যে জাতি দুর্বলতাকে চাপা দেয় শাস্ত্র দিয়ে, ভগবান দিয়ে,সে জাতি কখনো দাসত্ব থেকে মুক্তি পায় না।

পূর্ববঙ্গের সব হারানাে হিন্দুদের অনেককেই বলতে শুনেছি, মুসলমানেরা আমাদের ওপর এত অত্যাচার শুধু শুধু করেছে নাকি? নিশ্চয়ই আমাদের কোন অপরাধ ছিল। এ জন্মের না হলে পূর্বজন্মের কোন পাপ ছিল। দুর্বলতাই পাপ, স্বার্থপরতাই পাপ, কাপুরুষতাই পাপ, সংগঠনহীনতাই পাপ, স্বার্থপরতাই পাপ, আত্মকেন্দ্রিকতাই পাপ, একথাটা সে কিছুতেই বুঝবে না। 

প্রথম পর্ব ………….. উন্মুখ জাতি আজ দর্পনে মুখোমুখি শিথিল নড়বড়ে আত্মসমর্পণ।
দ্বীতিয় পর্ব ………….সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নামে বজ্জাতি, জাতি আজ দর্পনে মুখোমুখি।

| দাসজাতি, দুর্বল জাতির দৃষ্টিভঙ্গী ঠিক এইরকম হয়। সে প্রকৃত সত্য দেখতেই পায় না। দুর্বল জাতির জ্যোতিষী পণ্ডিত শাস্ত্রজ্ঞরাও সেইরকমই হয়। গ্রহ নক্ষত্রের সমাবেশ পরাজয়ের অনুকলে দেখতে পায়। মুসলমানদের আস্ফালন দেখলে এই পণ্ডিতেরাই বলে, এতাে হবেই। শাস্ত্রেই আছে, “কলি শেষে একবর্ণ হইবে যবন।” এসব কথা কোন শাস্ত্রে নেই, তবু বলে। চীনা আক্রমণের সময় কতজনকে বলতে শুনেছি, “পীতবর্ণ রাজা হবে এ তত শাস্ত্রবচন।” অর্থাৎ বিদেশী আক্রমণের পটভূমিটাকে এরা সহনযােগ্য করে দেয়। নিজেদের দুর্বলতাকে চাপা দেয় শাস্ত্র দিয়ে, ভগবান দিয়ে। এই মানসিকতা আমাদের গােটা জাতির আত্মবিশ্বাস, মেরুদণ্ড চূর্ণ করে দিয়েছে, দিচ্ছে। এইরকম ললাকেদের বাড়ী একদল ডাকাত পড়ুক, সর্বস্ব লুণ্ঠন করে নিয়ে যাক, পরিবারের সকলকে হত্যা করুক, শুধু একজনের দুটো হাত কেটে নিয়ে একটা চোখ তুলে নিয়ে প্রাণে বাঁচিয়ে রাখুক। সর্ব লুণ্ঠন, সকলের নৃশংস হত্যা, নিজের হাত কাটা, চোখ ভােলার জন্য তার রাগ, ঘৃণা, আক্রোশ কিছু হবে না। তার প্রাণে বাঁচানাের জন্যই সে ডাকতটাকে পরম দয়ালু মনে করবে। ডাকাতের করুশাকে সে গুরুর কৃপা, ঈশ্বরের ইচ্ছা বলে মনে করবে। বলবে, ভগবান আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। ডাকাতটা ইচ্ছা করলেই তাে আমাকে মেরে ফেলতে পারত। ডাকাতের ইচ্ছেটাই তার কাছে ভগবানের ইচ্ছা বলে মনে হবে। দুর্বল, মিথ্যেবাদী মানুষের এটাই জীবনদর্শন। রবিবারে মুসুরীর ডাল খেতে আছে কি নেই, মাছে পেঁয়াজ না দিয়ে রাঁধলেই নিরামিষ, এই নিয়ে কত পণ্ডিতকে তুমুল ঝগড়া করতে দেখেছি। কল্পনা করতে পারি এদের পূর্বপুরুষেরা আরাে ছােটোখাটো বিষয় নিয়ে দিনের পর দিন ঝগড়া করেছে, তর্ক করেছে। একাদশীতে কেন কলমি শাক খেতে নেই, কিংবা হাততালি দিয়ে কেন তুলসী তুলতে হয়, এইসব তুচ্ছ বিষয়। পাঠানেরা এসে দুপক্ষকেই পিটিয়ে 

