ভারত-চীন সীমান্ত বিবাদ, তার পিছনের আসল কারণ আর সম্ভাব্য পরিণাম এবং তার কূটনৈতিক বিশ্লেষণ।।

ভারত-চীন সীমান্ত বিবাদ, তার পিছনের আসল কারণ আর সম্ভাব্য পরিণাম এবং তার কূটনৈতিক বিশ্লেষণ।।সাম্প্রতিক সময়ে ভারত-চীন  বিবাদ সারা বিশ্বের নজর  কেড়েছে। ধারণা করা হচ্ছে 1965 সালের পরে ভারত-চীনের মধ্যে দ্বন্দ্ব এটাই হয়তো বা সবচাইতে বেশি। দু’দেশেই তাদের স্ব স্ব অবস্থান থেকে আক্রমনাত্মক রুপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সীমান্তে। এমন পরিস্থিতিতে দু’দেশের দেশের উচ্চ পর্যায়ে অনেকগুলো মিটিং হয়েছে। কিন্তু গত দুই মাস ধরে চলা এই সমস্যার কোনো সমাধান পাওয়া যায়নি। এই পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের মনে একটা প্রশ্ন বারবার উঁকি দিচ্ছে আসলে কি শুধু রাস্তা বানানোর কারণেই এই  বিবাদ,না এর পেছনে অন্য কোন কারণ আছে? সত্যি কথা বলতে কি এই বিবাদের পিছনে চীনের অন্য কোনো কারণ আছে। আজ এই পোস্টের মাধ্যমে সেই বিষয়গুলো তুলে ধরার চেষ্টা করব কারোব। যদি এই বিষয়ে কোন মন্তব্য থাকে অবশ্যই আমাদেরকে জানাবেন অন্যথায় কোন প্রশ্ন থাকে তাহলে একটু কষ্ট করে নেটে সার্চ দিয়ে নেবেন প্রত্যেকটা বিষয়ে আমরা বর্তমান প্রেক্ষাপট থেকে লেখার চেষ্টা করব| 

  

বর্তমান মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিশ্বের বুকেতাদের ইমেজটা তুলে ধরার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। যার ফলে বিশ্বের বুকে বর্তমানে ভারত বর্ষ একটা অন্যতম দেশ হিসেবে নিজেদেরকে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে।  এমনকি মোদি সরকার চীনের সাথে প্রায় 22 এর উপরে সংলাপ করেছে  যার উদ্দেশ্য ছিল চীনের সাথে ভারতের সম্পর্ক ভালো করা। এমন পরিস্থিতিতে আসলে চীনকে চেনা বড়  কষ্টকর। কারণ সব সময় চীন মুখে এক কথা বলেছে কাজে অন্যতা দেখিয়েছে। তার ব্যতিক্রম মোদি সরকারের আমলে  হয় নাই।  মোদি সরকার বিষয়টা ভালোভাবে  আছ করতে পেরেছে। যার ফলে মোদি সরকার তাদের বিদেশ নীতির কিছুটা পরিবর্তন করেছে  চীনের জন্য।  মূলত  চীন যে ভাষায় কথা বলছে ভারত সে ভাষায়  উত্তর দেয়ার চেষ্টা করছে। 

চীন বর্তমান করোনা কালীন পরিস্থিতিতে বিশ্বের কাছে একটা ঘাতক হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করে ফেলেছে। এর পাশাপাশি চীন দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে তার প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সুসম্পর্ক বদলে আগ্রাসন নীতি নিয়েছে সেটা কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে।  বিষয়টা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভালোভাবে কোন দেশে  নেয় নাই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরেই চীনের বিরুদ্ধে তার দক্ষিণ-পূর্ব নীতির সমালোচনা করে আসছে। সেইসাথে বর্তমান সময়ে জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ফিলিপাইন যোগ হয়েছে। চীন ইতিমধ্যে উপরে উল্লেখিত দেশগুলোর সাথে  ভূমি বিরোধে জড়িয়ে পড়েছে।

 

