রীতিতে বিয়ে করছিলেন নববধূ এমিলি শেঙ্কলকে।-সোজাসাপ্টা

নেতাজি,নববধূ এমিলি শেঙ্কল এর মাথায় সিঁদুর পরিয়ে সনাতনী রীতিতে বিয়ে করছিলেন। ১৯৩২ সালের ফেব্রুয়ারী থেকে অসহযোগ আন্দোলনের সময় গ্রেপ্তার হয়ে জেলে যাওয়ার পর থেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু।

চিকিৎসার জন্য সুভাষ বসুকে শেষমেশ ইউরোপে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার, তবে শর্ত ছিল চিকিৎসার খরচ তাঁর পরিবারকেই দিতে হবে।

অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় চিকিৎসা করানোর সময়ই সুভাষচন্দ্র ঠিক করলেন, স্বাধীনতা আন্দোলনের স্বপক্ষে ইউরোপে বসবাসরত ভারতীয় ছাত্রদের সংঘবদ্ধ করা দরকার।

এক ইউরোপীয় প্রকাশক ওই সময় তাঁকে ‘দা ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল’ নামে একটা বই লেখার কাজ দেন। বইটি লেখার জন্য একজন সহকারীর প্রয়োজন হল, যিনি ইংরেজী আর টাইপিং – দুটোই ভালমতো জানবেন। সুভাষ চন্দ্রের বন্ধু ড. মাথুর দুজনের নাম সুপারিশ করে পাঠালেন। তার মধ্যে ২৩ বছর বয়সী এমিলি শেঙ্কল এসেছিলেন ইন্টারভিউ দিতে।

সুন্দরী অস্ট্রিয়ান ওই যুবতীকেই সহকারী হিসাবে কাজে নিয়োগ করলেন সুভাষ চন্দ্র বসু। এমিলির সঙ্গে সাক্ষাতের পরেই সুভাষ চন্দ্র বসুর জীবনে একটা নাটকীয় পরিবর্তন এসেছিল। তখন উনার ৩৭ বছর বয়স, জীবনে প্রেম বা বিয়ের প্রস্তাব কম পাননি তিনি কিন্তু সেসবে তাঁর কোনও আগ্রহই ছিল না।

How Did Subhas Chandra Bose Met ( Wife ) Emilie Schenkl Daughter Anita Bose  Pfaff Tells The Story - YouTube

তাঁর ধ্যান-জ্ঞান সবই ছিল কী করে ইংরেজদের কাছ থেকে ভারতকে স্বাধীন করা যায় তার ওপর। কিন্তু এমিলি উনার জীবনে আসার পর দৃশ্যপট পাল্টে যায়। প্রেমের আভাসটা মূলতঃ সুভাষ চন্দ্র বসুর দিক থেকেই এসেছিল। ধীরে ধীরে সেটা একটা রোমান্টিক সম্পর্কের দিকে মোড় নেয়।

১৯৩৪-এর মাঝামাঝি সময় থেকে পরের বছর দুয়েক অস্ট্রিয়া আর চেকোস্লাভাকিয়াতে থাকার সময়ে সম্পর্কটা আরও মধুর হয়ে উঠেছিল। সুভাষ এবং এমিলি দুজনে শুরুতেই মেনে নিয়েছিলেন যে তাঁদের সম্পর্কটা আর পাঁচটি সম্পর্কের মতো হবে না। সেখানে নানা অসুবিধা আসবে।

একে অন্যকে যেসব চিঠিতে বহুবার লিখেছিলেন, সেগুলিতে সম্বোধন করার ধরণ দেখেই এর প্রমাণ পাওয়া যায়। এমিলি সম্বোধন করতেন ‘মিস্টার বোস’ বলে, আর সুভাষ চন্দ্র লিখতেন মিস শেঙ্কল বা পার্ল শেঙ্কল। সুভাষচন্দ্র এমিলির জন্য কতটা চিন্তা করতেন, তার প্রমাণ একটা চিঠিতে পাওয়া যায়, যেটাকে সুভাষ চন্দ্রের প্রেমপত্রও বলা যেতে পারে।

চিঠিটা ছিল এরকমঃ-
“মাই ডার্লিং, কখনও সখনও হিমবাহও গলে যায়। আমার মনে এখন অনেকটা সেরকমই অবস্থা। আমি যে তোমায় কতটা ভালবাসি সেটা জানাতে এই চিঠিটা লেখা থেকে নিজেকে সম্বরণ করতে পারলাম না। ‘মাই ডার্লিং’, আমাদের নিজেদের মতো করে কী বলতে পারি, যে তুমি আমার হৃদয়ের রাণী?

