বিবেকানন্দ সত্য চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন। কিন্তু আমাদের যে সত্য জম হয় না। তাই মিথ্যের শামুকে আমরা ঢুকে গেলাম। বাংলাদেশ, পাকিস্তানকে মিত্র মনে করছি। অন্যধর্মের লােকেদের বন্ধু ভাবছি। ভাবতে আপত্তি নেই। কিন্তু তারা আমাদের কি ভাবছে সেটা আমরা ভাবতে পারবাে না কেন? পারবাে না, কারণ, আমরা ভাবের ঘরে চুরি করতে অভ্যস্ত বলে।
এক একটা দেশে যেমন এক এক ধরণের ভাষার চলন, তেমনি এক একটা দেশের বন্ধুত্ব অর্জনেও বিচিত্র ব্যবহার প্রয়ােজন হয়। পাকিস্তান বাংলাদেশের ত্রিশ লক্ষ মুসলমানকে হত্যা করেছে। লক্ষ লক্ষ নারীর সম্ভ্রম নষ্ট করেছে। সারা দেশে রক্তের নদী বইয়ে দিয়েও তারা আজ বাংলাদেশের বন্ধু। আর আমরা? কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে, বারাে হাজার তাজা সৈনিকের প্রাণ দিয়ে বাংলাদেশের দশ কোটি মুসলমানকে বাঁচিয়ে দিয়ে দেশটাকে স্বাধীন করে দিয়ে আমরা হলাম শত্রু। আমাদের ভাবনা চিন্তার মধ্যেই জটিলতা রয়েছে। কারণ, আমাদের চিন্তার উৎস ভূমিটাই মিথ্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। |
শুধু হিন্দু-মুসলমান, বাংলাদেশ, পাকিস্তান কিংবা রাজনীতির ক্ষেত্রেই এই মিথ্যাচার সীমাবদ্ধ নয়। জীবনের সবক্ষেত্রে মিথ্যা কল্পনা অবাস্তবতাই এখন আমাদের একমাত্র নিয়ামক। ছান্দোগ্য উপনিষদে অশ্বিনীকুমার নারদকে উপদেশ দিচ্ছেন, দ্যাখাে নারদ, যা কিছু ভালাে, সুন্দর, উদার, পবিত্র সব নির্ভরশীল শক্তিতেই। শক্তি ছাড়া কোন ভালাে কথা বলা ভণ্ডামি মাত্র। যেহেতু হিন্দুসমাজ সংগঠিত নয়, শক্তিশালী নয়, তাই অধিকাংশ ব্যক্তিই দুর্বল, স্বাস্থ্যহীন-সুতরাং ভণ্ডামি, মিথ্যাচার তাে আমাদের আশ্রয় হবেই। আগে মুনিঋষিরা সাধনা করতেন, তপস্যা করতেন, কৃচ্ছসাধন করতেন। উদ্দেশ্য শক্তিসংগ্রহ। সেই শক্তি দিয়ে সমাজকে শুদ্ধ করতেন। রাজা মহারাজারা যাদের ভয় করতেন, ভক্তি করতেন। বশিষ্ঠ, চাণক্য, রামদাসের মতাে গুরুদের জন্যই আমরা রামচন্দ্র, চন্দ্রগুপ্ত, শিবাজীর মতাে আদর্শ রাজা পেয়েছি। আগের সাধুদের চেহারা রুক্ষ, কৃশকায়, তেজোময়। এখন অধিকাংশ সাধুসন্ন্যাসীদের দেখলে মনে হয় যেন অনেকদিন ধরে শাসক দলের M. L. A, কিম্বা M. P। শরীরের ভাঁজে ভাজে প্রােটিন। তেল গড়িয়ে পড়ছে, পড়বেই। কারণ সাধুগুরুদের জীবন রাজনৈতিক নেতাদের চেয়েও
১৩
দর্পনে মুখোমুখি
