ব্রহ্ম ও ব্রহ্মা কে

ব্রহ্ম ও ব্রহ্মা কে, ব্রহ্মা কি তাঁর নিজের মেয়ে সরস্বতীকে বিয়ে করেছিলেন? বিভ্রান্ত না হয়ে জানুন আসল ঘটনা।

ব্রহ্ম ও ব্রহ্মা কে, ব্রহ্মা কি তাঁর নিজের মেয়ে সরস্বতীকে বিয়ে করেছিলেন? বিভ্রান্ত না হয়ে জানুন আসল ঘটনা। হিন্দু ধর্মগ্রন্থ সঙ্গে অন্য ধর্মের শাস্ত্রের একটি মৌলিক পার্থক্য আছে।

নোয়াহ, মোজেস, ইব্রাহিম, এরা ঐতিহাসিক হক, না হোক মানুষ। যেটি অনেক পরে এসেছে হিন্দু শাস্ত্রে – কৃষ্ণ, রাম, সিতা, ইত্যাদি। কিন্তু এরা কেউই ভগবান নয়, অবতার কিংবা পৌরাণিক কাহিনীর মানুষ। কিন্তু আদি হিন্দু শাস্ত্রের চরিত্ররা যাদের কে দেবতা বা দেবী রূপে পূজিত করা হয় তারা কেউই মানুষ নন। তারা প্রতীকী।

ব্রহ্মা যেমন জ্ঞানের (wisdom) প্রতীকী। কিন্তু জ্ঞান একটি আধার, তার থেকে নদীর মতন বাক্যের মাধ্যমে যে নির্যাস বেরিয়ে আসে তাই হল বিদ্যা (knowledge)। তাই জন্যেই সরস্বতী দেবী বিদ্যার দেবী, নদী স্বরূপিনী, বাগদেবী। যেহেতু বিদ্যা জন্ম নিয়েছে জ্ঞানের ক্রোরে, তাই বলা হয় সরস্বতী দেবী ব্রহ্মাজাত। আমি যেমন আমার বাবার ছেলে সেইরকম ভাবে সরস্বতী দেবী ব্রহ্মার মেয়ে ভাবলে খুবই ভুল হবে।

এবার আসা যাক বিয়ের গল্পে:

ব্রহ্ম (ব্রহ্মা না) হল আদি অনন্ত অবিনশ্বর অজ্ঞাত। কিন্তু তার এই অজ্ঞাত রূপ কে দুটি ভাগ করা যায় – পুং এবং স্ত্রী। যাই স্থির, অবিচল তাই পুং। যেমন হিমালয়। যা বয়ে যায় সেই স্ত্রী। যেমন গঙ্গা। আরো বেশি আধুনিক করে বললে, থিয়োরি এবং অ্যাপ্লিকেশন।

এই পুং কে তিনটি ভাবে প্রকাশিত হতে দেখা যায় – ব্রহ্মা ( যার থেকে সবার উৎপত্তি), বিষ্ণু (যে অস্তিত্বের পালক) এবং মহেশ্বর (যে ধ্বংসের মধ্যে দিয়ে সৃষ্টির চক্রবূহ কে আবার চালিত করে)। কিন্তু যাই পুং থাকবে তারই স্ত্রী রূপ চাই। কারণ পুং এবং স্ত্রী এই দুটি রূপের সামঞ্জস্য না থাকলে সৃষ্টিই হয় না।

ব্রহ্মার স্ত্রী রূপ সরস্বতী, বিষ্ণুর স্ত্রী রূপ লক্ষী (ধন/খাদ্যশস্য), এবং মহেশ্বরের স্ত্রী চণ্ডী (যার দুটি রূপ কালি এবং দুর্গা – অসংযত ও সংযত ধ্বংস)। এবার আপনি যদি ভাবেন স্ত্রী রূপ মানে যার সাথে প্রেম করে বিয়ে করলেন, হানিমুন যাবেন সেই স্ত্রী তাতে আপনার শিক্ষার সম্পূর্ণ মানহানি হবার পূর্ণ সুযোগ।

ব্রহ্ম ও ব্রহ্মা কে

ব্রহ্ম ও ব্রহ্মা কে
ব্রহ্মা

যাই হোক, এবার নিশ্চই বুঝলেন যে সরস্বতী কী করে ব্রহ্মার স্ত্রী এবং কন্যা দুই হল।

ব্রহ্ম ও ব্রহ্মা কে

পুরাণে সরস্বতী সম্পর্কে বিভিন্ন মত রয়েছে। একটি বিশ্বাস অনুসারে, ব্রহ্মা তাদের মুখের মাধ্যমে প্রকাশ করেছিলেন। অন্য একটি পৌরাণিক রেফারেন্স অনুসারে, দেবী মহালক্ষ্মী (লক্ষ্মী নয়) যিনি তাঁর সত্ত্ব-প্রধান রূপে আবির্ভূত হন, দেবীর একই রূপকে সরস্বতী বলা হত। দেবী সরস্বতীর রং সাদা। সরস্বতী দেবী শারদা, শতরূপা, বাণী, বাগ্দেবী, বাগেশ্বরী এবং ভারতী নামেও পরিচিত। সঙ্গীতের উৎপত্তির কারণে তিনি সঙ্গীতের দেবীও বটে। বসন্ত পঞ্চমীর দিনটিও তার জন্মদিন হিসেবে পালিত হয়।