২০১৪ র পর থেকেই চীনের সমস্যা বেড়েছে । আর মোদী সরকার শপথ গ্রহণের দিন থেকে আজও পর্যন্ত প্রতিনিয়ত চীনকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কাউন্টার করার জন্য কাজ করে আসছে। আসলে এর কারণ হলো CPEC বা, চায়না পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর, যেটাকে আটকাবার জন্য মোদী সরকার নিরন্তর কাজ করে চলেছে। চীনের এই মাথা পাগলামির কারণ বুঝতে হলে আপনাকে কিছুটা সময় পিছনে যেতে হবে। 

সাল ২০০৫: চীন সাউথ চায়না সি, বঙ্গোপসাগর, মালাক্কা স্ট্রেট, ভারতীয় মহাসাগর থেকে আরব সাগর পর্যন্ত নিজের সৈন্য ঘাঁটি, নৌসেনা বন্দর, এয়ারপোর্ট, সার্ভাইলেন্স পয়েন্ট বানিয়ে ভারতকে মোটামুটি ঘিরে ফেলেছিল। যদিও, চীন এই পুরো ব্যাপারটাকে শুধুমাত্র বাণিজ্যের জন্যই তৈরি করছে বলে পুরো দুনিয়াকে বোঝাতো। কিন্তু এই বিষয়টা কারোর কাছ থেকে আজ আর গোপন নেই যে সেই সময় ভারত মহাসাগরে ভারতকে ঘিরে ফেলার কাজ করেছিল যাতে যুদ্ধকালীন ভারতকে বেকায়দায় ফেলা যায়। বছর বদলাল আর তার সাথে সাথেই চীনের এই রণনীতি সবার সামনে বিশেষ করে ভারতের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল।

China Pakistan Economic Corridor - CPEC an initiative of One Belt ...

সাল ২০১৪: চীন CPEC ঘোষণা করল। চায়না পাকিস্তান ইকনোমিক করিডর বালুচিস্তানের গয়াদার বন্দর থেকে শুরু করে পশ্চিমী চীনের কাশগর পর্যন্ত এই ২৫০০ কিলোমিটার লম্বা প্রজেক্ট পাক অধিকৃত কাশ্মীর গিলগিট বালতিস্তানের উপর দিয়ে যায়। তাই ভারত এই প্রকল্পকে ভারতের সম্প্রভূতা ও অখন্ডতার উপর হামলা বলে মনে করে।  2014 তে ভারতে মোদী সরকার নির্বাচিত হয়ে আসার পর এই সরকার আগের সরকারের থেকে গিফট হিসাবে CPEC, স্ট্রিং অফ পার্লস্, হাম্বানটোটা বন্দর (এই বিষয়ে পরে একটা বিশদ আর্টিকেল দেবো) ইত্যাদি সমস্যা পেয়েছিল।  

 

প্রথমে এটা বোঝা যাক যে CPEC থেকে চীনের কি লাভ হবে আর ভারতের কি লোকসান হবে। 

CPEC না থাকাকালীন মানে বর্তমান অবস্থায় চীন যদি পশ্চিমের দেশগুলির সাথে বাণিজ্য করতে চায় তাহলে আরবসাগর হয়ে শ্রীলঙ্কার নিচে দিয়ে গিয়ে মালাক্কা প্রণালী হয়ে সাউথ চায়না সমুদ্রে যেতে হয় বা এই পথেই চীন থেকে আসতেও হয় | যেটা খুবই ব্যয়বহুল | যদি CPEC চালু হয়ে যায় তাহলে বাণিজ্যিক পণ্য বিশেষ করে পেট্রোলিয়াম হোরমুজ প্রণালী হয়ে গোয়াদার পোর্ট দিয়ে সড়ক পরিবহনে সোজা চীনে পৌছে যেতে পারে | তাতে চীনের খরচ অনেক কম হবে | তার ওপর গোয়াদার পোর্ট চীনের সামরিক বাহিনীর তত্তাবধানে থাকবে তাই এই পোর্ট থেকে ভারতের পশ্চিম সীমান্তে নৌসেনার পাহারদারিও করা যাবে | যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে ভারতে পেট্রোলিয়ামের আমদানির রাস্তা আটকে দেওয়াও খুব সহজ হয়ে যাবে | 