নিশ্চিন্ত। রাজনৈতিক নেতাদের জনগণের জন্য কিছু না কিছু করতে হয়। নির্বাচনের সময় কৈফিয়ৎ দিতে হয়। সাধুগুরুদের সেসব বালাই নেই, নিরুদ্বেগ্ন জীবন। এদের অধিকাংশই আসন, প্রাণায়াম কিছুই করেন না। খাওয়া দাওয়া ভালােই হয়। ফলে প্রেসার, সুগার, ডায়াবেটিস, বাত, অনিদ্রা সব আছে। অধিকাংশই রােগী, রােগ সারলে বড়াে জোর ভােগী হবেন, যােগী কখনই নয়। নিরাপদ আশ্রম নিশ্চিন্ত ভােগ হারানাের ঝুঁকি নেবার সাহস এদের নেই। ভেজালদার ব্যবসায়ী, দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদদের এঁরা শিষ্য করতে পারেন, কিন্ত তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। তাদের দয়াতেই এঁদের জীবন চলে।
এই পবান্নভােজী, ভীরু, অলস, মিথ্যাবাদী, অসহায় জীবগুলােকে আমরা সাধু, গুরু বলি। কারণ, আমরাও মিথ্যা ভালবাসি, প্রবঞ্চনা ভালবাসি, ভণ্ডামি ভালবাসি। এঁদের খাদ্য, বস্ত্র সব জোগায় সমাজ। কিন্তু এইসব সাধুরা সমাজ, দেশ, রাষ্ট্র সম্পর্কে নির্বিকার থাকেন। দেশের বিপদে একটি কথা বলেন না, অথচ কথাবার্তায় এঁরা আভাস দেন জগৎ-ব্রহ্মাণ্ড সব এঁদের নখদর্পণে। খোঁজ নিলে দেখা যাবে আশ্রমটা ঠিকমত চলে না, সাধুতে সাধুতে মুখ দেখাদেখি নেই, গুরুভাই গুরুভাইয়ে ঝগড়া। যে পাড়ায় আশ্রম সেই পাড়ার লােকে এদের সহ্য করতে পারে না। ভক্তরা সব আসে দূর থেকে। ভুয়াে রেশন কার্ডের মালিকেরা যেমন দূরের রেশন শপ থেকে মাল নেয়। চক্ষুলজ্জার সংকোচ এবং ধরা পড়ার ভয় থাকে না। গুরু, শিষ্য, ভক্ত আমরা সবাই এক অসা জীবন কৃত্রিম বােঝার মত টেনে নিয়ে চলেছি।
শক্তি না থাকলে, সত্যের সঙ্গে সম্পর্ক না থাকলে ধর্মকে সমাজ নিরপেক্ষ, পরিস্থিতি নিরপেক্ষ-এই কল্পনার বস্তু বানিয়ে ফেললে এইরকম অপমানের জীবন, গোঁজামিলের জীবনই বেছে নিতে হয়। কৃষ্ণ গীতায় স্পষ্ট করে বলেছেন, যে নিজের জন্য রান্না করে সে পাপ ভক্ষণ করে। মানে সমাজকেন্দ্রিকতা অর্থাৎ বাস্তবতা। সে কথায় আমরা কর্ণপাত করলাম না। তিনি পরিপূর্ণ মানবজীবনের ছবি এঁকে দিলেন অর্জুনের সামনে। বললেন, জ্ঞান, ভক্তি ও কর্মের সমন্বয় চাই। শুধু একটার ওপর জোর দিলে অসম্পূর্ণ মানুষ, বিক্ষুব্ধ জীবন। গীতায় মূল বক্তব্য এটাই। আমরা মিথ্যে ভালবাসি,
দর্পণে মুখমুখি
তাই শুধু ভক্তিকে আঁকড়ে ধরলাম। আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে আমরা কি দেখছি? কাউকে ভক্তি করতে গেলে বিচার বুদ্ধি প্রয়ােগ করে, তাকে ভক্তি করা যায় কিনা, হিসেব ধরেই ভক্তি করি। অর্থাৎ জ্ঞান। তার সঙ্গে দেখা করতে গেলেও পথের জ্ঞান চাই। হেঁটে বা গাড়ীতে যাতেই যাই পরিশ্রম, অর্থাৎ কর্ম। তবে বৃত্তটি সম্পূর্ণ হ’ল। এখন আমাদের ভক্তির মাত্রা এত বেশী যে ভক্তির উচ্ছ্বাসে আমরা কৃষ্ণের ভুলভ্রান্তিগুলােও সংশােধন করে নিচ্ছি। তিনি বলে গেলেন, নিজের ধর্মে মরে যাবে, অন্য ধর্ম অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। আমরা তার প্রম সংশােধন করে নিয়েছি। সব ধর্মকে সমানভাবে গ্রহণ করতে চাইছি। মৃত্যু নিকটতর হচ্ছে। মিথ্যায় নিমজ্জিত হচ্ছি। কৃষ্ণ বললেন, অর্জুন, আমি অন্য কোথাও নেই, আমি তােমাদের সবার মধ্যে আছি। এতে নিজের দিকে তাকাতে হয়, নিত্য আত্মসমীক্ষায় নিজেকে সংশােধন করতে হয়।
