শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির মৃত্যু রহস্য,অবহেলিত ও বিস্মৃত নায়ক ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়- (শেষ পর্ব)

অবহেলিত ও বিস্মৃত নায়ক ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়

২৭ লন্ডন থেকে ফিরে এসে এই কথাই বলেছিলেন এবং তিনি বলেছিলেন এক শােকবহ দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে আর এক প্রকারে মুক্তি পেলেন। শ্যামাপ্রসাদজীও তাকে গ্রেপ্তারের পর জানিয়ে দিলেন যেভাবে ভারত সরকার তার কাশ্মীর ঢােকার পথ সুগম করেন এবং কাশ্মীর সরকার নিরাপত্তার কারণে গ্রেপ্তার করেন তা হতে ভারত সরকার ও কাশ্মীর সরকারের মধ্যে এক ষড়যন্ত্রের কথা প্রমাণিত হয়। শ্যামাপ্রসাদ ১১ই মে বন্দী হওয়ার পর প্রায় চল্লিশ দিন বন্দী অবস্থায় থাকেন অবশেষে ২৩শে জুন শহীদ হন। তাকে কোথায় কীভাবে রাখা হয়েছিল তাঁর সহবন্দী গুরুদত্ত বৈদের বিবরণ থেকে কিছুটা উল্লেখ করছি

 

অবহেলিত ও বিস্মৃত নায়ক ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়  (পর্ব ১ম)

অবহেলিত ও বিস্মৃত নায়ক ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়-দ্বিতীয় পর্ব।

শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির অবদান, অবহেলিত ও বিস্মৃত নায়ক ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়-(তৃতীয় পর্ব)

বাংলার বাঘ আশুতোষ মুখোপাধ্যায় সন্তান শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির অবদান-(৪র্থ পর্ব)

তাকে যে কুটীরে রাখা হয় আয়তনে ক্ষুদ্র অপরিসর। প্রধান কামরাটি ১০ x ১২ ফুট। তাঁরা তিন জন বন্দী ছিলেন চার জন থাকার মত জায়গা ছিল না। পাশের ছােট দুটি কামরায় সহ বন্দীদের রাখার ব্যবস্থাও করা হয়েছিল। ১৯ শে জুন যখন পণ্ডিত ডােগরা এলেন তখন তার বাইরে একটি তাবু খাটিয়ে রাখা হয়। কুটীর সংলগ্ন প্রাঙ্গণটি ফলের গাছ ও তরকারীর ক্ষেত ছিল, বেড়ানাের মত জায়গা ছিল না। এর ফলে তার খাবার প্রতি অনীহা এসে গিয়েছিল যদিও তিনি বেড়ানাের অনুমতি চেয়েছিল কিন্তু তাঁকে অনুমতি দেওয়া হয় নাই। জায়গাটি ছিল শহর থেকে প্রায় আট মাইল দূরে। এখানে চিকিৎসার কোনও প্রকার ব্যবস্থা ছিল না। প্রয়ােজন পড়লে শহর থেকে ডাক্তার ডেকে আনতে হত। তাঁর জন্য কোনও টেলিফোনেরও ব্যবস্থা ছিল না। নিকটবর্তী টেলিফোন ছিল জল সরবরাহ অফিসের বাড়ীতে। ওখানে থেকে দূরে এবং কম্পাউন্ডের বাইরে থাকায় ফোনটি ব্যবহার করা যেত না। তা ছাড়া অফিসের সময় ছাড়া টেলিফোন ঘর বন্ধ থাকত। হিন্দুস্থান টাইমস এবং পরে হিন্দুস্থান স্টান্ডার্ডও পত্রিকা তাকে দেওয়া হয়েছিল তবে সুপারিন্টেডেন্ট পত্রিকাগুলি নিয়ে আসতেন। শ্রীনগর থেকে আসা চিঠিপত্র পেতেও প্রায় এক সপ্তাহ লেগে যেত।

