সনাতন ধর্ম তত্ত্ব

সনাতন ধর্ম তত্ত্ব: খুব সংক্ষেপে সনাতন ধর্মের মর্ম কথা।-অভিরুপ

সনাতন ধর্ম তত্ত্ব: খুব সংক্ষেপে সনাতন ধর্মের মর্ম কথা। হিন্দুধর্ম ভারতীয় আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য এবং বৈদিক ঐতিহ্যকে অন্তর্ভুক্ত করে।

এটি বোঝা অন্য যে কোনও ধর্ম বোঝার চেয়ে আরও জটিল কারণ এর অনেকগুলি অংশ রয়েছে এবং প্রতিটি অংশের নিজস্ব ব্যবহারিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তাহলে চলুন জেনে নেওয়া যাক সেই সব বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে যা একে অন্য ধর্মের থেকে আলাদা করে তোলেছে।

দর্শন, ধর্ম এবং ফলিত আধ্যাত্মিকতা দেখতে পাবে, যদি দর্শনের দৃষ্টিকোণ থেকে হিন্দুধর্মকে দেখেন, আপনি দেখতে পাবেন যে হিন্দুধর্ম বস্তুবাদ থেকে আদর্শবাদ পর্যন্ত সমস্ত দার্শনিক শিক্ষাকে এমনভাবে অন্তর্ভুক্ত করে যা অন্য কোনো আধ্যাত্মিক ব্যবস্থা করে না। হিন্দুধর্মের ভিতরে বিভিন্ন ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এতগুলি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থাকা সত্ত্বেও, হিন্দুধর্ম তাদের খুব ঘনিষ্ঠভাবে গ্রহণ করেছে।

ব্যাখ্যা: হিন্দুধর্ম হল জীবনযাপনের একটি ব্যবস্থা যা আপনাকে আপনার উপলব্ধির উপর ভিত্তি করে একটি অনুভূত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে বেঁচে থাকার স্বাধীনতা দেয়। হিন্দুধর্ম আপনার উপর কিছু চাপিয়ে দেয় না তবে জীবনের বিভিন্ন পরিস্থিতিতে কীভাবে আচরণ করতে হয় তার একটি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে। হিন্দুধর্ম আপনাকে আপনার বোঝার ভিত্তিতে আপনার জীবনে এটি গ্রহণ করার স্বাধীনতা দেওয়, যাতে আপনি একটি উন্নত জীবন ও সমাজ গঠন করতে পারেন।

হিন্দুধর্মের ব্যবস্থা: এটির 6টি জটিল অংশ রয়েছে: ন্যায়, বৈশেষিক, মীমাংসা, বেদান্ত, সাংখ্য এবং যোগ। ঠিক যেমন অন্যান্য ধর্মগুলি একটি একক পবিত্র গ্রন্থ বা ধর্মগ্রন্থের উপর ভিত্তি করে, হিন্দু ধর্মের এই পদ্ধতিটি বেশ অনন্য। এর প্রতিটি অংশের নিজস্ব বিশেষ বৈজ্ঞানিক গুরুত্ব ও বৈশিষ্ট্য রয়েছে।

ব্যাখ্যা: হিন্দু ধর্ম সেরকম নয়, যেমন অন্যান্য ধর্মগুলি একটি পবিত্র গ্রন্থ উপর ভিত্তি করে। আপনি যদি মনোযোগ সহকারে লক্ষ্য করেন তবে আপনি দেখেতে পাবে হিন্দু ধর্মের একক ধর্মীয় গ্রন্থ নয় বরং আছে সম্পূর্ণ ব্যবস্থা যা বেদ, উপনিষদ, গীতার মতন ধর্মীও শাস্ত্রে এবং তাদের বিভিন্ন শাখা অন্তর্ভুক্ত করে।

এগুলিকে হিন্দুধর্মের ধর্মগ্রন্থ বলা যেতে পারে তবে এগুলি আপনাকে অন্য কোনও ধর্মগ্রন্থের মতো একটি লাইন অনুসরণ করতে শেখায় না, তবে তা আপনাকে একটি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি দেয় যা সময়ে সময়ে বিভিন্ন দার্শনিকরা প্রকৃতি এবং এর আচরণ বুঝতে সক্ষম হয়েছেন। আপনি যদি সমগ্র হিন্দু ধর্মকে বুঝতে চান তবে আপনাকে একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে অন্যথায় আপনি এর শিক্ষাগুলি সঠিকভাবে বুঝতে সক্ষম হবেন না এবং  প্রশ্ন করা এবং উত্তর খোঁজা হিন্দুধর্মের একটি বিস্তৃত নীতি।

