দর্পনে মুখোমুখি
আমাদের এই দেশে অর্থাৎ সংবিধানের ভাষায় “ইণ্ডিয়া দ্যাট ইজ ভারতে” সবক্ষেত্রেই একটা ভণ্ডামি আত্মপ্রবঞ্চনা বা ভাবের ঘরে চুরি লক্ষ্য করা যায়। পূর্বসূরীদের দেখে দেখে উত্তরসূরীরাও সিদ্ধান্তে আসে, মিথ্যাচার এদেশে কোন অন্যায় কর্ম নয়। অনেক প্রবীণের ধারণা এখন যত দুর্নীতি মিথ্যাচার ভণ্ডামী আগে নাকি এতটা ছিল না। এটিও একটি সর্বৈব মিথ্যা কথা। আমাদের পূর্বপুরুষেরা সবাই ভালাে ল্যাংড়া আমের গাছ ছিলেন, আর আমরা সেই গাছেরই ফল হয়ে একালে একেবারে আমড়া হয়ে গেলাম এ কথা কোন যুক্তিতেই টেকে । রামায়ণ মহাভারতকে যদি ইতিহাস ধরি সেখানেও এদেশের সাধারণ মানুষের নৈতিকতা কিম্বা অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ উজ্জ্বল ছিল চোখে পড়ে না। সীতার মত সতীর বারবার অগ্নিপরীক্ষা চেয়েছে এই দেশেরই মানুষ। কুলবধূ দ্রৌপদীকে রাজসভায় সকলের সামনে নগ্ন করতে চেয়েছিল ক্ষমতাসীন দলের লােকেরাই। দ্রোণাচার্যের মত একজন জেনারেলকে অভাবের তাড়নায় ছেলেকে দুধের বদলে চাল বেটে খাওয়াতে হয়েছে দুধের মত করে। দুর্নীতি এবং দারিদ্র্য আমাদের চিরদিনের সঙ্গী। কারণ, আমরা অলস এবং অকর্মণ্য। যুক্তি দিয়ে বিচার করে শক্তি দিয়ে নিজের ভাগ্য আমরা নিজে গড়ে নিতে জানি না। তাই, আমাদের আশ্রয় নিতে হয় কল্পনা, আবেগ, ভক্তির কাছে, মিথ্যা এবং প্রবঞ্চনার কাছে। দুর্বল, অলস, অকর্মণ্যদের এই একটিমাত্র নিরাপদ দুর্গ-কল্পনার দুর্গ। তাই এদেশে এত ধর্ম দেবতা ভক্তির ছড়াছড়ি। এই মিথ্যে আবেগ এবং ভক্তির ছড়াছড়ি আমাদের চিরকালের জন্য ছাড়াছাড়ি করে দিল সত্যের সঙ্গে, শক্তির সঙ্গে, বাস্তবতার সঙ্গে। আমাদের দেবতা, দর্শন, ধর্ম, মহাপুরুষদের বেছে নিয়ে বানিয়ে নিলাম ঠিক আমাদের মত করে। মহাদেবকে জ্ঞানের দেবতা মঙ্গলের দেবতারূপে কল্পনা করেছিলাম, বেশিদিন সেটা চালাতে পারলাম না! তব হাতে গাঁজার কক্ষে তুলে দিয়ে অন্নপূর্ণার কাছে ভিক্ষে করিয়ে ঠিক আমাদের লাইনে এনে ফেললাম। ভিখারী এবং গাঁজাখাের বানিয়ে দিলাম।
অর্জুন সারাজীবন একটা মিথ্যে কথা দর্পণে মুখখামুখি বলেনি, দাদাকে হাজারবার বারণ করেছে পাশা খেলতে, তাকে আমরা শুধু বীর বলে ছেড়ে দিলাম। আর যে ঘরের বৌকে বাজী রেখে জুয়াে খেলল তাকে বললাম-পণ্ডিত, স্থিরবুদ্ধি, ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির। কৃষ্ণের বুদ্ধি, দূরদর্শিতা, শক্তি, কূটনীতি সারা বিশ্বে তুলনাহীন। তাঁর শৌর্য বীৰ্য্য, বীরত্বের জন্য তিনি আমাদের পূজ্য, নাড়ু