মুসলমান করে নিয়েছে। তারপর তাদের আর নামাজ পড়তে গরু খেতে শাস্ত্র বাধা হয়নি। পাঁজি, পুঁথি, চুলচেরা তর্কও ঘুচে গেছে। গােপাষ্টমীতে গরু খেতেও আর কোনপক্ষই আপত্তি করেনি। এই আমাদের তার্কিকতা, পাণ্ডিত্য, শূন্যগর্ভ আস্ফালন, শক্তির সামনে নতমস্তক, আত্মসমর্পিত। শক্তির কাছে সব শাস্ত্র মিথ্যা, অর্থহীন হয়ে গেল। তবু আমরা এই মিথ্যে পরিত্যাগ করতে পারছি না। এরই ফলশ্রুতিরূপে ব্যক্তিজীবন, রাষ্ট্রজীবন ডুবে আছে গভীর নৈরাশ্যের উজ্জ্বল অন্ধকারে। নিজেদের সৃষ্ট মধুর মিথ্যের সমুদ্রে আরও ডুবে আছি। 

মিথ্যে আমাদের কিভাবে প্রভাবিত করেছে তার প্রমাণ এদেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের জীবনী শুধুই প্রশংসা এবং গুণকীৰ্ত্তন। পুরাে মানুষটাকে কিছুতেই খুঁজে পাওয়া যাবে না। মহাপুরুষ বলে যেন তার দোষ দুর্বলতা কিছু থাকতে নেই। তাই এদেশের কোন মানুষের জীবনীকে বায়ােগ্রাফী বলা যায় না, বলা যায় হ্যাগিওগ্রাফী। মানুষটাকে দেবতা বানাবার অপচেষ্টা। বেশী কথা কি, এদেশের বহু মানুষ একান্তে ডায়েরী লিখতে গিয়েও তারমধ্যে মিথ্যে কথা লেখে। উদ্দেশ্য, বহুদিন পরে এই ডায়েরী যদি কেউ পড়ে সে যেন আমাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে। আধ্যাত্মিকতা আর ভক্তির নামে আমরা মিথ্যের শেষ ডিগ্রীতে নেমে এসেছি। প্রশ্ন জাগতে পারে হাজার হাজার বছর ধরে এত মিথ্যে বিনা বাধায় চলে আসছে। কি করে? উত্তর আগেই দিয়েছি, আমরা মিথ্যে ভালবাসি বলে। একটা স্কুল উদাহরণ দিই। অনেক অভিনেতা রামকৃষ্ণ সেজে মঞ্চে দাঁড়িয়ে টাকা মাটি, মাটি টাকা বলে দুটোই ফেলে দিয়ে হাততালি নিচ্ছেন, আর গ্রীনরুমে গিয়ে বলছেন—কই টাকা দাও। বিবেকানন্দ সেজে স্টেজে ভবতারিণীর সামনে বলছে, টাকাপয়সা, ধনদৌলত কিছু চাইনা , আমায় জ্ঞান দাও, বৈরাগ্য দাও, শ্রদ্ধাভক্তি দাও। সাজঘরে গিয়ে বলছে, সব টাকা মিটিয়ে দাও, নইলে যাত্রা হবে না। এ নাটক চলছে না হাজার রজনী ধরে? তেমনি চলছে আমাদেরও। ধর্মের নামে ভক্তির নামে স্ববিরােধিতা, মানে নিজের সঙ্গে নিজেরই চলছে লুকোচুরি খেলা। তবু ঘুরে ফিরে প্রশ্ন আসবেই। আধ্যাত্মিকতার কি কোন মূল্য নেই, নেই কোন প্রয়ােজনীয়তা ? নিশ্চয়ই আছে। ফরাসী ভারততত্ত্ববিদ, রামকৃষ্ণভক্ত, নােবেল 

