শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির অবদান, অবহেলিত ও বিস্মৃত নায়ক ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়-(তৃতীয় পর্ব)

অবহেলিত ও বিস্মৃত নায়ক ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ১৫

নূতন ধরণের বিবাদ বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করবে। আমার মনে হয় আপনার বলা উচিৎ স্বাধীনতা কেবলমাত্র সমস্ত রাজনৈতিক দল ও সম্প্রদায়ের ঐক্যবদ্ধ সহযােগিতাতেই পাওয়া সম্ভব। অনেক মুসলমানও আজ বুঝতে পারছেন যে পাকিস্তান একট অবাস্তব চিন্তা ভাবনা। বৃটিশ সরকারও জিন্নার উপর ভরসা হারিয়ে ফেলেছে। ঠিক এই সময় আপনি জিন্নাকে তুলে ধরে বলতে চাইছেন যে জিন্নাই যেন পাকিস্তানের ভরসা। যাঁরা মুসলীম লীগের রাজনীতি পছন্দ করে না সেই সমস্ত মুসলমানদের কাছে এটা একটা বিরাট আঘাত। আপনি যখন আলােচনা করবেন তখন নিশ্চয়ই ভারতীয় হিসাবে আলােচনা করবেন হিন্দু হিসাবে নয়। কিন্তু একজন ভারতীয় হিসাবে যখন মুসলমানদের দাবী নিয়ে চিন্তা ভাবনা করেন এবং সেই ব্যাপারে জিন্নাকেও তােষণ করতে প্রস্তুত তখন আমিও একজন ভারতীয় হিসাবে হিন্দুদের ন্যায্য অধিকার ও দাবীর কথা তুলতে পারব না কেন? আমার অনুরােধ একজন ভারতীয় হিসাবে কেবলমাত্র ভারতীয়দের কথাই চিন্তা করুন এই চিঠিতে কিছুটা কাজ হল। কংগ্রেস বুঝল দেশের জনসাধারণের কাছে তার হেয় হয়ে যাচ্ছে। বল্লভভাই কলকাতায় এসে শ্যামাপ্রসাদজীর সঙ্গে দেখা করলেন এবং বললেন কংগ্রেস পাকিস্তান দাবী মেনে নেবে না। গান্ধীজি অনুরূপ আশ্বাস দিলেন। কিন্তু কংগ্রেস পুণা অধিবেশনে দেশের অখণ্ডতায় বজায় রাখা ইচ্ছা প্রকাশ করলেন, কিন্তু প্রস্তাবের শেষে ঘােষণা করলেন অনিচ্ছুক অংশগুলিকে ভারতে থেকে যাবার জন্য জোর জবরদস্তি করা হবে না। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে প্রথম অংশ অথাৎ অখণ্ডতাকে জোর দিয়ে নির্বাচনে গেল এবং জনগণকে একটা বিরাট ধাপ্পা দিল। কংগ্রেসের এই ধাপ্পাতে হিন্দুরা বিশ্বাস করে সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে কংগ্রেসকে ভােট দিল এবং উঃ পঃ সীমান্ত প্রদেশ ছাড়া সমস্ত মুসলীম অধ্যুষিত অঞ্চলে মুসলীম লীগ জয়ী হল। বাংলায় মুসলীম লীগ সরকার আবার অধিষ্ঠিত হল দেশবিভাগের পক্ষে জোরদার আন্দোলন শুরু করল।

অবহেলিত ও বিস্মৃত নায়ক ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়  (পর্ব ১ম)

অবহেলিত ও বিস্মৃত নায়ক ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়-দ্বিতীয় পর্ব।

বাংলার বাঘ আশুতোষ মুখোপাধ্যায় সন্তান শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির অবদান-(৪র্থ পর্ব)

