ভারত গুরুত্বপূর্ণ: ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে, ভারত এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন পারস্পরিক সম্পর্ক বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।রাশিয়া, আমেরিকা, চীন ও ব্রিটেনের আধিকারিকদের প্রতিশ্রুতির পর এখন ইউরোপও ভারতকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে।
ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফোন ডি লিয়ন দুদিনের ভারত সফরে এসেছেন। তার সফরের প্রথম দিনেই ইইউ এবং ভারত একটি ট্রেড অ্যান্ড টেকনোলজি কাউন্সিল গঠনে সম্মত হয়। এর উদ্দেশ্য হবে এসব ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানো। এর ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পর ভারত দ্বিতীয় দেশ হিসেবে এই প্রযুক্তিগত চুক্তি করেছে।
সোমবার ফোন ডে লায়ন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গেও দেখা করেন। এ সময় তিনি বলেন, আমি মনে করি আজকের এই সম্পর্কগুলো আগের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ইউরোপীয় কমিশনের প্রধান বলেন, “আমাদের মধ্যে অনেক মিল রয়েছে, তবে আমরা একটি চ্যালেঞ্জিং রাজনৈতিক পরিস্থিতিরও সম্মুখীন হচ্ছি।”
ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ভারতের ব্যাপার
24 ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে আমেরিকা, রাশিয়া, ব্রিটেন এবং চীনের শীর্ষ কর্মকর্তারা ভারতে এসেছেন। পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করতে চায়। এ জন্য তাদের ভারতের সহযোগিতা প্রয়োজন। অন্যদিকে রাশিয়া ভারতকে সস্তায় জ্বালানি ও নতুন ধরনের উন্নত অস্ত্র দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। মার্চে দিল্লিতে এসে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ দাবি করেছিলেন যে “ভারত যা চাইবে রাশিয়া তাই দেবে।”
আমেরিকা, ব্রিটেন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন জানে ভারত অস্ত্রের ক্ষেত্রে রাশিয়ার উপর কতটা নির্ভরশীল। ভারত তার ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ অস্ত্র ক্রয় করে রাশিয়া থেকে। পশ্চিমারা এই নির্ভরতা কমাতে চায়। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন, যিনি গত সপ্তাহে ভারতে এসেছিলেন, ভারতকে যুদ্ধবিমান তৈরির সম্পূর্ণ প্রযুক্তি দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। জনসনের সফরে ভারত ও ব্রিটেনের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক প্রতিরক্ষা ও বাণিজ্য সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়েও একমত হয়েছিল।
ভারত এখন পর্যন্ত ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য রাশিয়ার সমালোচনা করা এড়িয়ে গেছে। ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক চাপ সত্ত্বেও, ভারত বারবার উভয় পক্ষকে সহিংসতা বন্ধ করার এবং ইতিবাচক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিরোধের সমাধান করার জন্য আবেদন করছে।
ভারতীয় পররাষ্ট্র নীতির সামনে বিকল্প ক্রমবর্ধমান
পশ্চিমারা মনে করে ভারত ও চীনের সহায়তায় রাশিয়া অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়তে পারে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলেছে যে তারা প্রতিরক্ষা, বাণিজ্য এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মতো ইস্যুতে ভারতের সাথে একসাথে কাজ করতে চায়। সোমবারের বৈঠকের পরে, ভারত এবং ইইউ একটি যৌথ বিবৃতি জারি করে বলে, “উভয় পক্ষই একমত যে দ্রুত পরিবর্তনশীল ভূ-রাজনৈতিক পরিবেশের জন্য একটি ভাগ করা গভীর কৌশলগত প্রতিশ্রুতি প্রয়োজন।”
বিবৃতিতে যোগ করা হয়েছে, “বাণিজ্য ও প্রযুক্তি কাউন্সিল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য, প্রযুক্তিগত কাজের সমন্বয় করার জন্য রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা এবং প্রয়োজনীয় কাঠামো প্রদান করবে। এটি ইউরোপীয় ও ভারতীয় অর্থনীতির টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলি সুসংহতভাবে বাস্তবায়নের জন্যও দায়ী থাকবে।” রাজনৈতিক পর্যায়েও এ বিষয়ে তথ্য দেবেন।
ভারত-ফ্রান্স সম্পর্ক ছাড়াও ইউরোপীয় ইউনিয়ন এতদিন ভারতের কাছে সরাসরি অস্ত্র বিক্রি এড়িয়ে চললেও এখন এই নীতির পরিবর্তন হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। মনে করা হচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রধান ভারতকে আরও সামরিক সামগ্রী বিক্রির প্রস্তাব দেবেন। আনুষ্ঠানিক আলোচনার আগে, জ্যেষ্ঠ ইইউ নেতা বলেছিলেন যে দুই দেশের মধ্যে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা ট্র্যাকে ফিরে আসবে।
ভারতের সঙ্গে চীনের চোখ
ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলো যারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে তারা জানে পরবর্তী বড় চ্যালেঞ্জ চীন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে, চীনের উপর নির্ভরতা কমানোর জন্য ক্রমবর্ধমান চাহিদা রয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নও এশিয়া প্যাসিফিকের পরিবর্তে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের কথা বলা শুরু করেছে। ভারত ও চীনের মধ্যে সীমান্ত বিরোধ এবং তা থেকে সৃষ্ট সংঘর্ষও কারো কাছে গোপন নয়। এ কারণেই পশ্চিমা দেশগুলো ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ভারত ও রাশিয়ার বন্ধুত্ব হজম করছে।