২২ 

পুরস্কারপ্রাপ্ত মনীষী রােমা রোঁলা বড় সুন্দর ভাষায় এর উত্তর দিয়েছেন। তিনি বলেছেন ঈশ্বর অনুভূতি, আধ্যাত্মিকতা হচ্ছে একটা উচ্চভাব, ডিভাইন ড্রিম-দিব্যস্বপ্ন। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে স্বপ্ন দিয়ে মানুষের কি কল্যাণ হবে? হয় স্বপ্নেও কল্যাণ হয়। ধরা যাক একটা মােটামুটি ভদ্ৰব্যক্তি দু রাত্রে দুটি স্বপ্ন দেখলল। একদিন দেখলাে সে রবীন্দ্রনাথ বিবেকানন্দ বিদ্যাসাগরের সঙ্গে গল্প করছে, রামকৃষ্ণের পা টিপে দিচ্ছে, বিদ্যাসাগরের তামাক সেজে দিচ্ছে। নানান উচ্চ বিষয়ে আলােচনা শুনছে। ঘুম ভেঙ্গে গেল। মিথ্যে স্বপ্ন মাত্র। দ্বিতীয় দিন স্বপ্ন দেখলাে পতিতালয়ের একটি নর্দমায় মদ্য পান করে সে পড়ে আছে। এও স্বপ্ন, মিথ্যে, তবু মুহূর্তে কলুষিত হয়ে যাবে মনটা। নিজের প্রতি একটা ঘৃণার উদ্রেক হবে। এ জন্যও উচ্চভাব দিব্যস্বপ্ন দরকার। এসব শুধু ব্যক্তির ক্ষেত্রে ভাবের ক্ষেত্রে সত্য। সমাজে, বাস্তবে এর কোন উপযােগিতা নেই। পকেটে লক্ষ টাকা আছে মনে করে আনন্দে বিভোের হয়ে ঘুরে বেড়ানাে যেতে পারে, গল্প করা যেতে পারে। কিছু মূল্যবান জিনিষ কিনতে গেলেই স্বপ্ন শেষ। আমদেরও ঠিক তাই। যেখানে যুদ্ধ প্রতিযােগিতা সংগ্রাম, সেখানে আমাদের চিত্র বড়ই করুণ। সে ৭০০ বছরের ইতিহাসই হােক কিংবা আজকের খেলাধুলার জগতই হােক। অপমান লজ্জা আর পরাজয় ছাড়া সেখানে আর কোন সঞ্চয় আমাদের নেই। এগুলাে উচ্চভাব দিবাস্বপ্ন লীলার অবতারণা আর কীর্তনে অর্জিত হয় না। কল্পনায় কিন্তু এগুলােকেই জীবন বলে মনে করি। কল্পনাকে সত্য মনে করে আঁকড়ে ধরার দীর্ঘকালীন অভ্যাস থেকেই করি। রামকৃষ্ণ মা মা করলে তার গুরু তােতাপুরী ভীষণ রেগে যেতেন। বলতেন, সত্যের, ব্রহ্মের, ঈশ্বরের এইরকম মা-মাসী হয় না। এসব তােদের ভারে মা, কল্পনার মা। সত্যিকারের কোন অস্তিত্ব নেই। রামকৃষ্ণ তার নিজস্ব ভঙ্গীতে বলতেন, এই তত মা চলে গেল, পালিয়ে গেল। একদিন তােতাপুরী ক্রদ্ধ হয়ে ভাঙা বােতলের কাঁচ দিয়ে রামকৃষ্ণের কপালটা কেটে দিলেন, রামকৃষ্ণ জলে গেল বলে চীকার করতেই তােতাপুরী বললেন, কই তাের মা কই, মাকে ডাক। রামকৃষ্ণ বললেন কৈ মাকে আমি দেখতে পাচ্ছি না। তােতাপুরী বললেন, তাহলে বুঝতে পারছিস, ওটা 

তাের কল্পনার মা, ভাবের মা। বাস্তবে এরকম হয় না। তারপর ধ্যানযােগে আত্মস্থ হয়ে রামকৃষ্ণ যথার্থ রামকৃষ্ণ হলেন। এরপর থেকে তিনি আর বিশেষ মা, মা করেননি। তার প্রিয় শিষ্য বিবেকানন্দ জীবনেও মা বলেননি। বলেছেন সব দেবতাকে তুলে রেখে ভারতমায়ের পুজো কর। অর্থাৎ দেশ-সমাজ-রাষ্ট্র, যা বাস্তব। আমরা কিন্তু রামকৃষ্ণের ‘মা’ ‘মা’ অংশটাই গ্রহণ করলাম। আর স্বামীজির কথায় কর্ণপাত করলাম না। কারণ বাস্তবতা আমাদের অস্বস্তি দেয় আর কল্পনা আমাদের বড় প্রিয় বস্তু। 

