১৯৪৭ সালের দেশভাগ

১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় হিন্দু প্রধান যশোর খুলনা বাংলাদেশের ও মুর্শিদাবাদ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্বেও কেন ভারতের হলো?

১৯৪৭ সালের দেশভাগ: ১৯৪৭ সালের দেশভাগে হিন্দু প্রধান যশোর খুলনা বাংলাদেশে ও মুর্শিদাবাদ জেলা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্বেও কেন ভারতের হলো? ভাই আপনি গ্রামেরদিকে বাবার মৃত্যুর পর ছেলেদের সম্পত্তি ভাগ দেখেছেন? বাস্তুজমি ছোটো বলে একভাইকে দুবিঘে জমি বেশি দেওয়া হল!

খাটটা একজন নিল বলে একজনকে দুটো চৌকি দেওয়া হল! বিধবা মায়ের এক মাস করে খেতে দেওয়ার চুক্তি হল! সেইরকম কংগ্রেস আর মুসলিম লীগ নামক দুই বিবাদরত ভাই সম্পত্তি ভাগ করছে! গঙ্গা পদ্মা ভাগ হল । গঙ্গার ওপারে হিন্দু প্রধান যশোর খুলনা গেল লীগ ভাইয়ের হাতে!

মুসলমান প্রধান মালদা মুর্শিদাবাদ গেল কংগ্রেস ভাইয়ের হাতে! নদিয়ার হিন্দু প্রধান রানাঘাট মহকুমা কংগ্রেস পেল! বাকিটা লীগ ভাই!

দিনাজপুরের হিন্দু আর মুসলমান প্রধান অংশ ও তাই! কোলকাতা পেল কংগ্রেস,ঢাকা পেল লীগ! এবার বন্দর ভাগ ! কোলকাতা বন্দর কংগ্রেস পেল! তাহলে হিন্দু-বৌদ্ধ প্রধান পার্বত্য চট্টগ্রামের চট্টগ্রাম বন্দর লীগকে না দিলে কী চলে?

দুই দেশীয় রাজ্য কংগ্রেস পেল কিন্তু বাংলা শুধু কোচবিহার পেল! ত্রিপুরা বাংলার থেকে কয়েকশো মাইল দুরে চলে গেল! আহা! শুধু কী তাই?

মানুষগুলোকে ও ধর্ম অনুসারে এদিকে আর ওদিকে কুকুর ছাগলের মতো তাড়িয়ে দেওয়া হল! আমাদের পূর্ব পুরুষদের ঐ অসভ্যতার নজির মনে হয় পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল! দয়া করে আর খুঁচিয়ে ঘা করেন না ভাই!

আমি স্বাধীনতার পরের তৃতীয় প্রজন্মের মানুষ হয়েও যদি এসব কথায় আমার এত কষ্ট হয়,তাহলে ঐ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়া তৎকালীন পূর্ব বাংলার মানুষগুলোর আর “জানেন দাদা আমরা কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান ছিলাম।” বলা বাংলাদেশের মানুষগুলোর কত কষ্ট ?

বাংলাদেশের জেনেভা ক্যাম্পে বিহারিদের ৩য় প্রজন্ম এখনো ছাগলের ঘরের মতো ঘরে থাকছে গাদাগাদি করে, সুত্র বিবিসি বাংলা। পাকিস্তানে বন্দী বাঙ্গালিদের অবস্থা খবরে পড়ি একই। ভারতে এমন পরিস্থিতি রয়েছে। ৪৭ এর দেশভাগ আর ৭১ এর যুদ্ধ উপমহাদেশের কয়েক লাখ মানুষের জীবনকে নরক বানিয়ে দিয়েছে।

পূর্ব বাংলা থেকে আসা মানুষের গল্প শুনি” কারো কারো ২০০-৩০০ বিঘা জমি ছিলো” বাংলাদেশ সেগুলো ফেলে এসে ভারতে ভিক্ষা করছে তাঁদের প্রজন্ম। বাংলাদেশের তাদের অনেক জমি-জমা-জমিদারি ছেড়ে পালিয়ে এসেছে যারা  তাদের বর্তমান প্রজন্ম কি মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে না? এমন কি যারা পাকিস্তননে গিয়েছে তাদের অবস্থা একই। যে জিন্নহা ধর্মের নামে দেশে ভাগ করে ছিল তার দেশে তাকে শিয়া হওয়া আসল মুসলমান না বলে আওয়াজ তলে।

