যত গপ্পো জুতো নিয়ে।

       যত গপ্পো জুতো নিয়ে

                       যূথিকা আচার্য্য

  আমাদের শরীরের যত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ রয়েছে তাদের  মধ্যে পায়ের পাতাদুটো হলো সবচাইতে বেশী লো মেইনটেনান্স। পা চাটা,পায়ের জুতো,পায়ের তলা এই শব্দগুলির প্রত্যেকটাই নেগেটিভিটি বহন করে। অথচ বলুন দেখি, এতে পা দুটোর কী দোষ? পুরো শরীরটাকে বয়ে নিয়ে বেড়ায় তারা সর্বক্ষণ। কোনো দাবী-দাওয়া নেই। আদর যত্নের বালাই নেই। মাথা ব্যথা হলে হাজারখানা দাবাই আছে, কিন্তু পা ব্যথা হলে আমরা বলি “ও কিছু না,সেরে যাবে!”

আমাদের পায়ের পাতা দুটো হল সমাজের ওই অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষগুলোর মতো। যারা বড় কিছু দাবী করে না, শুধু একটু পেট ভরে খাওয়া। দুটো রুটি, বা একটুকরো পেঁয়াজ সহযোগে একথালা পান্তা খেতে পেলেই তারা ঐরাবতের মতো মহাতেজা হয়ে ওঠে । রোগভোগের বালাই নেই। অথচ আমাদের মতো লোকগুলোর অবস্থা দেখুন। দিনরাত গন্ডেপিন্ডে ভালোমন্দ গিলছি কিন্তু আজ অম্বল, কাল আমাশা, পরশু আর্থারাইটিস আমাদের লেগেই রয়েছে।

চরণকমলদুখানা বাদ দিলে দেখবেন শরীরের বাকী অঙ্গ-প্রত্যঙ্গদের হাজারটা বায়নাক্কা। মুখের কথা তো ছেড়েই দিন। রকমারী রূপটানের দায় মিটোতে জেরবার হয়না এমন মানুষ নেই।

কী বললেন, পুরুষদের সেসব বালাই নেই !

ও মশাই থামুন, থামুন। বলি আছেন কোথায় ?

আফটার শেভ, শেভিং ক্রীম, কোলন, মেনস্ ফেস ওয়াস এগুলো কী? এমনি এমনি এই কোম্পানীগুলো মিলিয়ন ডলারের বিজনেস করছে নাকি ! হুহ্ বললেই হল! অমনি যেন শুনবো আমি।

তারপর গলা বা হাতের কথাই ধরুন। মালা-চুড়ি-নেকলেস-ব্রেসলেট-কড়া-আংটি ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। গয়নাগাটির লম্বা লিস্টি শুরু হলে শেষ কবে হবে তা বলা মুশকিল। সেই তুলনায় নিজের পদযুগলের কথা একবার ভাবুন তো। নারী হলে নূপুর বা তোড়ার অলঙ্করণ জুটলেও জুটতে পারে,পুরুষ হলে বাপু জুতোটুকুই সার। মোটের উপর দেখবেন,পাদুটো বেশী বায়না করে না,দুপাটি আরামদায়ক পাঢাকনি অর্থাৎ জুতো পেলেই তারা দিব্যি খুশি!

   তাই এহেন নির্বাক সেবকদের প্রতি অবহেলা আসে খুব সহজে। পা দুখানা যত্নের দাবী করে না,অতএব তার যত্ন করে কী লাভ। এমতাবস্থায় যিনি পাদুটোকে যত্নআত্তি করে,ভালোবেসে রাখেন তিনি প্রকৃত অর্থেই তার নিজের শরীরের মর্যাদা দিতে জানেন,তার আভিজাত্য নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করাটা বোকামো।

     জুতো নিয়ে গপ্পো হলেই সিরাজদৌল্লার কাহিনী মনে পড়ে। বাংলার শেষ নবাব সিরাজ যখন ছদ্মবেশ ধারণ করে, স্ত্রী লুৎফা ও কন্যা কে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিলেন তখন তিনি জুতোটি পরিবর্তন করতে ভুলে গিয়েছিলেন আর সেই জুতো দেখেই এক পীর তাকে চিনে ফেলছিল এবং ধরিয়ে দিয়েছিল। অবশ্য গোরার দল বিশ্বাসঘাতকতা মাফ করেনি। সিরাজের মৃত্যুর পর সেই পীরকেও প্রাণদন্ডে পুরস্কৃত করা হয়েছিলো। যেমন কর্ম তেমন ফল!

        মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত জুতো জোড়াও ইতিহাস রচনা করেছিল। ব্যাপারটা মোটামুটি হয়েছিল এমন যে,শোভাবাজারের রাজবাড়িতে জলসা হবে, বিরাট আয়োজন। শহরের অর্ধেক লোক জমা হবে সেখানে; যত বড়ো বড়ো লোক, রাজরাজড়া সকলের নেমন্তন্ন হয়েছে। তখন ঠাকুরবাড়ির বিষয়সম্পত্তির অবস্থা বড়ো খারাপ। পিতা দ্বারকানাথের দেনা মেটানোর পর পুত্র দেবেন্দ্রনাথের হাত একবারেই শূন্য।  বড়ো বড়ো লোকেরা মজা দেখার অপেক্ষায় রইলেন। সবার মনে একই প্রশ্ন,ঠাকুরবাড়ির দিন গেছে, প্রিন্স দ্বারকানাথের ছেলে কী ভাবে নিজের মানরক্ষা করবেন? এবারে দেবেন্দ্রনাথ কী সাজে আসবেন নেমন্তন্ন রক্ষা করতে যাতে সাপও মরে এবং লাঠিও না ভাঙে!

   এসব কথা বোধহয়  দেবেন্দ্রনাথের কানেও এসেছিল। তিনি বাড়ির দেওয়ানকে দিয়ে করমচাঁদ জহুরীকে বৈঠকখানায় ডাকিয়ে আনালেন। করমচাঁদ জহুরী সেকালের খুব পুরোনো জহুরী, ঠাকুরবাড়ির “বাবামশায়”-এর পছন্দ তার বেশ জানা ছিল।

  দেবেন্দ্রনাথ তাকে বললেন, একজোড়া মখমলের জুতোয় আগাগোড়া মুক্তো দিয়ে কাজ করে আনতে। সেই আদেশমতো করমচাঁদ জহুরী দানা দানা মুক্তো সেলাই করে সাজানো সুন্দর একজোড়া মখমলের জুতো তৈরি করে এনে দিলেন।

  জুতোর ঝামেলা তো মিটলো। এবার চিন্তা, কেমন জামা,কেমনই বা সাজপোশাক হবে ? রাজবাড়িতে নেমন্তন্ন বলে কথা, যেমন তেমন পোশাকে কী যাওয়া যায় ? সবাই ভাবছে তোষাখানা থেকে কাশ্মিরী পশমিনা শাল বের করবে, না রেশমের জোব্বা। দেবেন্দ্রনাথ হুকুম দিলেন,

“ও সব কিছুই নয়! আমি সাদা কাপড়ে যাব।”

জলসার দিন তিনি পরলেন ধবধবে সাদা আচকানজোড়া। মাথার মোড়াসা পাগড়িটি অবধি সাদা, কোথাও জরি, পশম, কিংখাব বা জরোয়ার নামগন্ধ নেই। আগাগোড়া সাদা। পায়ে কেবল সেই মুক্তো বসানো মখমলের জুতোজোড়াটি।

    ভাবুন একবার অবস্থাখানা! রাজবাড়ির সভাস্থলে সবাই বসে রয়েছেন কিংখাব-জড়ি-মখমলের পোশাক পরে,হীরেমোতি-চুনিপান্না গলায় ঝুলিয়ে। এমন সময়ে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের সেখানে প্রবেশ। সভাস্থল নিস্তব্ধ। একখানা সূঁচ পড়লেও বুঝি আওয়াজ শোনা যাবে। দেবেন্দ্রনাথ কৌচে বসলেন পা-দুখানি একটু বের করে। সবাই চুপচাপ। শোভাবাজারের রাজামশাই ছিলেন তার বন্ধু। তিনি তখন ওনার পায়ের দিকে ইশারা করে হইহই করে উঠলেন,