খাওয়ার জন্য নয়। ননী, ক্ষীর, ছানা খাওয়া নাড়ুগােপাল এদেশে অনেক আছে। এদের আমরা ব্যঙ্গ করি, কটাক্ষ করি। তার গীতা কালের গ্রহণযােগ্য। একটি চিরায়ত দর্শন, এগুলাে আমাদের সহ্য হলাে না। আমাদের বিকৃত কামনা বাসনা দিয়ে এক অদ্ভুত কৃষ্ণ বানিয়ে নিলাম। যে সারাদিন বাঁশি বাজিয়ে ঘুরে বেড়ায়, স্নানের ঘাটে মেয়েদের কাপড় লুকিয়ে রাখে, বয়সে বড়, বিয়ে হয়ে গেছে সম্পর্কে মামী, তার সঙ্গে অবৈধ প্রেম করে। গীতা উদগাতা কৃষ্ণের চরিত্রে এগুলাে প্রক্ষিপ্ত মিথ্যে বিকৃতি— একথা আমাদের মনে হয় না। মনে হয় না মুসলিম আমলে অনুগ্রহভাজন পণ্ডিতদের দিয়ে এগুলাে লেখানাে। ইসলাম প্রবক্তার চরিত্রের মতাে করে কৃষ্ণকে দেখানাের অপচেষ্টা! বরং এসবে বিশ্বাস করে আমাদের সব নােংরা ইচ্ছাগুলাে, বিকৃতিগুলাে কৃষ্ণের ওপর চাপিয়ে দিলাম। আমাদের কাজের সুবিধের জন্য এই ইচ্ছা-বিকৃতিগুলাে যুক্তিহীন ভক্তিবাদে ভিজিয়ে রাধাতত্ত্বের উপস্থাপন করলাম। যে তত্ত্ব তই রয়ে গেল। সত্য কখনাে দেখা গেল না। শুধু রয়ে গেল বিচিত্র ব্যাখ্যায়। যৌন বিজ্ঞানীরা সকলেই বলেন বীৰ্য্যহীন এবং ভীতু লােকেদের এই ধরণের কুরুচিকর আলােচনায় একধরনের তৃপ্তি হয়।
দর্পনে মুখোমুখি
গীতায় সত্য আছে, কৃষ্ণের জীবনে সত্য আছে, যে সত্য মানুষকে তেজস্বী করে, সাহসী করে, মৃত্যুভীতি জয় করে, নির্বিকার নিরাসক্ত করে। এগুলাে আমাদের চরিত্রের সঙ্গে মেলে না। তার চেয়ে কান্তাপ্রেম, রাধামে, একঅঙ্গে রাধাকৃষ্ণ-এসবের আলােচনা, ব্যাখ্যা আমাদের চরিত্র উপযােগী। ভক্তি দেখানােও হয়, ঠিক জায়গায় সুরসুরিটাও দেওয়া হয়। কেউ ধরতেও পারে না। নােংরা অপকর্মের ওপর একটা ধর্মের সাদা চাদর বিছানাে রইল। জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে আমাদের এই ভণ্ডামী আত্মপ্রবঞ্চনা চলছে। আমরা কান্তাপ্রেম রাধাপ্রেম, আর পঞ্চমীতে কেন বেগুন খেতে নেই, ত্রয়ােদশীতে লাউ কেন অভক্ষ্য তার চুলচেরা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছি; আর কয়েক হাজার সাহসী কিন্তু আমাদের চেয়ে নিম্নমানের মানুষ সারাদেশটা দখল করে সব তছনছ করেছে। মা, বােন, মন্দির, দেবতা কারাে মৰ্য্যাদা আমরা রক্ষা করতে পারিনি। দুর্বল, স্বার্থপর, কল্পনাশ্রয়ী, মিথ্যক একটা জাতির জীবনে এগুলােই ঘটে। অন্তঃসারশূন্য ভণ্ড জাত কখনাে তার নিজস্বতা নিয়ে, মৰ্য্যাদা নিয়ে পৃথিবীতে টিকে থাকতে পারে, হারিয়ে যায়।