ধর্মকে সামনে রেখে কাটাকাটি-ভাগাভাগির রাজনীতি কারো জীবনেই আশির্বাদ হিসেবে আসে নি বরং সেটা এক বিশ্ব মানবতা সংকট তৈরি করেছে।

ইংরেজরা বঙ্গভঙ্গ রোধ করতে বাধ্য হওয়ার পর ই মনে হয় মনে মনে সপথ করেছিল বাঙালীদের মরণকামর দিয়ে যাবে।তার ই ফলশ্রুতি দেশ তথা বাংলা ভাগ।

আর আমার একটা চিরকালের সন্দেহ আছে যে 1945-46 এর শেষ ভোটে মুসলমানদের স্বশাসন উন্নতি এইসব ইস্যু না হয়ে বাংলাভাগ ইস্যু হলে তৎকালীন পূর্ব বঙ্গে মুসলিম লীগ এতগুলি আসন পেত কি না। এত কিছু করেও তো সীমান্ত প্রদেশে জিততে পারে নি।বাংলায় কংগ্রেসের অদূরদর্শীতার কারনে KPP কে সঙ্গে নিয়ে সরকার গড়তে হয়েছিল!

মুলল তো ঐ সময় বলা হয়েছিল ভারতে সীমানা ইছামতি হবে না মধুমতি? ইছামতি হলো বর্তমান বনগাঁর উপর দেয়ে প্রভাহিত নদী আর মধুমতি হল মাগুরা ফরিদপুর জেলা মাঝ দিয়ে প্রভাহিত নদী।

জনবিন্যাসের যে সূত্রে দেশ ভাগ হয়েছে সেই একই সূত্রে প্রদেশ এমনকি জেলারও বিভাজন হয়েছে। ১৯৪৭-এর ২০শে জুন বাঙলা এবং ১৫ই আগস্ট ভারত ভাগ হয় কোন প্রকার সীমা নির্ধারণ ছাড়াই। অত্যন্ত জটিল পরিস্থিতির মধ্যে পরবর্তী কালে র‍্যাডক্লিফ যখন ভারত ও পাকিস্তানের সীমানা নির্ধারণ করেন তখন তাতে বহু অসঙ্গতি থেকে যায়।

পূর্ব সীমান্তে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ যশোর খুলনা জেলার পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তি তার মধ্যে অন্যতম। প্রতিটি অসঙ্গতির জন্যই ভিন্ন ভিন্ন ও বহুমাত্রিক কারণ ছিল। বিচ্ছিন্ন ভাবে যশোর খুলনার আলোচনায় তাই বিষয়টির স্পষ্ট ও সঠিক ধারণা পাওয়া যাবে না। তাই পূর্ব সীমান্তের সবগুলো অসঙ্গতিকেই একসঙ্গে দেখব।

প্রথমত কাজটি অত্যন্ত তাড়াহুড়ো করে করা হয়েছে। ব্রিটিশরা যত দ্রুত সম্ভব ভারত ছেড়ে যেতে চাইছিল। ক্ষমতালিপ্সু নেহেরু ও লীগ নেতারাও আর অপেক্ষা করতে প্রস্তুত ছিলেন না। নেহেরুর নিজের কথায়, “আমরা বুড়ো হয়ে যাচ্ছিলাম, আমাদের পক্ষে আর অপেক্ষা করা সম্ভব ছিল না।” দ্বিতীয়ত যার হাতে এই দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছিল সেই র‍্যাডক্লিফ সাহেবের ভারতের সমস্যা ও ইতিহাস ভূগোল সম্পর্কে সম্যক ধারণা ছিল না। কোনও প্রকারে সীমান্ত রেখা এঁকেই দায়িত্ব শেষ করেছেন তিনি।