 

ঠিক যে যে কারণে CPEC চীনের জন্য লাভদায়ক, ঠিক সেই সেই কারণেই এটা ভারতের জন্য ক্ষতিকারক | যেহেতু CPEC পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের ওপর দিয়ে যাচ্ছে তাই এটা একপ্রকার PoK -র ওপর ভারতের দাবিকেও খন্ডন করছে | কারণ চীন এই এলাকার ওপর দিয়ে রাস্তা নিয়ে যেতে পাকিস্থানের সাথে চুক্তি করেছে | এরকম স্থায়ী প্রকল্প যদি PoK ওপর একবার চালু হয়ে যায় তাহলে এই ভূখণ্ডের ওপর ভারতের দাবি অনেকটাই ধাক্কা খাবে | সেই সাথে চীন পাকিস্তানের এই রাস্তাটি ভারতের জন্য ভয়ংকর রকমের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

তাই গোয়াদার পোর্ট আর CPEC-র কূটনৈতিক ঘেরাও করার লক্ষে ভারত গোয়াদার পোর্ট থেকে মাত্র ৭৫ কিমি পশ্চিমে ইরানের চারবাহার পোর্টকে ডেভেলপ করতে শুরু করে | ২০০৩ সালেই ভারতের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপায়ীর নেতৃত্বে চারবাহার পোর্ট ও ইরানেরই শহীদ বেহেস্তি পোর্ট ডেভেলপমেন্ট করার সিদ্ধান্ত নেয় | কিন্তু ২০০৪ সালে অটলবিহারী বাজপায়ীর সরকার গিয়ে কংগ্রেস সরকার আসার পর এই প্রকল্প ধামা চাপা পড়ে যায় | 

 

২০১৪ সালে মোদী সরকার আসার পর আবার এই প্রকল্প শুরু হয় | ২০১৬ সালের মে মাসে ভারত ইরানের সাথে একটা চুক্তি করে এই পোর্ট ডেভেলপমেন্ট শুরু করে | গোয়াদার পোর্ট বালুচিস্তানে আর বালুচিস্তান পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আন্দোলন করছে | ২০১৬ সালের আগস্ট মাসে স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে মোদীজি লালকেল্লা থেকে বালুচিস্তানের আন্দোলনকারীদের সমর্থনে কথা বলেন | এটা ছিল একটা বহু পরিকল্পিত কূটনৈতিক প্ল্যান | ভাষণে বালুচিস্তানের সমর্থনে কথা বলার জন্য ভারতের ৪০ জন কূটনৈতিক পরামর্শদাতা প্রায় ০৩ মাস অনেক চিন্তাভাবনা করে তবে ক্লিয়ারেন্স দিয়েছিলেন | 

A strategic shift in the foreign policy of Pakistan under CPEC ...

এর উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বালুচিস্তানের এই আন্দোলনকে নৈতিক সমর্থন দেওয়া | এমনিতেও পাকিস্তান প্রায়শই আফগানিস্তানে উপস্থিত ভারতের R&AW এজেন্ট দ্বারা বালুচিস্তানের আন্দোলনকারীদের অস্ত্র সরবরাহ করার দোষারোপ করতেই থাকে | বালুচিস্তানের জনগণও এই CPECকে তাদের দেশের সম্পত্তির লুট হিসাবেই দেখে | তাই বালুচিস্তান যদি একটা আলাদা দেশ হয় আর গোয়াদার পোর্ট যদি আর পাকিস্তানের দখলে না থাকে তাহলে CPEC এমনিতেই ধরশায়ী হয়ে যাবে | আমরা প্রায়ই শুনে থাকি যে বালুচিস্তানের বিদ্রোহীরা CPEC-র বা এর সাথে যুক্ত কর্মীদের আক্রমণ করে ক্ষতিগ্রস্থ করে | 

 