 “ওরে দেখ, দেখ, তোরা দেখ, একবার চেয়ে দেখ এ দিকে, একেই বলে আভিজাত্য। আমরা ঝুলিয়েছি গলায়, মাথায়, আর ইনি তা পায়ে রেখেছেন।”

এই দুখানা গল্প বললাম বাঙলার ইতিহাসের পাতা থেকে। এবার একখানা বিদেশী গপ্পো শোনাই। এই গল্পটা আমার বন্ধু পিট টেয়লরের মুখে শোনা। পিটের প্রেমিকা পামেলা জুতোর ব্যাপারে বড় খুঁতখুতে। মানে জামা-টুপি-গয়না-ব্যাগ এদিক ওদিক হলেও চলবে কিন্তু জুতোর ব্যাপারে এতটুকুও নড়চড় হওয়ার উপায় নেই। তো সে যাকগে, ওদের নেমন্তন্ন ছিল প্রতিবেশী মিস্টার তাকাশাকির বাড়িতে। তাকাশাকিমশাই জাপানের মানুষ, একটু বয়স্ক এবং আদ্যোপান্ত পুরাতন জাপানী রীতিনীতিতে বিশ্বাসী। সেই হিসেবমতো পিট ও পামেলা দুজনেই হাল্কা, সুতির ঢিলেঢালা পোশাক পরলো, যাতে তাকাশাকি মশাইয়ের বাড়ির পরিবেশে তা বেশ মানানসই হয়। কিন্তু গোল বাঁধলো জুতো নিয়ে। প্যামির ইচ্ছে একটু দামী হাই হিল পরে, ওদিকে পিটের তা নিয়ে আপত্তি, প্যামির জামার সঙ্গে নাকি ফ্ল্যাট চটিজোড়া পরলেই বেশী মানাবে। আসল ব্যাপারটা আমরা জানি, পিট বেচারার হাইটটা একটু কম, সেই কারণে প্রেমিকা হাই হিল পরে তার সঙ্গে ঘুরলে সে ইনসিকিউরিটিতে ভোগে।  ঝগড়া শুরু হয়েছিল বেশ খাদের সুরে“ডার্লিং-হানি” এসব বলে, কিছুক্ষণ পরেই থার্মোমিটারের পারা চড়তে চড়তে বিবাদের সুর সপ্তকে পহুছিল। শেষকালে পিটের এনগেজমেন্ট প্রায় ভেঙে যায় যায় দশা।

    এতকিছু ঝামেলা করে পিট ও পামেলা দুজনে তাকাশাকিমশায়ের বাড়িতে গিয়ে পৌছল পার্টি শুরু হওয়ার ঘন্টাদেড়েক পর। পামেলা নিজে হীলস্ তো পড়েছেই তার ওপর পিটারকেও হাই হীলড্ ফর্ম্যাল শ্যুজ পরিয়েছে ( হুঁ হুঁ বাওয়া, দেশী হোক বা বিদেশী,বৌ ইজ বৌ!) কিন্তু তাকাশাকি ভবনের দোরগোড়ায় পৌছতেই জোর কা ঝটকা লাগলো ধীরেসে! সুসজ্জিতা ম্যাডাম তাকাশাকি ভারী মিষ্টিসুরে জানালেন,

“দয়া করে জুতো খুলে ভেতরে আসবেন। জুতো জিনিসটা বাইরের, ওটাকে আমরা ঘরের ভেতর স্থান দিই না।“

এই ঘটনার পর  পিটের প্রেমিকা নাকি তিনদিন তার সঙ্গে কথা কননি। রাগে না অনুরাগে তা অবশ্য জানা হয়নি।