পূর্ব সীমান্তে সর্বাপেক্ষা বড় অসঙ্গতি ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তি। এই জেলার ৯৮.১% অধিবাসীই ছিল চাকমা জনজাতির এবং ধর্মপরিচয়ে বৌদ্ধ। মসলমানের সংখ্যা ছিল মাত্র ১.৮% যারা সমতল অঞ্চল থেকে সেখানে বসতি স্থাপন করেছিল। তথাপি বিশালায়তন এই জেলা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয় কেবল এই ছেঁদো যুক্তিতে যে চট্টগ্রামের মধ্য দিয়ে ছাড়া এখানে যাতায়াতের পথ নাই।

কেবল সাতচল্লিশই নয় এনডিএ সরকার ক্ষমতায় আসার আগে উত্তর পূর্বের সবটাই দীর্ঘকাল উপেক্ষিত ছিল অবশিষ্ট ভারতের কাছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে যাতায়াত চট্টগ্রামের মধ্য দিয়েই হত কিন্তু বিকল্প কোন পথ যে ছিল না এমনটা নয়। মিজোরামের মধ্য দিয়েও সেখানে যাতায়াত করা যেত। শুধু প্রয়োজন ছিল সেই পথ সুগম করে নেওয়া।

দেশ ভাগ হয়ে যাওয়ার পরেও দীর্ঘকাল পূর্ব পাকিস্তানের সাথে রেল সড়ক ও জলপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু ছিল। তখন আসাম ত্রিপুরা সহ পূর্ব ভারতে যাতায়াতও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্য দিয়েই চলত। সুতরাং এই সময়ের মধ্যে মিজোরামের মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজেই সুগম করে নেওয়া যেত। সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত হতো চট্টগ্রাম জেলার দক্ষিণ প্রান্তের টেকনাফ থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত সঙ্কীর্ণ একটুখানি অংশ পার্বত্য চট্টগ্রামের সাথে জুড়ে দেওয়া। সামান্য এইটুকু ব্যবস্থা নিলেই লক্ষ লক্ষ চাকমাদের জীবন নরকে পরিণত হতো না।

আর এক অবাক করার ঘটনা হল শ্রীহট্টের পাকিস্তানে চলে যাওয়া। এই জেলার পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তির জন্য লিগ ও তার দোসর যোগেন মণ্ডলের চেয়ে আসামের কংগ্রেস নেতা গোপীনাথ বরদলৈএর ভূমিকাই ছিল বেশি। আসামের সরকারী নথিতেই মুখ্যমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলৈ-এর ‘কৃতিত্ব’ হিসাবে শ্রীহট্টকে আসাম থেকে বিচ্ছিন্ন করাটাকে ফলাও করে তুলে ধরা হয়েছে।

 1947 সালের ভারত বিভাজন
1947 সালের ভারত বিভাজন

 

তৎকালীন আসামের এই জেলাটিকে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য গণভোটের দাবী করতে তিনিই লিগ নেতাদের প্ররোচনা দিয়েছিলেন। গান্ধী নেহেরু নিয়ন্ত্রিত কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে তিনিই রাজি করিয়েছিলেন শ্রীহট্টকে আসাম থেকে ছেঁটে ফেলতে। ফলে সেখানে গণভোটের সময় কংগ্রেস ভারতের পক্ষে কোন প্রচার না করে লিগকে এক প্রকার ওয়াক ওভার দিয়েছে।

ভারতের পক্ষে শ্যামাপ্রসাদ মুখপাধ্যায়ের একক প্রচেষ্টা ‘ন্যাশনাল গার্ড’ নামে লিগের সশস্ত্র গুন্ডা বাহিনীকে (চলতি কথায় এদের নাম ছিল আজরাইল বাহিনী) প্রতিহত করার পক্ষে ছিল নিতান্তই অপ্রতুল। সে ছাড়া মিঃ যোগেন মণ্ডলও সেখানে লিগের পক্ষে সম্ভব অসম্ভব সব কিছুই করেছেন। ‘বহিরাগত’ এই অজুহাতে চা বাগানের শ্রমিকদের ভোট দিতে দেওয়া হয়নি।

লিগের কারসাজিতে লক্ষাধিক হিন্দু ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হন। ২,৩৯,৬১৯ – ১,৮৪,০৪১ ভোটের ব্যবধানে শ্রীহট্টের পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তির সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। লিগ তথা যোগেনবাবুর ভূমিকা স্বাভাবিক। নেহেরুর পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করাটাও স্বাভাবিক। কংগ্রেস নেতা গোপীনাথবাবুর ভূমিকাকে অস্বাভাবিক বলাটাই যথেষ্ট নয়, রীতিমতো ভারতবিরোধী।