এ কথাগুলাে আমাদের ভাল লাগলাে না। তেত্রিশ কোটী দেবতা, অপদেবতা, হাজার হাজার গ্রহ, উপগ্রহ, গােমদ, পলা, অনন্তমূল, ঘােড়ার খুরের পিছনে আমরা ছুটছি। কৃষ্ণের বক্তব্যে বাস্তবতা আছে, আমরা চাই কল্পনা। তাই কৃষ্ণের চেয়ে গৌরাঙ্গ আমাদের কাছে বড় হয়ে গেল। যুক্তির চেয়ে শক্তির চেয়ে বড় হয়ে গেল ভক্তি। ভগবৎ সাধনায় চিরকাল অর্জিত হয়েছে শক্তি, তেজ, সাহস, পবিত্রত। ভক্তির সাধনায় আমরা অর্জন করলাম ভণ্ডামি, পৌরুষহীনতা। আর কারণে অকারণে কদবার ক্ষমতা। লক্ষ লক্ষ লােক এটাকেই ভক্তি মনে করে। জ্ঞান, বুদ্ধি, চেতনাকে অসাড় করে দিয়ে যেমন নেশাখােরেরা দুঃখ ভুলে একধরণের আনন্দ অনুভব করে থাকেন।
এই ধরণের যুক্তিহীন, জ্ঞানহীন ভক্তিতে একটা মাদকতার সৃষ্টি হয়। ভারসাম্য হারিয়ে, অসংলগ্ন হয়ে লােকটা ভাবে ভগবং সান্নিধ্য হচ্ছে। নইলে ভগবৎ সান্নিধ্য লাভের পরেও এইসব ব্যক্তিদের চরিত্রে এত অসঙ্গতি থাকে কেন? মিথ্যাচার, স্বার্থপরতা, চৈতন্যহীনতা কেন? পূর্ববঙ্গের বন্ধুরা কত উৎসাহের সঙ্গে গল্প করেন, আমাদের ওখানে যা কঠিন হতাে না, এই পশ্চিমবঙ্গে আর কী হয়? আমাদের গ্রামেই তিনদিনে পঁচাশী মন চালডালের খিচুড়ি রান্না হতাে। বৈষ্ণবেরা গলায় মালা, নাকে রসকলি আর কপালে ফোটা নিয়ে পরস্পর পরস্পরকে
১৫
দর্পণে মুখােমুখি
জড়িয়ে ধরে ভীষণ কাদত, সে কান্না যদি আপনারা দেখতেন! উৎসাহী শ্রোতারা জিজ্ঞাসা করে, তারপর মুসলমানেরা যখন পেটাতে শুরু করল তখন কি করলেন? উত্তর, তখনও কাদতে কাঁদতে পালিয়ে এলাম। কোনটা কিসের জন্য কেঁদেছিলাম মনে আছে? না মনে নেই। এই আমাদের ধর্ম, এই আমাদের ভক্তি। অর্থাৎ বিশুদ্ধ ভণ্ডামি। যাদের আমরা হিজড়ে বলি, তাদের কোন অসম্মানজনক কথা বলে দেখুন। আর কিছু না পারাল দু’হাতে তালি দিয়ে গালাগালি দিয়ে চোদ্দপুরুষ, উদ্ধার করে দিয়ে যাবে। তাদেরও আত্মমর্যাদাবােধ আছে। আমাদের দেশের ধর্মাচরণকারীরা সব ভুলে গেছে। মনে আছে কান্নার কথা আর খিচুড়ির কথা। কখন কিসের জন্য কেঁদেছে সে কথাও মনে নেই। তেত্রিশ কোটি দেবতা আর এই চেতনাহীন কীর্তন দিয়ে আমরা জড়ের উপাসনা করে চলেছি। দেশ হারানাের, মনুষ্যত্বহারানাের, মা-বােনেদের সম্ভ্রম হারানাের মত ঘটনাগুলােও আর আমাদের বিচলিত করতে পারছে না।