১৯৪৫ সালে হয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটে এবং কং»ে নেতাদের জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। ইতিমধ্যে লীগ মুসলমানদের মধ্যে যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে উঠল। কংগ্রেস নেতাদের মনােবল ভেঙ্গে তারা ক্ষমতা লাভের জন্য অধৈর্য হয়ে উঠল। ১৯৪৫ সালে, যখন ওয়াভেল দেশবিভাগের পরিকল্পনা নিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আলাপ আলােচনা শুরু করল তখন শ্যামাপ্রসাদজী ইহার তীব্র বিরােধীতা করেন। হিন্দু মহাসভাকে বাদ দিয়ে হিন্দুদের পক্ষে গান্ধী ও মুসলমানদের পক্ষে জিন্না ঐ আলােচনায় অংশগ্রহণ করল। ইহার দ্বারা প্রমাণিত হল কংগ্রেস ভারতীয় জনগণের প্রতিনিধি নয় হিন্দুদের প্রতিনিধি। ১৯৪৬ সালে বৃটিশদের আমন্ত্রণে শ্যামাপ্রসাদ তাঁদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। শ্যামাপ্রসাদ হিন্দু মহাসভার তরফে বৃটিশ মন্ত্রীমিশনে দেশ বিভাগ হিন্দুদের কাছে গ্রহণযােগ্য নয় বলে জানালেন। জিনা কিন্তু প্রকাশ্যেই পাকিস্তানের দাবী জানান।

১৬ । অবহেলিত ও বিস্মৃত নায়ক ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়

১৯৪৬ সালে যখন ভারতের সংবিধান সভা গঠিত হয় তখন শ্যামাপ্রসাদ বাংলা থেকে সদস্য নির্বাচিত হলেন তার বুদ্ধিদীপ্ত কথাবার্তা, সাংসদ হিসাবে যােগ্যতাও দায়িত্ববােধ তাকে এক জাতীয় নেতা হিসাবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হল। শ্যামাপ্রসাদজী বিশ্বাস করতেন যতদিন মুসলীম লীগ ও ইংরাজদের ষড়যন্ত্র চলবে এবং হিন্দুদের উপর আঘাত চলবে ততদিন হিন্দুদের জন্য একটা রাজনৈতিক দল থাকা উচিৎ। এইদল স্বাধীনতার পক্ষে সহায়তা করবে আর হিন্দুকে রক্ষা করতে পিছ পা হবে না। উনি চাইতেন কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার মধ্যে একটা বােঝাপড়া থাকা দরকার।

কংগ্রেস হিন্দুদের ভােটে নির্বাচনে জিততে পারে অথচ হিন্দুর স্বার্থরক্ষায় অক্ষম এবং নিজেদের হিন্দু প্রতিনিধি স্বীকার করতে অস্বীকার করে এর চেয়ে হিন্দুদের দুর্ভাগ্য আর কি হতে পারে। কংগ্রেস মুসলমান কেন্দ্রে প্রার্থী দাঁড় করাল না দু একটি ছাড়া। যেখানে কংগ্রেসের নামে মুসলমান জয়ী হল সেগুলি হল মিশ্র ধর্মের লােকের বাস অবশ্যই . হিন্দুদের ভােটার বেশী। কংগ্রেস যদি মুসলিম অঞ্চলে প্রার্থী দিয়ে জয়ী হতে পারত তাহলে বােঝা যেত মুসলমানদের মধ্যে কংগ্রেসের প্রভাব আছে। কিন্তু কংগ্রেস মুসলমান এমনকী শিখদের কাছেও পরাজিত হল।

