ব্যবসা-বিমুখ বাঙালি জাতির মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ব্যবসায়িক মহাপ্রতিভা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর(১৭৯৪-১৮৪৬খ্রিঃ)। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতামহ সতের বছর বয়সী দ্বারকানাথ ঠাকুর-এর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে দিগম্বরী দেবী ঠাকুরবাড়িতে পা রাখেন মাত্র ছয় বছর বয়সে। রূপে-গুণে তিনি ছিলেন অতুলনীয়া। অপরিনত বয়সেই তিনি কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন, একান্নবর্তী সুবিশাল ঠাকুর পরিবারের গুরুদায়িত্ব।
দিগম্বরী দেবী ঠাকুর পরিবারে পদার্পণ করার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের ব্যবসা-বানিজ্য বিস্তৃত হতে শুরু করে। ধীরে ধীরে তা ছড়িয়ে পড়ে পাবনা-রংপুর থেকে শুরু করে সুদূর আমেরিকা পর্যন্ত। স্বাভাবিকভাবেই পরিবারের সকলের কাছে দিগম্বরী হয়ে উঠলেন সুলক্ষণা।
অন্যদিকে ব্যবসা-বানিজ্য যতই ফুলেফেঁপে উঠতে লাগল, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ততই বিলাসিতায় ডুবতে লাগলেন। আসক্ত হয়ে পড়লেন মদ্যপানে। চলতে লাগল অফুরন্ত আমোদ-প্রমোদ। ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে বেলগাছিয়ায় একটি বাগানবাড়ি প্রস্তুত করেছিলেন তিনি। সেখানেই রাতের পর রাত চলত আমোদ-ফুর্তি,নাট্য-নৃত্য। দ্বারকানাথ ঠাকুরের ব্রিটিশ বন্ধুরা সেখানে নিয়মিত গমনাগমন করতেন।
দ্বারকানাথ ঠাকুরের স্ত্রী দিগম্বরী দেবী ছিলেন একজন অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ-নারী। স্বামীর এই স্বেচ্ছাচারী বিলাসিতা কোনোদিনই মেনে নিতে পারেননি তিনি। ঠাকুরবাড়ির ঐতিহ্যবাহী কুলদেবতা লক্ষ্মী-জনার্দনের পূজা করার অধিকার আগেই হারিয়েছিলেন, নিরাকার-একেশ্বরবাদী প্রিন্স দ্বারকানাথ। অতিরিক্ত বিলাসিতার কারণে স্ত্রী দিগম্বরী দেবীর সঙ্গে সম্পর্কে চিড় ধরতে শুরু করল দ্বারকানাথের। শুরু হল প্রচণ্ড দাম্পত্য কলহ।
ব্রিটিশদের ভাষায় ‘পারফেক্ট প্যালেস’-বেলগাছিয়ার প্রমোদভবনের কথা যেদিন দিগম্বরী দেবীর কানে এল, সেদিনই তিনি ঠিক করলেন – সনাতন কুলধর্ম জলাঞ্জলি দেওয়া স্বামীর সঙ্গে আর এক মুহূর্ত নয়। যদিও শেষ পর্যন্ত তিনি দ্বারকানাথকে ছেড়ে যাননি। কিন্তু সম্পর্কের সেই আগের আবেগ ফিরে আসেনি আর কখনওই।
এ-বিষয়ে দ্বারকানাথ ঠাকুরের জীবনী গ্রন্থে ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন – “…দিগম্বরী দেবী ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতগণের নিকটে মতামত চাহিয়া পাঠাইলেন যে, যদি স্বামী ম্লেচ্ছদিগের সহিত একত্র পানভোজন করেন, তবে তাঁহার সহিত একত্র অবস্থান কর্ত্তব্য কি না! তাঁহারা উত্তর দিলেন যে, স্বামীকে ভক্তি ও তাঁহার সেবা অবশ্য কর্তব্য, তবে তাঁহার সহিত একত্র সহবাস প্রভৃতি কার্য্য অকর্ত্তব্য। এই বিধান অনুসারে দিগম্বরী তাঁহার উপযুক্তমত সেবাকর্ম্ম ব্যতীত আর সর্বপ্রকার সম্পর্ক ত্যাগ করিলেন। …যতবার তিনি দ্বারকানাথের সহিত কথা কহিতে বাধ্য হইতেন, ততবারই সাতঘড়া গঙ্গা জলে স্নান করিয়া নিজেকে পরিশুদ্ধ বোধ করিতেন। এ বিষয়ে তাঁহার দিনরাতের বিচার ছিল না।…”