সত্যিই আমাদের ভক্তি যে ভক্তি নয়, কাপট্য ভণ্ডামি, তার অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে সর্বত্র। ভারতবর্ষে বহু প্রাচীন হিন্দু মন্দির ভেঙ্গে মসজিদ করা হয়েছে। বিগ্রহকে চূর্ণ করা হয়েছে, নানাভাবে অপবিত্র করা হয়েছে। কাশীর বিশ্বনাথের মন্দির, মথুরায় কৃষ্ণের জন্মস্থান, অযােধ্যায় রামচন্দ্রের মন্দির এর মধ্যে অন্যতম। এইসব তীর্থ দর্শন করতে যান, কোটি কোটি ভক্ত, লক্ষ লক্ষ সাধু, সন্ন্যাসী, গুরু। এদের কারাে মনে কখনাে ইচ্ছে জাগে না, আমাদের দেবতাকে আবার পর্ণ মৰ্য্যাদার সঙ্গে স্বস্থানে প্রতিষ্ঠিত করি। কাশীর বিশ্বনাথের মন্দির চুর্ণ করে মসজিদ তাে করেছেই, শিবলিঙ্গটিকেও পাশের কুয়াের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। শতশত বছর ধরে শিব সেই কুয়াের মধ্যে পড়ে আছে। লক্ষ লক্ষ ভক্ত কুয়াের পাড়ে দাঁড়িয়ে ভক্তিভরে প্রণাম করে–দশ পয়সা, পাঁচ পয়সা কুয়াের মধ্যে ছুঁড়ে দেয়। ভাবখানা এইরকম, আহা বেচারী শিব ওখানে আছে ওখানেই থাকবেঁচেবত্তে থেকে আমাদের কল্যাণ করে, তাই এই প্রণামী। অবহেলিত, অপমানিত শিবকে উদ্ধার করে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠা করার ইচ্ছা কোন ভক্তের হয় না। কৃষ্ণের জন্মভূমি মথুরায় ঠিক একই দৃশ্য। কারাগার ভেঙ্গে মসজিদ
দর্পণে মুখােমুখি
তৈরী করেছে। কোটি কোটি কৃষ্ণভক্ত রয়েছেন দেশে। মালায়, টিকিতে, রসকলিতে, নামাবলীতে সারা শরীরে কৃষ্ণভক্তির সাইনবোের্ড টাঙানাে। কিন্তু এঁদের কখনাে মনে হয় না-কৃষ্ণ অপমানিত, তার পবিত্র জন্মস্থান বিধর্মী কবলিত, জীবন দিয়েও কৃষ্ণ জন্মক্ষেত্র উদ্ধার করা দরকার। রামচন্দ্রের জন্মভূমিও তাই, মসজিদ। ভক্তদের কথা ছেড়েই দিলাম, শিবভক্ত, কৃষ্ণভক্ত, রামভক্ত গুরুদেও এ ব্যাপারে কোন হুঁস নেই। এই ভক্ত এবং গুরুরা ভণ্ড কপট না হলে দেখা যেত, এরা লাখে লাখে এইসব তীর্থে গিয়ে কীর্তন করছে প্রতিজ্ঞা করছে-হয় ইষ্টদেবের প্রতিষ্ঠা, নয় এখানেই কীর্তন করতে করতে প্রাণ বিসর্জন দেব। নেই। নপুংসকের ব্রহ্মচর্য্য, ভিখারীর বৈরাগ্যের মতই আমাদের ভক্তি, শুধুই আত্মপ্রবঞ্চনা। মিথ্যাবাদী আর আত্মপ্রবঞ্চকেরা বাস্তবের মুখােমুখি হতে ভয় পায়। মনের গভীরে যে আমাদের শ্রদ্ধাভক্তির একান্ত অভাব সেটাও প্রকাশিত হয়ে যায় আমাদের ভাষায়, মাঝে মাঝে, যখন অবচেতন থাকি: অনেক ধার্মিক ব্যক্তিকে বেশ হাসতে হাসতেই অতিথিদের বলতে শােনা যায় আপনারা একটু বসুন, আমি একবার মন্দির থেকে ঘুরে আসি, অর্থাৎ পায়খানা থেকে।