কিন্তু কিভাবে কি বুঝিয়ে কংগ্রেস দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে গোপীনাথবাবু মানিয়ে ফেললেন সেটা একেবারেই দুরধিগম্য। আসাম তো পরে একাধিকবার ভেঙ্গেছে। বরদলৈএর বাঙালি চুলকানিতে কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এভাবে মলম দিতেই পারতেন যে আপাতত শ্রীহট্টের ভারতে থাকা নিশ্চিত হোক পরে তা আসাম থেকে বাদ দেওয়া হবে। হয়তো তারা এটা করেও থাকবেন কিন্তু সেক্ষেত্রে বাঙালী অধ্যুষিত সমস্ত সমৃদ্ধ অঞ্চল হাতছাড়া হতে পারে বলে বরদলৈ তা মানেননি।

গোপীনাথ বরদলৈ কেন এমনটা করলেন তা বুঝতে হলে আমাদের অনেক পিছনে ফিরে যেতে হবে। প্রকৃতপক্ষে আসামের সুস্পষ্ট কোন ভৌগোলিক পরিচিতি বা অসমীয়া জাতিসত্তার কোন সুদৃঢ় ভিত্তি নাই। থাইল্যান্ড থেকে আসা অহোম জাতি ও বর্মীদের সুদীর্ঘ দখলদারী থাকলেও সাংস্কৃতিক ভাবে আসাম বাঙলারই প্রলম্বিত অংশ।

ব্রিটিশ শাসনেও আসাম তথা উত্তরপূর্ব ভারত প্রশাসনিক ভাবে দীর্ঘকাল বেঙ্গল প্রভিন্সের অধীনে ছিল। পরে যখন শিলংকে রাজধানী বা প্রশাসনিক কেন্দ্র করে পৃথক ‘চীফ কমিশনার্স প্রভিন্স’ গঠিত হয় তখন শ্রীহট্ট সহ বাঙলার কয়েকটি জেলা তাতে যুক্ত করা হয়। অনুন্নত এই অঞ্চলে অধিক রাজস্ব ও প্রশাসনের কাজে শিক্ষিত ও দক্ষ কর্মচারী পাওয়ার জন্যই বাঙলার উন্নত ও সমৃদ্ধ অঞ্চল এভাবে আসামকে দেওয়া হয়েছিল।

সে ছাড়া জনমানবহীন বিস্তীর্ণ জলজঙ্গলাকীর্ণ ভূমি থেকে সোনা ফলাতে বাঙলা থেকে বহু মানুষেরই সরকারী উদ্যোগ ও ব্যবস্থাতে আসামে বসতি স্থাপন করা হয়েছিল। ফলে আর্থিক শ্রী বৃদ্ধির সাথে সাথে মানব সম্পদেও সমৃদ্ধ হয় আসাম। শিক্ষার প্রসার ঘটে অসমীয়াভাষীদের মধ্যেও।

মান উন্নীত এই অসমীয়াভাষীরা তখন দেখল আসাম রাজ্যে বাঙ্গালীদের প্রভাব প্রতিপত্তি প্রচুর। এতে তাদের মনে বাঙালীদের প্রতি ঈর্ষা ও বিদ্বেষ জেগে ওঠে। তারা ভুলে গেল এবং বুঝতে চাইল না যে তাদের নিজেদের এবং আসামের উন্নতি এই বাঙালিদের জন্যই সম্ভব হয়েছ। তাদের মনে হল এরা বহিরাগত, ভুলে গেল যে এরা সেখানকার ভূমিপুত্র; বাঙলার বিশাল সমৃদ্ধ অঞ্চল আসামে যুক্ত হওয়ার ফলেই আজ এরা আসামের অধিবাসী হিসাবে গণ্য হয়েছন।

বাঙালিদের সংস্পর্শে ও সান্নিধ্যে অগ্রসর হওয়া অসমীয়ারা অপরাপর অসমীয়াদের খেপিয়ে তুলল বাঙালিদের বিরুদ্ধে। গোপীনাথ বরদলৈ ছিলেন এঁদের পুরোধা। বাঙলা থেকে পাওয়া সমৃদ্ধ অঞ্চল তাঁর দরকার। কিন্তু সেখানকার ভূমিপুত্ররা তাঁর কাছে অবাঞ্ছিত।