জগদীশ চন্দ্র বসু বৈজ্ঞানিক মানুষ, বাস্তব জগতের মানুষ, অঙ্কের জগতের মানুষ। তিনিও কত অবাস্তব জগতের অধিবাসী ছিলেন ভাবতে কষ্ট হয়। লণ্ডনে থাকার সময় টেলিফোন কোম্পানী নামে একটি সংস্থার প্রতিনিধি তার সঙ্গে দেখা করে। বলে আপনি বেতারের যেটুকু আবিষ্কার করেছেন তার পেটেন্ট আমাদের বিক্রী করে দিন, যত টাকা লাগে আমরা দিচ্ছি, আপনি বেতার সম্পূর্ণ করুন। কি সুন্দর প্রস্তাব। এই প্রস্তাব গ্রহণ করলে মানবসভ্যতার ইতিহাসে ভারতের একটা অক্ষয় অবদান থাকত। বেতারের আবিষ্কর্তারূপে জগদীশ চন্দ্র বসুর নাম অমর হয়ে থাকত। লক্ষ লক্ষ টাকা পেতেন যা দিয়ে অন্যান্য বিষয়ে গবেষণা করতে পারতেন। কত রকমের কল্যাণকর্ম করতে পারতেন। কিন্তু জগদীশ বসু কি করলেন? রাত জেগে রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লিখলেন ঃ গুরুদেব এরা আমাকে টাকার লােভ দেখায়, এতবড় স্পর্ধা ওদের, আমি কি বেনিয়া, ব্যবসা করতে এসেছি। আমিও দিয়েছি তাড়িয়ে। প্রায় এরকম ভাষায়। টেলিফোন কোম্পানী বাস্তব জগতে বাস করে। তারা ব্যবসা করতে চায়, চলে গেল মার্কনীর কাছে। যদিও মার্কনী জগদীশ বসুর তুলনায় অনেক পিছিয়ে ছিলেন। প্রস্তাব লুফে নিলেন তিনি। মানবসভ্যতার ইতিহাসে মার্কনীর নাম চিরস্থায়ী হয়ে রইল রেডিওর আবিষ্কর্তারূপে। আখের গােছানাে রইল চার চোদ্দং ছাপান্ন পুরুষের। তারপর জগদীশ বসু কি করলেন? বাড়ীতে প্রচুর পুরনাে ক্যানেস্তারা টিন কিনে নিয়ে এলেন। পুরনাে টিন মুড়ে দিলে তার প্রাণে যন্ত্রণা হয় কিনা পরীক্ষা চালালেন। পরীক্ষা চালালেন গাছের প্রাণ আছে কিনা। জগদীশ চন্দ্র বসু আমাদের গৌরব। 

তাকে নিয়ে বাঙ্গ কটাক্ষ আমার উদ্দেশ্য নয়। শুধু দেখাতে চাইছি যেহেতু আমাদের চরিত্রে কল্পনার আধিক্য, তাই বিজ্ঞানীরাও বেশীদিন বাস্তব জগতে থাকতে পারেন 