হিন্দুরা তারা নিজেদের কোনও প্রতিষ্ঠান গড়তে চায় না। যে প্রতিষ্ঠান আমরা এত বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছি তাকে স্বহস্তে ভাঙতে সে আনন্দ পায়। এর চেয়ে আর আত্মঘাতী আর কি হতে পারে। যে জাতি নিজেকে ধ্বংসের মুখে নিয়ে যেতে আগ্রহী, যে জাতির নিজ জাতীর গৌরববােধ নিয়ে গৌরববােধ করেনা, যে নিজের রাষ্ট্র গড়ার কথা ভাবলে বললে সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকতা বােধে দুষ্ট হচ্ছে বলে নিজেকে ধিক্কার দেয় সে জাতির ভবিষ্যত কী? শুধু ইংরাজ বা মুসলমানদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। ইংরাজ ব্যবসা করতে এসে এদেশের শাসনকর্তা হয়েছে। এত বড় সাম্রাজ্য বা জমিদারী সহজে ছেড়ে দিতে চাইবে কেন? মুসলমান এদেশে ৭০০ বৎসর ধরে সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিল হিন্দুদের উপর প্রভুত্ব করেছিল, কখনও ভাল, কখন মন্দ ব্যবহার করেছিল। বহুসংখ্যক লােক একদিন হিন্দু ছিল তবু তারা হিন্দুবিদ্বেষী। আবার তারা রাজত্ব করবে এটা তারা বিশ্বাস করতেই পারে। এখন ইংরাজ চলে গেলে কে রাজত্ব করবে, দুপক্ষে ভাবা উচিৎ এবং স্বাভাবিক। মুসলমান তৈরি হয়ে উঠছে তারা যেন হিন্দুদের তাবেদার না হতে হয়। যদি হিন্দু মুসলমান মিলিত ভাবে ভারতীয় সংস্কৃতিকে বজায় রাখে যে যার ধর্ম ও সংস্কৃতি নিয়ে বসবাস করে তাহলে তাে গােলমালের কোন প্রশ্নই নেই। আর মুসলমান যদি নিজধর্মে অতিরিক্ত নিষ্ঠা দেখিয়ে হিন্দুদের উপর আধিপত্য বিস্তার করে তবে হিন্দু কীভাবে নিজেদের রক্ষা করবে, চিন্তাভাবনা করেও দেখে না। যদি অপর পক্ষ সিভিল ওয়ার চায় আর আমরা প্রস্তুত না থাকি তাহলে কী হবে। কংগ্রেস হিন্দু মুসলমানের সমস্যা কোনও মীমাংসা করতে পারেনি, পারবেও না। আপােষ যদি না হয় যে পক্ষ শক্তিশালী

১৭ . অবহেলিত ও বিস্মৃত নায়ক ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়

সেই শেষপর্যন্ত টিকে থাকবে। একটা প্রতিষ্ঠান যে হিন্দুদের সহয়তার উপর নির্ভর করে গড়ে উঠছে অথচ হিন্দুদের স্বার্থরক্ষা করা প্রয়ােজন মনে করে না বা পাপ বলে মনে করে, সেই প্রতিষ্ঠান কী লড়তে পারে অপর এক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে মুসলমানের প্রাধান্য স্থাপন করা বা ইসলামের ধ্বজা বাড়িয়ে তােলা এই সামান্য কথা হিন্দু তার এত বুদ্ধি ও অর্থবল থাকা সত্ত্বেও বুঝতে পারে না। এর চেয়ে আর দুঃখের কী কথা হতে পারে। মুসলমান ধর্মের মধ্যে এক অদ্ভুত একতা আছে যা হিন্দু ধর্ম বা সমাজের মধ্যে পাওয়া যায় না। নানা জাতি, বর্ণভেদ, প্রাদেশিকতা এই সব কারণে এক হিন্দু অপর হিন্দুর জন্য সহানুভূতি দেখায় না বা অনুভব করে না। যাহা মুসলমান তা তার অপর কোন মুসলমান ভাইয়ের জন্য করে তা সে ভারতে বা পৃথিবীর যে কোন স্থান থেকে আসুক না কেন। ভারতের সব হিন্দু এক যতদিন না এই বােধ তাদের মধ্যে জন্মাবে, ততদিন হিন্দু রাষ্ট্র বা তার জাতিগত প্রাধান্য এদেশে স্থাপিত হতে পারবে না। হিন্দু মহাসভা এই কাজ করতে ব্রতী হয়েছে। অক্লান্ত পরিশ্রম, সামাজিক কুনীতি বা সংকীর্ণতার পরিবর্তন, সাম্যবাদের উপর ধর্মের আসল ভিত্তি স্থাপন, শিক্ষার প্রসার এসব না হলে হিন্দু জাগরণ সম্ভব নয়। শুধু ব্যক্তিগত আর্থিক বা আধ্যাত্মিক উন্নতি এই করে হিন্দু জগতে টিকতে পারবে না। নূতন করে বাঁচতে হবে। জাতিকে গড়ে তুলতে হবে। দরকার হলে অপরের কাছ থেকে নিজের প্রাপ্য কেড়ে নিতে হবে এই রকম একাগ্রতা ভারতের মুসলমান সমাজের মধ্যে প্রবেশ করেছে। শুধু তাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। তাদের এই কার্যপ্রণালী থেকে আমরা অনেক কিছু শিখতে পারি। কিন্তু শেখার প্রয়ােজনীয়তা উপলব্ধি করে কয়জন।