ভারত একটি বড় বাজার এবং ভারত মহাসাগর অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়ও। একই সঙ্গে ভারত অস্ত্রের ক্ষেত্রে রাশিয়ার ওপর নির্ভরতা কমানোর চেষ্টাও করছে। 20 বছর আগে পর্যন্ত ভারত তার 90 শতাংশের বেশি অস্ত্র ক্রয় করত রাশিয়া থেকে। বর্তমানে এই শেয়ার ৫০ থেকে ৬০ শতাংশের মধ্যে রয়ে গেছে।
ইউরোপের বৃদ্ধির শক্তি
অর্থনীতিবিদদের মতে, 2030 সালের মধ্যে চীন বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হবে। আমেরিকা নেমে যাবে দুই নম্বরে আর ভারত লাফিয়ে পড়বে তৃতীয় স্থানে। এই সময়ে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলির অর্থনীতি হয় সঙ্কুচিত হবে বা খুব ধীর গতিতে বৃদ্ধি পাবে। এমন পরিস্থিতিতে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যও ইউরোপীয় ইউনিয়নের আয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হয়ে উঠতে পারে।
অন্যদিকে, পরিষ্কার শক্তি, কারখানার আধুনিকীকরণ, পরিবেশ সুরক্ষা, গতিশীলতা, টেকসই উন্নয়ন এবং প্রতিরক্ষার মতো ক্ষেত্রে ভারতের ইইউ দক্ষতা প্রয়োজন। বর্তমানে ভারত ইউরোপীয় ইউনিয়নের তৃতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। ইউরোপীয় কমিশনের 2020 সালের তথ্য অনুসারে, দুই পক্ষের মধ্যে বার্ষিক বাণিজ্য 62.8 বিলিয়ন ইউরো। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ভারত দীর্ঘদিন ধরে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা করে আসছে, কিন্তু বিষয়টি 2013 সাল থেকে স্থবির হয়ে আছে। পেটেন্ট সুরক্ষা এবং আমদানি শুল্ক হ্রাসের মতো পার্থক্যগুলি উভয় পক্ষের মধ্যে থেকে যায়। 2021 সালের মে মাসে, আবারও উভয় পক্ষ এই কথোপকথন পুনরায় শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ভারত বর্তমানে জাপান, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া এবং ইসরায়েলের সাথে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা করছে। এমন পরিস্থিতিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নও যেন পিছিয়ে না পড়ে বলে মনে করছে। 2022 সালের ফেব্রুয়ারিতে, ভারত এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ বাড়াতে একটি অর্থনৈতিক চুক্তি স্বাক্ষর করে। উভয় পক্ষই একে “মাইলফলক” বলে অভিহিত করেছে।
ভারত কি বাকি বিশ্বের খাবারের চাহিদা মেটাতে পারবে
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বিশ্বে খাদ্যপণ্য সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে খাদ্যপণ্যের দাম। এই পরিস্থিতিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে বলেছেন, বাকি বিশ্বকে খাবার সরবরাহে প্রস্তুত তাঁর দেশ।
নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, নিজেদের ১৪০ কোটি মানুষের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য রয়েছে ভারতের। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) অনুমতি দিলে পরদিন থেকেই তাঁরা বিশ্বের জন্য খাদ্যপণ্য পাঠানো শুরু করতে প্রস্তুত আছেন।
বর্তমানে বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ধান ও গম উৎপাদনকারী দেশ ভারত। চলতি মাসের শুরুতে পাওয়া এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রায় ৭ কোটি ৪০ লাখ টন ধান ও গম ভারতে উদ্বৃত্ত রয়েছে। এর মধ্যে ২ কোটি ১০ লাখ টন খাদ্যশস্য দেশটির কৌশলগত মজুত এবং জনগণের মধ্যে বিতরণের জন্য রাখা হয়েছে। ভারতের ৭০ কোটির বেশি দরিদ্র মানুষকে সাশ্রয়ী মূল্যে এসব খাদ্য সরবরাহ করা হবে।
বিশ্বে যেসব দেশ তুলনামূলক কম দামে ধান ও গম রপ্তানি করে, সেই তালিকায় ওপরের দিকে রয়েছে ভারত। দেশটি ইতিমধ্যে বিশ্বের প্রায় ১৫০টি দেশে ধান ও ৬৮টি দেশে গম রপ্তানি করছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রায় ৭০ লাখ টন গম রপ্তানি করেছে তারা। সরবরাহ কম থাকায় বিশ্ববাজারে এসব পণ্যের চাহিদা বেড়েই চলেছে। এমন অবস্থায় এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত ৩০ লাখ টন গম রপ্তানির জন্য ভারতীয় ব্যবসায়ী চুক্তি করেছেন। অব্যাহত চাহিদার কারণে ২০২১-২২ অর্থবছরে ভারতের কৃষিপণ্য রপ্তানি রেকর্ড ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে।
ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর রিসার্চ অন ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক রিলেশনসের অধ্যাপক অশোক গুলাতি বলেছেন, চলতি অর্থবছরে ২ কোটি ২০ লাখ টন ধান এবং ১ কোটি ৬০ লাখ টন গম রপ্তানির সক্ষমতা রয়েছে ভারতের। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা ভারত সরকারকে এসব খাদ্যপণ্য রপ্তানির অনুমতি দিলে রপ্তানি আরও বাড়তে পারে। আর এটা সম্ভব হলে বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের দাম কমবে। একই সঙ্গে দুশ্চিন্তা কমবে আমদানিকারক দেশগুলোর। ভারত গুরুত্বপূর্ণ ভারত গুরুত্বপূর্ণ ভারত গুরুত্বপূর্ণ ভারত গুরুত্বপূর্ণ ভারত গুরুত্বপূর্ণ ভারত গুরুত্বপূর্ণ ভারত গুরুত্বপূর্ণ
ওএসজে/ভিএস (রয়টার্স, এএফপি)
আর পড়ুন….