বহু ভক্তিমতী গৃহস্বামিনী বলেন, আপনারা বসুন উনি একটু ঠাকুরঘরে গেছেন। মানে ল্যাট্রিনে। অরক্ষিত মনের মধ্যে আমাদের ঠাকুরঘর, মন্দির, পায়খানা এক। যখন সতর্ক সচেতন তখন কপট ভক্তির পরাকাষ্ঠা। দেবমন্দির মনােমন্দির হৃদয়মন্দির সবই ততা তিনি। তখন ভক্তিরসের কি আঠা। সব রস শুধু আমাদের কল্পনায়। যেখানে অলৌকিকতা অতীন্দ্রীয় স্বপ্ন কল্পনা, মানে মিথ্যা, আমাদের মন ছুটে যায় সেখানেই। রামকৃষ্ণ বললেন, শিবজ্ঞানে জীবসেবা করতে, মন মুখ একে করতে, কামিনী কাঞ্চন ত্যাগ করতে। এগুলাে আমাদের ঠিক পছন্দ হ’ল না। তিনি মা কালীকে দেখেছিলেন, তাকে সন্দেশ খাইয়েছিলেন, রামপ্রসাদের বেড়া বাঁধার সময় মা কালী দড়ি পড়িয়ে দিয়েছিল, একথা আমরা বিশ্বাস করি, গল্প করি। আমাদের একবারও মনে হয় না এগুলাে মিথ্যে কল্পনা। ঈশ্বর যতবার পৃথিবীতে এসেছেন একটা নির্ধারিত পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে তাকে আসতে হয়েছে। কোন মানুষী মায়ের গর্ভে তাকে জন্ম নিতে হয়েছে। মানুষের মতই তাকে একটু একটু
দর্পণে মুখােমুখি
করে বড় হতে হয়েছে। তারপর তার ঐশী শক্তির প্রকাশ ঘটেছে। তাকেও জগতের নিয়ম মেনে চলতে হয়। তারও ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা আছে। চমকে ওঠার মত কথা, কিন্তু নির্মম সত্য কথা। ভক্তদের ধারণা তিনি সর্বশক্তিমান, অসীম ক্ষমতার অধিকারী। এগুলাে আবেগ কল্পনা মাত্র। আমাদের আধার এবং যােগ্যতার ওপরই সব নির্ভরশীল। ভগবান সর্বশক্তিমান হলে কৃষ্ণের ছেলে শাম্ব ওইরকম বদ এবং চরিত্রহীন হতাে না। রামকৃষ্ণ চেষ্টা করলেই আরাে গােটা কতক বিবেকানন্দ তৈরী করতে পারতেন। একটা নয়নের জন্য এত ছটফট ফরতেন না। গৌরাঙ্গদেবের স্ত্রী লক্ষীপ্রিয়াকে সাপে কামড়ে মেরে ফেলতে পারত
। সন্ন্যাস নেবেন জেনেও তিনি দ্বিতীয়বার বিবাহ করে বিষ্ণুপ্রিয়াকে সারাজীবন কাঁদাতেন না। পৃথিবী সৃষ্টির কথা ধরা যাক, ভগবান তাে সর্বশক্তিমান, তাহলে শ্যাওলা থেকে অ্যামিবা এইরকম ক্রমবিবর্তনের মধ্যে দিয়ে আমাদের মানুষ করলেন কেন? তাকে আবার শিক্ষা সংস্কারের অপেক্ষায় রাখলেন কেন? একেবারেই পূর্ণ মানব নির্মাণ করতে পারেতেন। জানি ভক্তরা কি বলবেন, ডাক্তারেরা রােগের উৎস খুঁজে না পেলে বলেন অ্যালার্জি। জড়বুদ্ধি ভক্তরা যুক্তি খুঁজে না পেলে বলেন, ওটাই তাে লীলা। অর্থাৎ স্ববিরােধিতা মানে গোঁজামিল। আধ্যাত্মিক শক্তিটা যে ভাবের শক্তি কল্পনার শক্তি, বাস্তব জগতে তার কোন মূল্য নেই, এই সত্যটা আমাদের নতুন করে বুঝতে হবে। ধর্ম ব্যবসায়ীরা এটা না বােঝার চেষ্টা করতে পারেন, কারণ, এটা তাদের জীবিকা । আমাদের এই সত্যটা বুঝতেই হবে। না হলে জাতি হিসাবে আমরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাব, যাচ্ছি।
