সোজাসাপ্টা ডেস্ক: প্রাচীনকাল থেকে আমাদের এই অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের ধর্মীয় প্রথা প্রচলন আছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য মন্দিরের ঘন্টা বাজানো, নমস্কার করা, নদীতে পয়সা ফেলা, কপালে সিঁদুর দেওয়া ইত্যাদি। আমাদের এই ধর্মীয় প্রথাগুলোকে অনেকে কুসংস্কার বলে থাকে। এমনকি আমাদের মধ্যেও এখন আধুনিক শিক্ষা আশাতে এগুলোকে কুসংস্কার আমরাও বলে থাকি।
তবে দুঃখের বিষয় এটাই আমরা কখনোই ভাবি না কেন আমাদের পূর্বপুরুষেরা এই প্রথাগুলো চর্চা করতেন, আর কেনই বা আমরা এখনও পরম্পরায় বহন করে চলেছি। নিশ্চয়ই কোন না কোন কারণ অবশ্যই ছিল ।কারণ না ছাড়া কোন কিছুই তৈরি বা চালু হতে পারেনা। প্রতিটি প্রথা প্রচলনের পিছনে কোনো না কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা অবশ্যই ছিল বা আছে। আসুন আজকে আমরা হিন্দু ধর্মের কিছু প্রচলিত প্রথা সম্পর্কে জানি। আজ প্রথম পর্ব।
নদীতে কয়েন ফেলা:
খুব ছোটবেলায় দেখেছি বিভিন্ন সময় বয়োজ্যেষ্ঠরা নদীর জলে পয়সা ফেলতো। হয়তোবা সেই সময় আমরা এর কারণ কি জানতাম না । এই কারণেই এই প্রথা টি আমাদের হয়তো বা কুসংস্কার মনে হতেই পারে। কিন্তু এই প্রথাটার পিছনে একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা রয়েছে। সাধারণত আগের আমলের পয়সাগুলো বিভিন্ন ধাতু দ্বারা তৈরি হতো বিশেষ করে তামা।
আমাদের শরীর অনেক ধরনের উপাদান এর চাহিদা থাকে যেটা আমরা প্রাকৃতিক ভাবে প্রকৃতি থেকেই নিয়ে থাকি। নদীতে পয়সা ফেলার মূল উদ্দেশ্য ছিল ওই সময় বেশিভাগ মুদ্রা যেহেতু তামা জাতীয় পদার্থ দ্বারা তৈরি হতো সেটা নদীতে ফেলে জলের সংস্পর্শে এসে আমাদের শরীরে প্রবেশ করতে সহয়ত করত।তাই আমাদের পূর্বপুরুষেরা এই প্রথা চালু করেছিল। বিষয়টা হয়তো বা বর্তমান সময়ে অনেকটাই হাস্যকর মনে হতে পারে কিন্তু প্রাচীনকালে মানুষের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হওয়ার একমাত্র জলের উৎস ছিল নদী। এই কারণেই পয়সা ফেলা হতো নদীতে। এখন আপনার মনে হতে পারে জলে না ফেলে বাড়িতে জলে ভিজিয়ে সেটা ব্যবহার করলেই তো হত। না সেটা শরীরের চাহিদা পুরোপুরি মিটাতন। অনেক দিন ধেরে জলে তামা থাকলে তা থেকে শরীরের জন্য প্রযোজনীয় যে উপদান তৈরি হয় সেটা বাড়িতে ব্যবহার করলে হয় না। কারণ সেখানে প্রকৃতির ছুয়া প্রযোজন অনুযায়ী থাকে না।
হাতজোড় করে নমস্কার করা:
হাতজোড় করে নমস্কার করা এটা আফগানিস্থান থেকে সেই সুদূর ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত এই অঞ্চলের মানুষের অভ্যর্থনা জানানোর প্রথা। এর পিছনেও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা রয়েছে অন্যকে সম্মান জানানোর জন্য যখন দুই হাত জোড় করে প্রণাম করা হয়। তখন দুই হাতের আঙ্গুল একে অপরকে স্পর্শ করে। ফলে আমাদের চোখ এবং মস্তিষ্কের পেশীর উপর চাপ পড়ে। যার ফলে যে ব্যক্তির উদ্দেশ্যে আমরা হাতজোড় করে প্রণাম করি সেই ব্যক্তিকে দীর্ঘদিন আমাদের মস্তিষ্ক ধরে রাখতে সক্ষম মনে রাখতে।