তাই পাকিস্তানের নামে ভারতভূমি বিচ্ছিন্ন হওয়ার উপক্রম হতেই একটা সুযোগ দেখতে পেয়ে তিনি বাঙলা থেকে পাওয়া অন্য জেলাগুলোকে রেখে শুধু শ্রীহট্টকে ছেঁটে ফেলার পরিকল্পনা বা ষড়যন্ত্র করলেন। বরদলৈএর অফার পেয়ে মূষলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ না হলেও আজরাইল বাহিনী ও যোগেন মণ্ডলের সাহায্যে শ্রীহট্টকে ছিনিয়ে নেওয়া সম্ভব দেখে লীগও দাবী জানাল পাকিস্তানভুক্তির প্রশ্নে সেখানে গণভোট নেওয়ার।

নোংরামি ও নীচতায় এই বরদলৈ জিন্নাহ সুরাবর্দিদের চেয়ে কোন অংশে কম ছিলেন না। শ্রীহট্টকে ছেঁটে বাঙালিদের সংখ্যা ও শক্তি খর্ব করে তিনি বাঙলা থেকে পাওয়া অন্যান্য জেলাগুলির ভূমিপুত্র সহ আসামে বসবাসকারী সমস্ত বাঙালীদের নিশ্চিণ্হ করার উদ্যোগ নিলেন। ‘আসাম ইজ ফর আসামীজ’, ‘উই শ্যাল নট এলাউ আসাম অ্যাজ আ বাই লিঙ্গুয়াল স্টেট’ ইত্যাকার বিবৃতি দিয়ে অসমীয়াদের খেপিয়ে বাঙালিদের উপর আক্রমণ ও বিতাড়ণ শুরু করেন।

বিপুল সংখ্যক বাঙ্গালী পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও অন্যান্য রাজ্যে আশ্রয় নেয়। ধর্ষণ ও নারী হরণের ঘটনা বাদ দিলে এই বাঙালী নির্যাতন ও বিতাড়নে পূর্ব পাকিস্তান ও আসামের মধ্যে কোন পার্থক্য ছিল না। বাহান্নতে যেমনটা হয়েছিল পাকিস্তানে (উর্দু, অনলি উর্দু উইল বি দ্য স্টেট ল্যাঙ্গুয়েজ অফ পাকিস্তান) ঠিক তেমনই একষট্টিতে আসামে কেবলমাত্র অসমীয়া ভাষাকেই সরকারি ভাষা হিসাবে মান্যতা দেওয়া হয়।

বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলে এর বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ হয়। বরদলইয়ের পুলিশ এগারো জন প্রতিবাদিকে গুলি করে হত্যা করে। আসাম কংগ্রেসমুক্ত হয়েছে কিন্তু যে বিষ বরদলইরা ছড়িয়ে গেছেন ক্ষমতায় থাকা কথিত জাতীয়তাবাদী দলও তা প্রশমিত করতে পারেনি।

এখনও এ রাজ্যের রাজনীতির মূল রসায়ন এটাই। মূষলমান অনুপ্রবেশকারীদের হাতে আসাম বিপন্ন হয়েছে এই বাস্তবতার ভিত্তিতে এনআরসি এলেও কার্যক্ষেত্রে এই শক্তি এনআরসি থেকে বাদ দিয়েছে কেবল বাঙালি হিন্দুদেরই। এমনকি এরা বাঙালিদের কোনাঠাসা করতে অনুপ্রবেশকারী মূষলমানদের দলে টেনেছে।

এর কারণ শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে এই বাঙালিদের সাথেই তাদের প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে, অনুপ্রবেশকারী মূষলমানদের সাথে নয়। শেষোক্তরা ক্ষুদ্র ব্যবসা, দিনমজুরি, চুরি, ছিনতাই, মসজিদ, মাদ্রাসা বা সন্ত্রাসবাদী ক্রিয়াকলাপে নিজেদের জীবিকার ব্যবস্থা করে নেয়।