। মানুষের প্রয়ােজনে লাগে কল্যাণ হয় এমন বহু জিনিষ তিনি আবিষ্কার করতে পারতেন। পাশ্চাত্যে বিজ্ঞানীরা যা করেছেন। তা না করে তিনি ভাগীরথীর উৎস সন্ধানে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। নদী তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ। মহাদেবে জটা হইতে। যা মানুষের কোন কাজে লাগে না। কাজের চেয়ে ভাব আমাদের প্রিয়, সত্যের চেয়ে মিথ্যা, বাস্তবের চেয়ে কল্পনা। জগদীশ বসু গাছের প্রাণ আবিষ্কার না করে যদি বৃহদাকার লাউ কুমড়াে অথবা বেগুন সৃষ্টির চেষ্টা করতেন, এই ক্ষুধাতুর দেশে কত মানুষের উপকার হত, তা তিনি করলেন না। কারণ, কল্পনা আমাদের ঐতিহ্য। ছাড়তে বড় মায়া। বলতে লজ্জা হলেও একথা সত্যি আজ যে আমরা খাদ্যে স্বয়ম্ভর, অন্য দেশে চাল রপ্তানী করি, চিরকালের দরিদ্র চাষীরাও আজ দু’পয়সার মুখ দেখছে, এইসব চালের স্পেসিস এসেছে চীন জাপান কোরিয়া থেকে। এতে আমাদের কোন অবদান নেই। আধুনিক পদ্ধতির কৃষিকর্ম এও আমাদের নিজস্ব নয়। আমরা যে ফ্যান চালাই, আলাে জ্বালাই, রেডিও শুনি, টিভি দেখি, সিনেমা দেখি, ভিডিও, টেপ রেকর্ডার, ক্যামেরা ব্যবহার করি, পেনিসিলিন, টেট্রাসাইক্লিন, চিনি, এর একটাও আমাদের সৃষ্ট নয়। যেসব দেশে ভগবান কখনাে লীলা করতে যাননি, যেখানে তেত্রিশ কোটী দেবতা নেই, ভক্তির জোয়ার নেই, তাদের অবদান। মানবসভ্যতার ইতিহাসে মানুষের নিত্য প্রয়ােজনে। লাগে এমন কিছুই আমরা দিতে পারিনি, শুধু নিয়েছি। ভাবখানা আমাদের কিন্তু এমনই যেন জগত আমাদের ইচ্ছাতেই চলছে, কল্পনাবিলাসী মানুষেরা এভাবেই চিন্তা করে। ভগবানকে আমরা অন্তর্যামী বলি। আন্দাজে বলি। কিন্তু কুঁড়েরা সর্বান্তর্যামী হয় এটা আমরা দেখতে পাই। অলস প্রকৃতির একজন ব্যক্তিকে বলুন কাছাকাছি কোন দোকান থেকে কিছু কিনে আনতে, সে সঙ্গে সঙ্গে বলবে দোকান বন্ধ। আমাদেরও ঠিক তাই। নিজেদের চরিত্রের অসঙ্গতি দুর্বলতা লক্ষ্য করে চারিদিকে অন্ধকার দেখে অতীতের গহ্বর থেকে খুঁজে নিই মিথ্যে স্বর্ণময় ঐতিহ্য। ‘আমাদের সবই ছিল’ ভাবনায় ঝুঁদ হয়ে গােটা জাত আরাে নিষ্ক্রিয় হয়। সে 

গীতায় টেলিভিশন দেখতে পায়, নারদের পেঁকিকে রকেটের সঙ্গে তুলনা করে আনন্দিত হয়, মহাভারতে আণবিক বােমা, রামায়ণে বিমান দ্যাখে। জয়ন্তবিষ্ণু নার্লিকার প্রখ্যাত বৈজ্ঞানিক, ভারতের ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তিনি বলেছেন “এসব তৈরীর কৌশল কোন শাস্ত্রে নেই, বিমান শাস্ত্রে বিমানপােত বিষয়ে কোন কথা নেই। বৈজ্ঞানিকেরা বললে কি হবে, আমরা মিথ্যে গল্প চালিয়ে যেতে ছাড়ব না।। 