জেলে থাকার সময় তাকে বন্ধ বা আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। তার পত্র শ্রীনগরে বাবার সঙ্গে দেখা করা অনুমতি চেয়েছিল কিন্তু দিল্লীর সরকার তাকে শ্রীনগরে বাবার সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দেয়নি। ২৪ শে মে নেহরু শ্রীনগরে বিশ্রামের জন্য বেড়াতে যান। ভদ্রতার খাতিরে তিনি কেমন আছেন বা অন্যান্য খরব নেওয়ার মত সামান্যতম সৌজন্যটুকু তিনি দেখাননি, ফিরে এসে তিনি দুমাসের জন্য লন্ডনে ছুটি কাটাতে গেলেন।

৩ রা জুন থেকে তার পায়ের ব্যথা শুরু হয় ৬ তারিখ থেকে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করেন। জ্বর শুরু হয়। তার আত্মীয়রা ডাঃ রায়ের সঙ্গে দেখা করে তার অসুস্থতার কথা জানান এবং তাঁকে কাশ্মীরের সঙ্গে যােগাযােগ করার অনুরােধ জানান। তারপর থেকে তার ওজন কমে যাচ্ছিল তিনি খুব দুর্বল হয়ে পড়ে ছিলেন। ২০ তারিখে ডাঃ আলি মহম্মদ ও অমরনাথ রায়না তাকে পরীক্ষা করেন এবং চিকিৎসা করে বলেন ড্রাই প্লুরিসির জন্য তার

২৮ অবহেলিত ও বিস্মৃত নায়ক ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখােপাধ্যায়

কষ্ট হচ্ছে। এজন্য তার আপত্তি সত্ত্বেও তাঁকে Streptomycen ইনজেকসন দেওয়ার ব্যবস্থা করেন, কেননা ঐ ইনজেকসন তাঁর শরীরের পক্ষে সহ্য হবে না একথা পারিবারিক চিকিৎসক জানিয়েছিলেন। ২১ শে জুন তার জ্বর ও বুকের ব্যথা বাড়ে, কিন্তু ডাঃ আলি তাকে দেখতে আসার প্রয়ােজন মনে করেনি। ২০ শে জুন শ্যামাপ্রসাদজী তার অসুখের খবর বাড়ীতে জানানাের জন্য সুপারিনটেন্ডেন্টকে বলেন কিন্তু সে সংবাদ জানানাে হয়নি বা কোন প্রকার বুলেটিনও প্রচার করেন নি। ২২তারিখে অসুস্থতার জন্য তাঁকে নাসিং হােমে পাঠানাের ব্যবস্থা করা হয়। ২০ শে জুন তার রােগ প্লুরিসি বলে নির্ণয় করা হলেও তাকে ২০ থেকে ২২শে জুন পর্যন্ত নার্সিংহােমে পাঠানাের ব্যবস্থা করা হয়নি। রােগের এমন অবস্থা সত্ত্বেও তার কোনও প্যাথােলজিক্যাল পরীক্ষা করা হয়নি তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় তার দুই সহ বন্দীকে তাদের অনুরােধ সত্ত্বেও সঙ্গে বাবার অনুমতি দেওয়া হয়নি। তাকে কোনও নার্সিংহােমেও ভর্তি করা হয়নি সরকারী হাসপাতালে স্ত্রীরােগ সংক্রান্ত ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। সেই সময়ও তাকে পুলিশ প্রহরায় কয়েদীর মত বন্দী করে রাখা হয়। ২৩ তারিখে ভাের পৌনে চারটার সময় তার মৃত্যু হয়। তিনি চাইলেও তার সহবন্দীদের মৃত্যু শয্যার পাশে উপস্থিত থাকতে দেওয়া হয় নি। এদিকে ২৩ শে জুন সকাল পৌনে ছটায় শ্যামাপ্রসাদজীর ৭৭ নং বাড়ীতে টেলিফোন বাজে। দাদা জাষ্টিস রমাপ্রসাদ মুখার্জী টেলিফোন ধরেন। অপর প্রান্ত থেকে অপারেটর সংবাদ জানান যাহা বিনা মেঘে বজ্রাঘাতের মত এসেছিল। বৃদ্ধা মা যােগমায়া দেবী তখন পূজা করছেন। বাড়ীর সকলে তখন টেলিফোনের কাছে জড়াে হয়েছে। অপারেটর জানান- Sree Nagar Tells me that there is message form Sheikh Abdulla to you and the message is that Dr Shyamprosad is dead and Sheekh Abdulla wants to know what about the disposal of the body” খবরটা শুনে সকলে স্তম্ভিত হয়ে যান। জাষ্টিস মুখার্জী যখন বিস্তারিত খবর জানতে চাইছেন তখন অপারেটর জানান শ্রীনগর বলছে যে তিন দিন আগে ডঃ মুখার্জীর প্লুরিসি রােগ হয় এবং গতকাল তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া এবং সেখানে তিনি ৩.৪০ মি নাগাদ হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। তখন মি. মুখার্জী খবরটা সত্যতা জানতে চান তখন দিল্লীর অপারেটর আবার শ্রীনগরের সঙ্গে যােগাযােগ করে জানান কাশ্মীরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মি. ধর টেলিফোনে জানিয়েছেন। জাস্টিস মখাজী জানান যে বডি অবশ্যই কলকাতায় পাঠাতে হবে। তখন অপারেটর জানান কাশ্মীর সরকার আবার আধঘন্টা বাদে টেলিফোন করবেন বলে জানিয়েছেন। এইভাবেই শ্যামাপ্রসাদের মৃত্যুর খবর তাঁর জননীও পরিবার বর্গকে জানানাে হয়।

