নারী নির্যাতন

নারী নির্যাতন: পাকিস্তানি সমাজে ধর্মীয় কারনে নারীদের প্রতি বিষাক্ত মানসিকতার প্রকাশ ঘটাছে।

নারী নির্যাতন: পাকিস্তানি সমাজে ধর্মীয় কারনে নারীদের প্রতি বিষাক্ত মানসিকতার প্রকাশ ঘটাছে। সম্প্রতি ইসলামাবাদে, ২৭ বছর বয়সী নূর মুকাদামকে প্রথমে গুলি করা হয়েছিল এবং তারপরে তার মাথা কেটে ফেলা হয়েছিল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নূরের হত্যাকাণ্ড পাকিস্তানি সমাজে ধর্মীয় কারনে নারীদের প্রতি বিষাক্ত মানসিকতার প্রকাশ ঘটাছে।

নূর মুকাদম ছিলেন দক্ষিণ কোরিয়ায় পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূতের মেয়ে। ২০ জুলাই ইসলামাবাদে নূরকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এই হত্যার মূল হতা জহির জমির জাফর, যিনি আগে থেকেই নূরকে চেনত। পুলিশের রিপোর্ট অনুযায়ী, জহির প্রথমে নূরকে গুলি করে এবং তারপর তার শিরশ্ছেদ করে ।

 

নারীদের প্রতি সহিংসতার ঘটনা পাকিস্তানে ব্যাপক হারে লিপিবদ্ধ আছে, কিন্তু সাম্প্রতিক এই ধরনের হত্যার ঘটনা বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছে। গত রবিবার দক্ষিণ সিন্ধু প্রদেশে এক ব্যক্তি তার স্ত্রীকে পুড়িয়ে হত্যা করে, অন্যজন একই দিন শিকারপুর শহরে তার স্ত্রী, তার খালা এবং দুই নাবালিকা কন্যাকে গুলি করে হত্যা করে।এর একদিন আগে, রাওয়ালপিন্ডিতে ৩০ বছর বয়সী এক নারী ধর্ষণের পর ছুরিকাঘাতে নিহত হন। 

১ জুলাই সিন্ধু প্রদেশে এক মহিলাকে তার স্বামী পিটিয়ে হত্যা করে। গত মাসে পেশোয়ারে এক ব্যক্তি তার প্রাক্তন স্ত্রী সহ দুই নারীকে ধর্মীয় ও পারিবারিক ‘সম্মানের’ নামে হত্যা করে।

সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো নতুন বিতর্ক শুরু করেছে যে সরকার কেন নারীদের রক্ষা করতে পারছে না? মানুষের মধ্যে আইনের ভয় কি শেষ হয়েছে? সমাজ কি নারীদের স্বাধীনভাবে বসবাস করতে দিতে চায় না কি সমাজে নারীদের হয়রানির প্রবণতা বাড়তেই থাকবে? এত কিছুর কারণ কি?

দোষীদের শাস্তি না দেওয়ার সংস্কৃতি

নারীদের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশ হিসেবে পাকিস্তানের অবস্থান ষষ্ঠ। দেশে মহিলাদের বিরুদ্ধে গার্হস্থ্য ও যৌন সহিংসতার দ্রুত বর্ধনশীল ঘটনা এর সাক্ষ্য দেয়। নারী অধিকার কর্মীরা বলছেন, সাম্প্রতিককালে নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধির জন্য “শাস্তিবিহীন সংস্কৃতি” দায়ী।

২০২১ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানের অনেক শহরে 'আওরাত মার্চ' বের করা হয়।
২০২১ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানের অনেক শহরে ‘আওরাত মার্চ’ বের করা হয়।

 

বেলুচিস্তান প্রদেশের প্রাক্তন সংসদ সদস্য ইয়াসমিন লাহিড়ি বলেন, ” এক ব্যক্তি একজন তরুণ মহিলা আইনজীবীকে ১২ বারের বেশি ছুরিকাঘাত করেছে তাকে সম্প্রতি আদালত ছেড়ে দিয়েছে এটা নারীদের প্রতি সহিংসতার জন্য অপরাধীদের বার্তা দেওয়।