      সিন্ডেরেলা আর তার কাঁচের জুতোর গল্প সবাই জানে। রাত বারোটার সময় সিন্ডেরেলা প্রিন্স চার্মিংয়ের পার্টি থেকে ছুটে বেরিয়ে যান। যাওয়ার পথে তার পা থেকে একপাটি কাঁচের জুতো খুলে পড়ে যায়। পরে সেই জুতোর সাহায্যে রাজকুমার সিন্ডেরেলাকে খুঁজে পান অ্যান্ড দে লিভড্ হ্যাপিলি এভার আফটার! মোটের উপর এই হচ্ছে গল্পখানা। কিন্তু গল্প পড়ে একটু ভাবলেই বুঝবেন যে জুতো খুলে যাওয়া ব্যাপারটার মধ্যে যথেষ্ট ফাঁক রয়েছে। চমৎকার মাপে মাপে পায়ে বসে যাওয়া জুতো অমনি অমনি পা থেকে খুললো কী করে? বারোটা অবধি হইহুল্লোর নাচগান করা অবধি জুতো দিব্যি ঠিক ছিলো, ঠিক দৌড়ে পালানোর সময়ই তাকে খুলে পড়তে হল! মানে যা ইচ্ছে তাই বললেই হল! আমার মনে হয়, সিন্ডেরেলা ইচ্ছে করেই জুতোখানা ওখানে ফেলে রেখে এসেছিল যাতে তাকে খুঁজে পেতে রাজকুমারের অসুবিধে না হয়! একটু ভাবুন, ভাবলেই বুঝবেন সিন্ডেরেলাকে আমি আপনি  যতটা সোজা সরল ভেবেছিলাম, ততটা ইনোসেন্ট সে মোটেই নয়। সিন্ডেরেলা যথেষ্ট সেয়ানা মেয়ে।

প্রখ্যাত সাহিত্যিক শ্রী রূপঙ্কর সরকার মহাশয়ের থেকে শোনা আরেকখানা জুতোর গল্প শুনুন। ওঁর ভাষাতেই বলি, “সত্তর দশকের আশেপাশের ঘটনা। আমার এক বন্ধু, এখন পরলোকে, তার দাদার কথা। সেই দাদা আইওসি-র উচ্চপদস্থ আধিকারিক ছিলেন। শেখদের রাজ্যে প্রায়ই যেতে হতো তাঁকে। একবার শেখ এসেছেন সপরিবারে কলকাতায়। এক পার্টিতে বৌদির গায়ে বেনারসি দেখে শেখ গিন্নি উচ্ছ্বসিত। দাদা ঠিক করলেন এর পরের বার ওদেশে গেলে খুব ভাল নকশার একটা বেনারসি নিয়ে যাবেন। শেখ গিন্নি শাড়ি পরতে জানুন আর না জানুন। আজকাল শিখে নেওয়া কোনও ব্যাপার না। ওঁরা কত দামি দামি উপহার আনেন, একটা বেনারসি দিতেই হবে, যত টাকা লাগে, লাগুক।

তা গেলেন তিনি বেনারসি নিয়ে পরের বার। শেখগিন্নি খুব খুশি। শেখও খুশি, বললেন চলো তোমায় রিটার্ন গিফট দিই, বলে টেনে নিয়ে গেলেন সোনার দোকানে। দাদার তো চক্ষু চড়কগাছ অত বড় আর ভারি সোনার গয়না জানাশোনা কেউ পরেনা এ দেশে। আর এত দামি জিনিস নেওয়া যায় নাকি! শেখ তো খুব ঝুলোঝুলি, নিতেই হবে। নইলে খুব দুঃখ পাব আমরা। তাছাড়া তোমায় তো দিচ্ছিনা, দিচ্ছি আমাদের ভাবিকে।