সাংখ্য ব্যবস্থা: এটি একটি সর্বজনীন ব্যবস্থা যা ব্যবহারিক জ্ঞান এবং সাধারণ জ্ঞানের বিজ্ঞানের উপর ভিত্তি করে। এর মানে হল যে এটি আপনাকে অন্ধ করে না, এবং যা লেখা আছে তা বিশ্বাস করতে শেখায় না, তবে আপনার নিজের সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য আপনার ব্যবহারিক জ্ঞান এবং সাধারণ জ্ঞান ব্যবহার করার স্বাধীনতা দেয়।

ব্যাখ্যা: হিন্দুধর্মের বেশিরভাগ আধ্যাত্মিক ব্যবস্থা ব্যবহারিক জ্ঞান এবং সাধারণ জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে। উদাহরণস্বরূপ, যখন আপনাকে ধ্যান করতে বলা হয় (অর্থাৎ ধ্যান), আপনাকে বলা হয় আপনার ভিতরে ঘটে চলা প্রতিটি ছোট আন্দোলন সম্পর্কে সচেতন হতে। কারণ যখন আপনি সেই সূক্ষ্ম চিন্তাগুলিকে আপনার মধ্যে ঘটতে দেখেন, তখন আপনার বোধগম্যতা সেই চিন্তার অর্থ সম্পর্কে নয়, চিন্তাগুলি কীভাবে উদ্ভূত হয় সে সম্পর্কে সচেতন করবে। আপনি বেশিরভাগ ধ্যানমূলক অনুশীলনে এই ধরণের সিস্টেমটি দেখতে পাবেন।

হিন্দুধর্ম মানুষের আধ্যাত্মিক চাহিদাগুলিকে খুব ভালভাবে প্রতিফলিত করে। হিন্দু ধর্ম মানুষের আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত করে, যার প্রধান অংশ গুলি হল মানসিক, মনস্তাত্ত্বিক, দার্শনিক এবং ব্যবহারিক। এই সমস্ত বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণগুলি হিন্দুধর্মের বিশাল ঐতিহ্য, সাহিত্য এবং ঐতিহ্য থেকে এসেছে। অন্য কোন আধ্যাত্মিক ব্যবস্থা যা এই সমস্ত মানবিক আচরণকে এমন মর্যাদাপূর্ণ উপায়ে প্রতিফলিত করে না।

ব্যাখ্যা: হিন্দুধর্ম শুধুমাত্র একটি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে না বরং একটি আধ্যাত্মিক পদ্ধতিও প্রদান করে যেখানে মানুষের বিভিন্ন মানসিক অবস্থা যেমন মানসিক, দার্শনিক, আচরণগত এবং মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তি তৈরি করা হয়। আপনি যদি হিন্দুধর্মের সাহিত্য সঠিকভাবে পড়েন এবং তাদের ঐতিহ্যগুলিকে সঠিকভাবে বুঝতে পারেন, তাহলে আপনি মানব জীবনের এই সমস্ত মানসিক অবস্থাকে সঠিকভাবে বুঝতে পারবেন। হিন্দু ধর্মে এমন সাহিত্যের অভাব নেই। আপনি শ্রীমদ ভগবদ্গীতায় এর একটি সম্পূর্ণ সংকলন দেখতে পাবেন যা মানব জীবনের বিভিন্ন পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে এবং যা জীবনযাপনের একটি বিশেষ শিল্প শেখায়।

ধর্মগ্রন্থের উত্তরাধিকার | পৃথিবীর অন্য কোনো আধ্যাত্মিক মতবাদ বা ধর্ম হিন্দু ধর্মের মতো অনেক ধর্মগ্রন্থ সংরক্ষণ করেনি। এই ধর্মীয় ব্যবস্থায় মানুষকে ঈশ্বরকে ভয় করার ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। যদি এটি কোথাও করা হয় তবে এটি একটি বিকৃতি যা অস্বীকার করা উচিত। এই ধরনের বিকৃতি অন্যান্য দর্শনে পাওয়া যায়। এটা মানবসৃষ্ট, ধর্ম থেকে সৃষ্ট নয়। হিন্দু ধর্মে ঈশ্বর বন্ধুর মতন, যাবে শ্রদ্ধা, ভক্তি, ভালোবাসা যায়, ভয় নয়।