যদি এতই আমাদের ছিল তাহলে আমরা জগতকে দিলাম কি? শুধু কিছু গ্রন্থ দিয়েছি, আর যুগ যুগ ধরে দিয়ে চলেছি রাশি রাশি উপদেশ-অলস কল্পনা যা সৃষ্টি করতে পারে। ইওরােপ আমেরিকা জাপান বাস্তব জগতে থাকে। তাই তারা দুধে, মাখনে, মাংসে, প্রাচুর্যে ভাসছে, শিক্ষায়-স্বাস্থ্যে-সৌন্দর্য্যে হাসছে। আমরা রােগে, শােকে, অশিক্ষায়, দারিদ্র, অজ্ঞতায়, ভণ্ডামিতে আর ভক্তিরসে ডুবে আছি। কারণ, অবাস্তব কল্পনা আমাদের জীবন। এদেশে এখন সাধু, গুরু, পণ্ডিত, পাণ্ডাদের সংখ্যা আটান্ন লক্ষ, এরা বেশীরভাগ খায় দুধ, ঘি, ফল, সন্দেশ। মলমূত্র ছাড়া কিছু ত্যাগ করেন না, আর দানের মধ্যে করেন শুধু উপদেশ। এর সঙ্গে অলৌকিক গালগপ্প আর ভাষার প্যাচ কষে সবকথার বিচিত্র ব্যাখ্যা। এই খরচে আমরা আটান্ন লক্ষ দেশী গুরুর বদলে যদি বিদেশী গরু পুষতাম এদেশের দুগ্ধাভাব মিটে যেত, খুঁটের সমস্যা থাকত না। এগুলাে রেগে যাবার মত কথা, কিন্তু বড় নির্মম সত্যকথা। গরুকে আমরা মা বলি, ভগবতী বলে পূজো করি। এদেশে অসংখ্য ভগবতী আছে নিংড়ে দুধ পাই আধকেজি। আর যারা গরু খায় পূজো করে না, তাদের গরু তিয়াত্তর কেজি পর্যন্ত দুধ দেয়। আমরা তাে দুধ চাই না, আমরা গল্প চাই, কল্পনা চাই। সাধুগুরুরা এসব ভালাে দিতে পারেন। অতিন্দ্রীয় অনুভূতি জ্যোতির্ময় আলাে আর কত কি! এই গল্প দিয়ে আমরা দেশের মানুষের মধ্যে উৎসাহ কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারিনি, দেশের দারিদ্র ঘােচাতে পারিনি। সমগ্র দেশ আমার মাতৃভূমি এই চেতনা সৃষ্টি করতে পারিনি। চরিত্রবান, নিঃস্বার্থবুদ্ধি, নির্ভীক মানুষ তৈরী করতে পারিনি। কোন বিদেশী আক্রমণ প্রতিরােধ করতে পারিনি। আক্রমণকারীরা অত্যাচারের স্টীম 

রােলার চালিয়েছে। আমরা জপ করেছি, কীর্তন করেছি, পালিয়েছি আর মিথ্যের পাহাড় রচনা করেছি। মা-বােন-স্ত্রীকে রক্ষা করতে পারিনি। তাদের ফেলে আগেই পালিয়ে গিয়েছি। দু’একজনকে পেয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে শাস্ত্র বার করেছি, পণ্ডিত ডেকে এনেছি বিচার বসিয়েছি। তারপর পাঁজিপুঁথি খুলে সিদ্ধান্তে এসেছি, ওরা আমাদের মা-বােন হলেও ওদের ঘরে নেওয়া চলবে না। কারণ, বিধর্মীরা ওদের স্পর্শ করেছে। চোখের জল ফেলতে ফেলতে আর এই ক্লীব সমাজকে অভিসম্পাত দিতে দিতে তারা চলে গেছে অন্য সমাজে। | সংঘাতের মুখােমুখি হলেই আমরা একেবারে দিগম্বর হয়ে গেছি, সঙ্গে সঙ্গে মিথ্যের চাদর চাপা দিয়ে বলেছি সবই গােবিন্দের ইচ্ছা! এই আমাদের ধর্ম, ভক্তি, আমাদের জীবন। মন্দিরে কম পূজো দেওয়া হয় না অলিম্পিকে একটি পদক পাওয়ার জন্য। অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারা, পলকে প্রলয় করতে পারা সাধু গুরু নাকি অনেক আছেন এই দেশে। দায়িত্ব নিন না, বেশী নয় একটা গুরু একটি স্বর্ণপদক পাইয়ে দেবেন। বহু জীবন্ত ভগবান ছিলেন পূর্ববঙ্গে। কেউ মাটিকে সন্দেশ বানিয়ে দিতেন, কেউ মরা মানুষ বাঁচিয়ে দিতেন, কেউ শৈশবে হাত নেড়ে ঝড় থামিয়ে দিতেন। পাকিস্তান হওয়া মাত্র তাদের সব বুজরুকি শেষ। ঝড় থামানাে মরা বাঁচানাে পড়ে রইল, নিজের প্রাণটুকু হাতে নিয়ে পালিয়ে আসতে পথ পেলেন না। তবু তাদের বাজার খারাপ হয়নি। কারণ আমরা মিথ্যে ভালবাসি, ভণ্ডামি ভালবাসি। আমাদের কারাে মনে প্রশ্নই জাগে না যে গুরুবা নিজের দেশে টিকতে পারে না, প্রাণ বাঁচাতে অন্যত্র পালায়, তাদের সত্যিকারের ক্ষমতা কতটুকু? ভূপালে কতবড় দুর্ঘটনা ঘটে গেল। হাজার হাজার জাতক মারা গেল অসহায়ভাবে। ত্রিকালদর্শী সাধু এবং ভবিষ্যতদ্রষ্টা জ্যোতিষসম্রাট এদেশের পথে ঘাটে। এদের সব শক্তি নিয়েও কেউ বলতে পারেননি ভূপালে একটা দারুণ দুর্যোগ আসছে, তােমরা সব সাবধান হও এদের প্রতিই আমরা নির্ভরশীল। কারণ কপটে কপটে আমরা ধূল পরিমাণ। শিষ্যরা নিজেদের ভালাে করেই চেনে এবং এইসব সাধুগুরুদের জানে, তাই কোন অসুবিধে হয় না। তিনজন ভগবতুল্য গুরুর কথা বলি, তিনজনই সাধুদের ভাষার অপ্রকট অর্থাৎ মারা গেছেন। প্রথমজন 

