মহিলা পুরোহিত

নারী পুরোহিত: নারী স্বাধীনতার এ এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত নয় কি?

নারী পুরোহিত: নারী স্বাধীনতার এ এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত নয় কি? পূজারী বা অর্চক হলেন হিন্দু মন্দিরের ধর্মযাজক। শব্দটি সংস্কৃত পূজা শব্দ থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ উপাসনা করা।  পূজারীগণ পূজা, আরতি, মূর্তির যত্ন নেওয়া সহ মন্দিরের নিত্যকর্মসমূহ সম্পাদন করেন। সাধারণত পুরুষরাই  পূজারী হয়ে থাকেন। তাবে শাস্ত্র অনুযায়ী নারী বা পুরুষ যে কেউ পূজারী হতে পারেন।

এই দেশে কেবলমাত্র সর্ব সাধারণের জন্য মন্দিরগুলি পুরুষদের দ্বারা দেখাশোনা করা হয়, কারণ তারা জনসাধারণকে সহজে পরিচালনা করতে পারে। তবে এমন নয় নারীরা মন্দিরে পূজারী বা পুরোহিত হতে পাবেনা।

 

হিন্দু এমন কোনও বাড়ি নাই, যেখানে কোন ছোট মন্দির নাই। তবে সেখানে মহিলারা সব সময় পূজা দিয়ে থাকে। সুতরাং সেই অর্থে, বেশিরভাগ মন্দির পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজটি পুরুষদের চেয়ে মহিলাদের সংখ্যা বেশি এখনও রয়েছে।

মন্দিরের পূজা বা যত্ন কে নেবে সে প্রশ্ন শ্রেষ্ঠত্ব বা হীনমন্যতার নয়, এটি উপযুক্ততার প্রশ্ন। বিভিন্ন ধরণের কাজের জন্য, বিভিন্ন ধরণের লোক উপযুক্ত। তদনুসারে, সেই কাজটি সম্পন্ন হয়। 

এটি লিঙ্গের বিষয় নয়, এটি মানের বিষয়। কিছু বৈশিষ্ট্য মহিলাদের মধ্যে হয়ে থাকে। আবার কিছু অন্যান্য বৈশিষ্ট্য পুরুষদের মধ্যে আরও সহজে পাওয়া যায়। তবে এর কোনও নির্দিষ্ট অনুপাত নেই। 

 

কিছু মহিলা এই ধরনের কাজে পারদর্শী হতে পারে, যা সাধারণত কোনও পুরুষ ভাল করতে পারে না। আবার কিছু পুরুষ এ জাতীয় কাজে খুব পারদর্শী হন যা সাধারণত মহিলারা ভাল পারে না।

বেদের নারী লেখক

বৈদিক গ্রন্থে নির্দিষ্ট কিছু নারী ঋষি কথা উল্লেখ করা হয়েছে। একজন নারী ঋষি হওয়ার অর্থ তিনি বৈদিক মন্ত্রগুলির চর্চা করতেন।

লোপামুদ্রা, অপালা, ঘোষা, মান্ধাত্রি, শাশ্বতী,গোধা, অগস্ত্যের মনির বোন, ভাসুক্রের স্ত্রী,  তিনারা ছিলেন বেদে নারী ঋষি।

ঘোষাকে ঋক বেদের (1.117.7, 10.40.5, 10.39.3.6) মন্ত্রগুলি রচনা করেন। ঘোষা ছিলেন রাজা কর্ম্মীবতের কন্যা। অপ্পালা ও বিশ্ববারা আত্রিয়া রাজবংশের অন্তর্ভুক্ত। ঋক পঞ্চম আচ্ছাদনে আট্রিয়া ঋষিদের মন্ত্র রয়েছে। তাঁদের মধ্যে অপালা ও বিশ্বরও মন্ত্র রয়েছে। এর মধ্যে কিছু নারী  ঋষি পুরো পুরো সুক্ত (সংখ্যাগরিষ্ঠ মন্ত্রের একটি অধ্যায়) রচনা করেছিলেন।

নারী পুরোহিত:

বছর কয়েক আগে দু’জন হিন্দু বিধবাকে ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের একটা মন্দিরে পুরোহিত হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছিল৷

দু’জন নারী পুরোহিতের নাম ছিল – লক্ষ্মী আর ইন্দিরা৷ পুরোহিত হওয়ার জন্য তাঁদের প্রায় চার মাস প্রশিক্ষণ নিতে হয়েছিল৷ ভারতীয় সমাজের প্রেক্ষাপটে এই দুই নারীকে পুরোহিত হিসেবে নিয়োগ।

তবে এখন শুধু মন্দিরে নয়, পারিবারিক ক্রিয়াকর্মের জন্যও ডাক পড়ছে নারী পুরোহিতের৷ তাদের মধ্যে কয় এক জনের সম্পর্ক আসুন জানি।

পুণে শহরে একটি শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে ডাক পড়েছিল পুরোহিত বর্ষা গাডগিলের৷ পরনে সাধারণ শাড়ি-ব্লাউজ হলে কী হবে, কণ্ঠ দৃঢ়, সংস্কৃতের উচ্চারণও চমৎকার৷ বর্ষার কথায়, ‘‘হাজার বছরের ঐতিহ্য, পরম্পরাকে ভেঙে এ পেশায় আসাটা সহজ ছিল না৷

