প্রাচীন মন্দিন: বাংলাদেশের প্রাচীন এই মন্দিনগুলো আজও সনাতনী সভ্যতার স্বাক্ষর বহন করে চলেছে। বাংলাদেশের প্রাচীনতম মন্দিরগুলি এর গৌরবময় ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অনন্য স্বাক্ষর বহন করে চলেছে।
কয়েক দশক আগে, এই মন্দিরের আঙ্গিনা প্রাচীন সাধুদের ধ্যানে নিমগ্ন হওয়ার জন্য ব্যবহৃত হত, যা প্রাচীন বৈদিক সভ্যতার ঐতিহ্য এবং জীবনধারার ছাপ বহন করত। আজ হয় তো সেটা নেই তবে আজও মন্দিরগুলো দাড়িয়ে আছে তার আপনা মহিমায়।
সারা বিশ্বে, প্রাচীনতম মন্দিরগুলি তাদের অসাধারণ স্থাপত্য শৈলী, ঐতিহ্যগত তাৎপর্য এবং ইতিহাসের জন্য সবচেয়ে অনন্য পর্যটক আকর্ষণ হয়ে উঠেছে। আমাদের দেশের মন্দিরও এর ব্যতিক্রম নয়। স্থাপত্য বৈচিত্র্য এবং ঐতিহাসিক বিশেষত্ব এই স্মৃতিস্তম্ভগুলিকে অনন্য করে তুলেছে।
প্রাচীন মন্দিন ঢাকেশ্বরী মন্দির
বাংলাদেশের প্রাচীন মন্দির
এটি বাংলাদেশের প্রাচীনতম মন্দিরগুলির মধ্যে একটি। বলা হয় এটির নাম “ঢাকার ঈশ্বরী” শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ ঢাকা দেবী (যিনি রক্ষা করেন)। ঢাকার ঐতিহ্যবাহী শ্রী শ্রী ঢাকেশ্বরী মন্দিরটি 1200 খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে রাজা বল্লাল সেন দ্বারা নির্মিত হয়েছিল।
কালক্রমে এই মন্দিরটি ঢাকার জাতীয় মন্দির হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরটি স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানার পূর্ব দিকে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের দক্ষিণ-পশ্চিমে 10 অরফানেজ রোড, লালবাগ, ঢাকা – 1211-এ অবস্থিত।
বর্তমানে ঢাকেশ্বরী মন্দির বাংলাদেশের শারদীয় উৎসবের প্রধান কেন্দ্র। শারদীয় উৎসবের ৫দিন হাজার হাজার দর্শনার্থীর ভিড় থাকে মন্দির প্রাঙ্গণ। ঢাকেশ্বরী মন্দির বেশ কয়েকটি মন্দির এবং স্মৃতিস্তম্ভের একটি সংগ্রহ এবং এটি দুটি ভাগে বিভক্ত।
পূর্ব দিকে অভ্যন্তরীণ পথ এবং পশ্চিমে বাইরের পথ। ভিতরের পথে রয়েছে মূল মন্দির, নাটমন্দির। আর বাইরের পথে রয়েছে কয়েকটি মন্দির, একটি হোটেল এবং বেশ কয়েকটি বাড়ি। মন্দিরের পশ্চিম পাশে একটি প্রাচীন হ্রদ রয়েছে। লেকের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে একটি প্রাচীন বটগাছ রয়েছে। সেই লেকের পাশেই রয়েছে কয়েকটি সমাধি।
লেকের উত্তর-পূর্ব কোণে পরপর চারটি ছোট মন্দির রয়েছে। ঢাকেশ্বরী মন্দিরে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য একটি পাঠাগারও রয়েছে। এটি মন্দিরের প্রশাসনিক ভবনের ২য় তলায় অবস্থিত। অন্যান্য লাইব্রেরির মতো বসার ব্যবস্থা থাকলেও মন্দিরে আসা দর্শনার্থী বা অতিথিদের জন্য নয়।
আগেই বলা হয়েছে, হিন্দুদের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপূজা প্রতি বছর আড়ম্বর সহকারে অনুষ্ঠিত হয়। এই মন্দিরে প্রতিদিন প্রার্থনা করা হয়। প্রতি শুক্রবার মা সন্তোষীর পূজা, শনিবার শনি দেবতার পূজা, রবিবার কীর্তন হরি সেবার পূজা, সোমবার শিব পূজা, মঙ্গলবার, বুধবার ও বৃহস্পতিবার দেবী দুর্গার পূজা। এছাড়া সাপ্তাহিক পূজাও দেওয়া হয়। আর প্রতিদিন সন্ধ্যা ৭টায় আরতি (একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান) হয়।
প্রাচীন মন্দিন রমনা কালী মন্দির