নেহরুজী ফিরে এসে জানান যে টেলিফোনে যােগাযােগের কারণেই এরূপ ভাবে সংবাদ বাড়ীতে জানান হয়। আসলে ভারত সরকার কাশ্মীর গভর্ণমেন্টের কাছে Flash messege এ এই খবর পান। তখন হােম সেক্রেটারী মি. পাই কাশ্মীর সরকারকে নির্দেশ

অবহেলিত ও বিস্মৃত নায়ক ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখােপাধ্যায়।

দেন অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ার জন্য যেন ডাঃ মুখার্জীর পরিবারবর্গের সঙ্গে যােগাযােগ করেন। আসলে কাশ্মীর সরকার প্রথমে ভারত সরকারকে মৃত্যু সংবাদ জানান এবং ভারত সরকারের নির্দেশেই শ্যামাপ্রসাদজীর বাড়ীতে খবর দেন। এই মর্মান্তিক দুঃসংবাদ সময় নষ্ট না করে কাশ্মীর সরকার শ্যামাপ্রসাদজীর বাড়ীতে সরাসরি জানাবার প্রয়ােজন মনে করেন নি। সুতরাং টেলিফোনে যােগাযােগের বাধা-বিঘ্নের কাহিনী ধােপে টেকে না।

মৃত শ্যামাপ্রসাদকে নিয়েও ষড়যন্ত্র শুরু হল। ৮টা নাগাদ শবদেহ বার করা হল। শ্যামাপ্রসাদজী বন্দী অবস্থায় বই পড়ে, ডায়েরী লিখে ও অন্যান্য কিছু লেখা নিয়ে সময় কাটাতেন। হাসপাতালে যাবার সময় সেই ডায়েরী ও কাগজগুলি নিয়ে যান। তাঁর ব্যবহৃত হাতঘড়ি, কলম, সুটকেস পাওয়া গিয়েছে কিন্তু সঙ্গের অ্যাটাচি কেসটা ছিল না। সুটকেসে কোনও তালা বা চাবি ছিল না। সেই লেখা বা ডায়েরী পাওয়া যায়নি। কাশ্মীর সরকারকে বিশেষ অনুরােধ জানিয়েও সেগুলি ফিরে পাওয়া যায়নি এবং তারা এসব রেখে দিয়েছেন বলে অস্বীকার করেছিলেন। স্বভাবতঃই সন্দেহ জাগে কাশ্মীর সরকার ডায়েরী বা কাগজপত্র চেপে রেখেছেন কেননা তাহলে বন্দী জীবনের অনেক কিছু মূল্যবান তথ্য জানা যেত।

