শিরােনামটি পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক আবহাওয়ায় একেবারেই অচ্ছুৎ জেনেও সরাসরি সমস্যার পরিচয়ে যাওয়ার জন্য এই উসকানি। না বললেও চলে যে পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘু বলতে মুসলমান জনগােষ্ঠীকেই বােঝায়, ও তার চাপে অন্যান্য ধর্মীয় বা ভাষাগত সংখ্যালঘু গােষ্ঠীদের এখানে কোন সংখ্যালঘু পরিচয় গড়েই ওঠেনি। অর্থাৎ সঁওতাল সংখ্যালঘু বা নেপালি সংখ্যালঘু কথাটি বাংলায় অচল।
পশ্চিমবঙ্গে এই সংখ্যালঘু মুসলমান জনগােষ্ঠীর বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে, সবচেয়ে বড় সমস্যা যে এই জনগােষ্ঠীর বৃহদংশ প্রবল দারিদ্রের মধ্যে রয়েছেন এবং তার সঙ্গে এই জনগােষ্ঠী দিনে দিনে ধর্মীয় সংকীর্ণতায় নিমজ্জিত হচ্ছেন। এই নিবন্ধ সংখ্যালঘু মুসলমানদের এই সমস্যার আলােচনায় যাবে না যদিও তা অবশ্যই জরুরী।
তবে এই সমস্যা নিয়ে অনেক আলােচনা হয়। এই নিবন্ধ প্রশ্ন করবে যে এই সংখ্যালঘু মুসলমান জনগােষ্ঠী ধর্মনিরপেক্ষ পশ্চিমবঙ্গীয় সমাজের জন্য একটি সমস্যা হয়ে উঠছে কিনা এবংবিশেষ সংখ্যালঘু?
যদি প্রশ্ন করা হয় পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান জনগােষ্ঠীকে সত্যিই সংখ্যালঘুর বিশেষ মর্যাদা দেওয়া যায় কিনা তবে হয়ত লেখকের পাটিগণিতের জ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন উঠে যাবে। কিন্তু এটা বােঝা উচিত যে সংখ্যায় কম হলেই তাকে সংখ্যালঘুর বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয় না।
- ধ্বংসের পর, পুরনো রূপে ফিরে এসেছে ১৪০০ বছরের পুরনো ভগবান বুদ্ধমূর্তি।
- বোরকা নিষিদ্ধ: ৫১ শতাংশ সুইস জনগণ বোরকা নিষিদ্ধ করার পক্ষে ভোট দিয়েছেন।
- বাংলাদেশে ১০০০ বছরের হিন্দু মন্দির উন্মোচিত।
- মঙ্গলে সফল অবতরণ করলো নাসার “পারসিভের্যান্স”, অভিনন্দন ডক্টর স্বাতী মোহনকে।-সোজাসাপ্টা
- ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর: ব্রিটিশ ভারতের বৃহত্তম সমাজ সংস্কারক।-সোজাসাপ্টা
- ফ্রান্সে উগ্র মৌলবাদকে নির্মূলের জন্য নতুন বিল পাস, কি থাকছে বিলে?-সোজাসাপ্ট
জনসমাজে চোর, ডাকাত বা ব্রাহ্মণরাও সংখ্যায় কম কিন্তু তা বলে। তাদের সংখ্যালঘু বলা হয় না, পাড়ার মাস্তানকে আমরা সংখ্যালঘুর মর্যাদা দিই না।
অতীতে দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গরা, ইরাকে সুনি মুসলিমরা বা ভারতের একটা বড় অংশে মুসলমানরা সংখ্যালঘু হয়েও সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন, তখন তাদের আমরা সংখ্যালঘুর মর্যাদা দিই না।
সুতরাং জনসমাজে সেই অংশকেই সংখ্যালঘুর মর্যাদা দেওয়া হয় যারা সংখ্যায় কম হওয়ার ফলে সমাজ বা রাষ্ট্র দ্বারা দীর্ঘদিন নিপীড়িত, সে নিপীড়ন অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় বা ভাষাগত হতে পারে।
১৯৪০ সালে, দেশভাগ হবার অনেক বছর আগে বাবাসাহেব আম্বেদকার পাকিস্তান প্রস্তাব সম্পর্কে আলােচনায় বলেছিলেন ‘দু দেশের মধ্যে সংখ্যালঘু বিনিময় কেবল মাত্র দীর্ঘস্থায়ী সাম্প্রদায়িক শান্তির পথ।
তিনি আরাে বলেছিলেন যে পাকিস্তান না হলে দেশে সাম্প্রদায়িক গােলমালে জড়িত থাকবে সাড়ে ছ কোটি মুসলমান আর পাকিস্তান হয়ে গেলে পড়ে থাকবে দুকোটি মুসলমান। ..আমার মনে হয় পাকিস্তান হিন্দুস্তানের সাম্প্রদায়িক সমস্যা সমাধান করবে না।
কিন্তু তা যথেষ্ট পরিমাণে কমাবে। পাঞ্জাবে দেশভাগের সময় কার্যতঃ জনবিনিময় ঘটে, ফলে পূর্ব পাঞ্জাবে (ভারতের পাঞ্জাব) মুসলমান জনসংখ্যা ৩৩. ১% থেকে কমে দাঁড়ায় ১.৮%।
ফলে আম্বেদকারের ভবিষ্যৎবাণী অনুযায়ী পাঞ্জাবে গত ৬০ বছরে হিন্দুমুসলমান বা শিখ-মুসলমান সমস্যা আর ঘটে নি, পাকিস্তান থেকে নিয়মিত উদ্বাস্তু আগমনও আর হয়নি। বাবাসাহেবের এই উপদেশ পশ্চিমবঙ্গ শােনেনি, তাই উদ্বাস্তু সমস্যার শেষ আজও হল না, হল
‘সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধানও। ফলে ১৯৫১ সালের ১৯ শতাংশ সংখ্যালঘু এখন বেড়ে ৩০ শতাংশের কাছাকাছি।পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের অর্থনৈতিক পশ্চাদপরতার জন্য কতটা রাষ্ট্র দায়ী আর কতটা মুসলমান সমাজের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গী দায়ী তা বিতর্কিত। বামফ্রন্ট সরকার সার্বিকভাবেই পশ্চিমবঙ্গের দারিদ্র |