হাতজোড় করে প্রণাম করার পিছনেও সুদীর্ঘ চিন্তা ছিল আমাদের পূর্বপুরুষদের। হাতজোড় করে প্রণাম করলে এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তির সংস্পর্শ হয়না। যার ফলে রোনাল নামক স্মৃতির তৈরি হয় না। এছাড়াও হাতজোড় করে প্রণাম করলে যেহেতু একে অপরের সংস্পর্শে আসে না। সেহেতু বিভিন্ন ধরনের রোগ একে অপরের থেকে প্রবেশ করার সম্ভাবনাও থাকে না। সাম্প্রতিক সময়ে করোনাভাইরাস আমাদেরকে এই বিষয়ে বড় ধরনের শিক্ষা দিয়েছেন।
পায়ের আঙুলে আংটি পড়া:
বিবাহিত মহিলারা হিন্দু প্রথা মেনে পায়ের আঙুলে আংটি পড়লেও, এর পিছনে বিজ্ঞান রয়েছে। সাধারণত পায়ের দ্বিতীয় আঙুলে এই আংটি পড়া হয়। ওই দ্বিতীয় আঙুলের একটি স্নায়ু জরায়ু হয়ে হৃদযন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত। এই আঙুলে আংটি পড়লে, তা জরায়ুকে সুস্থ, সবল রাখে। এর ফলে রক্তপ্রবাহ নিয়ন্ত্রিত হয় এবং নিয়মিত মাসিক হয়। রুপো ভালো কনডাক্টর হওয়ায় তা পৃথিবী থেকে পোলার এনার্জি আত্মসাত্ করে শরীরে ছড়িয়ে দেয়।
কপালের তিলক কাটা:
সাধারণত আমরা কপালের দুই ভ্রুর মাঝখানে তিলক কেটে থাকে পেতে থাকি। এই দুই ভুরুর মাঝখানের অংশটি মানব শরীরের গুরুত্বপূর্ণ স্নায়ু থাকে।সাধারণভাবে আমাদের পুরুষদের ধারণা করেছিল এবং বর্তমানে সেটা বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে যে তিলক শক্তির অপচয় রোধ করে। লাল রংয়ের কুমকুম দ্বারা তৈরি তিলক মানব শরীরের শক্তি এবং মনোযোগ নিয়ন্ত্রণে রাখে। কপালে কুমকুম লাগানোর সময়ে ভুরুর মাধখানের অংশ এবং আদ্য-চক্রে চাপ পড়ে। এর ফলে মুখের পেশিতে রক্ত চলাচল সুচারু ভাবে সম্পন্ন হয়।
মন্দিরে ঘণ্টা বাজাই কেন?
সাধারণত আমরা প্রতিটি মন্দিরে ঘন্টা দেখে থাকি, আমরা মন্দিরে প্রবেশ করলে সেই ঘন্টা বাজিয়ে তারপর প্রবেশ করি। আমাদের শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা অনুযায়ী মন্দিরের ঘন্টা ঈশ্বরের প্রিয় এবং সকল ধরনের অশুভ শক্তির বিপরীতে কাজ করে। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান এর পিছনেও ব্যাখ্যা খুজেঁ বের করেছে।
বিজ্ঞান বলছে, ঘণ্টাধ্বনি আমাদের মস্তিষ্ক পরিষ্কার করে। ঘণ্টা বাজানোর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মস্তিষ্কের ডান এবং বাম অংশ এক হয়ে যায়। ইকো মোডে ৭ সেকেন্ড পর্যন্ত ঘণ্টাধ্বনি বজায় থাকে। এই সাত সেকেন্ডে আমাদের শরীরের সাতটি আরোগ্য কেন্দ্র সক্রিয় হয়। যার ফলে আমাদের মস্তিষ্কে বর্তমান সমস্ত নেগেটিভ চিন্তাধারা মুছে যায় এবং ঈশ্বর আরাধনায় আমাদের সম্পূর্ণভাবে মনোযোগী করে তোলে।
বছরে দু’বার নবরাত্রি কেন হয়?