মুর্শিদাবাদ জেলাতে মুসলমানেরা কিছুটা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল দেশভাগের আগে থেকেই। তথাপি এই জেলাকে ভারতের মধ্যে রাখা হয়েছে কলকাতা বন্দরের নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে। কলকাতা বন্দরের প্রাণ প্রবাহ ভাগীরথী নদী এই জেলার মধ্য দিয়া প্রবাহিত। এই জেলা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হলে কলকাতা বন্দর এবং সেই সঙ্গে বিপন্ন হয়ে পড়ত সমগ্র পূর্ব ভারত। এখনও এরা শিলিগুড়ি করিডোরকে কেটে দিয়ে সমগ্র পূর্ব ভারতকে বিচ্ছিন্ন করতে সচেষ্ট।

পাকিস্তানপন্থী দুষ্টচক্র এই প্রচার চালাচ্ছে যে মুর্শিদাবাদ, মালদহ ও পশ্চিম দিনাজপুর মূষলমান গরিষ্ঠ হওয়া সত্বেও উত্তরবঙ্গের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করার জন্য এই তিন জেলা পাকিস্তানকে না দিয়ে ভারতে রাখা হয়েছে। মুর্শিদাবাদ সম্পর্কে বাস্তবতা উপরে দিলাম। মালদা বা পশ্চিম দিনাজপুর কোথাও মূষলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল না। ১৯৫১ সালের জনগণনাতেও এই দুই জেলায় হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। পশ্চিম দিনাজপুর বর্তমানে উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুরে বিভক্ত। সর্বশেষ জনগণনাতেও এখানে ৫১.৬৭% হিন্দু রয়েছে।

উপরোক্ত দুষ্টচক্রের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বিপজ্জনক ও বিধ্বংসী হল দলিত মূষলিম ঐক্যগোষ্ঠী। যোগেন মণ্ডলের প্রেতাত্মা এদের কাঁধে ভর করেছে। কেবল খুলনা জেলার পাকিস্তানভুক্তিতেই নয় দেশভাগের ইতিহাসকেই এরা উল্টো করে প্রচার করছে। দেশভাগের কারণ তথা প্রেক্ষাপট সম্পর্কে এরা যে মিথ্যা প্রচার করছে তা সীমাহীন ও অকল্পনীয় যা মূলতঃ বামৈসলামিক বৌদ্ধিক দুবৃত্তদের মস্তিস্ক প্রসূত।

মূষলমানদের পৈশাচিক বর্বরতাকে আড়াল করতে এরা প্রচার করছে যে মূষলমানরা দেশভাগ চায়নি দেশ ভাগ করেছে হিন্দুরা। এই উদ্দেশ্যে তারা ভারতভাগ ও বাঙলা ভাগের বিষয় দুটিকে গুলিয়ে দিয়ে প্রচার চালাচ্ছে। মূষলমানরা ভারত ভাগ করে সম্পূর্ণ বাঙলাকেই পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছিল।

অনন্যোপায় হিন্দুরা তখন বাঙলা ভাগ করে বাঙালীদের (বাঙলার ভূমিজ সংস্কৃতির লালনকারী) হোমল্যান্ড হিসাবে পশ্চিমবঙ্গকে ভারতের সাথে যুক্ত করতে সমর্থ হয়। ভারত ভাগের প্রশ্নে বাঙলা ভাগের এই শর্তটি দিয়েছিলেন বাবাসাহেব ডঃ বি আর আম্বেদকর। ভারতের অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে ভুল বুঝিয়ে বিপথগামী করার উদ্দেশ্যে পাকিস্তানপন্থী এই দলিত মূষলিম ঐক্যগোষ্ঠী বাবাসাহেবের নাম ও প্রতিকৃতি ব্যবহার করে।

কিন্তু এদের অবস্থান ও বিচরণ বাবাসাহেবের শিক্ষা ও সিদ্ধান্তের সম্পূর্ণ বিপরীতে। এরা প্রচার করছে, মূষলমানদের সমর্থনে বাবাসাহেব বাঙলা থেকে গণপরিষদে নির্বাচিত হয়েছিলেন তাই আক্রোশ বশতঃ বাঙলা ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। আর খুলনা এলাকা থেকে বাবাসাহেব নির্বাচিত হয়েছিলেন তাই খুলনাকে পাকিস্তানে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।