একসময় মন্দিরের চূড়া ছিল ১২০ ফুট উঁচু ছিল। রমনা কালী মন্দির ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম বিখ্যাত হিন্দু মন্দির। এটি রমনা কালীবাড়ি নামেও পরিচিত। এটি 1000 বছর পুরানো বলে মনে করা হয়, এটি বাংলাদেশের প্রাচীনতম মন্দিরগুলির মধ্যে একটি। বর্তমানে এটি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বাইরের অংশে অবস্থিত।
প্রাচীন মন্দিন রমনা কালী মন্দির
কথিত আছে, প্রায় 500 বছর আগে বদ্রীনাথের যোশিমঠ থেকে গোপালগিরি নামে এক উচ্চপদস্থ সন্ন্যাসী প্রথম ঢাকায় আসেন এবং আধ্যাত্মিক ধ্যানের জন্য একটি আশ্রয়স্থল তৈরি করেন। আরও 200 বছর পরে, আসল রমনা কালী মন্দিরটি অন্য একজন মহান সাধক হরিচরণ গিরি তিনিই এই মন্দির তৈরি করেছিলেন। যদিও পরবর্তীতে ভক্তি ভক্তিমতি ও দানশীলা রানী বিলাসমণি দেবীর রাজত্বকালে এই মন্দিরের মূল সংস্কার কাজ করা হয়।
কিন্তু ১৯৭১ সালের ২৬ ও ২৭ মার্চ পবিত্র ভূমি রমনা কালী মন্দিরকে ঘিরে সংঘটিত মুক্তিযুদ্ধের মর্মান্তিক ঘটনা ইতিহাসের পাতায় চিরকাল অক্ষয় হয়ে থাকবে। তীর্থস্থানটি রাতারাতি কসাইখানায় পরিণত হয়।পাকিস্তানি সেনাবাহিনী রমনা কালী মন্দিরের অধ্যক্ষ স্বামী পরমানন্দ গিরিসহ প্রায় 100 জন নারী-পুরুষকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল।
শিশুরাও রেহাই পায়নি। এই হত্যাকাণ্ডের সময় রমনা কালী মন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রমে আগুন জ্বলছিল। রমনা কালী মন্দিরের চূড়া ছিল 120 ফুট লম্বা, যা দূর থেকে দেখা যেত যেটিও বর্বর বাহিনী ভেঙ্গে ফেলেছিল। 2006 সালে রমনা কালী মন্দির পুনর্নির্মিত হয়।
রমনা কালী মন্দিরে বর্তমানে দুর্গা মন্দির, লোকনাথ মন্দির, রাধা গোবিন্দ মন্দির এবং মা আনন্দময়ীর মন্দির সহ আরও বেশ কয়েকটি মন্দির রয়েছে। রমনা কালী মন্দিরের প্রধান পূজা হল কালী পূজা। কালী পূজার সময় পুরো মন্দিরটি সুন্দর করে সাজানো হয়।
প্রধান মূর্তি শ্রী শ্রী ভদ্রকালী মাতা বিভিন্ন অলংকারে সুশোভিত। দুর্গাপূজাও জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালিত হয়।এছাড়া এখানে সরস্বতী পূজাসহ বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব ও বার্ষিক অনুষ্ঠান হয়। ভারতের পাশাপাশি বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকেও বহু ভক্ত মন্দিরে আসেন।
প্রাচীন মন্দিন পুঠিয়া রাজবাড়ী
ইন্দো-সারাসেনিক রিভাইভাল আর্কিটেকচারে নির্মিত
পুঠিয়া মন্দির চত্বর হল বাংলাদেশের রাজশাহী পুঠিয়া মহকুমার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এবং প্রাচীনতম হিন্দু মন্দিরগুলির একটি। রাজশাহী থেকে 23 কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত, পুঠিয়ায় বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি ঐতিহাসিক মন্দির রয়েছে। এই মন্দিরগুলি হিন্দু শাসকদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যারা রাজশাহীর পুঠিয়ার বিখ্যাত রাজপরিবারের জমিদারও ছিলেন।
বাংলাদেশের প্রাচীনতম মন্দিরগুলির মধ্যে, এই পোড়ামাটির মন্দিরগুলি বাংলার পোড়ামাটির স্থাপত্যশৈলীর সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ উপস্থাপন করে। যাইহোক, এই মন্দিরগুলি অন্যান্য স্থাপত্য শৈলীকেও একত্রিত করেছে।পুঠিয়া রাজবাড়ি ইন্দো-সারাসেনিক স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত।