এইবার বলি ১৯৪৬ সালের দাঙ্গা তথা গণহত্যার কথা। মুসলীম লীগ পাকিস্তানের দাবীতে দাঙ্গা শুরু করল। বােঝাতে চাইল হিন্দু-মুসলমান এক সঙ্গে থাকতে পারে না। তারা সমগ্র বাংলাকে কুক্ষিগত করতে চাইল কেননা বাংলার লােকের বিশেষ করে হিন্দুরা পাকিস্তানের সাথে থাকতে চাইছেন না। তাই ১৬ই আগষ্ট এক গণহত্যা সরকারী তত্ত্বাবধানে শুরু হল যাহা Direct Action-1946′ নামে পরিচিত যার সম্পর্কে কোন ধারণা আজকের প্রজন্মের নেই বা ঘটনা সম্বন্ধে কিছুই জানে না।

১৬ই আগষ্ট মুসলীম লীগ হরতাল ডাকল এবং সরকারী ছুটী ঘােষণা করল যাতে করে মুসলীম সরকারী ও বেসরকারী কর্মীরা নিজ নিজ এলাকায় প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে পারে। এর জন্য নির্দিষ্ট অঞ্চলের লােকেদের নিজস্ব অংশ ভাগ করে দেওয়া হল প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অংশগ্রহণ করার জন্য। ভাের না হতেই বিস্তীর্ণ হিন্দু এলাকায় মুসলীম গুণ্ডা বাহিনী অসাবধান ও অপ্রস্তুত হিন্দুদের উপর ঝাপিয়ে পড়ল। লুটপাট, খুন, জখম ধর্ষণ, অগ্নিসংযোেগ ইত্যাদিতে হিন্দু কলােনীতে বা এলাকায় ঝাঁপিয়ে পড়ল মুসলীম গুণ্ডাবাহিনী। লালবাজারে বসে সুরাবর্দী, সেরিফ খান, প্রমুখ মুসলীম নেতারা দাঙ্গা পরিচালনা করেছিল। অবিশ্যা-২

১৮ । অবহেলিত ও বিস্মৃত নায়ক ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখােপাধ্যায়

এই দাঙ্গা সফল করার জন্য আগে থেকেই সরকার প্রস্তুতি শুরু করেছিল। বাইরে থেকে প্রচুর মুসলমান আমদানি করা হয়েছিল। বিভিন্ন মুসলমান অঞ্চলে মুসলমানদের অস্ত্রে শান দিতে দেখা গিয়েছিল কসাইখানার কসাইদের সক্রিয় ভূমিকায় লাগান হয়েছিল। বহু জায়গায় লাঠি, ছােরা, তরওয়াল ও অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র ভর্তি লরি, ঠেলাগাড়ি আনা হয়েছিল। বহু সংখ্যক লরিকে অস্ত্র বহনে লাগান হয়েছিল। কলকাতার মেয়র ওসমান, সুরাবর্দী প্রমুখ পেট্রোলের ঢালাও কুপন ইসু করে ১৮ আগষ্ট পর্যন্ত। ওই সব লরিগুলি গুণ্ডাদের পরিবহণ ও লুটপাটের কাজে লাগান হয়েছিল। এই প্রত্যক্ষ সংগ্রামের একটাই কারণ যাতে করে কংগ্রেস নেতারা মাথা নত করে দেশ বিভাগ মেনে নেয়। এই সময়ে শ্যামাপ্রসাদ জনগণের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের আত্মরক্ষায় সাহায্য করেছিল। মুসলীম লীগের গুণ্ডাদের বিরুদ্ধে আক্রান্ত জনগণ উল্লেখযােগ্য প্রতিরােধ করেছিল। এব্যাপারে গােপাল মুখার্জী ওরফে ‘গােপাল পাঁঠা’ উল্লেখযােগ্য ভূমিকা নিয়েছিল।