৮.৪০ মি. নাগাদ শবদেহ বিমানবন্দরের দিকে রওনা হয়। ৯.০৫ নাগাদ বিমানবন্দরে পৌঁছায়। সেখানে সেখ আবদুল্লা ছাড়া সকল মন্ত্রীই উপস্থিত ছিলেন। ১০-১৫ মি নাগাদ মুখ্যমন্ত্রী এলেন। ১০-৩০ মি নাগাদ প্লেন রওনা দেয় এবং বেলা ৩টা নাগাদ দমদমে পৌঁছাবে আশা করা গিয়েছিল। কিন্তু সেই বিমান পৌঁছাল রাত্রি ৯ টায়। কৌসুলী শ্ৰীত্রিবেদী ওই শবদেহের সঙ্গে আসছিলেন। তিনি অত্যধিক বিলম্বের কয়েকটি কারণের উল্লেখ করেছিলেন। মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল শবদেহ যেন রাত্রের আগে কলিকাতায় না পৌঁছায়। সবাই আশা করেছিল দিল্লী হয়ে বিমান কলিকাতা বিমান বন্দরে নামবে। মৃতদেহবাহী বিমান সারাদিন ধরে আকাশে চক্কর দিয়ে বেড়িয়ে সময় নষ্ট করেছে যাতে করে প্লেন দিনের বেলায় কলকাতায় না নামে। | সমগ্র ভারতবাসী শশাকে মুহ্যমান। জম্মুতে পুলিশ রাস্তায় নেমেছে। দিল্লীতে লাখ লাখ মানুষের মিছিল। শােকস্তব্ধ পাঞ্জাব বিমানবন্দর দখল করে নিয়েছে। অজস্র মানুষের ঢল কলকাতার রাজপথে। শালিমার রেল ইয়ার্ডের শ্রমিকরা বেতন প্রত্যাখ্যান করে চলে এসেছেন মহামিছিলে যােগদিতে। মানুষ এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না খবরের সত্যতাকে। সবাই আশা করছে যেন খবরটা ভুল হয়। তাদের ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়ে মৃত্যু সংবাদ সঠিক বলে প্রমাণিত হল। তখন রাস্তায় কাতারে কাতারে লােকের মিছিল। অজস্র মানুষ চলেছে বিমানবন্দরের পথে। মানুষ চলেছে প্রিয় নেতাকে শেষবারের মত শ্রদ্ধা জানাতে। অফিস, আদালত, কাজকর্ম বন্ধ করে মানুষ চলেছে মহা মিছিলে যােগ দিতে। কলকাতা কিভাবে উত্তাল হয়েছিল ওই সময়কার সংবাদ পত্রে প্রকাশিত হয়েছিল। ওই সময়কার কোনও ব্যক্তি জীবিত থাকলে তার কাছ থেকে কিছুটা তথ্য জানতে পারবেন। রাত্রি প্রায়

৩০ অবহেলিত ও বিস্মৃত নায়ক ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখােপাধ্যায়

৯টার সময় শবদেহ বহনকারী বিমান দমদমে নামে। ঐ সময়ও জনতার ভীড় এতছিল যে প্রবেশ পথে পুলিশ বেষ্টনী করে শৃঙ্খলা রক্ষা করতে হয়। রাত্রি দশটার সময় দমদম থেকে বিরাট শােভা যাত্রা সহ ডঃ মুখার্জীর শবদেহ রওনা হয়। যতই এগােতে থাকে ততই কাতারে কাতারে লােকে মিছিলে যােগদান করে এত রাত্রেও। শ্যামবাজার মােড়েই লক্ষাধিক নরনারী গভীর রাত পর্যন্ত ডঃ মুখার্জীকে শেষ দেখার জন্য অপেক্ষা করে থাকে। তাদের এই বাঁধভাঙ্গা হাহাকারই বলে দেয় মানুষের মনে তিনি কত গভীরে স্থান করে নিতে পেরেছিলেন। নেতাজী ছাড়া অন্য কোনও ব্যক্তি মানুষের হৃদয়ে এতটা স্থান করে নিতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। কিন্তু তারপরে যখন শ্যামাপ্রসাদজীকে নিয়ে সমগ্র বাংলা উত্তাল কংগ্রেস সরকার তথা নেহরুকে লােকে গালাগালি দিচ্ছে এবং নানারকম পত্র চালাচালি হচ্ছে তখন লােকের মন ও ব্যথাকে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য কংগ্রেস সরকার ট্রাম ও বাসের ভাড়া বাড়িয়ে দিল এবং তাই নিয়ে বামপন্থীরা আন্দোলন শুরু করে দিল, ট্রাম বাস পােড়ান শুরু করে দিল। লােক আস্তে আস্তে শ্যামাপ্রসাদজীকে ভুলে গেল।