সােমনাথের মন্দিরে ষাট হাজার সন্ন্যাসীকে হত্যা করা হয়েছিল, তাদের মধ্যে একজনও কি আধ্যাত্মিক শক্তিসম্পন্ন ছিলেন না? আমি বিশ্বাস করি না। বৃন্দাবনে পঞ্চাশ হাজার বৈষ্ণবকে হত্যা করা হয়েছিল। তাদের কেউই ঠিকমতাে জপকীর্তন করেনি, তিলকসেবা করেনি, একথাও ঠিক নয়। সাতশাে বছর ধরে আমাদের দেবদেবী, মন্দির, সমাজ আক্রান্ত হয়েছে, আমরা কিছুই করতে পারিনি। সারাদেশে ধর্মচর্চা, আধ্যাত্মিক চর্চা কিন্তু অব্যাহত ছিল। তবু পারলাম না। কারণ লড়াইটা
দর্পণে মুখােমুখি
১৮ হ’ল বাস্তবের সঙ্গে কল্পনার। কল্পনার সঙ্গে কল্পনার লড়াই হলে, মিথ্যের সঙ্গে মিথ্যের লড়াই হলে আমরা অবশ্যই জিতে যেতাম। এমন লীলার অবতারণা করতাম যে সবাই চুপ মেরে যেত। মিথ্যেতে আমাদের সঙ্গে কেউ কোনদিন পেরে ওঠেনি, এখনও পারে না। আজও আমরা দুর্নীতি এবং ভেজালে সারা পৃথিবীকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারি। এগুলি কোন আকস্মিক ঘটনা নয়, দীর্ঘদিনের আত্মপ্রবঞ্চনা আর মিথ্যার বাইপ্রােডাক্ট। সেদিনও আমরা পরাজয়ের কারণ অনুসন্ধান করে শক্তি সংগ্রহে মনযােগ দিইনি, জাতিকে সংগঠিত করিনি। পালিয়ে নিরাপদ দূরত্বে বসে গ্রহের অবস্থান নিয়ে গবেষণা করেছি। শাস্ত্র নিয়ে চুলচেরা তর্ক করে পাণ্ডিত্যের ফোয়ারা ছুটিয়ে দিয়েছি। এসবে নিজেদের ভক্ত এবং পণ্ডিত প্রমাণ করা যায়, আত্মরক্ষা করা যায় না। অস্ত্রের কাছে, শক্তির কাছে এই ভক্তি, ধর্ম, পাণ্ডিত্যের কোন মূল্য নেই। মার খেয়েও এটা আমরা বুঝতে পারছি না। কারণ, অবাস্তব কল্পনার জগতে আমরা বাস করতে অভ্যস্ত।
ভাবনাচিন্তা-কাজকর্মে আমরা প্র্যাকটিক্যাল নই। প্র্যাকটিক্যাল হলে আমরা বুঝতে পারতাম, পৃথিবীতে মৃত্যুর মত সত্য একটাই তা হচ্ছে শক্তি। সত্যের সঙ্গে শক্তি যুক্ত না হলে সে সত্য মূল্যহীন, মৰ্য্যাদাহীন, করুণার যােগ্য। এই সরল সত্যটা আমাদের বুঝতে হবে, আমাদের অসাড় চৈতন্যে প্রশ্ন জাগাতে হবে,-শিষ্ট, বিশ্বামিত্র অপেক্ষা কি আমরা বেশী আধ্যাত্মিক শক্তিধর, না অধিকতর ভক্তিমান ভক্ত? অতবড় তপস্বী হয়েও এঁরা নিজেদের আশ্রম রক্ষা করতে পারতেন না। রাক্ষসেরা যজ্ঞ অপবিত্র করলে, আশ্রম লুঠ করলে এঁরা ছুটে যেতেন রাম লক্ষ্মণের কাছে। তাদের কাছে শক্তি ছিল বলে। দরিদ্রের বড়লােকি কথা, হাবভাব যেমন মনকে চোখ ঠারা, দুর্বলের অধ্যাত্মচর্চাও তেমনি হাস্যকর। শুনতে কষ্ট হলেও এটা ঐতিহাসিক সত্য, হাজার হাজার বছর ধরে ঘরে, পরে আমরা এই প্রবঞ্চনা করে চলেছি। শক, হুন, পাঠান, মােগল যার যখন খুশী আমাদের আক্রমণ করেছে, দখল করেছে, যার যা ইচ্ছে তাই করেছে। খরগােস শিকারে শিকারীর যেমন কোন ঝুকি থাকে না, শিকার নিজেই প্রাণভয়ে ছুটোছুটি করে তারপর মরে। বিদেশী আক্রমণকারীদের চোখে আমরা ছিলাম তাই।