উল্লেখ্য লীগ ঐ বছর নির্বাচনে একচ্ছত্র অধিকারী হয়ে সুরাবর্দীর নেতৃত্বে মন্ত্রিসভা গঠন করে এবং সােনার বাংলায় ছােরা মারা রাজনীতি শুরু করে। তার ২য় ছােরা মারা শুরু হল ঐ বছর কোজাগরী লক্ষীপূজার দিন অর্থাৎ ১০ অক্টোবর। কলিকাতার দাঙ্গার পর নােয়াখালীতে দাঙ্গা শুরু করে। আল্লাহহা আকবর। পাকিস্তান জিন্দাবাদ, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান, মালাউনের রক্ত চাই এই শ্লোগানতুলে নিরীহ, নিরস্ত্র হিন্দুদের উপর মুসলীম গুণ্ডারা ঝাপিয়ে পড়ল। বীভৎস হত্যাকাণ্ড, লুট দাঙ্গা, হিন্দুদের ঘরে আগুন লাগান, ধর্ষণ, জোরপূর্বক ধর্মান্তকরণ শুরু হল। পালাবার পথ অবরুদ্ধ করে দেওয়া হল। রাস্তা কেটে, পুল বা সাঁকো ভেঙ্গে। পথঘাট লীগের স্বেচ্ছাসেবক অবরুদ্ধ করে রাখল। নৌকার মাঝিমাল্লারা সবাই মুসলমান। নােয়াখালি জেলার রামগঞ্জ, বেগমগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর পার্শ্ববতী ত্রিপুরা জেলায় চাঁদপুর, ফরিদপুর ইত্যাদি জায়গায় হিন্দুদের উপর একতরফা আক্রমণ শুরু হল।

শ্যামাপ্রসাদজী নেরােখালী ও ত্রিপুরা জেলার উপদ্রুত অঞ্চল সফর করে যে বিবৃতি দিয়াছিলেন তাহার সংক্ষিপ্ত বিবরণ এখানে উল্লেখ করলাম। দাঙ্গার ইতিহাসে অভূতপূর্ব, যাকে কোন প্রকারেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বলা যায় না। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ে সংঘটিত ও সুপরিপরিকল্পিত আক্রমণ। এই আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য ছিল ব্যাপকভাবে ধর্মান্তকরণ, লুণ্ঠন, বিগ্রহ ও দেব মন্দির অপবিত্র করণ। ধর্ষণ, নারীহরণ, বলপূর্বক বিবাহ এই কুকার্য্যের অন্যতম অঙ্গ ছিল। হত্যাকাণ্ডও পরিকল্পনার অঙ্গ ছিল। এই সকল কার্য প্রণালী চিন্তা করলে বােঝাযায় হিন্দু লােপ ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার একটা সুপরিকল্পিত চক্রান্ত। এই ঘটনার পর নােয়াখালিতে মাত্র ৫০ জন ও ত্রিপুরায় কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জাতি, বর্ণ নির্বিশেষে হিন্দুদের উপর যে অপমান ও নির্যাতন হয়েছে তার তুলনা নাই। হিন্দুদের নাম পরিবর্তন করা হইয়াছে মহিলাদের অপমানিত করা হইয়াছে। হিন্দুদের মসুলমানদের মতন পােষাক পরতে, আহার

19 .অবহেলিত ও বিস্মৃত নায়ক ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়

করিতে, জীবন যাপন করিতে বাধ্য করা হইয়াছে। পুরুষদের মসজিদে যাইতে বাধ্য করা হইয়াছে। | আমাদের শত সহস্ৰভ্রাতা ও ভগিনীগণ নতিস্বীকার করে হিন্দু সমাজের বাহিরে চলিয়া গিয়াছে বলে মনে করি না। তাহারা হিন্দু ছিলেন। হিন্দু আছেন এবং আমরণ হিন্দু থাকিবেন। যখনই কোন মহিলাকে উপযুক্ত অঞ্চল হইতে উদ্ধার করা হইবে তাঁকে বিনা বাধায় স্বীয়পরিবারে ফিরিয়ে নিতে হবে। যে সকল কুমারী মেয়েকে উদ্ধার করা হইবে তাহাদের স্বধর্মে বিবাহ দেওয়ার ব্যবস্থা করিতে হইবে। যদি হিন্দু সমাজ দুরদৃষ্টি সহ বর্তমান বিপদে স্বেচ্ছায় এগিয়ে না আসে তা হলে সেই সমাজের ভবিষ্যত অন্ধকারাচ্ছন্ন।