এটা জগতের নিয়ম। মাৎস্যন্যায় বলেছে ঃ বড় মাছ ছােট মাছকে খেয়ে ফেলবে। অর্থাৎ শক্তিশালী সংগঠিত জাত অসংগঠিত দুর্বল জাতকে আত্মসাৎ করে নেবে। শক্তিমানদের জন্যে প্রবাদ রয়েছে ঃ বীরভােগ্যা বসুন্ধরা। দুর্বলদের জন্য জগৎ তদ্বির ভােগ্যা। আমরা সােজাসুজি মােকাবিলা এড়াতে চাই।তরি করে সব ব্যবস্থা করে নিতে চাই। এগুলােই জীবন থেকে, বাস্তব থেকে, সংগ্রাম থেকে সরে আসা। ধীরে ধীরে অন্তরালে যাওয়া, হেরে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়া। আত্মপ্রবঞ্চক জাতি এই হারানাের নিষ্ঠুর সত্যটাকে স্বীকার করতে চায় না। চাপা দিতে চায় আরাে বড় মিথ্যে দিয়ে। এদেশের ইতিহাসে পড়ানাে হয় সাতশাে বছর মুসলমান আর দুশাে বছর ইংরেজ ভারতে রাজত্ব করেছে। কিন্তু কথাবার্তায় কাগজপত্রে আমরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে আন্দোলনটাকেই স্বাধীনতা আন্দোলন বললাম। মুসলমান আমলটা স্বাধীনই ছিলাম ধরে নিলাম। ইংরেজ যদি তার শাসন সাতশাে বছর কায়েম রাখতে পারত তাহলে আমরা কি বলতাম কে জানে! দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জার্মানীর সঙ্গে লড়ে ইংরেজ বিপর্যস্ত হয়ে গেল। সিদ্ধান্ত নিল এশিয়ায় তারা সাম্রাজ্য রাখবে না। তাই ভারতবর্ষ স্বাধীন হ’ল। আমরা মিথ্যের পাহাড় রচনা করতে লাগলাম। মহাত্মা গান্ধীর রামধুন গানে আতঙ্কিত হয়ে পালিয়ে গেল ইংরেজ, এটা গান্ধীভক্তদের ধারণা। ইংরেজ পরিত্যক্ত অসহায় সৈনিকদের গায়ে আজাদ হিন্দ ফৌজের তকমা লাগিয়ে ভারতের এক কোণে ইম্ফলে যে লড়াই হয় তাতেই ভারত ছাড়লাে ব্রিটিশ, নেতাজী অনুরাগীদের বিশ্বাস। আর যারা বিপ্লববাদের সমর্থক, তাদের ধারণা দুটো মরচে ধরা মসার পিস্তলের আওয়াজেই ইংরেজ পালিয়ে গেল।
দর্পণে মুখখামুখি
মহাত্মা গান্ধী অচলায়তন ভারতের একটি বড় অংশকে খালি হাতে ইংরেজদের বিরুদ্ধে খাড়া করেছিলেন ঠিক কথা, নেতাজীর দেশপ্রেম, বীরত্বের কোন তুলনা নেই একথাও সত্য, বিপ্লবীরাও যুবসমাজে একটা প্রেরণার সঞ্চার করেছিলেন এতেও দ্বিমত নেই। কিন্তু এইসবের সামগ্রিক যােগফলে কতটুকু প্রতিক্রিয়া হয়েছিল ইংরেজের মধ্যে? তিলমাত্র। প্রতিক্রিয়া কিছু হয়ে থাকলে, আতঙ্ক কিছু হয়ে থাকলে তা হয়েছে নৌবিদ্রোহের কারণে। নৌবিদ্রোহই ব্রিটিশের হাড়ে কাপুনি ধরিয়ে দিয়েছিল। একথাটা আমরা কেউ বলি না। মূল কারণ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। ভারতে না হয় এইসব বীরত্বপূর্ণ আন্দোলন হয়েছিল। ব্রিটিশ কিন্তু ছেড়ে দিয়ে গেল শুধু ভারত নয়, সিংহল, বার্মা, মালয় সব। আফ্রিকায় তাদের