আফগান-ও-পাকিস্তান-সম্পর্ক

আফগান ও পাকিস্তান সম্পর্ক: আফগানিস্তানের জনগণ কেন পাকিস্তানকে বিশ্বাস করে না??

আফগান ও পাকিস্তান সম্পর্ক: আফগানিস্তানের জনগণ কেন পাকিস্তানকে বিশ্বাস করে না?? আফগানিস্তান থেকে ন্যাটো সেনা প্রত্যাহারের মধ্যে তালেবান আবারও তার শক্তিকে আরও জোরদার করছে। আফগান মিডিয়া অভিযোগ করেছে যে এর পিছনে পাকিস্তান রয়েছে এবং তালেবানদের সহায়তা করছে। 

আফগানিস্তানের বেশিরভাগ সংবাদমাধ্যম এবং রাজনৈতিক ভাষ্যকাররা তাদের দেশে বর্তমান অশান্তির জন্য পাকিস্তানকে দোষ দিচ্ছেন। তাদের অভিযোগ, বিদেশি সেনা প্রত্যাহারের পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তার গোয়েন্দা সংস্থাগুলি তালেবানকে সহায়তা করছে। এটি চরমপন্থীদের আরও বেশি বেশি অঞ্চল দখল করতে সহায়তা করছে।

এসব অভিযোগ নতুন নয়। আফগান কর্মকর্তারা দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছেন যে পাকিস্তান তালেবানদের আশ্রয় দেয় এবং তাদের সামরিক সহায়তা দেয়। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে যখন আমেরিকা আফগানিস্তানে দুই-দশকের যুদ্ধ শেষ করছে এবং সেনা প্রত্যাহার করছে, আফগানিস্তানে পাকিস্তানের কথিত হস্তক্ষেপ আফগান মিডিয়ায় আলোচনার একটি প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আফগানিস্তানের সাংসদ আবদুল সাত্তার হুসেনি সাম্প্রতিক একটি টিভি শো চলাকালীন বলেছিলেন, “আপনারা জেনে রাখা উচিত যে পাকিস্তান তালেবানের হাত ধরে আমাদের আক্রমণ করছে। আমরা তালেবানদের সাথে লড়াই করছি না। আমরা পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ করছি। তালিবানদের আফগানিস্তানের কোন পরিকল্পনা নেই এবং আমাদেরও নেই। কিন্তু এই অশান্তির মূলে রহয়েছে পাকিস্তানের পরিকল্পনা। “

ভঙ্গুর সম্পর্ক

পাকিস্তান অভিযোগ অস্বীকার করে যে তারা তালেবানকে সমর্থন করে না। তবে অনেক আফগান কর্মকর্তা পাকিস্তানের অবস্থান বিশ্বাস করতে রাজি নন। একইভাবে, পাকিস্তানি কর্মকর্তারা মনে করেন যে আফগান মিডিয়াকে বোঝানো বেশ চ্যালেঞ্জের বিষয়। গত মাসে, পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মেহমুদ কুরেশি একটি আফগান টিভি শোতে উপস্থিত হয়ে তাঁর দেশ নিয়ে উদ্বেগকে প্রশ্রয় দিয়েছিলেন, যা তাকে এক বিশ্রী অবস্থানে ফেলেছিল। 

অনুষ্ঠানের উপস্থাপক জিজ্ঞাসা করলেন কুরেশি সাহেবে জানেন কি পাকিস্তানে কিছু তালিবান কমান্ডার উপস্থিত বর্তমানে উপস্থিত? এই প্রশ্নে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জবাব দিয়েছিলেন যে তিনি এ সম্পর্কে অবগত নন। তারপরে, উপস্থাপক জানিয়েছে যে কাতারে থাকা তালেবান শান্তি আলোচক শেখ হাকিম এই গ্রুপের নেতাদের সাথে শান্তি প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করতে পাকিস্তান গিয়েছিলেন।

কুরেশি জবাব দিয়েছিলেন, “তিনি আমার সাথে যোগাযোগ করেননি, তাই আমি জানি না।” উপস্থাপক বলেছিল, “সুতরাং অন্তত আপনি তাদের (তালিবান) নেতা নন।” পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আফগান টিভি হোস্টকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন যে তার দেশের বিরুদ্ধে সমস্ত অভিযোগ ভিত্তিহীন। তা সত্ত্বেও তাকে কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছিল।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে এই জাতীয় টকশো পাকিস্তানকে আফগানিস্তানের শত্রু দেশ হিসাবে দেখায়। একই সঙ্গে পাকিস্তান সম্পর্কে আফগানিস্তানের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিও খুব একটা ভালো না। দীর্ঘদিন ধরে এই দুই দেশের মধ্যে এ জাতীয় অনেক সমস্যা চলছে, যার কারণে আফগানিস্তানের জনগণ পাকিস্তানের দিকে সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছে।