এই দুরবস্থার জন্য শাসকগােষ্ঠী ও গভর্ণর দায়ী এই শাসন ব্যবস্থা জারী থাকলে হিন্দুদের ধনপ্রাণ ভয়ংঙ্কর বিপদের সম্মুখীন হবে। আর হিন্দুদের বুঝতে হবে যে তারা যদি সঙ্ঘবদ্ধ না হয় তাদের ভবিষ্যত অন্ধকারাচ্ছন্ন হইবে। এই দাঙ্গা প্রত্যক্ষ সংগ্রাম হিন্দুদের শেষ করে দিতে না পারলেও কংগ্রেস নেতাদের মনােবল ভেঙ্গে দিয়েছিল এবং গান্ধী সমেত কংগ্রেসীরা দিশহারা হয়ে গিয়েছিল। অবশ্য নেহরুর কাছে ইহা একপ্রকার আশীর্বাদ হয়েছিল কেননা তখন নেতাজীর ভয়ে নেহরু ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল। এই সময় লর্ড মাউন্টব্যাটেন দেশ বিভাগের পরিকল্পনা নিয়ে ভারতে পদার্পণ করলেন। তখন শ্যামাপ্রসাদজী বুঝলেন দেশ বিভাগকে আর আটকানাে যাবে না।

| দেশভাগের যখন পরিকল্পনা করা হচ্ছে তখন অনিচ্ছুক প্রদেশগুলিকে ভারতে থেকে যাবার জন্য জোর জবরদস্তি করা হবে না বলে কংগ্রেস আগেই ঘােষণা করেছিল। এর ফলে পাঞ্জাব ও বাংলা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা হবে স্থির করা হল। লীগ সমর্থ বাংলাকেই এবং পাঞ্জাবকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করতে চায়। তখন শ্যামাপ্রসাদজী বাংলা ও পাঞ্জাব বিভাগের দাবী তুলল। কেননা যে হিসাবে পাকিস্তান দাবী করা হচ্ছে সেই হিসাবে বাংলার পশ্চিমাংশ ও পাঞ্জাবের পূর্বাংশ ভারতে যাবার কথা। তখন মুসলিম লীগের চক্ষু ছানা বড়া’ যা তারা কল্পনাও করতে পারে নি। হিন্দুরাও মুসলমানদের অত্যাচার ও নারকীয় হত্যাকাণ্ড দেখে আর অখণ্ড বাংলা চাইল না। তা দেখে সুরাবর্দী সাহেবরা প্রমাদ গুণলেন। তখন তারা অখণ্ড বাংলা বা বাঙালী স্থানের ধুয়া তুলল। শরৎ বােস, কিরণ শঙ্কর রায় সুরাবর্দী সাহেবের তালে তাল দিলেন। হিন্দুরা ভীত সন্ত্রস্ত ও নারকীয় ভয়াবহ অত্যাচার দেখে আর অখণ্ড বাংলা বা বাঙালীস্থানে থেকে মুসলমানদের হাতে যেতে রাজী হল না। শ্যামাপ্রসাদজীও ভারত থেকে বিছিন্ন হয়ে মুসলিম শাসনে স্বাধীন বাংলা গঠনে রাজী হল না। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাগুলি নিয়ে আলাদা রাজ্য গঠন করে ভারতে থাকার দাবী তুলল। ব্রিটিশ ও মুসলীম লীগ আর ঐ প্রস্তাব না করতে পারল । তাই এক তৃতীয়াংশ বাংলা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সৃষ্টি হল আর পাঞ্জাব হিন্দু ও শিখে সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র যুক্ত থাকল। কারণ তিনি বুঝেছিলেন

২০ অবহেলিত ও বিস্মৃত নায়ক ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়