সাম্রাজ্য আজও রয়েছে। স্বাধীনতাটা শুধু আমাদের ইচ্ছায় হলে আমরা ভারতবর্ষকে কিছুতেই দ্বিখণ্ডিত হতে দিতাম না। ইংরেজ এশিয়ায় সাম্রাজ্য রাখবে না তাই চলে গেল। তারা ঠিক করলাে ভারতকে দুটুকরাে করে দিয়ে যাবে, দিয়ে গেল। ঝড়ে পাখী মরাটা আমরা ফকিরের কেরামতি বলে চালিয়ে দিলাম। মিথ্যা দিয়ে, প্রবঞ্চনা দিয়ে আমাদের কৃতিত্ব শতগুণ করে দেখালাম, কারণ, সত্যের সামনে আসা, দর্পণের মুখােমুখি হওয়ার আমাদের সাহস নেই, স্বভাবও নয়। স্বাধীনতা আন্দোলনের ত্যাগ তিতিক্ষা এবং কর্মকাণ্ডকে আমি ছােট বলে দেখাতে চাইছি
। অহেতুক বড় না করে নির্জলা সত্যটুকু দেখাতে চাইছি। এই সত্য আরও প্রকট হয় দেশে হাজার হাজার ভাতা পাওয়া স্বাধীনতা সংগ্রামী দেখে। যেন তেন প্রকারে পেনশন পাবার অপচেষ্টা। পেনশন হারানাের ভয়। সরকারী কোন অন্যায়ের প্রতিবাদে দ্বিধা, সঙ্কোচ। এইসবে বােঝা যায় এঁরা কি ধরণের সাহসী ত্যাগব্রতী বিপ্লবী ছিলেন। বিপ্লবী আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই বাংলা, অখণ্ড বাংলা। শতশত বিপ্লবী দেশের জন্য ফঁাসীর মঞ্চে প্রাণ দিয়েছে একথা বেশ গর্বের সঙ্গে আমরা গল্প করে থাকি। সত্যি কথাটা শুনলে লজ্জা হবে, উনিশশাে আট থেকে উনিশশাে তেতাল্লিশ এই পঁয়ত্রিশ বছরের বিপ্লব আন্দোলনে পুর্ব বাংলা, পশ্চিমবাংলা মিলিয়ে ফাসীর মঞ্চে প্রাণ দানের সংখ্যা মাত্র চল্লিশ। পরিসংখ্যান না দেখেই বলা যেতে পারে এই পঁয়ত্রিশ বছরে কালাজ্বর, পালাজ্বর,
দর্পণে মুখখামুখি
ম্যালেরিয়া, ডায়েরিয়াতে প্রাণ দিয়েছে পঁয়ত্রিশ লক্ষের অধিক মানুষ। | ট্র্যাজেডি আরাে আছেঃ এই অখণ্ড বাংলায় মুসলমানের সংখ্যা ছিল বেশী, যে অধিকারে তারা বাংলার দুই তৃতীয়াংশ পাকিস্তান করে নিল। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এই প্রদেশে কিন্তু একজন মুসলমানও ফাসীর মঞ্চে প্রাণ দেয়নি। এই যে চল্লিশ জন এরা সবাই ছিল হিন্দু। সারা ভারতের প্রত্যেকটি প্রদেশের চিত্র এক। দেশের জন্য কঁাসীর মঞ্চে আত্মদানের তালিকায় নেই কোন মুসলমানের নাম, এই নিদারুণ সত্যটা আমাদের চমকে দেয় না, প্রশ্ন জাগায় না। কারণ, সত্য আমাদের অস্বস্তি দেয়। সারা ভারতে একমাত্র ব্যতিক্রম আসফাকউল্লা। মুসলমান হিসাবে ইনিই উত্তরপ্রদেশে ফঁাসীর মঞ্চে প্রাণ দিয়েছেন। কিন্তু বিরল ব্যতিক্রমটা সরল নিয়মকেই প্রতিষ্ঠা করে। আমরা কিন্তু মিথ্যাটাই বারবার উচ্চারণ করেছি। হিন্দু-মুসলমান কাধে কাধ মিলিয়ে বিপ্লব করার মিথ্যে গল্প আজও করে চলেছি। প্রশ্ন