প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর জাহাজ ব্যবসা, রপ্তানি বাণিজ্য, বীমা, ব্যাংকিং, কয়লা খনি, নীলচাষ, গৃহায়ণ প্রকল্প এবং জমিদারি তালুকে বিশাল অর্থ বিনিয়োগ করেন। ব্যবসা তদারকির জন্য তিনি কয়েকজন ইউরোপীয় ম্যানেজার নিযুক্ত করেন।
১৮৩৯ সালে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের স্ত্রী দিগম্বরী দেবী মাত্র ৩৩ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন। এরপর ইউরোপীয় ও স্বদেশী বন্ধুদের উৎসাহে অনুপ্রাণিত হয়ে দ্বারকানাথ ঠাকুর তার বন্ধু ও বিখ্যাত দার্শনিক রাজা রামমোহন রায়-কে অনুসরণ করে ব্রিটেন যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৮৪২ সালের ৯ জানুয়ারি তিনি নিজস্ব স্টিমার ‘দি ইন্ডিয়া’ যোগে সুয়েজের পথ ধরে বিলেত যাত্রা করেন । তার সফরসঙ্গী ছিলেন ইউরোপীয় চিকিৎসক ডা. ম্যাকগাওয়ান, তার ভাগনে চন্দ্রমোহন চ্যাটার্জী, ব্যক্তিগত সহকারী পরমানন্দ মৈত্র প্রমুখ।
বিলেতে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরকে রাজকীয় সংবর্ধনা জ্ঞাপন করেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী রবার্ট পীল, বোর্ড অব কন্ট্রোলের প্রেসিডেন্ট লর্ড ফিটজার্যাল্ড, প্রিন্স এলবার্ট, কেন্টের রাজকুমারী এবং স্বয়ং রানী ভিক্টোরিয়া। ১৮৪২ সালের ২৩ জুন তিনি রানীর সঙ্গে রাজকীয় সৈন্যবাহিনীর কুচকাওয়াজ পরিদর্শন করেন। ৮ জুলাই রানী তাকে নৈশভোজে আপ্যায়ন করেন। দ্বারকানাথ ঠাকুর সম্পর্কে রানী তার ডায়রিতে লেখেন ―
“ব্রাহ্মণ ভদ্রলোক বেশ ভাল ইংরেজি বলেন এবং তিনি একজন বুদ্ধিমান ও চমৎকার মানুষ…”
১৮৪৩ সালের ১৫ অক্টোবর প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ইংল্যান্ড থেকে প্যারিসে গমন করেন। ২৮ অক্টোবর ফ্রান্সের রাজা লুই ফিলিপ তাকে সেন্ট ক্লাউডে এক সংবর্ধনা দেন। ১৮৪২ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি কলকাতা প্রত্যাবর্তন করেন। উনিশ শতকের চল্লিশের দশকের গোড়ার দিকের ব্যবসায়িক মহামন্দা এবং দ্বারকানাথের নবলব্ধ আড়ম্বরপূর্ণ জীবনযাপন – এই দু’য়ে মিলে, তার ব্যবসা-বাণিজ্য ভয়ানক লোকসানের সম্মুখীন হয়। ফলে তিনি বহু ব্যক্তি ও কোম্পানির নিকট ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এই ঋণের বোঝা তার মৃত্যু অবধি- ক্রমাগতভাবে বাড়তেই থাকে।
প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর মাত্র ৫১ বছর বয়সে পরলোকগমন করার পর, তার জ্যেষ্ঠপুত্র মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর,সারা জীবনের প্রচেষ্টায় পিতার বিশাল ঋণের বোঝা থেকে গোটা ঠাকুর পরিবারকে দায়মুক্ত করতে সমর্থ হয়েছিলেন।
১৯০৫ সালের ১৯ জানুয়ারি পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মহাপ্রয়াণের পর শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, “…আজ প্রায় পঞ্চাশ বৎসর অতীত হইল, আমাদের পিতামহের মৃত্যুর পরে এই গৃহের উপরে সহসা ঋণরাশি ভারাক্রান্ত কী দুর্দিনে উপস্থিত হইয়াছিল তাহা সকলে জানেন…কতকাল ধরিয়া তাঁহাকে (দেবেন্দ্রনাথ) কী দুঃখ, কী চিন্তা, কী চেষ্টা, কী দশাবিপর্যয়ের মধ্য দিয়া প্রতিদিন প্রতিরাত্রি যাপন করিতে হইয়াছে, তাহা মনে করিতে গেলে শরীর কণ্টকিত হয়। তিনি অতুল বৈভবের মধ্যে লালিতপালিত হইয়াছিলেন—অকস্মাৎ ভাগ্যপরিবর্তনের সম্মুখে কেমন করিয়া তিনি অবিচলিত বীর্যের সহিত দণ্ডায়মান হইলেন!…”