আফ্রিকার দ্বীপরাষ্ট্র মরিশাসে ৫২ শতাংশ জনগোষ্ঠী হিন্দু ধর্মের অনুসারী। সেখানে আর্য সমাজের অবস্থান অত্যন্ত দৃঢ়। ১৯১১ সালে মরিশাসে আর্য সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। আর্য পরোপকারিনি সভা নামে এই প্রতিষ্ঠান ১৯১৩ সালে নিবন্ধিত হয়। প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতীর আদর্শ অনুযায়ী পরিচালিত আর্য সমাজ সেখানকার হিন্দু জনগোষ্ঠীর ধর্ম, শিক্ষা এবং সংস্কৃতি বিকাশে প্রভূত ভূমিকা পালন করেছে। এর ভিতর উল্লেখযোগ্য ছিল বাল্য বিবাহ রোধ এবং নারী শিক্ষার বিস্তার। এর ফলে মরিশাসের হিন্দুরা আর্য সমাজকে প্রগ্রতিশীল চিন্তাধারার প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করেন। আর্য সমাজ সেখানে অনাথাশ্রম, প্রাথমিক এবং উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে।
তবে বলে রাখা ভালো, ১৯১১ সালে মরিশাসে আর্য সমাজ প্রতিষ্ঠিত হলেও ১৮৯৭ সালেই ব্রিটিশ ভারতের সেনাবাহিনীর সদস্যদের দ্বারা সেখানে আর্য সমাজের শিক্ষা পৌঁছে যায়। সেখানে প্রথম বেঙ্গল ইনফ্রেন্ট্রির সুবেদার ভোলানাথ তিওয়ারি ছিলেন আর্য সমাজের অনুসারী। ১৯০২ সালে সেই সেনারা মরিশাস ত্যাগ করলেও সেখানে সত্যার্থ প্রকাশ আর সংস্কার বিধির একখানা করে কপি রেখে যান। সেই বইদুটি দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ১৯০৩ সালে অনানুষ্ঠানিক ভাবে বেকারিলাল সিং, লাল খেমলাল আর গুরুপ্রসাদ দুলজিৎ কিউরপাইপ শহরে আর্য সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। এই তিনজন সেখানে হিন্দু সমাজের অধঃপতন নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। তাদের এই কাজ এখানকার হিন্দুদের মাঝে জাগরণ শুরু করল।
১৯০৭ সালে মনিলাল ডাক্তার মরিশাসে আগমনের পর এই আন্দোলন বেগ পায়। মনিলাল ডাক্তার নাম হলেও তিনি ছিলেন একজন আইনজীবী। তিনি হিন্দিতে আর্য সমাজের একটি ম্যাগাজিন প্রকাশ করেন। ১৯১১ সালের ৮ মে পোর্ট লুইসে আরেকটি আর্য সমাজের শাখা চালু হয়। এই দুই শাখা মিলে আর্য পরোপকারিনি সভা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯১১ সালের ১৫ ডিসেম্বর চিরঞ্জীবী ভরদ্বাজ মরিশাসে এসে এই আন্দোলনে আরও বেগ প্রদান করেন। ভ্যাকোয়াজ, ট্রায়োলেট, লেবারডোনাইস, প্যাম্পলমাউসেস আর রিভিয়ে দেস এনগুইলেসে আর্য সমাজের শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি সান্ধ্য হিন্দি ক্লাস শুরু করেন। গ্রামে বেদের বাণী প্রকাশ করেন। ১৯১৩ সালে চিরঞ্জীবী ভরদ্বাজে পোর্ট লুইসে আর্য সমাজের স্থায়ী ভবন স্থাপন করেন। মরিশাসের আর্য সমাজ ধর্মশিক্ষা এবং প্রচারের জন্য তাদের কর্মীদের প্রশিক্ষণ নিতে ভারতে প্রেরণ করেন।
এই কর্মীরা প্রশিক্ষণ নিয়ে মরিশাসে ধর্মপ্রচার শুরু করেন। ১৯১৪ সালে ভারত থেকে স্বামী স্বতন্ত্রানন্দ এসে আর্য সামজের মুখপত্র আর্য পত্রিকা প্রকাশ শুরু করেন। ১৯১৬ সালে তিনি ভারতে ফিরে যান। তাঁর মশাল বহন করে নিয়ে যান তাঁর ছাত্র পণ্ডিত কাশীনাথ কিস্ট। পণ্ডিত কাশীনাথ প্রকাশ্যে বিতর্কে অংশ নেন। ১৯২৪ সালে সেখানে প্রথম বৈদিক স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। সাথে সাথে দুইটা প্রাথমিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করে। ১৯২৬ সালে স্বামী বিদ্যানন্দ সরস্বতী মরিশাসে আগমন করেন। তিনি অডিও ভিসুয়াল পদ্ধতিতে তার লেকচার প্রদান করেন এবং একই সাথে শুদ্ধিকরণ কার্যক্রম শুরু করেন।