তুলিনি, তুললে সত্যের মুখােমুখি হতে হয়, বড় অস্বস্তি তাতে। গোঁড়া মােল্লাদের হাত থেকে তুরস্ককে বার করে এনে এক উন্নত আধুনিক রাষ্ট্ররূপে তৈরী করতে চেয়েছিলেন কামাল আতাতুর্ক। নজরুল যাকে নিয়ে কবিতা লিখেছিলেন “কামাল তু নে কামাল কিয়া ভাই”। খলিফাপন্থীরা আন্দোলন শুরু করলাে কামালের বিরুদ্ধে। এই প্রগতি বিরােধী আন্দোলনকে সমর্থন করতে বললেন মহাত্মা গান্ধী। আশা এই আন্দোলন সমর্থন করলে যদি মুসলমান সমাজ দয়া করে কংগ্রেসের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন করে। এই একটি ঘটনাই ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে মুসলমানদের ভূমিকাটি আরাে স্পষ্ট করে দেয়। এগুলাে ইতিহাসের সত্য। আমরা মিথ্যের জগতে থাকতে ভালােবাসি। তাই এইসব সত্যকে উপেক্ষা করি।।
অনেকে ক্রুদ্ধতায় মহাত্মা গান্ধীকে দুরাত্মা বলেন। মুসলিম তােষণের নায়ক এবং পাকিস্তানের স্রষ্টা বলে অভিযুক্ত করেন। আমি করি না। কারণ, আমার ধারণা মানুষের কিংবা জাতির জীবনে দু’ধরণের প্রেরণা আসে। কেউ বলে টিফিনে তুই কোথাও যাসনে দুজনে অঙ্ক করবাে। কেউ বলে এই চল জঙ্গলে গিয়ে বিড়ি খেয়ে আসি। ছাত্রটি তার প্রবণতা অনুযায়ী বন্ধু চয়ন করে। আমাদেরদর্পণে মুখােমুখিজাতীয় জীবনেও দু’ধরণের নেতৃত্ব এসেছিল। শিথিল নড়বড়ে আত্মসমর্পণে উন্মুখ মুসলিম তােষণে অভ্যস্ত মহাত্মা গান্ধী, অন্যদিকে বলিষ্ঠ বাস্তববাদী ত্যাগদীপ্ত সাভারকার। আমরা ভণ্ডামি ভালবাসি, তাই মহাত্মা গান্ধীকে বেছে নিলাম, অহিংসাবেছে নিলাম।অনেকেই মনে করেন অহিংসার মধ্যে দিয়ে বিনা রক্তপাতে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। মিথ্যে বলেই এগুলাে বিশ্বাস করি। লিওনার্ড মােশলে তার লাস্ট ডেজ অফ ব্রিটিশ রাজ” বইয়ে লিখেছেন, প্রত্যক্ষ সংগ্রামে মুসলমানদের হাতে শুধু পাঞ্জাবেই মারা গেছে ছ’লক্ষ হিন্দু। একটা মহাযুদ্ধেই শুধু এত মানুষ মারা যায়। এর সঙ্গে আছে নােয়াখালির “নরমেধ যজ্ঞ এবং সুরাবর্দীর পরিচালনায় “গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং”।এত নরমেধের পরও গান্ধীপন্থীরা অহিংসার জয় দেখেন। পাঞ্জাবে ছ’লক্ষ হিন্দু নিহত হয়েছিল তার মধ্যে সাড়ে চার লক্ষ শিখ হিন্দু, দেড়লক্ষ অশিখ হিন্দু। এটা কঠিন সত্য, তাই শিখেরা একথা ভুলে গেল। হত্যাকারীদের হাতে হাত রেখে তারা হিন্দু হত্যা করছে, খালিস্থান চাইছে, পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলছে। মহাত্মা গান্ধী পাঞ্জাব এবং কলকাতার ঘটনায় কোন