তথ্য বা যুক্তির কোন মূল্য এই সব মূর্তিমান শয়তানদের কাছে নেই। তবে সরলমতি যে সব ভাই বন্ধুরা এদের ফাঁদে পা দিয়েছেন তাঁদের কাছে সবিনয়ে দুটি তথ্য জানাতে চাই। কোনও প্রকার সংশয় থাকলে যথোপযুক্ত অধ্যয়নের মাধ্যমে যাচাই করে নিতে অনুরোধ করছি।

প্রথমতঃ তৎকালীন ভারতে মূষলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচনী ব্যবস্থা ছিল। যে ব্যবস্থায় মূষলমানদের দ্বারা কোনও অমূষলমানকে নির্বাচিত করার কোন প্রশ্নই আসতে পারে না। দ্বিতীয়তঃ বাবাসাহেব সাধারণ মানুষের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হননি। তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন বঙ্গীয় আইনসভার এমএলএদের দ্বারা।

সুতরাং খুলনা বা অনুরূপ কোন নির্বাচনী ক্ষেত্রের কল্পনাও এ ক্ষেত্রে একেবারেই অবাস্তব ও অবান্তর। সুতরাং ‘মূষলমানদের সমর্থন নিয়ে বাবাসাহেব গণপরিষদে নির্বাচিত হয়েছিলেন’ এই জাতীয় দুস্প্রচার সর্বৈব মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক। দেশভাগ, প্রদেশভাগ বা খুলনার পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তি সর্বক্ষেত্রেই এই দুষ্টচক্রের ষড়যন্ত্রমূলক প্রচারকে দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখান করুন।

যে শিরোনামে প্রতিবেদনটি শুরু করেছিলাম এবার আমরা সেই খুলনার প্রসঙ্গে আসতে পারি। খুব বেশি না হলেও খুলনা জেলায় হিন্দুদের সুস্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল। হিন্দুরা চেষ্টাও করেছিল যাতে এই জেলা ভারতে থাকে।

১৮ই জুন কলকাতার ভারত সভা হলএ আয়োজিত এক সভায় তৎকালীন এমএলএ ও গণপরিষদ সদস্য শ্রী প্রমথ রঞ্জন ঠাকুর খুলনা জেলা ও তৎসংলগ্ন গোপালগঞ্জ, বাকেরগঞ্জ ও ফরিদপুরের হিন্দুপ্রধান এলাকা সমূহ পশ্চিমবঙ্গে যুক্ত রাখার দাবী জানান। এই সংবাদ পরিবেশন করে ২০শে জুনের অমৃতবাজার পত্রিকা জানাচ্ছে যে এই বিষয়ে শ্রী ঠাকুর ও ডঃ আম্বেদকরের মধ্যে বার্তালাপ হয়েছে। ’৪৭এর ১৫ই আগস্ট থেকে কয়েক দিনের জন্য এখানে ভারতের পতাকাও উড়ছিল।

কিন্তু লিগ ও তার দোসর যোগেন মণ্ডলেরা বিপরীত চেষ্টা চালায় এবং তা সফল হয়। হিন্দুদের যেটুকু সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল তা নস্যাৎ হয়ে যায় যোগেন মণ্ডল ও তার অনুগামীরা পাকিস্তানের পক্ষ নেওয়ায়। যোগেন্দ্র অনুগামী পাঁচ জন তফসিলি এমএলএ পাকিস্তানের পক্ষ নেওয়ায় ওই এলাকায় পাকিস্তানের পাল্লা ভারী হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, যোগেন মণ্ডল পরিস্থিতিকে আরও অনেক বেশি ঘোরালো ও বিপজ্জনক করে তুলেছিলেন। যোগেন বাহিনী লীগের সঙ্গে গলা মিলিয়ে বাঙলা ভাগের বিরোধিতা করেছিল সম্পূর্ণ বাঙলাকে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়ার জন্য।

কিন্তু সেটা সম্ভব হচ্ছে না দেখে ভাগীরথীকে সীমানা ধরে অন্তত কলকাতা পর্যন্ত যাতে পাকিস্তানে যায় তার আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। লীগকে তিনি আশ্বস্ত করেছিলেন যে তফসিলিদের ভোটে কলকাতাকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করে দিবেন এবং সেই মতো কলকাতা ও তার সন্নিহিত অঞ্চলে গণভোটের দাবি তুলেছিলেন।