অনেকে তো মনে করেন মেয়েরা নাকি এত কঠিন কঠিন সংস্কৃত শ্লোক, মন্ত্র ইত্যাদি মুখস্থ করে ঠিকমতো উচ্চারণই করতে পারবে না৷”

পুণে শহরে একটি শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে নারী পুরোহিত বর্ষা গাডগিলের৷
পুণে শহরে একটি শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে নারী পুরোহিত বর্ষা গাডগিলের৷

অবশ্য শুধু বর্ষা গাডগিল নয়, পুণেতে এমন আরো কয়েকজন মহিলা পুরোহিত হিসেবে কাজ করছেন৷ অর্থাৎ খালি গা, গলায় গামছা আর ধুতি পরা পুরুত ঠাকুরের জায়গায় একেবারে শাড়ি পরা পুরোহিত – নারী স্বাধীনতার এ এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত।

নন্দনি ভৌমিক

নন্দনী ভৌমিক হলেন প্রথম নারী পুরোহিত । বিহারের মধুবানিতে একটি অহল্যা মন্দির রয়েছে যেখানে নারী পুরোহিতরা পূজা করেন। অন্যান্য অনেক জায়গায় আপনি মহিলা পুরোহিতদের খুঁজে পাবেন।

তবে সাধারণত আপনি মহিলারা পুরোহিতদের বিয়েতে পড়াতে দেখবেনা। সেই কারণে নন্দনি ভৌমিক খবরের শিরোনামে ছিলেন। নন্দিনী পেশায় সংস্কৃত অধ্যাপক ও নাট্য শিল্পীও। 

নন্দনী ভৌমিক, বাংলার প্রথম মহিলা পুরোহিত
নন্দনী ভৌমিক, বাংলার প্রথম মহিলা পুরোহিত

তিনি তার কাজ দিয়ে সমাজের পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন। তিনি বাংলার প্রথম মহিলা পুরোহিত। তিনি সংস্কৃত মন্ত্রগুলি এবং শ্লোকগুলি বাংলা এবং ইংরেজী ভাষায় পড়েন যাতে বর ও কনে এই শ্লোকগুলি বুঝতে পারে।

চন্দ ব্যাস ব্রিটেনের প্রথম নারী হিন্দু পুরোহিত

আফ্রিকা-বংশোদ্ভূত চন্দ ব্যাস প্রায় এক দশক আগে ব্রিটেনের প্রথম নারী হিন্দু পুরোহিতের খেতাব পেয়েছিলেন। এর পরে দিন দিন তার জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। তার জনপ্রিয়তা হ’ল বিয়ে পড়ানোর জন্য তিনি ২০২২ সালের অবদি বুকিং নিয়েছেন।

 

চন্দ ব্যাস ব্রিটেনের প্রথম নারী হিন্দু পুরোহিত
চন্দ ব্যাস ব্রিটেনের প্রথম নারী হিন্দু পুরোহিত

এখন চন্দ ব্যাস এখন একটি কমিউনিটি হলের সন্ধান করছেন। এই হলটিতে মহিলা পুরোহিতদের ইংল্যান্ডের অভ্যন্তরে হিন্দু ধর্মীয় রীতি অনুসরণ করার প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এর মধ্যে জন্ম, বিবাহ এবং মরণোত্তর অনুষ্ঠান অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। 

চন্দা ব্যাস আমেরিকা, ইউরোপ, কানাডা, ব্রিটেন এবং আফ্রিকাতে 2 হাজার ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন।

চান্দ ব্যাস পুরোহিতের
চান্দ ব্যাস নারী পুরোহিত

চন্ডার দাদা বল্জীভাই পুরোহিত এবং বাবা করুণাশঙ্কর পুরোহিত 10 বছর আগে ব্রিটেনে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন শুরু করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘হিন্দুত্ব নারী বা পুরুষের আলাদা করার কথা বলে না। আমার বাবা আমার পরামর্শদাতা।

 

২০২০ সালের ৩০ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সনাতন ধর্মালম্বীদের স্বরস্বতী পূজা। বাংলাদেশে সব এলকার মতন এদিন বিদ্যাদেবীর আরাধনায় নিমগ্ন হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দু ধর্মালম্বী শিক্ষার্থীরা। প্রতিবারের মতো এবারও প্রতিটি বিভাগের আয়োজনে স্বরস্বতী পূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সব বিভাগকে ছাড়িয়ে অন্যরকম এক ইতিহাস গড়েছিল সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগ।

'নারী পুরোহিত' হয়ে আলোচনায় ঢাবি ছাত্রী তমা
‘নারী পুরোহিত’ হয়ে আলোচনায় ঢাবি ছাত্রী তমা

সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের স্বরস্বতী পূজায় পৌরহিত্য করেছেন একজন মেয়ে। নাম তমা অধিকারী। তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন।  তার পর থেকেই এই খবরটি সোশ্যাল সাইটে রীতিমতো আলোচনার সৃষ্টি করেছিল।

তমা অধিকারীর এই সাহসী পদক্ষেপকে সাধুবাদ জানিয়েছিল প্রগতিশীল সনাতন ধর্মালম্বীরা। তারা বলছিলেন, ‘এভাবেই সমাজ  সত্য এবং সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে’।

লেখক- সুমন বন্দ্যোপাধ্যায়- বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়।

আরো পড়ুন…..