প্রতিবাদ করেননি। নােয়াখালিতে শান্তিসভায় সুরাবর্দীকে সম্বােধিত করলেন “শহীদ সুরাবর্দী সাহেব” বলে। একেই আমরা মহাত্মা বললাম। লক্ষ লক্ষ বছরের একটা প্রাচীন জাতির পিতা বলে চিহ্নিত করলাম। আর রীর সাভারকার যিনি জীবনে কখনাে আপােষ করেননি অন্যায়ের সঙ্গে, যিনি অখণ্ড ভারতের প্রবক্তা ছিলেন, যিনি গােটা জাতিকে মিলিট্যান্ট করতে চেয়েছিলেন। যার প্রেরণায় সুভাষ বিদেশে গিয়ে সেনা সংগঠিত করে নেতাজী হলেন। অকথ্য অত্যাচার, যন্ত্রণা আর জেল ছিল যাঁর জীবনের সারা অংশ জুড়ে। সেই ত্যাগব্ৰতী সৈনিক ব্যারিষ্টার বিনায়ক দামােদর সাভারকারকে আমরা ভালাে করে চিনিই না। কিন্তু ফিল্ড মার্শাল ম্যনেশ তাকে চিনতেন। তাই তিনি লিখেছেনঃ সাভারকার নিজের জন্য কিছু চাননি।
দর্পণে মুখখামুখি
ভারত স্বাধীন হােক এটাই তার জীবনের একমাত্র আকাখা ছিল। ভারতের স্বাধীনতা লাভে তিনি যে পরিমাণ আনন্দিত হয়েছিলেন তার চাইতেও বেশী আঘাত পেয়েছিলেন ভারত বিভাগে। ১৯৬২ সালে চীনের সঙ্গে যুদ্ধে ভারতের পশ্চাৎ অপসারণ তার কাছে অসহ্য মনে হয়েছিল। ১৯৭১ সালে তিনি যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে ভারত পাকিস্তান লড়াইয়ে ভারতের জয় তার মনে অপার আনন্দের সঞ্চার করতাে। তিনি নিশ্চয়ই ডােকে আমাকে প্রশ্ন করতেন তােমার হাতে শক্তিশালী সেনাবাহিনী, সারা ভারতের জনমত তােমার পিছনে, তা সত্ত্বেও পাকিস্তানকে ভাঙতে তােমার তেবােদিন সময় লাগলাে কেন? আর মাত্র ৯৩ হাজার যুদ্ধবন্দী নিয়ে ফিরলে কেন? আমি তাকে উত্তর দিতাম, এ দোষ আমার একার নয়। যদি আপনি আমার মাথার ওপর থাকতেন তাহলে আমি মাত্র পাঁচদিনে শত্রুকে পরাজিত করতাম আর তিনলাখ শত্রুসেনাকে বন্দী করে নিয়ে আসতাম। ১৯৭১ সালে ভারতীয় বাহিনীর বিজয় সংবাদ পেলে বীর সাভারকার নিশ্চয়ই আমাকে ডাকিয়ে আমার পিঠ চাপড়ে প্রশংসা করতেন। সেটাই হতাে আমার জীবনের সর্বোচ্চ সম্মান। সেই সম্মান পেলে আমি কৃতজ্ঞ হতাম। ম্যনেশ বললে কি হবে, আমরা মিথ্যে ভালবাসি, ভণ্ডামি ভালবাসি। তাই সত্যনিষ্ঠ সাভারকার আমাদের কাছে অজ্ঞাত পরিচয়ের অন্ধকারেই রয়ে গেলেন। কারণ, সত্য বড়ই অপ্রীতিকর।