০৪ জুন ২০১৬ : মোদীজি আফগানিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সাথে মিলে “ইন্ডিয়া-আফগানিস্তান ফ্রেণ্ডশিপ ড্যাম”-এর উদ্বোধন করেন | ভারত ভুটানের পরে আফগানিস্তানকেই সবথেকে বেশি আর্থিক সাহায্য করে | ভারত আর আফগানিস্তানের বন্ধুত্ব কতটা গভীর সেটা পোস্টটি পড়তে থাকলে বুঝতে পারবেন | আর এই বন্ধুত্বের কারণেই আফগানিস্তানে ভারতের স্পাই এজেন্টরা নির্ভয়ে কাজ করতে পারে | 

২০১৬ -র শেষে সেপ্টেম্বর মাসে পাকিস্তানী আতঙ্কবাদীরা উরিতে হামলা করে | ভারত যখন এই হামলার উত্তর দেওয়ার জন্য পাকিস্তানকে কূটনৈতিক আর সামরিক দুই ক্ষেত্রেই ঘিরছে ঠিক সেই সময় হঠাত্‍ই রাশিয়া একটা স্টেটমেন্ট দেয় | রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি পুতিন বলেন রাশিয়া CPEC কে ইউরেশিয়ান ইকনমিক ইউনিয়ন প্রজেক্টের সাথে জুড়তে চায় | এটা CPEC কে মান্যতা দেওয়া ছাড়া অন্য কিছু ছিল না | 

 

কিন্তু ভারতের পুরানো বন্ধু রাশিয়া হঠাত্‍ এমন কাজ কেন করল ? রাশিয়ার এহেন ব্যাবহারের কারণ ছিল আফগানিস্তানে আমেরিকার উপস্থিতিকে ভারতের তরফ থেকে নৈতিক সমর্থন দেওয়া | আফগানিস্তানে আমেরিকার উপস্থিতি রাশিয়ার হিতের বিরুদ্ধে ছিল আর আফগানিস্তানে টিকে থাকতে গেলে ভারতের আমেরিকাকে প্রয়োজন ছিল | কঠিন কূটনৈতিক দ্বিধার সম্মুখীন হয় ভারত | জুলাই ২০১৭ – রাষ্ট্রপতি পুতিনের কথায় কর্ণপাত না করে মোদীজি ইসরায়েল গেলেন | 

এবং ইসরায়েলের সাথে সামরিক অস্ত্র কেনার চুক্তি করলেন | এর সাথে সাথেই ভারত ২০১৬ তে রাশিয়ার সাথে S400 কেনার চুক্তি থেকে পিছিয়ে আসার সংকেত দিল | নিজেদের এত বড় অঙ্কের ব্যবসা নষ্ট হতে দেখে পুতিন মে 2018 তে একটা আনঅফিসিয়াল মিটিং-এ মোদীজিকে S400 কেনার অফার দেন | মোদীজি শর্ত রাখেন যে রাশিয়ার সাথে ৪০০০০ কোটি টাকার এই ডীল তখনই সম্ভব হবে যখন রাশিয়া CPEC ব্যপারে তাদের স্ট্যান্ড থেকে পিছু হটবে | ভারতের এই প্রেসার ডিপ্লোমেসি কাজে লাগলো আর অক্টোবর ২০১৮ তে পুতিনের CPEC থেকে সমর্থন তুলে নেওয়ার পর এই সামরিক চুক্তি সাক্ষর হয় |

 

ওদিকে রাশিয়ার থেকে সামরিক অস্ত্র নেওয়ার এত বড় চুক্তিতে আমেরিকারও গোসা হয় | আর আমেরিকা ভারতের ওপর নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা লাগানোর ইঙ্গিত দেয় | কিন্তু গত পাঁচ বছরে ভারত আমেরিকার সাথে বাণিজ্য প্রায় পাঁচগুণ বাড়িয়ে নিয়েছিল | তাই আমেরিকা এত বড় একটা বাণিজ্যিক সম্পর্ক নষ্ট করার সাহস দেখায় না | 

এবার ফেরত আসা যাক আফগানিস্তানের কথায় 

আগস্ট ২০১৭ : আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আফগানিস্তানে তালিবানীদের সমর্থন দেওয়ার কারণে পাকিস্তানকে দেওয়া অনেক অনুদান বন্ধ করার নির্দেশ দেন আর ভারতকে আফগানিস্তানের পুনর্বাসনে বড় ভূমিকা নেওয়ার কথা বলেন |

To Meet Indian Concerns, China Offers to Re-Name China-Pakistan ...

