গুরুদক্ষিণা অর্থ কি

গুরুদক্ষিণা অর্থ কি?

গুরুদক্ষিণা অর্থ কি? সূর্য যেমন না বলে সবাইকে প্রাণশক্তি দেয়, মেঘ যে বৃষ্টির জল দেয়, তেমনি বাতাসও বৈষম্য ও লোভ ছাড়াই ঠান্ডা করে সবাইকে বাঁচিয়ে রাখে, ফুলও তার সুগন্ধে সবার জন্য ছড়িয়ে দেয়। একইভাবে শিক্ষক তার জ্ঞান ছড়িয়ে দেয় শিষ্যর মধ্যে কোন ধরনে প্রতিদান ছাড়াই। তাঁর লক্ষ্য শিষ্য থেকে গুরুদক্ষিণা নেওয়া নয়, শিষ্যকে সূর্যের মতো উজ্জ্বল করা , যা গর্বের সঙ্গে গুরুর মাথা উঁচু করবে।

একজন প্রাচীন গুরু তার আশ্রম নিয়ে খুব চিন্তিত ছিলেন। গুরু বুড়ো হয়ে গিয়েছিলেন এবং তখন তিনি তাঁর বাকি জীবনটা হিমালয়ে কাটাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার জায়গায় কে একজন যোগ্য উত্তরসূরি হবেন , কে সঠিকভাবে আশ্রম চালাতে পারবে তা নিয়ে গুরু চিন্তিত ছিলেন ।

সেই আশ্রমে দুজন যোগ্য শিষ্য ছিলেন এবং দুজনেই ছিলেন গুরুর প্রিয়। গুরু তাদের দুজনকে ডেকে বললেন- শিষ্যগণ, আমি তীর্থযাত্রায় যাচ্ছি এবং গুরুদক্ষিণা হিসাবে আমি আপনাদের কাছে যা চাইছি তা হল এই দুই মুঠো গম।

আপনারা প্রত্যেকেই এক মুঠো করে রাখুন এবং যখন আমি আসব, তখন আমাকে এই দুই মুঠো গম ফিরিয়ে দিতে হবে। যে শিষ্য তার গম নিরাপদে আমার কাছে ফিরিয়ে দেবে, আমি তাকে এই গুরুকুলের গুরু হিসেবে নিযুক্ত করব । উভয় শিষ্যই গুরুর আদেশ মেনে গুরুকে বিদায় দিলেন

একজন শিষ্য গুরুকে “শ্বর” মনে করতেন। তিনি গুরুর দেওয়া এক মুঠো গম বেঁধে একটি প্যানে নিরাপদ করে রেখেছিলেন এবং প্রতিদিন এটির পূজা শুরু করেছিলেন। আরেকজন শিষ্য, যিনি গুরুকে জ্ঞানের ঈশ্বর মনে করতেন, তাই তিনি গুরুর দেওয়া সেই এক মুঠো গাম গুরুকুলের পিছনে মাঠে বপন করেছিলেন।

কয়েক মাস পরে যখন গুরু এলেন, তিনি তার শিষ্যদের ডাকলেন এবং তার সেই গম ফেরত চাইলেন। যিনি গুরুকে “শ্বর” বলে বিশ্বাস করতেন। তিনি গুরুর দেয়া গম গুরুর কাছে নিয়ে গেলেন এবং বললেন যে তিনি প্রতিদিন সেই এক মুঠো গম পূজা করতেন। গুরু দেখলেন পাত্রের গম পচে গেছে এবং সেগুলো আর কোনো কাজে আসছে না।

অতপর গুরু সেই শিষ্যকে জিজ্ঞাসা করলেন যিনি গুরুকে জ্ঞানের দেবতা বলে বিশ্বাস করতেন তাকে তার গম দেখানোর জন্য। তিনি গুরুকে আশ্রমের পিছনে নিয়ে গেলেন এবং বললেন – গুরুদেব, আপনি যে ফসলটি দেখছেন, এটি আপনার মুষ্টিমেয় সেই গম এবং আমি দু:খিত যে আপনি যে গমটি দিয়েছিলেন সেই একই গম আমি আপনাকে ফেরত দিতে পারছি না।