গ্রামােফোন রেকর্ডে-বাংলা শুধু হিন্দুর নয়, বাংলা শুধু মুসলমানের নয়, মিলিত হিন্দু মুসলমানের গুগ এই বাংলা—শুনেই আমরা গদগদ হয়ে গেলাম। সিরাজদ্দৌলার মতাে একটা ডিবকে ন্যাশনাল হিরাে বানিয়ে দিলাম। সিরাজের হাতে কারাে মা বােন নিরাপদ ছিল না। সিরাজ জগৎ শেঠের বিধবা বােন, অসামান্য সুন্দরী রাণী ভবানীর মেয়ে তারাসুন্দরীর দিকেও হাত বাড়িয়েছিল। মেয়েছেলের ব্যাপারে তার শত্ৰুমিত্র ভেদ ছিল না। তাই তার । পতন ঘটানাে হলাে। আমরা সিরাজকে বীর, আর জগৎশেঠকে বলি বিশ্বাসঘাতক। তার কারণ আমরা নাটক ভালবাসি, মিথ্যা ভালবাসি। টিপু সুলতান নাকি এক বীর, স্বাধীনতা সংগ্রামের এক যােদ্ধা। নিজের রাজ্য রক্ষার জন্য ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়েছিল। তাই নিয়ে কত নাটক, যাত্রা, থিয়েটার। অথচ তার যে রাজ্য সে রাজ্যের রাজা ছিল এক হিন্দু।
টিপু সুলতানের বাবা হায়দার আলি ছিল তার কর্মচারী। সেই রাজাকে হত্যা করে সিংহাসন দখল করে। তার মানে টিপু, টিপুর বাবা হচ্ছে খুনী এবং বিশ্বাসঘাতক। একথা কিন্তু কেউ বলে না, এটা নিষ্ঠুর সত্য কিনা তাই।সাভারকার বলেছিলেন রাজনীতিকে হিন্দুঘেঁষা করাে। এই কথায় নির সত্য আছে তাই আমাদের কাছে সহ্য হ’ল না। মহাত্মা গান্ধী বললেন, যে কোন মূল্যে হিন্দুমুসলিম ঐক্য চাই। আমরা এই মিথ্যের পিছনে দৌড়ে অর্ধেক ভারত হারালাম। রমেশ মজুমদার তার ইতিহাসে লিখেছেন, হিন্দুমুসলিম ঐক্য ভারতে কোনদিন ছিল না। এই মিথ্যেটাকে প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের চেষ্টার অন্ত ছিল না, ব্যর্থ হওয়ার পরও প্রচেষ্টার ক্ষান্তি নেই। সারা ভারতে হিন্দু সমাজের ঐক্যের কথা বললে এই ব্যক্তিরাই বলে হিন্দু ঐক্য অসম্ভব। কিন্তু হিন্দু মুসলিম ঐক্য সম্ভব। এই অবাস্তব কল্পনা কোন্ মনের ফসল? নিঃসন্দেহে ভণ্ড এবং স্ববিরােধী মনের। আজ একথা ফলিত রসায়নের মতই প্রতিষ্ঠিত, এই ভারতে হিন্দুত্বত ব্যক্তিরাই দেশকে দ্বিখণ্ডিত করে পাকিস্তান নির্মাণ করেছে। উত্তর পূর্বাঞ্চলে এবং দক্ষিণ ভারতে খ্রীষ্টভূমি গঠনে তারাই অগ্রণী। হিন্দুত্বত শিখেরা খালিস্থানের দাবী করছে। হিন্দু লাইন থেকে ডিরেল্ড হলেই এই দেশের অখণ্ডতার প্রতি আর কোন মমত্ববােধ থাকছে না। এই সত্যটা আমাদের চোখে পড়ছে না। কারণ, দীর্ঘকাল থেকে আমাদের চোখে লাগানাে আছে মিথ্যের কাজল। তাই এদেশের জাতীয় স্তরের নেতারা পাকিস্তান হতে পারে কল্পনাতেও ভাবেননি। পাকিস্তান হবার পরেও তারা বিশ্বাস করতে পারেননি রাষ্ট্র হিসাবে পাকিস্তান শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবে। মিথ্যের নেশা বােধহয় গাঁজা চরসের অপেক্ষাও শক্তিশালী।