সাধনায় সিদ্ধি লাভ করে দুটি স্পিরিট অর্থাৎ আত্মা সংগ্রহ করলেন, যারা দুটি বিশমনি পাথর মাথায় করে নিয়ে গুরুর সঙ্গে সর্বত্র ঘুরে বেড়াবে। সারাজীবন অদৃশ্য থেকে শূন্যে পাথর নিয়ে তারা ঘুরে বেড়ালাে। কার কি লাভ হল জানি , শিষ্যদের চোখে ইনি দারুণ শক্তিমান, চোখে না দেখেও একথা শিষ্যরা বিশ্বাস করে। তখন বৃটিশ আমল, এই পাথর ছুঁড়ে যদি দুটো লাটসাহেবকে মারার ব্যবস্থা করতেন এই সাধু, তাহলে এত কাঠখড় পুড়িয়ে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলন করতে হত না। উড়ন্ত বিশমনি পাথর দেখেই বৃটিশ পালিয়ে যেত। এইসব অর্থহীন গালগল্প লেখা হয়, ছাপা হয়। আমাদের এগুলাে বলতে এবং শুনতে ভাল লাগে। দ্বিতীয় গুরুর দেহান্ত হয়েছে বছর পঁচিশ। হাঁটুতে প্রচণ্ড বাত। সাধারণ পায়খানায় বসতে পারতেন না। একটি কমােড়ে পায়খানা করতেন। অনেকদিন ব্যবহারের ফলে সেটি একটু ভেঙেচুড়ে গিয়েছিল। একজন শিষ্য একটি নতুন কমােড় কিনে দিয়ে গেল। দু’একদিন পরে মিস্ত্রী এসে পুরনোেটা পাল্টে নতুনটা ফিট করে দিয়ে যাবে, একদিন রাত্রে পুরনাে কমােডটি বিশুদ্ধ বাংলায় গুরুদেবকে বলছে, প্রভু এতদিন আপনার সেবা করে এলাম আর আমাকে আপনি বিনাদোষে ত্যাগ করছেন? গুরুদেব নির্দেশ দিলেন কমােড পরিবর্তনের কোন প্রয়ােজন নেই। এই কাহিনী শুনিয়ে শিষ্যরা বলেন ? তাহলে বুঝতে পারছেন চৈতনাময় ব্যক্তির স্পর্শে জড়বস্তুও চৈতন্যময় হয়ে যেতে পারে। এইসব শিষ্যদের ভক্তি এত বেশী যে যুক্তি দিয়ে কোন ঘটনার বিশ্লেষণ এরা করতে পারে না। নইলে এদের মনে হত সারাদেশ আজ অচৈতন্য, মানুষের মধ্যে চৈতন্য সৃষ্টি 