নারী অধিকার কর্মী মুখতার মাইও একই বিশ্বাস করেন। তিনি  বলেন, “যারা নারীর প্রতি সহিংসতা করে তারা আইনের ভয় পায় না। অধিকাংশ পাকিস্তানিরা নারীর মারধরকে সহিংসতা বলে মনে করে না, মুখতার মাই ২০০২ সালে গণধর্ষণের শিকার হন।

পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ও ধর্ম

অন্যান্য কর্মীরাও বলছেন যে নারীর প্রতি সহিংসতার পেছনে পুরুষতান্ত্রিক সমাজই প্রধান কারণ। লাহোরে বসবাসকারী একজন নারী অধিকার কর্মী মাহনাজ রহমান বলেন, “নারীদের পুরুষের আনুগত্য শেখানো হয় কারণ তাদের পরিবারে একটি ভালো অবস্থান আছে। যখন একজন নারী তার অধিকার দাবি করে, তখন তাকে প্রায়ই সহিংসতার শিকার হতে হয়।” “

লাহোর-ভিত্তিক সমাজ কর্মী শাজিয়া খান বিশ্বাস করেন যে এখানে পুরুষরা ধর্মীয় শিক্ষা দ্বারা নারীর প্রতি সহিংসতায় উৎসাহিত হয়। তিনি বলেন, “ইসলামিক আলেমরা ধর্মকে এমনভাবে ব্যাখ্যা করে যা পুরুষদের নারীকে দমন করার আভাস দেয়। তারা বাল্যবিবাহকেও সমর্থন করে। এছাড়াও, নারীদেরকে বলা হয় যে তারা সবকিছুতেই তাদের স্বামীর আনুগত্য থাকবে। স্বামী স্ত্রীর উপর হাত উঠালেও বিরোধিতা করবেন না স্ত্রী । প্রকৃতপক্ষে, এই আলেমরা ধর্মের মাধ্যমে পুরুষদের নারীর প্রতি সহিংসতা করতে প্ররোচিত করে। “

নারীকে দোষ দেওয়া

পাকিস্তানে অনেক মানবধিকার কর্মী দেশটিতে মহিলাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বৃদ্ধির জন্য প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের “ভুক্তভোগী দোষারোপ” নীতিকে দায়ী করেন। গত মাসে, প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বলেছিলেন, “যদি একজন মহিলা খুব কম কাপড় পরেন, তবে এটি যে কোনও পুরুষকে প্রভাবিত করবে, যদি তারা রোবট না হয়।” অ্যাক্সিওসের জন্য, আমেরিকান ব্রডকাস্টার এইচবিও দ্বারা প্রচারিত একটি ডকুমেন্টারি-নিউজ সিরিজ সাক্ষাৎকারের সময়, খান এটিকে বলেছিলেন “সাধারণ জ্ঞান”। ইমরান খানের মন্তব্য তীব্র সমালাচিত হয়েছে।

এই প্রথম ইমরান খান নারীদের নিয়ে এমন মন্তব্য করেননি। চলতি বছরের শুরুর দিকে তিনি গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, পাকিস্তানে যৌন হিংসার বৃদ্ধি দেশে ‘পর্দা’ না থাকার কারণে হয়েছে।

নারী অধিকার কর্মী সাজিয়া খান বলেন, “পিএম খান এবং তার মন্ত্রীরা প্রায়ই নারী বিরোধী মন্তব্য করেন। এটি পাকিস্তানে নারীর প্রতি সহিংসতাকে উৎসাহিত করে।”

প্রাক্তন সাংসদ ইয়াসমিন লাহিড়ী মনে করেন, খানের সরকার নারীদের নিরাপত্তার জন্য কিছুই করেনি।পরিবর্তে, সরকার নারীদের প্রতি অত্যাচার বন্ধের জন্য একটি বিল এনেছিল যা এখনো পাস হয়নি।