সেপ্টেম্বর ২০১৮ : আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প ‘জালমে খালিজাদ’ কে আফগানিস্তান বিষয়ের আমেরিকান প্রতিনিধি নিযুক্ত করে কয়েক দশক ধরে পড়ে থাকা আফগানিস্তান শান্তি চুক্তি শুরু করেন | এই চুক্তির জন্য তালিবান, আমেরিকা, চীন, রাশিয়া আর পাকিস্তান মিটিং এ বসে | যারা মিটিং এ আসে না তারা হলো ভারত আর আফগানিস্তান সরকার | ভারত ঘোষণা করে যে “ভারত এরকম কোনও মিটিং-এ অংশগ্রহণ করবে না যেখানে তালিবানের মত আতঙ্কবাদী সংগঠনের প্রতিনিধি আছে | আফগানিস্তান শান্তি চুক্তি আফগান সরকারের নেতৃত্বে আফগান সরকারের সমর্থনেই হওয়া উচিত |” এই স্ট্যান্ড নেওয়ার কারণে সারা বিশ্বের কুটনীতি বিশেষজ্ঞরা মোদীজির সমালোচনা করেন | 

 

তাঁদের মতে ভারত বাস্তবকে অস্বীকার করছিল, আফগানিস্তানে কোনরকম শান্তি চুক্তি থেকে তালিবানীদের বাদ দেওয়া বাস্তবিক নয় | কিন্তু মোদীজি অনেক দূরের কথা মাথায় রেখে এই সিদ্ধান্তে অনড় ছিলেন | মোদীজি কে দেশের বিরোধীরাই এখনও ঠিক করে বুঝল না তো বিদেশের বিশেষজ্ঞরা কী বুঝবে !

৩০শে সেপ্টেম্বর ২০১৯ : এটা ছিল আফগানিস্তান শান্তি চুক্তি ফাইনাল হওয়ার শেষ দিন | তালিবান, আমেরিকা, চীন, রাশিয়া আর পাকিস্তান মিটিং এ তো বসেছিল কিন্তু কোনও বিষয়ে কোনোরকম সম্মতি আনতে অসফল হয় | ট্রাম্প এই মিটিং ফেল হওয়ার কথা ঘোষণা করেন আর আফগানিস্তানে আমেরিকান সেনা রেখে দেওয়ার কথাও জানান |

 

এখন প্রশ্ন হলো এই শান্তি চুক্তি অসফল হলো কেন ? এর ছোট জবাব হলো ভারতের অনুপস্থিতি আর বড় জবাব হলো ভারতের আফগানিস্তান সরকার ও তার সাধারণ জনগণের সাথে মধুর সম্পর্ক | বিশ্বের বিশেষজ্ঞরা বুঝতে পারেন যে বাস্তব হলো এই চুক্তিতে আফগান সরকারের উপস্থিতি যেটা ছাড়া এই চুক্তি কখনোই সম্ভব নয় | এটা সময় থাকতে ভারত ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারে নি | যখন ২০০১ থেকে আমেরিকা আর NATO আফগানিস্তানে বোমা বর্ষণ করছিল তখন ভারত আফগানিস্তানে উন্নয়নের কাজ করছিল |

 

২০০১ ডিসেম্বরে বন চুক্তির পর থেকে এখনও পর্যন্ত ভারত আফগানিস্তানে ৩ বিলিয়ন ডলার ইনভেস্ট করেছে | এর মধ্যে অন্যতম ওখানকার সংসদ ভবন নির্মাণ | এছাড়া সড়ক নির্মাণ, ড্যাম নির্মাণ, হাসপাতাল, স্কুল, কলেজ, ছাত্রবৃত্তি এমনকি আফগানিস্তানের ক্রিকেট টীম তৈরী করাতেও ভারতের অবদান আছে | ভারতের আফগান সরকার আর জনগণ উভয়ের সাথেই ভাল সম্পর্ক আর ওখানে ভারতের স্পেশাল এজেন্সির মজবুত নেটওয়ার্ক-এর কারণে আফগান মামলায় কোনও রকম চুক্তি ভারতকে বাদ দিয়ে সম্ভব নয় | 

