চীন-ভারত সর্বাত্মক যুদ্ধ! শক্তি প্রয়োগ করে আদৌ কী চীনকে হটানো সম্ভব?

                                         লেখক-কৃত্তিবাস ওঝা,ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক।
সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করে, গ্রেটার কাশ্মীরের উপর পূর্ণ রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাকল্পে ভারত লাদাখ সীমান্তে রাস্তা নির্মাণ করছিল, সেখানে চীন এসে তাঁবু খাটিয়ে বসে পড়েছে। চীন যে যথেষ্ট আটঘাট বেঁধেই নেমেছে, সেটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। কারণ চীন সম্প্রতি নেপালকে ভারতের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলেছে। নেপালকে ভারতের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলার উদ্দেশ্য – লাদাখের মতো সুউচ্চ পার্বত্য অঞ্চলে যুদ্ধ করতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর নেপালি সৈন্যরা শুধু যে দক্ষ তা-ই কেবল নয়, পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ। আলোচনা,মল্লযুদ্ধ, আবার আলোচনা – কিছুতেই চীন ভারতের জায়গা ছেড়ে দিতে চাইছে না। শক্তি প্রয়োগ করে আদৌ কী চীনকে হটানো যাবে? ভারতকে যদি নিজের সীমান্তে রাস্তা নির্মাণ করতে হয়, তাহলে কী যুদ্ধ অনিবার্য?

 

সর্বাত্মক যুদ্ধ সহজ কথা নয়। ৭ দিন যুদ্ধ হলে উভয় দেশ কমপক্ষে ২০ বছর পিছিয়ে যাবে। চীনের ভৌগোলিক আয়তন ভারতের থেকে প্রায় তিন গুন বড়। ভারতের পাশ্ববর্তী চীনের বিস্তৃর্ণ এলাকা(ভারতের দ্বিগুণ আয়তনের) বলতে গেলে জনবিরল। ঐ বিশাল পাহাড়-পর্বত-মালভূমি-মরুভূমি অতিক্রম করে চীনের মূল ভূখণ্ডে আঘাত হানা মোটেও সহজ কাজ নয়। সর্বাত্মক যুদ্ধ হলে, পাকিস্তান চীনকে সামরিক ঘাঁটি – বিশেষ করে নৌঘাঁটি ব‍্যবহার করতে দেবে। মিয়ানমারেও চীনের সামরিক ঘাঁটি আছে। ফলে ভারতের বড় শহরগুলো চীনের বিমানবাহিনীর নাগালের মধ্যে চলে আসবে। চীনের সামরিক ও অর্থনৈতিক সক্ষমতা এবং ভৌগোলিক আয়তনের সুবিধা,ভারতের চেয়ে অনেক বেশি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাথে তুলনা করলে, ভারত যদি হয় জাপান, চীন তাহলে আমেরিকা।

 

জাপান বাস্তবতার চেয়ে জাতীয় আবেগকে প্রধান‍্য দিতে গিয়ে, হঠকারিতা করে নিজের পরাজয় ডেকে এনেছিল। নাহলে জাপান আজ পৃথিবীর অন‍্যতম বৃহৎ রাষ্ট্র ও সুপার পাওয়ার থাকতো। সুতরাং ভারতকে সস্তা আবেগে গা না ভাসিয়ে, বুদ্ধিদীপ্ত কৌশলী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। যদি যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে, সেক্ষেত্রে যুদ্ধ লাদাখ সীমান্তে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। চীনের তুলনায় ভারতের আন্তর্জাতিক মিত্র অনেক বেশি; কিন্তু কোন মিত্র দেশ ভারতের হয়ে যুদ্ধ করবে না। তাছাড়া পশ্চিমা দেশগুলোর বানিজ্যিক বিনিয়োগ, ভারতের থেকে চীনে অনেক অনেক বেশী। কাজেই পশ্চিমা দেশগুলো মুখে যে যত কথাই বলুক, কোন দেশই নিজের বিনিয়োগ ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে চাইবে না।

 

চীনকে সামরিক ভাবে ঘায়েল করতে হলে, চীনের দুর্বলতর জায়গায় আঘাত হানতে হবে। চীনের প্রধান দুর্বলতা হচ্ছে, প্রশান্ত মহাসাগর উপকূলীয় প্রতিবেশী দেশসমূহ। চীনের ঘোরতর শত্রু দেশসমূহের মধ্যে আছে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান-এর মতো উন্নত, আধুনিক, সমৃদ্ধশালী দেশ। ফিলিপাইন,ভিয়েতনামের মতো উদীয়মান রাষ্ট্রের সাথে চীনের জটিল সীমান্ত সমস্যা রয়েছে। উল্লেখ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধ চালাতে গিয়ে ভিয়েতনাম যখন প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল, তখন সেই মুমূর্ষ ভিয়েতনামকে দখল করে নিতে, চীন সামরিক আগ্রাসন চালিয়েছিল। লড়াকু ভিয়েতনামীরা তখন চীনকে এমন মার দিয়েছিল, চীন বাধ্য হয়েছিল লেজ গুটিয়ে পালাতে।

 

চীনের ওই শত্রু রাষ্ট্রগুলোর সাথে ভারতের ঘনিষ্ঠ সামরিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। ওই সব রাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটিতে সামরিক সরঞ্জাম স্থানান্তরিত করতে হবে। যাতে চীনের প্রধান শহরগুলো ভারতীয় যুদ্ধবিমানের পাল্লার মধ্যে চলে আসে। তবে এই সামরিক সম্প্রসারণ অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। কাজেই দীর্ঘমেয়াদে যুদ্ধ প্রস্তুতি গ্রহণের পাশাপাশি, ভারতকে ঘনিষ্ঠ সামরিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে – চীনের বৈরী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও আঞ্চলিক শক্তি অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে।

 

চীন পরিকল্পিত ভাবে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে দিয়ে, ইতোমধ্যেই ভারত সহ প্রায় সমগ্র বিশ্ব বিপর্যস্ত করে ফেলেছে। আপাতত অর্থনৈতিক ভাবে বয়কট করে, চীনের যতটুকু সম্ভব ক্ষতি সাধন করতে হবে। সেক্ষেত্রে চীনের পন্য-বর্জন মহৌষধ। অনেকে পয়সা দিয়ে কেনা চীনের পণ্য পুড়িয়ে দেশপ্রেম জাহির করছে। এটা বোকামি। আমি নিজের কষ্টার্জিত অর্থ দিয়ে যে পণ্য কিনেছি – সেটা একান্তই আমার ; উৎপাদকের নয়। তাই চীনের যেসব পণ্য নিজেদের কাছে আছে, সেগুলো অক্ষত রেখে আমরা প্রতিজ্ঞা করি যে, নতুন করে আর কোন চাইনিজ পণ্য ক্রয় করবো না।

আমাদের পাশে থাকতে একটি লাইক দিয়ে রাখুন।

লেখক-কৃত্তিবাস ওঝা,ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক।
লেখকের অন্য আর লেখা