১৯২৭ সালে আর্য প্রতিনিধি সভা স্থাপিত হয়। এটি ছিল আর্য সমাজের আরেকটি শাখা। একে দিল্লীর সর্বদেশিক আর্য প্রতিনিধি সভা (ওয়ার্ল্ড কাউন্সিল অফ আর্য সমাজ) স্বীকৃতি দান করেন এবং জনপ্রিয়তা লাভ করেন। ১৯৩৩ সালে এই দুই সংগঠন (আর্য প্রতিনিধি সভা আর আর্য পরোপকারিনি সভা) স্বামী দয়ানন্দজির ৫০ তম মৃত্যুবার্ষিকী পালন করেন।
১৯৩৪ সালে আর্য রবি বেদ প্রচারিনী সভা নামে আরেকটি আরেকটি শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। এতগুলো বিভক্তির পরও আর্য সমাজ বৈদিক ধর্মপ্রচার করতে থাকে। ১৯৫০ সালে স্বামী স্বতন্ত্রানন্দ মরিশাসের ত্রিভক্ত আর্য সমাজের একতার উদ্যোগ নেন। আর্য প্রতিনিধি সভা আর আর্য পরোপকারিনি সভার সদস্যরা এক হয়ে মরিশাস আর্য সভা প্রতিষ্ঠা করেন। আর্য রবি বেদ প্রচারিনী সভা আলাদাভাবে চলার সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর স্বামী স্বতন্ত্রানন্দ ভারতে ফিরে যান। আর্য প্রতিনিধি সভার প্রথম নির্বাচনে প্রাক্তন আর্য প্রতিনিধি সভার সকল সদস্য পরাজিত হন। তারা ১৯৫৪ আর্য প্রতিনিধি সভা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। সর্বদেশিক আর্য প্রতিনিধি সভা বাধ্য হয়ে আবার হস্তক্ষেপ করেন এবং স্বামী দুরবানন্দ সরস্বতীকে প্রেরণ করেন।
১৯৫৮ সালে মরিশাস আর্য সভা আবার একত্রিত হন। ১৯৭০ সালে মরিশাস আর্য সভা এবং আর্য রবি বেদ প্রচারিনী সভা যৌথভাবে মরিশাসে আর্য সভার ষাট বছর উৎযাপন করেন। আর্য সমাজ মরিশাসে হিন্দি ভাষার প্রচার করে এবং ১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই সেখানে প্রথম হিন্দি স্কুল প্রতিষ্ঠা করে। সেখানে ধীরে ধীরে অন্য বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত হয় এবং ধীরে ধীরে তা সরকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। ১৯২০ সালের ভিতর সেখানে ৭৫ টি হিন্দি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। আর্য সমাজের চাপে মরিশাসের স্কুলে এশীয় ভাষার ক্লাস নেওয়া শুরু হয়। ১৯৩৮ সালে আরেকটি বৈদিক স্কুল চালু হয়। ১৯৬৫ সালের ১১ জানুয়ারি পোর্ট লুইসে দয়ানন্দ এংলো বৈদিক কলেজ (ডিএভি) প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই স্কুলে সেকেন্ডারি লেভেলে হিন্দি ভাষার শিক্ষা শুরু হয়।
আর্য সমাজ ১৯৪০ সালে মরিশাসে একটি অনাথাশ্রম চালু করে। আর্য সমাজ শুরু থেকেই নারীদের সমাধিকার প্রচার শুরু করে। ১৯১২ সাল থেকে সেখানে নারীশিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে। ভ্যাকোয়াজে একটি নারী সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৩১ সালে পোর্ট লুইসে মহিলা মণ্ডল প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৩৩ সালে একটি আর্য সমাজ সেখানে ৫০০ নারীর সম্মেলন আয়োজন করেন। এই সম্মেলন ধীরে ধীরে মরিশাসের বিভিন্ন জায়গায় আয়োজন করা হয়। ১৯৬৫ আর ১৯৭০ সালে পোর্ট লুইসে মহিলা মণ্ডল সম্মেলন আয়োজন করে। এখন মরিশাসে ৫০টির মত মহিলা সভা আছে।১৯৬৭ সালে আর্য সমাজ আর্য যুবক আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে। এরা ভারতীয় হিন্দু সংস্কৃতি যুবকদের মাঝে প্রচার করে। বর্তমানে সারা মরিশাসে আর্য সমাজের ৪০০টির মত শাখা এবং ২৪৭ টি আর্য মন্দির আছে।
সূত্র:-
- মরিশাস বিশ্বের কাছে হিন্দুদের গর্বিত করেছে ! – UHC বাংলা
- বিশ্বের কাছে হিন্দুদের গর্বিত করেছে মরিশাস!
- বাংলাদেশ অগ্নিবীর
- সত্য প্রকাশে নির্ভীক সৈনিক
লেখাটি ভাল লাগলে এবং আমাদের পাশে থাকতে অবশ্যই একটা লাইক দিয়ে রাখুন। ধন্যবাদ সকলকে।