মূষলমানরা একপ্রকার নিশ্চিত ছিল যে কলকাতাকে তারা পাকিস্তানে পাচ্ছেই। দেশভাগের সময় সরকারী কর্মচারীদের কাছে অপশন রাখা হয়েছিল ভারত বা পাকিস্তানে যোগ দেওয়ার। মূষলমান কর্মচারীরা ব্যাপকভাবে অপশন লিখেছিলেন এইভাবে, “পাকিস্তান, প্রেফারেবলি ক্যালকাটা”।

মূষলমান কর্মচারী তার হিন্দু সহকর্মীকে বলছেন, “কলকাতা পাকিস্তানে থাকলেও আপনাদের হাওড়াটা বোধহয় ভারতেই যাবে।” যোগেন মণ্ডলই মূষলমানদের আকাঙ্খা এবং মনোবল এমন তুঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। এমএলএদের পাল্লা পাকিস্তানের পক্ষে ভারী হওয়ায় খুলনাকে ভারতে ধরে রাখার আর একটাই পথ ছিল সেটা হল গণভোট।

কিন্তু সেই পথে গেলে যোগেন মণ্ডল ও লিগের দাবী মেনে ভোট করতে হতো কলকাতা ও চব্বিশ পরগণাতেও। ফলে খুলনা তো বটেই হারাতে হতো কলকাতা ও চব্বিশ পরগণাও। কারণ আজরাইল বাহিনী যে সন্ত্রাসের পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল তাতে হিন্দুদের পক্ষে ভোট দিতে যাওয়া অত্যন্ত দুরূহ ছিল যেমনটা হয়েছে শ্রীহট্টে। এই প্রসঙ্গে সেই সময় যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের চিন্তা চেতনার স্বরূপটুকুও চিনে নেওয়া আবশ্যক।

বিশিষ্ট আম্বেদকর অনুরাগী সাহিত্যিক ও সাংবাদিক শ্রীরঞ্জিত কুমার সিকদার এক সাক্ষাৎকারে (৩০.৭.২০০৩) জানান যে শ্রীমতী হেমলতা মণ্ডলকে (প্রাক্তন প্রধান শিক্ষিকা, রাজপুর পদ্মমণি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়) সাথে নিয়ে তিনি একবার যোগেনবাবুর কাছে গিয়েছিলেন ১৯৬৪ বা ’৬৫তে। শ্রীমতী মণ্ডল যোগেনবাবুকে প্রশ্ন করেন যে কিভাবে তিনি মুসলিম লিগের হয়ে পাকিস্তানের পক্ষে সিলেটে প্রচারে গিয়েছিলেন।

উত্তরে যোগেনবাবু বলেন যে সেই সময় তাঁর পক্ষে লিগের অনুরোধ (নাকি আদেশ?) উপেক্ষা করা সম্ভব ছিল না। সুধী পাঠকগণ এবার বিচার করুন, গণভোট হলে তার ফলাফল কি হতো ? কলকাতাকে ধরে রাখার জন্যই হিন্দুরা গণভোটের দাবি এড়িয়ে যশোর খুলনাকে বলি দেন লিগ ও যোগেন বাহিনীর হাতে।

আমাদের দেশে ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তকে ভারত বিভাজন সম্পর্কে প্রায় কিছুই উল্লেখ করা হয় না। মুখ্য ধারার প্রচার মাধ্যম সমূহও এই বিষয়টিকে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে এড়িয়ে চলে। সামাজিক মাধ্যম সমূহ আসার পরেই পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়। অনেকেই বিষয়টিতে আগ্রহ ও ঔৎসুক্য দেখাচ্ছেন। ফলে মুখ্য ধারাও বাধ্য হয়েছে বিষয়টিতে মনোনিবেশ করছে। তবে সেটা ঐ আড়াল করার তাগিদ থেকেই। হিন্দুপ্রধান যশোর খুলনা জেলার পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নে নিজ নিজ মতবাদ ও এজেণ্ডা অনুযায়ী বক্তব্য প্রচার করছেন অনেকেই।

আর পড়ুন…