দাদা বললেন, এই জিনিস নিয়ে আমি দেশে ঢুকব কী করে? ডিউটি দেওয়ার ক্ষমতা হবে আমার? শেখ মৃদু হাসলেন। বললেন, ঠিক আছে, এমন জিনিস দেব চলো, যার ডিউটি তোমাদের কাস্টমস ঠিক করতে পারবেনা। ম্যাডামের পায়ের মাপ জানো? নিয়ে গেলেন জুতোর দোকানে। দারুণ সুন্দর একজোড়া মখমলের নাগরা, তার ওপরে শানদার নকশা করা সুতোর। দাদা তো খুশ দিলে জুতো বগলে কলকাতায়। পরে খুঁটিয়ে দেখে ওপরের নকশা পুরোটাই হীরে দিয়ে। কাস্টমসে আন্দাজও করতে পারেনি জুতোয় হীরে থাকে। তবে বন্ধু বলেছিল, দুঃখ কী জানিস! বৌদি একদিনও পায়ে দেয়নি জুতো জোড়া। ওদুটো ব্যাঙ্কের লকারে আছে।“

  আমার এক বাংলাদেশী বন্ধুর মুখে শোনা মোহাম্মদ নাসির আলির লেখা জুতো নিয়ে আরেকখানা গল্প দিয়ে শেষ করি।  গল্পের নাম “অলক্ষুণে জুতো।“ গল্পখানা এমন, আলি আবু বাগদাদ শহরের অত্যন্ত ধনী অথচ কৃপণ লোক। তার কিপ্টেমির এপিটোম হল তার জুতো। তিনি কত বছর ধরে সেলাই করিয়ে, পেরেক লাগিয়ে, তালি লাগিয়ে একই নাগরাই জুতো পরে চলেছেন, তা শুধু খোদাই জানে। কালে এমন হল যে, আলি আবুকে সবাই তার জুতোর নামে চেনে।

তা একদিন হল কী, একদিন আলি আবুর বন্ধু তার জুতো নিয়ে মজাক করলেন তার সঙ্গে। আবু এবং তার বন্ধু দুজনেই গোসল করতে ঢুকেছেন হামামে। বন্ধুটি সুযোগ বুঝে তার ছেঁড়াখোঁড়া, তালি মারা নাগরা জোড়া লুকিয়ে রাখলেন অন্য জায়গায়। মতলবখানা এই যে, জুতো হারিয়ে আবুর দশা কেমন হয়!

এদিকে আলি আবু তো এসব কিছুই জানেন না। তিনি গোসলখানা থেকে বেড়িয়ে দেখলেন তার জুতোর জায়গায় অন্য একটি দিব্যি সুন্দর, এমব্রয়ডারী করা নতুন জুতো রাখা আছে। তিনি সরলমনে ভাবলেন এই জুতোজোড়া নিশ্চয় তার বন্ধু তার জন্যই রেখে গেছে। তিনি বিনি পয়সায় নতুন জুতো পেয়ে আল্লাহ্তালা কে সুক্রিয়া জানিয়ে, নতুন জুতো পরে ফিরে এলেন বাড়িতে।

কিন্তু আসলে সেই নতুন জুতোটি ছিল কাজিসাহেবের। কাজিসাহেব বের হয়ে দেখলেন তার জুতোজোড়া গায়েব। অনেক খুঁজে দেখা গেল হামামের এক কোনে আবুর তালি মারা জুতোজোড়া পড়ে রয়েছে। ওদিকে বিপদ বুঝে আলি আবুর বন্ধুটিও মুখে কুলুপ এঁটে কেটে পড়েছেন। ব্যস আর যায় কোথা, কাজিসাহেব অমনি ভেবে নিলেন যে আলি আবুই তার জুতো নিয়ে গেছেন।

এর জন্য জুতো চোর হিসেবে আবু আলির শাস্তি হয়। রাগে দুঃখে আলী আবু জুতো নদীতে ফেলে দেন। সেখানে এক জেলে জুতোটি পায়। সে বেচারা আবুর জুতোজোড়া ঠিক চিনতে পারে এবং সরলমনেই ভাবে হয়ত আবুর জুতোটি হারিয়ে গেছে। কারণ সবাই জানত এই জুতোজোড়া আবুর বড়ই প্রিয়। ভেবেচিন্তে পুরস্কারের লোভে জেলে বেচারা জুতোটি নিয়ে আসে আবুর বাড়িতে। আবু তখন বাড়িতে ছিলেন না। অনেক হাঁকডাক করে বিরক্ত হয়ে জেলে আবুর বাড়ির জানালা দিয়ে ছুঁড়ে দেয় জুতো জোড়া। জুতো ভেতরে গিয়ে পড়ে আতরের বোতলে। এই বোতলগুলোর ভেতরে খাস আতর ছিল আবু বড়ই পেয়ারের। সব নষ্ট হয়।