তারপর থেকে আজও বিভিন্নভাবে শ্যামাপ্রসাদজীকে সরকার ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে বা করছে এবং শ্যামাপ্রসাদজীর অবদান লােকে ভুলতে বসেছে। এই প্রচারে সরকার বহুলাংশে সফল। এই প্রচারের ফলে জনমানসে ধারণা শ্যামাপ্রসাদ একজন সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি। এযুগের লােকেরা বিশেষ করে আধুনিক প্রজন্ম তার নামই জানে না। ছবশ সাঁইত্রিশ বছর আগে আমার এক শিক্ষিত, ব্যাঙ্ক কর্মচারী আত্মীয়কে শ্যামাপ্রসাদজীর ফটো দেখিয়ে বলেছিলাম ফটোটা চিনিস, এটা কার ফটো’। সে কিন্তু বলতে পারল না। শুধু কংগ্রেসীরা কেন বামপন্থী তথা সেকুলার পন্থী সকল দল শ্যামাপ্রসাদের নাম উচ্চারণ করে না পাছে সাম্প্রদায়িক দোষে দুষ্ট হয়, মুসলমান ভােট না পায়। তাই বলছিলাম আজকের পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের জনগণ বিশেষ করে যুব সমাজ যদি তাকে স্মরণ না করে মহাপাপের ভাগীদার হবে।

অবহেলিত ও বিস্মৃত নায়ক ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখােপাধ্যায়

৩১। সাম্প্রদায়িকশ্যামাপ্রসাদ সম্বন্ধে কিছু মন্তব্য

| যখন শ্যামাপ্রসাদজী যখন ভারত তথা বঙ্গ বিভাগে সায় দিয়াছিলেন তখন বহু বুদ্ধিজীবি, ঐতিহাসিক, গুণীজন বাংলা বিভাগের পক্ষে সায় দিয়াছিলেন। কাশ্মীরের হুরিয়ত নেতা আলি শাহ গিলানি ও স্বীকার করে ছিলেন শ্যামাপ্রসাদজী দেশ বিভাগের পক্ষে ছিলেন না। এমন কী বাংলাদেশের লেখক শাহরিয়ার কবির মত প্রকাশ করেছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরাই পাকিস্তানের সমর্থক ছিলেন এবং প্রকৃত অবস্থা বিচারে বাংলা বিভাগে না হলে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও নিরাপত্তা সব দিক দিয়ে হিন্দুগণ বিপন্ন হয়ে পড়তেন এবং তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হত সংখ্যালঘু হিন্দুদের কথা বিবেচনা করে তিনি বাংলা ও পাঞ্জাবকে বিভাজন করে হিন্দু, শিখেদের মন প্রাণ বাঁচিয়ে ছিলেন এবং তাদের অস্তিত্ব রক্ষা করতে সমর্থ হয়েছিলেন। আজকের হাভার্ডের অধ্যাপক কিন্তু শ্যামাপ্রসাদজীকে বঙ্গভঙ্গের প্রবক্তা ও সাম্প্রদায়িক বলে অভিহিত করেন।

ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখােপাধ্যায়কে লেখা কাজী নজরুল ইসলামের একটি পত্র