দূরীকরণে একেবারে ব্যর্থ, তার প্রভাব দরিদ্র মুসলমান সমাজসহ সব দরিদ্রকে ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এজন্য দারিদ্রকে মাপকাঠি করে যে উন্নয়নের কার্যক্রম নেওয়া প্রয়ােজন তা ধর্মনির্বিশেষে কারও জন্যই নেওয়া হয়নি। ফলে মুসলমান সমাজ যে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা বলবার অপেক্ষা রাখে না।
যথেষ্ট সুযােগসুবিধা থাকা সত্বেও ঠিক একই অবস্থা ঘটেছে আদিবাসী ও অন্যান্য হিন্দু দরিদ্রতম মানুষদের ক্ষেত্রেও। কিন্তু মুসলমান সমাজের এই পশ্চাদপরতার জন্য মুসলমান জনগােষ্ঠীর স্বার্থবিরােধী অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় বা ভাষাগত কোন সরকারি বিশেষ বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
মনে রাখতে হবে এই সংখ্যালঘু মুসলমানরাই কিন্তু ভারতে ও বাংলায় কয়েকশ বছর রাজত্ব করেছেন, ফলে এদেশে চিরকাল সংখ্যালঘুর দুরবস্থা তাদের কখনােই ছিল না। এর পর দু’শ বছরের ব্রিটিশ রাজত্বেও মুসলমানরা সংখ্যাগু রু হিন্দুদের শাসনে ছিলেন না। বরং যুক্ত বাংলায় স্বাধীনতার পূর্বে মুসলিম লীগই ছিল প্রধান শাসক দল।
সেজন্যই একদাশাসক সংখ্যালঘু মুসলমানদের সঙ্গে হিন্দুসমাজের চিরকাল নিপীড়িত তফসিলি সমাজের পশ্চাদপরতার তুলনা করা চলে না। স্বাধীনতাপরবর্তী পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘু মুসলমান জনগােষ্ঠীর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় বা ভাষাগত ক্ষেত্রে কোন সরকারি বিশেষ বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয় নি।
দীর্ঘকালীন অবিশ্বাসের জন্য বাড়িভাড়া থেকে বেসরকারি চাকরির ক্ষেত্রে সংখ্যাগুরু হিন্দু সমাজে পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘু মুসলমানদের যে অনেক অসুবিধায় ভুগতে হয় তা অনস্বীকার্য। কিন্তু মুসলমান সমাজের উপর শারীরিক অত্যাচার, নারীদের উপর অত্যাচার, সম্পত্তির লুণ্ঠন বা বিতাড়ন –
এধরণের ঘটনা পশ্চিমবঙ্গে বিরল যা বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের ক্ষেত্রে অতি সাধারণ অভিজ্ঞতা। এর জন্য (পরে আরাে বিশদে আলােচনা করা হয়েছে) দেশভাগের প্রাথমিক ধাক্কার পর নিরাপদ পশ্চিমবঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান ও পরে বাংলাদেশ থেকে মুসলমানরা চলে এসেছেন ও আসছেন।
ফলে পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘু মুসলমান সমাজ তার দরিদ্র অংশের অর্থনৈতিক অবস্থানের উন্নতি তেমন না ঘটাতে পারলেও ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দাপটে যথেষ্ট শক্তিশালী। এই দাপটে তারা পশ্চিমবঙ্গের সামাজিক সাংস্কৃতিক মূল্যবােধের অবস্থানকে ইতিমধ্যেই পাল্টাতে শুরু করেছেন।
এই ‘সংখ্যালঘুদের দাপটে পশ্চিমবঙ্গ থেকে নির্বাসিত হয়েছেন সাহিত্যিক তসলিমা নাসরিন, এই সংখ্যালঘুদের দাপটে কলকাতায় স্থাপিত হয়েছে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় যাতে আরবি ভাষা ও ইসলামি বিষয় পড়া বাধ্যতামূলক। এর ছাত্রী ও অধ্যাপিকাদের বােরখা পরাও বেসরকারিভাবে বাধ্যতামূলক।
এই ‘সংখ্যালঘুদের দাপটে ক্রমশঃ পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সমাজের শিক্ষা হয়ে উঠছে ধর্মীয় মাদ্রাসা ভিত্তিক, অন্য কোন ধর্মের এরকম আলাদা শিক্ষাব্যবস্থা পশ্চিমবঙ্গ বা ভারতে নেই।
সংখ্যালঘু উন্নয়ন বলতে উলেমা ইমামদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে মুসলমান সমাজকে। সুতরাং এই সংখ্যালঘুদের দাপটে একটি গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ বহুমাত্রিক পশ্চিমবঙ্গীয় সমাজের ধ্বংসের কাজ কমুনিস্ট, কংগ্রেস ও তৃণমূল কংগ্রেসের কল্যাণে শুরু হয়ে গেছে। সুতরাং পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান জনগােষ্ঠীকে একটি বিশেষ সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বললে হয়ত ভুল হবে না।
লেখক- মোহিত রায়
সুত্র:-
1. B.R.Ambedkar Pakistan or Partition of India, p 116, Babashaeb Ambedkar Writings and Speeches Vol8, Education Department, Government of Maharashtra, 1990.