বিশ্বাসের অভাব

কাবুল ভিত্তিক অ্যারিনা নিউজ টিভি চ্যানেলের প্রধান শরীফ হাসনায়ার ডয়চে ভেলেকে বলেছেন: “আফগানিস্তান-পাকিস্তান সম্পর্ক চার দশকেরও বেশি সময় ধরে উত্তেজনা বজায় রয়েছে। বড় বড় শহরগুলিতে বসবাসরত বেশিরভাগ আফগান নাগরিকই পাকিস্তানের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করেছেন। পাকিস্তান সমর্থন করেছিল নব্বইয়ের দশকে তালেবান ও মুজাহিদিনদের যা এখনো অব্যহত। “

প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির মুখপাত্র নজিবুল্লাহ আজাদ বলেছেন, আফগানিস্তানের পাকিস্তান সম্পর্কে ধারণা বাস্তবতার ভিত্তিতে রয়েছে। তিনি বলেছিলেন, “পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ আফগানিস্তানের বিশেষজ্ঞদের দ্বারা করা কিছু অভিযোগও মেনে নিয়েছে।

পাকিস্তানের প্রাক্তন সামরিক শাসক পারভেজ মোশাররফ ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলিকে দেওয়া এক সাক্ষাত্কারে স্বীকার করেছেন যে তার দেশ তালেবানকে সমর্থন দিচ্ছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ২০১৫ সালে বিরোধী ছিলেন। সে সময় তিনি একটি সাক্ষাত্কারে বলেছিলেন যে আহত তালেবান যোদ্ধাকে তার হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

আজাদ আরও যোগ করেছেন, “সম্প্রতি পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ রশিদ স্বীকার করেছেন যে তালেবান সদস্যদের পরিবার পাকিস্তানে বাস করে। আহত ও নিহত যোদ্ধাদের আফগানিস্তান থেকে পাকিস্তানে আনা হয়েছিল।”

যুদ্ধের রেখা

ন্যাটো সেনা প্রত্যাহার এবং দেশে তালেবানদের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের ফলে আফগানিস্তানে গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। আফগানিস্তানের শীর্ষস্থানীয় বিশেষজ্ঞ আহমেদ রশিদ সাম্প্রতিক এক সাক্ষাত্কারে ডব্লুডব্লুকে বলেছিলেন যে আফগানিস্তানের পরিস্থিতি বিশৃঙ্খলা হয়ে উঠলে “এটি প্রতিবেশী দেশগুলিকেও প্রভাব ফেলবে।” তিনি বলেছেন, “যদি এটি হয় তবে তা আফগানিস্তানকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেবে।

তিনি আরও বলেছিলেন যে ততদিন তালেবান আফগান রাষ্ট্রপতি আশরাফ গনির সরকারের সাথে আলোচনায় অংশ নেবে না যতক্ষণ না পাকিস্তানী সামরিক ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলি তাদের আশ্রয় অব্যাহত রাখে। 

 

তিনি বলেছেন, “যতক্ষণ তালেবান নেতারা এবং তাদের পরিবার নিরাপদ থাকবে ততক্ষণ তারা কেন আলোচনা করবে? পাকিস্তান যদি আন্তরিকতার পরিচয় দিতে চায় তবে তা অবিলম্বে তালেবান নেতাদের কোয়েটা বা পেশোয়ারে নির্মিত নিরাপদ আশ্রয় ত্যাগ করতে বাধ্য করা উচিত।” ” বর্তমান পরিস্থিতিতে যুদ্ধের রেখাগুলি টানা হচ্ছে এবং নতুন জোট জাল হচ্ছে। আফগানিস্তান ও পাকিস্তান উভয় দেশের গণমাধ্যমের মধ্যকার যুদ্ধও পুরোদমে চলছে।

আফগান ও পাকিস্তান সম্পর্ক
আফগান ও পাকিস্তান সম্পর্ক

উন্নতির সুযোগ আছে কি?