সমৃদ্ধশালী ফসল দেখে গুরুর মন খুশি হয়েছিল এবং তিনি বলেছিলেন যে শিষ্য গুরুর জ্ঞান ছড়িয়ে দেয় , বিতরণ করে, সে উত্তম উত্তরাধিকারী হওয়ার যোগ্য। মূলত এটাই গুরুর প্রতি প্রকৃত দক্ষিণা। সাধারণ অর্থে গুরুদক্ষিণার অর্থ পুরস্কার হিসেবে নেওয়া হয়, কিন্তু গুরুদক্ষিণার প্রকৃত অর্থ অনেক বিস্তৃত। শুধু পুরস্কার নয়।

গুরুদক্ষিণা অর্থ কি

গুরুদক্ষিণা অর্থ হলো গুরুর কাছ থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা ও জ্ঞান ছড়িয়ে দেওয়া এবং জনকল্যাণের জন্য সঠিকভাবে ব্যবহার করা। মূলত গুরুদক্ষিণার অর্থও শিষ্যের পরীক্ষার প্রেক্ষিতে নেওয়া হয়। গুরুদক্ষিনা হল গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভক্তির অঙ্গভঙ্গি। গুরুর কাছে সঠিক দক্ষিণা হল যে গুরু এখন চান আপনি নিজে গুরু হোন।

গুরু জীবিত হোক বা তত্ত্বের রূপে, যদি সত্যিকারের ভক্তির সাথে গুরুর ভক্তি সত্য নিষ্ঠার সাথে আবেগের সাথে গ্রহণ করা হয়, তাহলে তত্ত্বও একলব্যের মতো জীবন হয়ে ওঠে, তিনি অর্জুনের মতো ছিলেন না, কিন্তু তিনি ছিলেন তীরন্দাজ।

গুরুর প্রতি শিষ্যের একনিষ্ঠ ভক্তির উদাহরণ একলব্য

গুরুদেব দ্রোনের কাছে একলব্য গিয়েছিলেন যুদ্ধবিদ্যা শিখতে। কিন্তু একলব্য ক্ষত্রিয় ছিল না বলে দ্রোন তাকে শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করতে রাজী হননি। কিন্তু বালক একলব্য দ্রোনকেই গুরু মেনে গহীন বনে একমনে যুদ্ধবিদ্যা শিখতে থাকে।

গুরুর প্রতি শিষ্যের একনিষ্ঠ ভক্তির উদাহরণ একলব্য
গুরুর প্রতি শিষ্যের একনিষ্ঠ ভক্তির উদাহরণ একলব্য

একদিন দেখা যায় একলব্য দ্রোনের ক্ষত্রিয় শিষ্যদের চেয়েও বড় যোদ্ধা হয়ে যান। বনে ঘুরতে এসে একদিন দ্রোন একলব্যের প্রতিভার পরিচয় পেয়ে জানতে চান কে তার গুরু। একলব্য দ্রোনকেই গুরু বলে জানায়। দ্রোন তখন গুরুদক্ষিণা হিসেবে একলব্যে হাতের বুড়ো আঙ্গুল দাবি করে।

একলব্য বিনাবাক্যে গুরুকে তা দিয়ে দেয় মহাভারতে উক্ত একলব্য দ্রোণাচার্যের নিকট ধনুবিদ্যা শিক্ষা করবার জন্য উপনীত হলে দ্রোন তাকে প্রত্যাখ্যান করেন। ফলে একলব্য দ্রোণাচার্যের মূর্তি স্থাপন করে গুরু রূপে উপাসনা করে সেই মূর্তির মাধ্যমে ধনুর বিদ্যা লাভ করেন অর্থাৎ পরমাত্মাই গুরু দ্রোণের মুর্তির মাধ্যমে।

অর্থাৎ প্রতি ক‌তির মাধ্যমে ধনু বিদ্যা প্রাপ্ত হন। উপকোসলকে দক্ষিণাগ্নি,গারহপত্যাগ্নি,আহবণীয়াগ্নি ব্রহ্ম জ্ঞান দিয়ে ছিলেন। গুরু অল্পজ্ঞ হলেও গুরুকে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর জ্ঞানে সেবা শুশ্রূষা করলে সেই গুরুর উপদেশ ক্রমে শিষ্য মোক্ষ লাভ করতে পারে।

আর পড়ুন…