ফেব্রুয়ারি ২০২০: বেগতিক দেখে ট্রাম্প এই চুক্তি মামলায় ভারতকে অংশগ্রহণ করতে অনুরোধ করেন | মোদী ট্রাম্পের আনঅফিসিয়াল মিটিং হয় | ভারতের সম্মতির পর ট্রাম্প চুক্তি সাক্ষরের দিন ধার্য করেন ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০ | এই চুক্তির শর্তাবলীর আলোচনা করতে ট্রাম্প ভারতে আসেন | ২৪ আর ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০ “নমস্তে ট্রাম্প”- এর আড়ালে আফগান শান্তি চুক্তির বিষয়ে আলোচনা হয় | ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০ তে কাতার-এর দোহাতে আমেরিকা আর তালিবানের মধ্যে চুক্তি সাক্ষর সফল হয় | 

 

এই চুক্তি অনুযায়ী আমেরিকা ১৪ মাসের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে নিজের সৈন্য ফিরিয়ে নেবে, তালিবান আর আফগান সরকার নিজেদের মধ্যে বন্দীদের বিনিময় করবে ইত্যাদি | আফগান সরকার এই চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছে | ভারত অফিসিয়ালি কিছু না বললেও ওই চুক্তির সভায় ভারতের প্রতিনিধিও ছিল | এই চুক্তি কতটা কার্যকর আর সফল হয় সেটা এখন পুরোপুরিভাবে ভারতের ওপর নির্ভর করছে | আমেরিকা তার সেনাদের ফিরিয়ে নিতে সক্ষম তখনই হবে যখন ভারত আফগানিস্তানে শান্তি সেনা পাঠাবে বা আফগানিস্তানের সুরক্ষার দ্বায়িত্ব নিজের ওপর নেবে | 

কিন্তু কোনও কিছুই বিনামূল্যে পাওয়া যায় না | ভারত যদি আফগানিস্তানে শান্তিসেনা পাঠায় আর ওখানকার সমাজব্যবস্থা পুনর্নির্মাণের দ্বায়িত্ব নেয় তাহলে ভারত এর বদলে কী চায় ? কাশ্মীর ? না ….. ভারত এর বদলে গিলগিট বালতিস্তান ফেরত চায় | এই বিষয়ে বিশ্বের সমর্থ দেশগুলি আর অন্তররাষ্ট্রীয় সমুদায়ের সমর্থন চায় | 

০৫ আগস্ট ২০১৯: গৃহমন্ত্রী অমিত শাহ সংসদে কাশ্মীর থেকে ধারা ৩৭০ আর ৩৫এ হটানোর জন্য বিল পেশ করেন আর একই সাথে জম্মু-কাশ্মীর আর লাদাখকে আলাদা করে দেন | কারণ নেহেরুর দয়ায় কাশ্মীর মামলা ইউনাইটেড নেশনে গেলেও লাদাখ আর গিলগিট বালতিস্তান এর মধ্যে নেই | আর গিলগিট বালতিস্তানের ব্যাপারে ভারতের আইনি দাবিও যথেষ্ট পোক্ত | গিলগিট বালতিস্তানের গুরুত্ব এই মূহুর্তে ভারতের কাছে অনেক বেশি কারণ এটা যদি ভারতের কাছে চলে আসে তাহলে CPEC-র লিঙ্ক শুরু হওয়ার আগেই ভেঙে যাবে |

 

কিন্তু আমেরিকা এর থেকে কি পাবে ? আমেরিকা আফগানিস্তান থেকে নিজের সেনা ফেরত নিতে পারবে | আমেরিকার, বিশেষ করে ট্রাম্পের জন্য এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ | কারণ ট্রাম্পের নির্বাচন প্রতিশ্রুতি ছিল যে উনি আফগানিস্তান থেকে সেনাদের ফেরত আনবেন | আগামী নভেম্বরে আমেরিকায় আবার নির্বাচন আছে | আর ট্রাম্পের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারে একমাত্র ভারতই | 