মধুপর, ১৭.৭.৪২ শ্রীচরণেষু,

আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম গ্রহণ করুন। মধুপুরে এসে অনেক relief ও Relaxation অনুভব করছি। মাথার যন্ত্রণা অনেকটা কমেছে। জিহ্বার জড়ত্ব সামান্য কমেছে। আপনি এত সত্বর আমার ব্যবস্থা না করলে হয়ত কবি মধুসূদনের মত হাসপাতালে আমার মৃত্যু হ’ত। আমার স্ত্রী আজ প্রায় পাঁচ বৎসর পঙ্গু হয়ে শয্যাগত হয়ে পড়ে আছে। ওকে অনেক কষ্টে এখানে এনেছি। ওর অসুখের জন্যই এখনাে সাত হাজার টাকার ঋণ আছে। এর মধ্যে মাড়ােয়ারী ও কাবলিওয়ালাদের ঋণই বেশী। হক সাহেব যখন আমার কাছে এসে কাঁদতে থাকেন যে, “আমায় রক্ষা কর, মুসলমান ছেলেরা রাস্তায় বেরুতে দিচ্ছে না”, আমি তখন মুসলিম লীগের ছাত্র ও তরুণদলের লীডারদের ডেকে তাদের শান্ত করি। তারপর Assembly-র সমস্ত মুসলমান মেম্বারদের কাছে আমি আবেদন করি। তারা আমার আবেদন শুনলেন। ৭৪ জন মেম্বার হক সাহেবকে সমর্থন করতে রাজি হলেন। “নবযুগের”সম্পাদনার ভার যখন নিই, তার কিছুদিন আগে ফিমের Music-direction-এর জন্য সাত হাজার টাকার কনট্রক পাই। হক সাহেব ও তাঁর অনেক হিন্দু-মুসলমান Supporters আমায় বলেন যে তারা ও ঋণ শােধ করে দেবেন। আমি Film-এর Contract cancel করে দিই। পরে যখন দুতিন মাস তাগাদা করে টাকা পেলাম না, তখন হক সাহেবকে বললাম “আপনি কোন ব্যাঙ্ক থেকে অল্প সুদে আমায় ঋণ করে দিন, আমার মাইনের অর্ধেক প্রতি মাসে কেটে রাখবেন।” হক সাহেব খুশী হয়ে বললেন,

৩২ । অবহেলিত ও বিস্মৃত নায়ক ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখােপাধ্যায়

“পনের দিনের মধ্যে ব্যবস্থা করব”। তারপর সাতমাস কেটে গেল, আজ নয় কাল করে। তার Supporter-রাও উদাসীন হয়ে রইলেন। হিন্দু-মুসলিম ইউনিটির এক লাখ টাকা যখন মঞ্জুর হল, টাকা যখন হক সাহেব পেলেন, তখন তিনি উদাসীন হয়ে রইলেন। আপনি জানেন, Secretariat-এ আপনার সামনে হক সাহেব বললেন, “কাজীর ঋণ শােধ করে দিতে হবে।” আপনিও আমাকে বললেন, “ও হয়ে যাবে”। আমি নিশ্চিন্ত মনে কাজ করব বললাম। আপনি জানেন, হিন্দু-মুসলমান Unity-র জন্য আমি আমার কবিতায়, গানে গদ্যে দেশবাসীকে আবেদন করেছি। সে লেখা সাহিত্যে স্থান পেয়েছে-সে গান বাঙলার হাটে-ঘাটে, পল্লীতে, নগরে নগরে গীত হয়। আমি হিন্দু-মুসলমান ছাত্র ও তরুণদের সঙ্ঘবদ্ধ করে রেখেছি। যদি হক মন্ত্রীত্ব ভেঙ্গে যায়, তা হবে আবার Coalition ministry-র জন্য।হ সাহেব একদিন বললেন, “কিসের টাকা?” আমি চুপ করে চলে এলাম। এরপর আর তার কাছে যাইনি। আপনি Secretariat-এ যখন বলেছিলেন, “ও হয়ে যাবে” তখন থেকে স্থির বিশ্বাসে বসে রইলাম “আমি নিশ্চয়ই টাকা পাব।” এই Coalition ministry-র একমাত্র আপনাকে আমি অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করি, ভালবাসি আর কাউকে নয়। আমি জানি-আমরাই এই ভারতবর্ষকে পূর্ণ স্বাধীন করব। সেদিন বাঙালীর আপনাকে ও সুভাষ বসুকেই সকলের আগে মনে পড়বে-আপনারাই হবেন এদেশের সত্যকার নায়ক।