রক্ষণশীলরা পশ্চিমা সংস্কৃতিকে দায়ী করে

প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের মতো দেশের রক্ষণশীল অংশও নারীদের বিরুদ্ধে যৌন ও শারীরিক সহিংসতার জন্য “পশ্চিমা সংস্কৃতি” কে দায়ী করে। সাবেক সাংসদ সামিয়া রাহিল কাজী বলেছেন, সাম্প্রতিক সহিংসতার ঘটনাগুলোর মধ্যে এমন মানুষও রয়েছে যারা ইসলামী শিক্ষা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।

কাজী বলেন, “নূর মুকাদ্দাম মামলার অভিযুক্ত অপরাধী একজন নাস্তিক। দেশে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির ক্রমবর্ধমান প্রভাবের কারণে পরিবার ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ছে এবং এ ধরনের অপরাধ বাড়ছে।” এমপি কিশোয়ার জেহরাও কাজীর দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন করেন এবং বলেন, “এই অপরাধগুলো বন্ধ করতে আমাদের পারিবারিক মূল্যবোধ ফিরে পেতে হবে।”

তবে পাকিস্তানের মানবধিকার কর্মীরা ঠিক এর উল্ট কথা বলছে। তারা বলছে ধর্মের নামে এখানে নারীদের গৃহবন্ধী করতে চাই  ধর্ম অন্ধ খান সরকার এবং তার অনুসারীরা। সম্প্রতি সময়ে একটি জরিপে দেখা গিয়েছে পাকিস্তানে নারীর প্রতি সংহিতার কোন না কোন ভাবে ধর্মীও কারণ রহয়েছে। এখানে নারীদের জীবন নরকে রুপ নিয়েছে শুধু কিছু সার্থলোভী ধর্মীও ভণ্ড আলেম এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিদের জন্য।

পাকিস্তানে নারীদের ওপর যৌন নির্যাতন এবং ধর্ষণ নিয়মিত ঘটনা। কিন্তু সম্প্রতি এক নারীকে গণধর্ষণের পর পাকিস্তানের সবগুলো বড় শহরে শুরু হয়েছে প্রতিবাদ বিক্ষোভ। ভয়ঙ্কর ছিল ওই ধর্ষণের ঘটনা। মহাসড়কে ওই নারীর গাড়ি খারাপ হয়ে গেলে, একদল ডাকাত তার সন্তানদের চোখের সামনে ওই নারীকে গণধর্ষণ করে।

কিন্তু ধর্ষণের ঘটনার পর শীর্ষ এক পুলিশ কর্মকর্তার মন্তব্যে প্রতিবাদের আগুন জ্বলে উঠেছে। হামলাকারীদের খুঁজে বের করার দায়িত্বপ্রাপ্ত এই অফিসার বরং ধর্ষিতার ওপর ঘটনার দায় চাপিয়েছেন। প্রতিবাদকারীরা বলছেন ‘ধর্ষিতাকেই দায়ী’ করার এই বিষাক্ত সংস্কৃতি বন্ধ করতেই তাদের এই আন্দোলন।

পাকিস্তানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা চরম নির্যাতনের শিকার : ইউরোপীয় পার্লামেন্টের রিপোর্ট

পাকিস্তানে খ্রিষ্টান, শিখ, হিন্দু বা আহমদিয়াদের মতো ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা যে কী চরম দুর্দশা ও নির্যাতনের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন, তা নিয়ে একটি তীব্র সমালোচনামূলক রিপোর্ট প্রকাশ করেছেন ইউরোপীয় র্লামেন্টের সদস্যরা।

বাস্তব জীবন থেকে একের পর এক উদাহরণ তুলে ধরে তারা দেখিয়েছেন, কীভাবে সেখানে সংখ্যালঘু সমাজের নারী বা বাচ্চা মেয়েরা পর্যন্ত ধর্ষণ ও অপহরণের শিকার হচ্ছেন। তাদের প্রতিনিয়ত খুনের হুমকিও দেওয়া হচ্ছে। সুত্র বিবিসি

আর পড়ুন….