ias-toppers-chinese-presence-in-the-indian-ocean | IASToppers

ট্রাম্প ভারতকে আফগানিস্তানে শান্তিসেনা পাঠাতে আর আফগান সমাজব্যবস্থার পুনর্নির্মাণ করতে এগিয়ে আসতে অনুরোধ করেছেন | আমেরিকান-আফগান রাষ্ট্রদূত জালমে খালিজাদও ভারতকে প্রায়ই একই অনুরোধ করেন বিভিন্ন দেশের সাথে কূটনৈতিক আলোচনাসভা থেকে | এছাড়া, CPEC বিফল হলে চীন ক্ষতিগ্রস্থ হবে | চীনের অর্থনৈতিক আর বাণিজ্যিক ক্ষতি হবে | তাতে আমেরিকার সুবিধাই হবে |

 

তাহলে রাশিয়া ভারতকে সমর্থন করবে কেন ? আফগানিস্তান থেকে আমেরিকার প্রভুত্ব শেষ করাই রাশিয়ার দশক পুরানো লক্ষ | এতে রাশিয়ার দূরগামি লাভ আছে | রাশিয়ার অর্থনীতি খুব খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে | বিশ্বে ১২ নম্বর স্থানে পৌছে গেছে | ভারত রাশিয়ার অর্থনীতির উন্নতিতে ভাগীদার হবে রাশিয়ার সাথে বড় বড় অস্ত্র, জাহাজ, প্লেন এর সওদা করে | সম্প্রতিতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং রাশিয়ার ভিক্টরি ডে তে অংশগ্রহণ করে রাশিয়ার সাথে বেশ কিছু সামরিক অস্ত্রশস্ত্রের ডীল করেছেন | 

এই সব কিছু দেখে চীন ভারতের এই রণনীতি ভাঙতে লাদাখ সীমান্তে ঝামেলা শুরু করে ভারতকে অন্যদিকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টায় আছে | আর্ট অফ ওয়ারে এটাকে ডিকয় বলে, ডাইভার্সন টেকনিক | যাতে অন্য কোথাও কিছুতে ফাসিয়ে আসল লক্ষ থেকে শত্রুকে ঘুরিয়ে দেওয়া যায় | নেপালকে ফুসলিয়ে, লাদাখে ঝামেলা করে শেষ চেষ্টা করে দেখা ছাড়া আর কিছু নয় | 

 

আমার মতে ভারত-চীন যুদ্ধ তো হবেই না, উল্টে দু-দেশের মধ্যে পাকিস্তান মামলায় সমঝোতা হয়ে যাবে | ভারত কোভিড মামলায় চীনকে দোষী সাব্যস্ত করায় নিউট্রাল থাকবে | ভারত ওয়ান চায়না পলিসিকে মান্যতা দেবে আর হংকং -এর ব্যাপারে নাক গলাবে না | বিআরআইসি গোষ্ঠীর নানাবিধ প্রজেক্টে অংশীদার হবে | এইসব বিষয়ে সি-জিনপিং -এর সাথে ২০১৮ তে বুহানের মিস্টিরিয়াস আনঅফিসিয়াল মিটিং-এ  হয়ে গেছে | এখন যা ঘটছে সেগুলো শুধুমাত্র শেষ বেলার দড়ি টানাটানি ছাড়া আর কিছু নয় | দর কষাকষিতে ভারতও আছে | ভারত কিছুদিন আগে তাইওয়ানের রাষ্ট্রপতির শপথগ্রহণ সমারোহতে সাংসদ মীনাক্ষী লেখি সমেত দুজন সাংসদকে পাঠিয়েছিল | প্রেসার ডিপ্লোমেসি |

 

এই পুরো ঘটনাতে পাকিস্তান শুধু তেজপাতা | শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানকে সবাই ছুঁড়ে ফেলেই দেবে | খুব অলৌকিক কিছু না ঘটলে ২০২২ এর শেষের দিকে পাকিস্তানের তিনটুকরো হতে বাধ্য |

লেখক এর পরবর্তী লেখা পড়তে একটি লাইক দিয়ে রাখুন।- ধন্যবাদ।

 

লেখক© অনিন্দ্য নন্দী