শ্রী ভগবতানন্দ গুরুজীর মতে, ‘সরস্বতী’ শব্দটি সেই ব্যক্তির জন্য ব্যবহৃত হয়েছে যিনি জ্ঞানের কর্তা, বিদ্যার কর্তা এবং শারীরিক রূপে বিরাজমান। সেই শক্তি শক্তির জন্য ‘সরস্বতী’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। শাস্ত্র মতে জ্ঞান বা বিদ্যা যেমন দুই, তেমনি সরস্বতীও দুই। 

বিদ্যায় অপরা ও পরা বিদ্যা আছে। অপরা বিদ্যা ব্রহ্মা থেকে সৃষ্টি হয়েছে, কিন্তু পরা বিদ্যা ব্রহ্ম (ঈশ্বর) থেকে সৃষ্টি হয়েছে। পুরাণে উল্লেখ আছে যে বিদ্যার দেবী সরস্বতী ব্রহ্মার স্ত্রী, তাঁর কন্যা ছিলেন না। এগুলো আসলে পৌরাণিক কাহিনি। বাস্তবিক অর্থে উপরে যে আলোচনা করা হয়েছে, আসলে সরস্বতী ও ব্রহ্মা কোন মানব সত্তা না। 

হিন্দু ধর্মকে আসলে অন্য ধর্মের সাথে গুলিয়ে ফিলেল ভূল হবে। বৈদিক সময়ে শেষের দিকে মানুষের চিন্তা ক্ষমতা তুলনা মূলক কমে যাওয়ার কারণে বিভিন্ন সত্তাকে বিভিন্ন রুপ দিয়ে কল্পনা করা হয়েছে। আদতে হিন্দু ধর্মে স্বর্গ নরক, ঈশ্বরের রুপ এগুলো কিছুই ছিল না। শুধু মানুষের চিন্তা শক্তির ক্ষীনতার জন্য এই সত্তা দিয়ে কল্পনা করা হয়েছে। মূল ব্রহ্ম (ব্রহ্মা না) হল আদি অনন্ত অবিনশ্বর অজ্ঞাত। যাকে আজ আমরা বিগ ব্যাঙ্গ বলছি।

 

কারসাজি?

মধ্য ও ইংরেজ যুগে পুরাণের সাথে অনেক টানাটানি হয়েছে। হিন্দু ধর্মের দুটি গ্রন্থ ‘সরস্বতী পুরাণ’ এবং ‘মৎস্য পুরাণ’-এ বিশ্বজগতের স্রষ্টা ব্রহ্মার সঙ্গে সরস্বতীর বিবাহের উল্লেখ করেছে, যার ফলশ্রুতিতে এই পৃথিবীতে প্রথম মানব ‘মনুর’ জন্ম হয়েছিল।

কিন্তু পুরাণের ব্যাখ্যাকারীরা সরস্বতীর জন্মের কাহিনীকে সেই সরস্বতীর সাথে যুক্ত করেছেন যিনি ব্রহ্মার স্ত্রী, যার কারণে সবকিছুই পঙ্কিল হয়ে গেছে । 

যারা এটি করেছে তারা হয় ভূল করে নয় উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে করেছে। উল্লেখ্য পুরাণ চরনা কাল মধ্য যুগে সুতরাং কি উদ্দেশ্য কারা করেছে সেটা নতুন করে বলার দরকার হবে না। 

নইলে আবার ইভের চরিত্র হননের প্রশ্ন এসে যায়। “প্রথম মানুষ আদম এবং ইভের তিন পুত্র হয়, তার থেকে গোটা মনুষ্যজাতির জন্ম” – আক্ষরিক ভাবে নিলে কি যে দাঁড়াবে ভাবলেও ভয় লাগে। এই কথার হয় তো অন্য ব্যাখ্যা থাকতে পারে তবে সাধারণ চিন্তা যেটা আসে সেটাই বলাম।

লেখক- অভিরুপ বন্দ্যোপাধ্যায়- কলকাত বিশ্ববিদ্যালয়।

আমাদের পাশে থাকতে একটি লাইক দিয়ে রাখুন।-ধন্যবাদ

ব্রহ্ম ও ব্রহ্মা কে, ব্রহ্ম ও ব্রহ্মা কে

আর পড়ুন…..