আমার অন্তরের কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ গ্রহণ করবেন। আমি জানি আমি Hindu muslim unity Fund থেকে আমার ঋণমুক্তির টাকা পাব। আপনার কথা কখনাে মিথ্যা হবে না। পাঁচশ’ টাকা পেয়েছি। আরাে পাঁচশ’ টাকা অনুগ্রহ করে যত শীঘ্ৰ পারেন, পাঠিয়ে দেবেন বা যখন মধুপুরে আসবেন, নিয়ে আসবেন, কোর্টের ডিক্রির টাকা দিতে হবে। তিনি চার মাস দিতে পারিনি। তারা হয়ত Body Wareant বের করবে। আপনার মহত্ত্ব আমার উপর ভালােবাসা, আপনার নির্ভিকতা, শৌর্য্য, সাহস-আমার অণুপরমাণুতে অন্তরে বাহিরে মিশে রইল।

সমাপ্ত

https://sojasapta.com/ডঃ-শ্যামাপ্রসাদ-মুখোপাধ্/

অবহেলিত ও বিস্মৃত নায়ক ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়  (পর্ব ১ম)

অবহেলিত ও বিস্মৃত নায়ক ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়-দ্বিতীয় পর্ব।

শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির অবদান, অবহেলিত ও বিস্মৃত নায়ক ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়-(তৃতীয় পর্ব)

বাংলার বাঘ আশুতোষ মুখোপাধ্যায় সন্তান শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির অবদান-(৪র্থ পর্ব)

আমার আনন্দিত প্ৰণাম-পদ্ম শ্রীচরণে গ্রহণ করুন।

প্রণত কাজী নজরুল ইসলাম

কি ব্যবস্থা করা যাবে যে বিষয়ে জুলফিকর হাইদারের সঙ্গে কথা হয়েছে। নজরুল সুস্থ হয়ে ফেরত আসে।

শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়

শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় দুজনেই ভদ্র বংশজাত, দেশহিতৈষী, রাজনীতিবিদ, . নিঃস্বার্থভাবে দেশের সেবা করে গেছেন, কিছু পাওয়ার প্রত্যাশা না করে। একজনকে ষড়যন্ত্র করে সূদুর কাশ্মীরে হত্যা করা হয়েছিল আর একজনকে তাে নিরুদ্দেশই করে দেওয়া হয়েছিল, তিনি জীবিত না মৃত, মৃত হলেও কবে সেটা সংঘটিত হয়েছিল কেউ জানে না। এত প্রচার সত্ত্বেও নেতাজী প্রত্যেকটি ভারতবাসীর হৃদয়ে স্থান করে নিতে পেরেছেন কিন্তু শ্যামাপ্রসাদজী, তাকে লােকে ভুলতে বসেছে। আজকের জনগণ অনেকে তাঁর নামই জানে না, কি তাঁর অবদান তাইই জানে না, সেই দুঃখে ও বেদনায় মন ভারাক্রান্ত হয়ে এই ক্ষুদ্র লেখার উদ্দেশ্য। জনগণের কাছে শ্যামাপ্রসাদজীর পরিচিতি, জনগণের হৃদয়ে তার স্থান করে দেওয়ার মুখ্য উদ্দেশ্য নিয়ে সহজবােধ্য এই লেখা। যদি জনসাধারণ তার অবদানের কথা মনে রাখে বা তঁাকে হৃদয়ে স্থান দেয় তবে আমার এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা সার্থক হবে। এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টায় যদি কেউ আঘাত বা ক্ষুব্ধ হয়ে থাকেন তামার ভাবাবেগের কথা স্মরণ করে তাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।

কমল মুখার্জী

তারিখ -২১/১০/০১৪ কুঁচুড়া