দর্পণে মুখখামুখি
কোন বাদশা ভাবেনি, হিন্দুদের প্রচণ্ড ভগবৎশক্তি, আধ্যাত্মিক শক্তি, অতএব ভীষণ বিপদের সম্ভাবনা আছে প্রতি মুহূর্তে, দরকার নেই আক্রমণের। বরং তারা আধ্যাত্মিক কেন্দ্রগুলােকেই আক্রমণ করে, ধ্বংস করে স্বজাতির কাছে প্রমাণ করে দিয়েছে হিন্দুর দেবদেবী এবং ধর্মের কোন শক্তিই নেই। পরবর্তীরা আরও উৎসাহ নিয়ে আমাদের ধর্মস্থানকে আক্রমণ করেছে। ভগবৎ শক্তিসম্পন্ন কোন ব্যক্তির কাছ থেকে তারা প্রতিরােধের সম্মুখীন হয়নি। স্বাভিমানী দেশপ্রেমী ক্ষাত্রশক্তির কাছে তারা বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। বাকীরা পালিয়ে আত্মরক্ষা করেছে। তারপর আত্মপ্রসাদের সঙ্গে গল্প করেছে এবং এখনও করে, এত অত্যাচারের পরও আমরা টিকেতে রয়েছি।
পদাঘাত, পলায়ন, আত্মীয় হারানাে, দেশ হারানাের বেদনা তার মধ্যে একটুও অপমান, যন্ত্রণার সৃষ্টি করে না। অস্তিত্ব রক্ষাকেই সে পরম প্রাপ্তি বলে মনে করে। কাপুরুষ, দুর্বলদের ভাবনাচিন্তার ধরণটাই এইরকম হয়। অত্যাচারী, আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ, প্রতিশােধের কথা সে ভাবতেও পারে না। অত্যাচারীদের মধ্যেই সে তখন ভালমন্দ খুঁজে নেয়। ইতিহাসে না পেলে নাটকে ভালমানুষ বানিয়ে নেয়। হিন্দুসমাজের সবচেয়ে সর্বনাশ সাধনকারী চরিত্রহীন, যিনি মেয়েদের জন্য নির্দিষ্ট মীনা বাজারে মেয়ে সেজে নারী সংগ্রহ করতে গিয়ে রাজপুতানীর কংকনের আঘাতে আহত হন, সেই আকবরকে এরাই মহান আখ্যা দেয়।
আজীবন হিন্দুবিদ্বেষী, অসংখ্য হিন্দুমন্দির ধ্বংসকারী, ভ্রাতৃহত্যাকারী, বাবাকে নির্দয়ভাবে যে বন্দী করে রাখে, শুধুমাত্র সিংহাসন লােভে, সেই পাষণ্ড আওরঙ্গজেব সম্পর্কে লেখা হয় তিনি অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ মুসলমান ছিলেন। এই দেশে শতকরা সাতানব্বই জন মুসলমান পাকিস্তানের পক্ষে ভােট দিয়েছে, অর্ধেক ভারত পাকিস্তান করেছে। বাকীটা পাকিস্তান করার জন্য প্রকাশ্যে চক্রান্ত চালিয়ে যাচ্ছে। তবু একদল মানুষ প্রশ্ন তােলেন, সব মুসলমান খারাপ নাকি! ইতিহাসে মুসলিম নির্মমতা, পাকিস্তানে হিন্দুহত্যা, হিন্দু বিতাড়ন কিংবা ভারতে কোন মুসলমানদের কোন অন্যায় আব্দারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করতে একজন মুসলমানকেও দেখা যায়নি।
এপর থেকে পড়ুন……………….
প্রথম পর্ব……………………
এটি এতটি ধারাবাহিক পোস্ট, পরবর্তী পোস্টটি পেতে আমাদের সাইটে চোখ রাখুন।
লেখক, ডাঃ শিবপ্রসাদ রায়