ক্ষমতার জন্য কংগ্রেস সমগ্র বাংলা এমনকী অসমকে পর্যন্ত পাকিস্তানের হাতে তুলে দিতে দ্বিধা বােধ করবে না। মূলত শ্যামাপ্রসাদজীর প্রচেষ্টায় এক তৃতীয়াংশ বাংলা ভারত অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। এজন্যে তিনি গর্ব করে বলেছিলেন। ‘Congress partitiond India and I partitiond Pakistan’ এই ভাবে তিনি মুসলীম লীগ ও ব্রিটীশের দুরভিসন্ধি বানচাল করে দিয়েছিলেন। | স্বাধীনতার অব্যবহিত পূর্বে বাংলা ও পাঞ্জাবে লােক বিনিময়ে কথা উঠল। কিন্তু পাঞ্জাবে এটা সম্ভব হল বাংলায় হল না কারণ নেহরুর বাঙালী স্থানের ভয়। যদি লােক বিনিময় হয় তাহলে বিহারে একটা বিরাট অংশ পশ্চিমবঙ্গে চলে যাবে যাহা নেহরুর মনপূত ছিল না। উনি তাে গােটা বাংলাটাকেই পাকিস্তানের হাতে তুলে দিতে চেয়েছিলেন কেন না বাংলার নেতারা তার কাজের চালাকি ধরে ফেলত তার সমালােচনা করত। তাই তিনি তােক বিনিময় প্রথা বাংলায় চালু করলেন না তাহলে একটা স্থায়ী সমস্যার সমাধান হয়ে যেত।

এর পর ভারতবর্ষ দ্বিখণ্ডিত হয়ে ১৫ই আগষ্ট সরকার গঠন করে। নেহরু প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন বা তার বহুদিনের আকাঙ্খা ছিল। শ্যামাপ্রসাদজী হিন্দু মহাসভার সংস্রব ত্যাগ করে মন্ত্রীসভায় যােগ দেন এবং শিল্প সরবরাহ দপ্তরের ভার নেন। তিনি হিন্দু মহাসভাকে রাজনৈতিক কার্যকলাপ ত্যাগ করে সামাজিক ও সংস্কৃতিক কাজে আত্মনিয়ােগ করতে।

বাংলার বাঘ আশুতোষ মুখোপাধ্যায় সন্তান শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির অবদান-(৪র্থ পর্ব)

 

আগে প্রথম পর্ব পড়ে আসুন… এখান থেকে

অবহেলিত ও বিস্মৃত নায়ক ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখােপাধ্যায়-দ্বিতীয় পর্ব।

বাংলার দুই মহান সন্তান, কৃতী সন্তান, একজনের নাম নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, অপরজন ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখােপাধ্যায়। দুজনেই ভদ্র বংশজাত, দেশহিতৈষী, রাজনীতিবিদ, . নিঃস্বার্থভাবে দেশের সেবা করে গেছেন, কিছু পাওয়ার প্রত্যাশা না করে। একজনকে ষড়যন্ত্র করে সূদুর কাশ্মীরে হত্যা করা হয়েছিল আর একজনকে তাে নিরুদ্দেশই করে দেওয়া হয়েছিল, তিনি জীবিত না মৃত, মৃত হলেও কবে সেটা সংঘটিত হয়েছিল কেউ জানে না। এত প্রচার সত্ত্বেও নেতাজী প্রত্যেকটি ভারতবাসীর হৃদয়ে স্থান করে নিতে পেরেছেন কিন্তু শ্যামাপ্রসাদজী, তাকে লােকে ভুলতে বসেছে। আজকের জনগণ অনেকে তাঁর নামই জানে না, কি তাঁর অবদান তাইই জানে না, সেই দুঃখে ও বেদনায় মন ভারাক্রান্ত হয়ে এই ক্ষুদ্র লেখার উদ্দেশ্য। জনগণের কাছে শ্যামাপ্রসাদজীর পরিচিতি, জনগণের হৃদয়ে তার স্থান করে দেওয়ার মুখ্য উদ্দেশ্য নিয়ে সহজবােধ্য এই লেখা। যদি জনসাধারণ তার অবদানের কথা মনে রাখে বা তঁাকে হৃদয়ে স্থান দেয় তবে আমার এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা সার্থক হবে। এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টায় যদি কেউ আঘাত বা ক্ষুব্ধ হয়ে থাকেন তামার ভাবাবেগের কথা স্মরণ করে তাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।

কমল মুখার্জী

তারিখ -২১/১০/০১৪ কুঁচুড়া