বাস্তবতা হ’ল দুই দেশ ভৌগলিক ও সাংস্কৃতিকভাবে সংযুক্ত। আফগানিস্তানে অশান্তি থাকলে পাকিস্তানেও এর প্রভাব পড়বে। হাসনায়ার বলেছেন, “উভয় দেশের নাগরিক সমাজের সদস্য এবং সাংবাদিকরা বিশ্বাস পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করেছেন, তবে সরকারের এটি করা উচিত। আফগানিস্তান থেকে প্রচারিত সংবাদমাধ্যমগুলি কোনও প্রতিক্রিয়া জানাতে কাবুলে পাকিস্তানি দূতাবাসে পৌঁছেছে, কিন্তু পাকিস্তানি কূটনীতিকরা চায় না তাদের সাথে যুক্ত হতে । “

আজাদ বলেছিলেন যে আফগানিস্তান কূটনৈতিকভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলার চেষ্টা করেছে। তিনি বলেছিলেন, “বিগত কয়েকমাসে অনেক শীর্ষ আফগান কর্মকর্তা পাকিস্তান সফর করেছেন, তবে এই ভূমিতে কিছুই বদল হয়নি। আফগানিস্তানের চিত্রের উন্নতি করতে পাকিস্তানকে চরমপন্থীদের সমর্থন করা বন্ধ করতে হবে।” এই পুরো বিষয়টি নিয়ে পাকিস্তানি কর্মকর্তারা বলেছেন যে আফগানিস্তান পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সড়যন্ত্র করা বন্ধ না করা পর্যন্ত দু’দেশের সম্পর্কের উন্নতি হবে না।

আফগান যুদ্ধে স্থানীয় সমাজের জয়!

ভিয়েতনাম ও আফগানিস্তান যুদ্ধের অনেক মিল থাকলেও অমিলটাই বড় হয়ে দেখা যাচ্ছে। ভিয়েতনামে যুদ্ধ শেষে ছিল স্থানীয় সমাজে তীব্র আশাবাদ, একটা নতুন সমাজব্যবস্থা গড়ার স্বপ্ন। কাবুলে এই মুহূর্তটি অনিশ্চয়তার কালোমেঘে ঢেকে আছে। বিদেশি সেনাদের বিদায়ে বিজয়ের উৎসব নেই সেখানে। দেশের সব দিকে ভ্রাতৃঘাতী হানাহানির শঙ্কা বাড়ছে প্রতিদিন।

 

রাশিয়া ও মধ্য এশিয়াকে শরণার্থীর ভাগ নিতে হবে

আফগানিস্তান থেকে আমেরিকা পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে ফেরায় সবচেয়ে খুশি রাশিয়া, চীন ও ইরান। কিন্তু মাঠের পরিস্থিতিতে এসব দেশের জন্য উদ্বিগ্ন হওয়ারও উপাদান আছে।

তালেবাননিয়ন্ত্রিত আফগানিস্তান মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন সশস্ত্র গোপন দলের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হওয়ার সুযোগ আছে, যা বিশেষভাবে রাশিয়া ও আশপাশের দেশগুলোর জন্য হুমকি। তালেবানদের ক্ষমতায় থাকতে হলে এই উদ্বেগ দূর করতে হবে। রাশিয়া এ মুহূর্তে সে রকম দর-কষাকষিতে আছে।

 

এ বিষয়ে তালেবান তাদের আশ্বস্ত করতে পারলেও আইএসসহ অ-তালেবান গ্রুপগুলো থেকে আগামী দিনে আফগানিস্তানের উত্তর সীমান্তে অস্থিরতার শঙ্কা থাকছেই। তালেবাননিয়ন্ত্রিত আফগানিস্তানকে গভীর মনোযোগে রাখছে ইরানও। ঘরের কাছ থেকে আমেরিকা বিতাড়িত হওয়ায় তারা খুশি। কিন্তু আফগানিস্তানে আইএস শক্তিশালী হয়ে উঠলে ইরানে প্রতিশোধ হামলার শঙ্কা আছে। স্থানীয় শিয়া ‘হাজারা’দের নিরাপত্তা নিয়েও তেহরান উদ্বিগ্ন। 

 

রিপোর্ট: সাইফুল্লাহ শামস

আমাদের সাথে চলতে পেজে  একটি লাইক দিয়ে রাখুন।- ধন্যবাদ