এই শৈলীটি ঐতিহ্যগত হিন্দু স্থাপত্য শৈলীকে রেনেসাঁ যুগের ইউরোপীয় স্থাপত্যের সাথে সংযুক্ত করে। পুঠিয়ার মন্দিরগুলি একটি বিশাল হ্রদের চারপাশে নির্মিত। মন্দিরের মাঝখানে একটি সবুজ প্রাঙ্গণও রয়েছে। রাজা পীতাম্বর ছিলেন পুঠিয়া জমিদার বংশের প্রতিষ্ঠাতা। তবে এই এলাকার প্রাচীন শাসক ছিলেন লস্করী খান।
সম্রাট আকবরের শাসনামলে লস্করী খান বিদ্রোহী হয়ে উঠলে জেনারেল মানসিংহ পীতাম্বরের হাতে শাসনভার হস্তান্তর করেন। পুঠিয়া রাজবংশ ছিল ব্রিটিশ বাংলার দ্বিতীয় বৃহত্তম জমিদারি। সম্পদের দিক থেকে তারা ছিল সবচেয়ে ধনী। ভারত স্বাধীন হলে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার জমিদারি প্রথা বাতিল করে এবং জমিদারির সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে। এরপর পুঠিয়া রাজবংশ ভারতে চলে যায়।
কান্তজি মন্দির প্রাচীন মন্দিন
আপনি যদি টেরাকোটা শিল্পকে সবচেয়ে ভালোভাবে দেখতে চান তাহলেকান্তজি মন্দিরে যান। কান্তজি মন্দির বা কান্তজিউ মন্দির বা কান্তনগর মন্দির বাংলাদেশের দিনাজপুরে অবস্থিত একটি প্রাচীন মন্দির। এই মন্দিরটি সাধারণত হিন্দু ধর্মের কান্ত বা কৃষ্ণ মন্দির নামে পরিচিত যা বাংলাদেশে রাধা-কৃষ্ণ সাথে জনপ্রিয়। সম্ভবত, মহারাজা সুমিত ধর শান্ত এখানে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
এই প্রাচীন মন্দিরটি দিনাজপুর-তেতুলিয়া মহাসড়কের পশ্চিমে ঢেপা নদীর তীরে কান্তনগর গ্রামে অবস্থিত যা দিনাজপুর থেকে 20 কিলোমিটার উত্তরে এবং কাহারোল মহকুমার সুন্দরপুর ইউনিয়নের 7 কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত।
বাংলাদেশের প্রাচীনতম মন্দিরগুলির কথা বললে, এই প্রাচীন মন্দিরটি 18 শতকের শুরুতে নির্মিত হয়েছিল।মন্দিরের উত্তরে ভিত্তি শিলালিপি অনুসারে, প্রাণনাথ রায়, যিনি তৎকালীন দিনাজপুরের মহারাজা জমিদার ছিলেন, তাঁর শেষ বছরগুলিতে মন্দিরটি নির্মাণ শুরু করেছিলেন।
1722 সালে, তাঁর শেষ ইচ্ছা অনুসারে তাঁর মৃত্যুর পর, তাঁর দত্তক পুত্র মহারাজা রামনাথ রায় 1752 সালে নির্মাণ শেষ করেন। প্রথমে মন্দিরের উচ্চতা ছিল 70 ফুট। কিন্তু 1897 সালে, একটি ভূমিকম্প এর সমস্ত চূড়া ধ্বংস যায়। যদিও মহারাজা গিরিজানাথ মন্দিরটি ব্যাপকভাবে সংস্কার করেছিলেন, কিন্তু স্পিয়ারগুলি পুনর্নির্মাণ করা হয়নি।
মন্দিরের বাইরের দেয়াল জুড়ে টেরাকোটায় রামায়ণ, মহাভারত এবং অন্যান্য ধর্মীয় কাহিনী লেখা আছে।মন্দির জুড়ে 15,000 টিরও বেশি পোড়ামাটির টাইলস রয়েছে। মন্দিরটি তিন ধাপে উপরে উঠে গেছে। আর মন্দিরের চারপাশের সব খিলান দিয়ে সব মূর্তি দেখা যায়। মন্দিরের আঙিনা আয়তাকার হলেও ৫০ ফুট পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা মন্দিরটি বর্গাকার।
নিচতলায় প্রতিটি প্রবেশপথে খোদাই করা খিলান রয়েছে। খিলান দুটি জটিল নকশা করা ইটের স্তম্ভ দ্বারা পৃথক করা হয়েছে। মন্দিরের নিচতলায় 21টি খিলান, দ্বিতীয় তলায় 27টি এবং তৃতীয় তলায় 12টি খিলানপথ রয়েছে।
এখানো বাংলাদেশের প্রাচীনতম মন্দিরগুলির আমাদের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির ডিএনএ ধারণ করে এবং বিভিন্ন স্থাপত্য শৈলীর সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ নিয়ে গর্ব করে। নিঃসন্দেহে, এই মন্দিরগুলি প্রকৌশলের একটি আশ্চর্যজনক কীর্তি যা আমাদের ইতিহাসেরই একটি অংশ। আপনি যদি প্রাচীন ইতিহাস এবং প্রত্নতত্ত্বে আগ্রহী হন তবে একটি পরিদর্শন করতে পারেন।
আর পড়ুন…..