Abdul Barkat et al – Deprivation of Hindu Minority in Bangladesh – Living with Vested Property, Pathak Samabesh, Dhaka, 2008. * Bangladesh Hindu Buddhist Christian Unity Council – Communal Discrimination in Bangladesh: Facts and Documents, pp 431-435, Dhaka 1993. ১০ একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মল কমিটি – ১৫০০ দিনের সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিবরণ – শ্বেত পত্র, সম্পাদনা – শাহরিয়র কবির, ৩ খন্ড, ঢাকা, ২০০৫
Abdul Barkat et al – Deprivation of Hindu Minority in Bangladesh – Living with Vested Property, pp 66-68, Pathak Samabesh, Dhaka, 2008.
Mohammad Rafi, Can We Get Along, pp 201, Panjere Publications, Dhaka 2005 * Wikepedia 64 se 616-19 932120 og were fat 192T I
পশ্চিমবঙ্গের মাদ্রাসা শিক্ষা আজ দেশের গর্ব – তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, আগস্ট, ২০১০। ১৪ গিয়াসুদ্দিন – মাদ্রাসা শিক্ষার পশ্চাদগামিতা নয়, চাই মুলধারার আধুনিক উচ্চশিক্ষা – হিযাব ঃ নারী দাসত্বের প্রতীক, পৃ-১২৭, – মার্চ, ২০১০, কলকাতা। * মাদ্রাসা দর্পণ, ষষ্ঠ বর্ষ, পাঠ্যসূচী সংখ্যা – পশ্চিমবঙ্গ মাদ্রাসা শিক্ষা পর্ষ, আগস্ট ২০০৭
Hiranmoy Karlekar, Bangladesh – The Next Afghanisthan, Pp 38, Sage Publications 2005 ১৯ অনুপ্রবেশ , অস্বীকৃত উদ্বাস্তু ও পশ্চিমবঙ্গের অনিশ্চিত অস্তিত্ব – মােহিত রায়, অনুষ্টুপ, শারদীয় ২০০৯ ২৩ মহাপ্রাণ যােগেন্দ্রনাথ • জগদীশ মন্ডল, ১ম খন্ড, পৃ ২২১ (উদ্ধৃত -ভারত বিভাজন যােগেন্দ্রনাথ ও আম্বেদকর – শ্রীবিপদভঞ্জন বিশ্বাস, পৃ ১৫, বিবেকানন্দ সাহিত্য কেন্দ্র, কলকাতা, ২০০৩)। ২” ভারত বিভাজন যােগেন্দ্রনাথ ও আম্বেদকর – শ্রীবিপদভঞ্জন বিশ্বাস, প ১২৭-৩২, বিবেকানন্দ সাহিত্য কেন্দ্র, কলকাতা, ২০০৩। যােগেন্দ্রনাথ মন্ডলের মূল ইংরাজীতে পদত্যাগপত্র ও তার বঙ্গানুবাদ পাওয়া যাবে শ্রীদেবজ্যোতি রায়ের লেখা ‘মুসলিম রাজনীতি ও যােগেন্দ্রনাথ মন্ডলের পদত্যাগ বইতে। প্রাপ্তিস্থান – বিবেকানন্দ সাহিত্য কেন্দ্র, ৬ বস্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট, কলকাতা ৭৩ ২২ মহাপ্রাণ যােগেন্দ্রনাথ – সদানন্দ বিশ্বাস , পৃঃ ১৬০- ১৬১, দীপালি বুক হাউস, কলকাতা ২০০৪ **The Telegraph – Sunday, August 3, 2008 ২৪ আনন্দবাজার পত্রিকা, ৮ সেপ্টেম্বর ২০১০