করে যে গুরু পায়খানাকে চৈতন্যময় করেন, সত্যিই এদেশে এরকম গুরুর আদৌ প্রয়ােজন আছে কি? বাতে অসাড় হয়ে যাওয়া হাঁটু দুটিতে চেতনার সঞ্চার করলে পুরাে সমস্যাটারই সমাধান হয়ে যায় একথাও ভক্তদের মনে হবে না। গুরু করুন আর না করুন একথা ফলাও করে বলার মত ভক্তশিষ্য এদেশে যথেষ্ট রয়েছে। বলার পর তার মনে হয় এগুলাে মিথ্যে নয় সত্যি বলছি। তৃতীয় সাধু একদিন সন্ধ্যায় জপ করতে করতে ‘হেই হেই’ করে চিৎকার করে উঠলেন। শিষ্যরা ছুটে এসে জিগ্যেস করলাে কী হয়েছে বাবা? সাধু বললেন, না কিছু 

নয়, বিপদ কেটে গেছে। বৃন্দাবনে কৃষ্ণের মন্দিরে ছাগল ঢুকে পুইগাছ খাচ্ছিল, তাড়িয়ে দিলাম। অনেকে পুইগাছ না বলে তুলসীগাছের কথা বলেন। এ ঘটনা বিবরণ দিয়ে ভক্তের গদগদ জিজ্ঞাসা, বলুন তাে এই সাধুর কি তপঃশক্তি কি অন্তদৃষ্টি? এদেরও বিনীতভাবে বলার কেউ নেই যে, এইধরণের সাধুও এদেশে নিষ্প্রয়ােজন। এ সাধুর দেহান্ত হয়েছে শতাধিকবছর। পঞ্চাশ বছর পরে অর্ধেক ভারতবর্ষ খেয়ে নেবে বিধর্মীতে, এ সম্ভাবনা তার চোখে পড়ল না। দেশের মানুষের চরিত্র বলে কিছু থাকবে না, মানুষের মুখের ভাষা হয়ে উঠবে খিস্তি, এগুলাে কেউ বুঝতে পারলেন না। সারাজীবনের তপস্যা দিয়ে সাধনা দিয়ে ভক্তি দিয়ে বাঁচিয়ে দিয়ে গেলেন পাঁচ নয়ার পুইডাটা। 

এইসব গল্প আমরা দীর্ঘদিন ধরে করে চলেছি এবং করে যাব। অধিকাংশ সাধুগুরুকে কেন্দ্র করে আমরা এই মিথ্যে গল্প চালু রেখেছি। কারণ এই মিথ্যা আমাদের মেরুদণ্ডের মজ্জার মধ্যে মিশে আছে। এগুলাে আমাদের মনে এক ধরণের আনন্দ দেয়। কোন প্রশ্ন সন্দেহ মনের মধ্যে জাগাতে পারে না। খাইবার গিরিপথ দিয়ে মােগল, পাঠান, তুর্কিরা যখন আসছিল ভারত জয় করতে, ধ্যান যােগে দেখে ওখান থেকেই তাড়িয়ে দেবার মতাে একজনও অন্তদৃষ্টিসম্পন্ন সাধুর দেখা পাওয়া যায়নি। পালাবার সাধু দেখা গিয়েছিল অনেক। ইংরেজ যখন জাহাজে করে আসছিল ব্যবসার নামে দেশ দখল করতে, কেউ বুঝতে পারেননি। স্বাধীন খণ্ডিত ভারতে চীন, পাকিস্তান যখন আক্রমণ করল তখন যােগবলে সীমান্ত থেকেই তাদের তাড়িয়ে দেবার মত একজনেরও কথা শােনা যায়নি। যত কাহিনী নির্বোধ শিষ্যদের কাছেই। আমাদের দেশের অধিকাংশ সাধুসন্তের অন্তদৃষ্টি তপঃশক্তি অলৌকিকতা সমাজের রাষ্ট্রের কোন কল্যাণে লাগে না। শুধু ভক্তদের মুগ্ধ করার জন্য আর শিষ্য সংখ্যা বৃদ্ধি করার জন্য গল্প আর বিজ্ঞাপন হিসাবে ব্যবহৃত হয়। 

এর পর থেকে —–দুর্বলকে কেউ শ্রদ্ধা করে না, হয় করুণা নয় ঘৃণা করে। দুর্বলতা কাপুরুষতা পাপ।

প্রথম পর্ব ……………