সনাতন ধর্ম তত্ত্ব

প্রাচীনকালে ধ্বজা পূজা হতো। ‘ধ্বজা’ শব্দের অর্থ হলো পতাকা বা নিশান। এখানে ‘ধ্বজা’ বলতে প্রাচীন বাঙলায় ভিন্ন ভিন্ন কোম ও গোষ্ঠির প্রতিনিধিত্বকারী ভিন্ন ভিন্ন পশু-পাখি ও পৌরাণিক প্রাণী বোঝানো হয়েছে। কোম ও গোষ্ঠিগুলোতে গরুড়ধ্বজা, মীনধ্বজা, ইন্দ্রধ্বজা, ময়ূরধ্বজা, কপিধ্বজা, সিংহধ্বজা, হংসধ্বজা, নন্দীধ্বজা, পেঁচকধ্বজা, মকরধ্বজা ইত্যাদি ধ্বজা পূজা প্রচলিত ছিল। মীন, গরুড়, ময়ূর, সিংহ, হাঁস, পেঁচা সেইসব কোম অথবা গোষ্ঠির প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হতো। আর কোম অথবা গোষ্ঠির যিনি নেতা তিনি মীনধ্বজ, পেঁচকধ্বজ, হংসধ্বজ, সিংহধ্বজ, মকরধ্বজ ইত্যাদি নামে পরিচিত হতেন।

সময়ের পরিবর্তনে ধ্বজাপূজা হারিয়ে গেলেও ‘ধ্বজা’ হারিয়ে যায়নি বরং মূলস্রোতে মিশে গিয়েছে বিভিন্ন দেব-দেবীর বাহন হিসেবে। যেমন জ্ঞানের দেবী সরস্বতীর বাহন হাঁস, ধনের দেবী লক্ষ্মীর বাহন পেঁচা, যমের বাহন মহিষ, শিবের বাহন বৃষভ, দুর্গার বাহন সিংহ, গণেশের বাহন ইঁদুর, কার্ত্তিকেয়র বাহন ময়ূর, ষষ্ঠীর বাহন মার্জ্জার, অগ্নির বাহন ছাগল, বিশ্বকর্ম্মার বাহন হস্তী, পবনের বাহন মৃগ, ইন্দ্রের বাহন ঐরাবত, সূর্যের বাহন অশ্ব, শীতলার বাহন গাধা। বিচিত্র প্রকৃতির দেবতার সাথে বিচিত্র ধরনের বাহন। এছাড়া সাপকে সনাতন ধর্মে আলাদা মর্যাদা দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। প্রাণিকুলকে রক্ষার জন্য প্রত্যেক দেবদেবী এক একটি বাহন নিয়েছেন, যা আমাদের ইকোসিস্টেমকে রক্ষার কাজে সহায়তা করে।  

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রত্যেক পূজাতেই গাছ-পালার ব্যবহার রয়েছে। যেমন বেল পাতা, তুলসি পাতা, কলার পাতা, বট পাতা, অশ্বত্থ পাতা, আম পাতা, ধান, ডাব, দুর্বাসহ বিভিন্ন প্রজাতির ফুল, ফলসহ প্রকৃতির সব কিছুকেই ব্যবহার করতে বলেছে সনাতন ধর্ম। এর মূল উদ্দেশ্য হলো প্রকৃতি সংরক্ষণ করা।

সনাতন ধর্ম একদিকে যেমন পাহাড়-পর্বত, গাছ-গাছালি, পশু-পাখি রক্ষা করে তেমনি নদ-নদী সংরক্ষণেও ধর্মীয় নীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারপরও অজ্ঞতা ও স্বার্থপরতার কারণে অনেকেই ধর্মীয় অনুশাসনকে পাশ কাটিয়ে প্রকৃতিকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

 

সনাতন ধর্ম তত্ত্ব
লেখক- অভিরুপ বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাত বিশ্ববিদ্যালয়।