সাধারণত একটি বছরে দুই মাস অন্তর অন্তর ঋতু পরিবর্তন হয়ে থাকে।আবার এই দুই মাসের মধ্যে খাবারের ভিন্নতা অর্থাৎ খাবারের অভ্যাস তো ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। আমাদের শরীর পরিবর্তিত ঋতু সাথে মানিয়ে নিতেই সময়ের প্রয়োজন হয়। নবরাত্রি মানুষকে সেই সময় টা দিয়ে থাকে। যাতে মানুষ পরিবর্তিত ঋতুর সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে। এই ৯ দিনের উপবাসে মানুষ অত্যধিক পরিমাণে নুন বা চিনি খায় না। যা মানুষের শরীর পরিষ্কার করে দেয়। এর ফলে মানুষের পজিটিভ এনার্জি, আত্মবিশ্বাস এবং আত্মনির্ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। অবশেষে ব্যক্তি পরিবর্তিত ঋতুর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়।
তুলসি পুজো কেন করি?
হিন্দু ধর্মে তুলসিকে মা মনে করা হয়। বৈদিক যুগের সাধুরা তুলসির উপযোগিতা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন, তাই তাঁরা সকলের মনে ধারণা গড়ে তোলেন যে তুলসি ঈশ্বরসম এবং সমগ্র সমাজের কাছে তুলসি সংরক্ষণের বার্তা পৌঁছে দেন। তুলসি মানবজাতির জন্য সঞ্জিবনী। তুলসির একাধিক ঔষধি গুণ রয়েছে। এটি অসাধারণ অ্যান্টিবায়োটিক। চা বা অন্য কোনও ভাবে তুলসি খেলে তা মানবশরীরের অনাক্রম্যতা বৃদ্ধি করে এবং মানুষকে রোগমুক্ত করে। এমনকি আয়ুও বাড়িয়ে তোলে। বাড়িতে তুলসি গাছ রাখলে, তা কীটপতঙ্গ বা মশা ঘরে ঢুকতে দেয় না। কথিত আছে, সাপ তুলসি গাছের ধারে-কাছে যেতে সাহস করে না। হয়তো তাই, প্রাচীন কালে বাড়ির সামনে তুলসি গাছ লাগানো থাকত।
অশ্বত্থ গাছের পুজো কেন করি?
সাধারণ মানুষের কাছে অশ্বত্থ গাছের কোনও উপকারিতা নেই। ছায়া প্রদান করা ছাড়া এই গাছটি না সুস্বাদু ফল দেয় আর না এর কাঠ এত শক্তপোক্ত, যে তা অন্য কাজে ব্যবহার করা যাবে। তা সত্ত্বেও অশ্বত্থ গাছের পুজো কেন করি আমরা? আমাদের পূর্বপুরুষরা জানতেন যে, অশ্বত্থ নির্দিষ্ট কয়েকটি গাছের মধ্যে অন্যতম (বা সম্ভবত একমাত্র গাছ) যা রাত্রিবেলাতেও অক্সিজেন উত্পন্ন করে। তাই এই গাছকে বাঁচানোর জন্য এর পুজো চালু করা হয়।
ঝাল দিয়ে খাওয়া শুরু, মিষ্টি দিয়ে শেষ:
আমাদের সমাজে একটা কথা প্রচলিত আছে ঝাল দিয়ে প্রথম পাতে মিষ্টি দিয়ে শেষ পাতে খাওয়া শেষ করতে হয়। আমরা খুব ছোটবেলায় ঠিক এটাই দেখে এসেছি কিন্তু কখনো এর পিছনের কারণটা আমরা হয়তোবা সেভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি নাই। সাধারণত আমরা মসলা জাতীয় এবং ঝাল জাতীয় খাবার হজম করা দ্রুত সম্ভব। যেহেতু মিষ্টিতে কার্বোহাইড্রেট থাকে সেহেতু হজম পদ্ধতি অনেক জটিল ভাবে হয়ে থাকে বা ধীরগতিতে হয়ে থাকে। এ ধরনের খাদ্যাভ্যাস তৈরির কারণ হল, মশলাদার বা ঝাল খাদ্য হজম পদ্ধতিকে সহজ করে দেয়। কিন্তু মিষ্টি বা কার্বোহাইড্রেট হজম পদ্ধতিকে ধীরগতিতে চালিত করে। তাই আমরা ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি যে খাবারের শেষে সবসময় মিষ্টি পরিবেশন করা হয় যেটা আমাদের শরীরের হজম প্রক্রিয়াকে সুস্থ রাখে।
মাথায় টিকি রাখা:
শুশ্রুত ঋষি মাথায় মুখ্য স্পর্শকাতর অংশটিকে অধিপতি মর্ম হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। যা সমস্ত স্নায়ুর যোগসূত্র। শিখা বা টিকি ওই অংশটিকে নিরাপত্তা প্রদান করে। শরীরের নিম্নাংশ থেকে মস্তিষ্কের নীচে, ব্রহ্মরন্ধ্রে সুশুম্না স্নায়ু পৌঁছয়। যোগ অনুসারে ব্রহ্মরন্ধ্র ১০০০ পাপড়ি বিশিষ্ট পদ্ম এবং এটি শীর্ষ সপ্তমচক্র। এটি জ্ঞানের কেন্দ্র। গিঁঠ বাধা শিখা বা টিকি কেন্দ্রটিকে উত্সাহিত করে এবং ওজস নামে পরিচিত এর সূক্ষ্ম শক্তিকে সংরক্ষিত করে।
মেহেন্দি কেন লাগানো হয়:
মেহেন্দির খুব শক্তিশালী ঔষধি গুনাগুণ রয়েছে। সাধারণত আমরা বিয়ের সময় বা কোন অনুষ্ঠানে মেহেন্দি ব্যবহার করে থাকি। বিশেষ করে বিয়েতে মেহেন্দি ব্যবহারের কারণ হলো এই সময় বর এবং কনে অনেক মানসিক চাপের ভিতর দিয়ে যায়। যার ফলে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যা দেখা দেয় বিশেষ করে মাথা ব্যথা এবং জ্বর দেখা দিতে পারে। তাই এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বর এবং কনে উপায় যাতে সুস্থ থাকে সেই লক্ষ্যেই দুইয়ের হাতে মেহেন্দি ব্যবহার করা হয়। মেহেন্দি শরীর ঠান্ডা করে। ফলে চাপ কমে এবং স্নায়ুকে চিন্তাগ্রস্ত হতে দেয় না। তাই হাতে এবং পায়ে মেহেন্দি লাগানোর প্রথা প্রচলিত।
মাটিতে বসে খাদ্যগ্রহণ:
আজকাল আমরা খাবার-দাবার যখন করে থাকি তখন সাধারণত চেয়ার টেবিলে বসেই করে থাকি। মাটিতে বসে খাদ্যগ্রহণের সময়ে আমরা সাধারণত সুখাসনে বসি। সুখাসনে বসে খাবার খেলে তা আমাদের হজমশক্তি বাড়িয়ে দেয়। সংবহনতন্ত্র হজমের ওপর দৃষ্টি দেয়। যা চেয়ারে বসে বা দাঁড়িয়ে খেলে হয় না।
পরবর্তী পর্ব পাবার জন্য নিচেই আমাদের পেজে লাইক দিয়ে রাখুন। যাতে করে নতুন পোষ্ট করা মাত্রই আপনি যেয়ে যান- ধন্যবাদ।