দেশটা যখন মুসলমানরা ভাগ করেই নিলাে, তখন লােক বিনিময় করে হিন্দু মুসলমান সমস্যার সমাধান করে নেওয়া হল না কেন? তাতে যে ভণ্ডামি নেই, সত্য আছে। তা আমাদের ভাল লাগবে কেন? টু নেশন থিয়ােরর ভিত্তিতে দেশটাকে ভাগ করতে পারলাম। ওটা পাকিস্তান এবং মুসলিম রাষ্ট্র ঘােষিত হয়ে গেল, আমরা কিন্তু সাহস করে বলতে পারলাম না এটা হিন্দুর দেশ। পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ এই দুটো রাষ্ট্রই আমাদের জন্মশত্রু। জন্মকাল থেকেই এরা আমাদের ক্ষতি করে আসছে এবং যতদিন বেঁচে থাকবে করবে। এটাই পৃথিবীর নিয়ম–যার বীজে বিদ্বেষ থাকে তার ফসলে বিদ্বেষ থাকবেই। পাকিস্তান আমাদের বারবার আক্রমণ করেছে, জিততে পারেনি, হেরে গেছে। জিতলে কি করতাে তাও জানি, ইতিহাস সাক্ষী। অথচ অসংখ্য অপরাধের নায়ক এক লক্ষের কাছাকাছি পাকিস্তানী সৈনিকদের বন্দী করে এনে তিনবছর মাইনে দিয়ে পুষে আমার তাদের ফেরৎ দিয়েছি। ওরা আমাদের সাড়ে চারহাজার নিরপরাধ সৈনিককে বন্দী করে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলেছে। ওরা দেশে আইন পাশ করে হিন্দুর সম্পত্তি মানে শত্রুর সম্পত্তি। অর্থাৎ হিন্দু মানেই শত্রু। এটা তাদের ধর্মের ঘােষণা। সারা পৃথিবীর কোন মুসলমান এটা গর্হিত কাজ বলে মনে করেনি। ওদের চক্ষুলজ্জা নেই। আমরা মিথ্যে ভালবাসি তাই চক্ষুলজ্জা আমাদের। অনুপ্রবেশ, সব দেশে চরম রাষ্ট্রদ্রোহিতা—শাস্তি মৃত্যু। আমরা অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে বলতে পারি না, ভােটের লােভে তাদের রেশন কার্ড করে দিই। আমাদের সীমান্তে আমরা বেড়া দিলে ওরা গুলি চালায়, আমরা চুপ করে থাকি। ভারত বাংলাদেশ সীমান্তের প্রতিটি ভারতীয় অঞ্চলে আতঙ্কিত জীবন কাটায় হিন্দুরা ! বাংলাদেশী ডাকাতেরা এসে প্রায়ই ডাকাতি করে। কিছু না পেলে গরু ছাগলগুলােকেই নিয়ে যায়। এদেশের সরকার কিছুই করে ! যে কোন সময় আমরা বাংলাদেশকে চুর্ণ করে দিতে পারি, দখল করে নিতে পারি, এই আন্দাজ যদি ওদের দিতে পারতাম, তাহলে সব বন্ধ হয়ে যেত। এগুলাে সরুল সত্য তাই মনে মনে ভাবলেও বলতে পারি না, শত্রুকে মিত্র বলে ভণ্ডামি করি। ধ্বংসকে নিকটতর করি।| স্বামীজী বলে গেলেন, একজন ব্যক্তি হিন্দুসমাজ থেকে অন্য ধর্মে চলে গেলে হিন্দুর শুধু একটা সংখ্যাই কমে না, একজন শত্রু বাড়ে। তাহলে হিন্দুর প্রতি অন্যধর্মের কি ভূমিকা দাঁড়াচ্ছে? শত্রুর ভূমিকা। তারা তা গােপনও করে না। বিবেকানন্দ সত্য চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন।
পরবর্তী অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন…..
এটি এতটি ধারাবাহিক পোস্ট, পরবর্তী পোস্টটি পেতে আমাদের সাইটে চোখ রাখুন।
লেখক, ডাঃ শিবপ্রসাদ রায়