বাড়িতে ফিরে সবকিছু দেখেশুনে রাগে দিশাহারা হন আলি আবু। তিনি সেই রাতেই জুতোজোড়া কে দফন করার জন্য গর্ত খুঁড়তে শুরু করেন প্রতিবেশীর দেয়ালের ধারে। কিছু লোক তাঁকে সেই অবস্থায় দেখে ভাবে তিনি হয়ত সিঁদ কেটে চুরি করতে যাচ্ছেন। অতএব আবার তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া  হয় কাজির কাছে। কাজিসাহেব শুধোলে আলি বলেন তিনি বিরক্ত হয়ে জুতোজোড়া মাটি চাপা দিচ্ছিলেন। কিন্তু কে আর সেকথা বিশ্বাস করবে! প্রাণের চেয়েও প্রিয় জুতো তিনি দফন করবেন, একথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় বইকি! ফলস্বরূপ পুনরায় শাস্তি পেতে হয় তাকে।

তিতিবিরক্ত হয়ে এরপর আবু জুতো ছুঁড়ে ফেলে দেন। ঘটনাক্রমে তা গিয়ে পড়ে এক ছেলের ঘাড়ে। সে অজ্ঞান হয়ে যায়। লোকেরা তৎক্ষণাৎ আবুর নাগরাই জুতা চিনতে পেরে কাজীসাহেবের কাছে নালিশ করে। আলি আবু আবার শাস্তি পান।

আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় “অলক্ষুণে জুতো”গল্পটির সারাংশ হল অত্যধিক কৃপণতা ভালো নয়, কিন্তু একটু ভেবে দেখলেই বুঝবেন আসল কথা তা নয়। গল্পটি রূপকধর্মী। আমাদের মধ্যে অনেকেরই এই  অভ্যাস রয়েছে, যে আমরা সচেতনভাবে বা অবচেতনে কিছু বস্তুকে নিজের পরিচয়ের অংশ করে তুলি। যেমন এই গল্পের ক্ষেত্রে, গল্পের নায়ক আলি আবু তার ছেঁড়া জুতোজোড়াকে নিজের অস্তিত্বের অবিচ্ছেদ্য অংশ করে তুলেছিলেন। ফলস্বরূপ জুতোর গুরুত্ব একসময় তার মালিককেও ছাড়িয়ে যায়। সাধারণ অবস্থাতেও মানুষ যেসব দুর্দশায় পড়েন তার বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই কারণ কিন্তু তুচ্ছ বস্তু অথবা অপদার্থ পরিজনের ওপর অনর্থক বিশ্বাস এবং নির্ভরশীলতা। তাই সাধু সাবধান! তুচ্ছ বস্তু, খারাপ অভ্যাস এবং অযোগ্য মানুষ (সে আপনার যত প্রিয়ই হোক না কেন) এই তিনের সম্পর্কে সদা সতর্ক থাকবেন। এই ত্রয়ীর যে কোনো একটি যদি আপনার পরিচয়ের সর্বাধিক শক্তিশালী অংশ হয়ে ওঠে তাহলে খারাপ সময়ে তা আপনার অস্তিত্ব‍ ও স্বাধীনতা দুয়েরই বারোটা বাজাবে, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।

নমস্কার। আমি যূথিকা।
পেশায় রেস্তোরাঁ ম্যানজার এবং নেশায় লেখক।
দেশ, যুগ- তোমার আমার, সঙ্ঘমিত্রা, করতোয়া দৈনিক,
জয়ঢাকসহ এপার বাংলা ও ওপার বাংলার বেশ কয়েকটি
ম্যাগাজিন ও ওয়েবজিনের যৎসামান্য লেখালিখি করি।
অবসর সময় কাটাই গল্পের  বই পড়ে