আমি জানি না ভবিষ্যতে কী হবে। হতে পারে, পুরো জীবনটাই হয়তো জেলে কাটাতে হবে, অথবা আমাকে গুলি করে দেওয়া হতে পারে, কিংবা ফাঁসীও হতে পারে। এও সম্ভব যে তুমি হয়তো আমাকে কখনও আর দেখতেই পাবে না, অথবা আমি হয়তো কখনও তোমাকে চিঠিও লিখতে পারব না।

কিন্তু ভরসা রেখ, তুমি চিরকাল আমার হৃদয়ে থাকবে, আমার মনে, আমার স্বপ্নে থাকবে। যদি এই জীবনে সম্ভব না হয়, তাহলে পরের জীবনে তোমার সঙ্গেই থাকব আমি। আমি তোমার অন্তরে থাকা নারীত্বকে ভালবাসি, তোমার আত্মার সঙ্গে আমার প্রেম। তুমিই আমার জীবনে প্রথম প্রেম।”

 সুভাষচন্দ্র বসুর স্ত্রী এমিলি শেঙ্কল
সুভাষচন্দ্র বসুর স্ত্রী এমিলি শেঙ্কল

১৯৩৭ সালের ২৬ ডিসেম্বর তাঁদের বিয়ে হয়েছিল অস্ট্রিয়ার বাদগাস্তিনে। তবে দুজনেই নিজেদের বিয়ের ব্যাপারটা গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ভারতীয় নববধূর মতো বিয়ের সময়ে সনাতনী রীতিতে এমিলির মাথায় সিঁদুর পড়ানো হয়েছিল।

১৯৩৪ থেকে ১৯৪৫ – এই প্রায় ১২ বছর সময়কালে দুজনে বছর চারেকেরও কম সময় একসঙ্গে কাটাতে পেরেছিলেন। কিন্তু তার মধ্যেই দুজনের প্রেমের চিহ্ন হিসাবে ১৯৪২ সালের ২৯ নভেম্বর জন্ম নেয় তাঁদের কন্যা অনিতা বসু। মেয়েকে দেখার জন্য ১৯৪২ এর ডিসেম্বরে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় গিয়েছিলেন সুভাষ চন্দ্র।

তারপরেই বড়ভাই শরৎ চন্দ্রকে বাংলায় লেখা একটি চিঠিতে সুভাষ চন্দ্র বসু উনার বিয়ে, স্ত্রী আর কন্যার ব্যাপারে বিস্তারিত জানিয়েছিলেন। এর আগ পর্যন্ত প্রেম ভালোবাসা আর বিয়ের বিষয়টি সম্পূর্ণ গোপন ছিল।

১৯৪৫ সালে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর অন্তর্ধানের পর স্ত্রী এমিলি এবং কন্যা অনিতা আর কখনো উনার সান্নিধ্যে পাননি। ১৯৪৫ সালের পর বিমান দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু হয় বলে ভারত সরকারের কয়েকটি তদন্ত কমিশনের রিপোর্টে উল্লেখ থাকলেও ১৯৮৪ সালেও ভারতে তাঁর জীবিত থাকার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে বলে বহু রাজনৈতিক বিশ্লেষণ থেকে জানা যায়।

বিভিন্ন নামে ছদ্দবেশে তিনি ভারতের বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপনে ছিলেন বলে অনেকের মত। সর্বশেষ গুমনামি বাবা ও ভগবানজী নামে আত্মগোপনে ছিলেন বলেও জানা গেছে। উল্লেখ্য, ব্রিটিশ ভাগাও আন্দোলনে সুভাষ চন্দ্র বসু ছিলেন মহাত্মাগান্ধীর বিপরীত মতাদর্শি।

তিনি মনে করতেন গান্ধীজির অহিংসার নীতি ভারতের স্বাধীনতা আনার ক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়। এই কারণে তিনি সশস্ত্র বিদ্রোহের পক্ষপাতী ছিলেন। একারণে ভারতের কংগ্রেস সরকার তাকে মন থেকে কখনো ভালো চোখে দেখেনি।

স্ত্রী এমিলি অবশ্য সুভাষের স্মৃতি নিয়ে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। একটা ছোট টেলিগ্রাফ অফিসে চাকরী করে সুভাষ চন্দ্রের শেষ স্মৃতি – নিজের মেয়ে অনিতাকে বড় করেছেন – জার্মানীর প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ বানিয়েছেন।

১৮৯৭ সালের আজকের এই দিনে তিনি পৃথিবীতে এসেছিলেন। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর ১২৫ তম জন্মদিনে জানাই শত সহস্র ভালোবাসা আর বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।।

 

লেখক-নিলয় চক্রবর্তী,
সমাজকর্মী ও ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক।
২৩শে জানুয়ারি ২০২১ ইং।।

আরো পড়ুন….