alt

ঐতিহাসিক পানাম নগর কি জন্য প্রসিদ্ধ ?

ঐতিহাসিক পানাম নগর

পানাম নগর পৃথিবীর ১০০টি ধ্বংসপ্রায় ঐতিহাসিক শহরের একটি । দিল্লির আওরঙ্গজেবের আমলে ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা সুবে বাংলার রাজধানী হিসেবে ঘোষিত করার পূর্ব পর্য়ন্ত সোনারগাঁওকে পূর্ববঙ্গের রাজধানী হিসাবে ধরা হত। ধারণা করা হয় প্রাচী সুবর্ণগ্রাম থেকে সোনারগাঁও নামের উদ্ভব । অনেকই সোনারগাঁও-কে পানাম ডাকত তবে এই নামটি কিভাবে এসেছে সে সম্পকে তেমন কোন তথ্য পাওয়া যায় না। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যে কয়টি পুরতন শহর পাওয়া গেছে তার মধ্যে পানাম হলো অন্যতম প্রাচীন ঐতিহাসিক নগর। এটি বাংলাদেশের ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁতে অবস্থিত। এই শহরের পাশে আর দুটি নগরের অস্থিত পাওয়া গেছে খাস নগর, বোরো নগর, তবে এদের মধ্যে পানাম নগর ছিল সবচেয়ে আকর্ষণীয় নগর । নগরটিতে ঔপনিবেশিক ধাঁচের দোতলা এবং একতলা ৫২ বাড়ি বর্তমানে আছে। এই নগরের যে সকল বাসিন্দরা ছিল তারা সকলেই ছিল ধনী হিন্দু ব্যবসায়ী। এই নগরীতেই হত সেই বিখ্যাত শাড়ি মসলিনের জমজমাট ব্যবসা। বর্তমানে এই প্রাচীন নগরীর চোখে পড়ার মতন, তেমন কিছু আর অবশিষ্ট নেই । বর্তমানে যে দালান গুলি অবশিষ্ট্য আছে তা যত্নের অভাবে ধ্বংসের দাড় প্রান্তে । এই নগরীর বাড়ি গুলো বেশিরভাগ তৈরি হয়ছে ঊনবিংশ শতাব্দিতে । (একটি বাড়িতে ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের নামফলক রয়েছে)। হিন্দু ধনী ব্যবসায়ীদের

alt
পানাম নগর

বসতক্ষেত্র হওয়ার কারণে এখানে মন্দির ছিলো। তার মধ্যে বর্তমানে একটি মন্দির নতুন করে সংষ্কার করে পূজা করা হয়। যেহেতু বাংলার বিখ্যাত শাড়ি মসলিন উৎপাদন হত এখানে, সেহেতু এই নগরীর ব্যবসায়ীদের ব্যবসা ঢাকা –কলকাতা পর্যন্ত বিস্তরিত ছিলো ।

ঐতিহাসিক পানাম নগর গোড়া পতন

ভাগ্যান্বেষণে অযোধ্যা থেকে গৌড়ে এসে ঈসা খাঁ পিতা কালিদাস গজদানী স্বীয় প্রতিভা গুণে রাজস্বমন্ত্রী পদে উন্নীত হন। কালিদাস গজদানী পরে সুলাইমান খাঁ নাম ধারণ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে । ঈসা খাঁ পিতা ধর্ম পরিবর্তন করে সুলতান গিয়াসউদ্দিন শাহের মেয়েকে বিয়ে, তার সুবাদে ব্রাহ্মনবাড়িয়ার সরাইল পরগণা ও পূর্ব মোমেনশাহী অঞ্চলের জায়গীরদারী লাভ করেন। কালিদাস গজদানী মারা গেলে, তার পুত্র ঈসা খাঁ মুসলিম হলেও তার বেশির ভাগ প্রজারা ছিল হিন্দু। ১৫ শতকে ঈসা খাঁর পিতার মৃত্যুর পর তার হাত ধরেই বাংলার প্রথম রাজধানী স্থাপন হয় পানাম নগরীতে ।পশ্চিমে শীতলক্ষ্যা পূর্বে মেঘনা নদীপথ হওয়াই ব্যবসা জন্য এক ধরণের সুবিধা পেত এই নগরী। বিলেত থেকে আসতো বিলাতি থানকাপড় আর এখান থেকে যেতো মসলিন। ডব্লিউ. ডব্লিউ. হান্টার-এর মতে, সোনারগাঁর রাজধানী পানার ছিলো সুলতানী আমলে থেকেই । কিন্তু আমার যদি লক্ষ্য করি পানাম নগরীর স্থাপত্য গুলোর দিকে সেখানে, সুলতানী আমলের তেমন কোনো স্থাপত্য নজরে পড়ে না, তাই এই দাবিটির ভিত্তিহীন ভিত্তিহীন বলে মনে হয়। জেম্স টেলর মতে, সোনারগাঁর প্রাচীন নগর হলো পানাম । আমারা যদি বাস্তবিক ভাবে লক্ষ্য করি তবে, এই তত্ত্বটির সাথে কোনো বিরোধ নেই।

নগরীর সৌন্দর্য়ের

বাংলার প্রাচীন রাজধানী সোনারগাঁও হলো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য়ের নান্দনিক ও নৈসর্গিক পরিবেশে ঘেরা । পানাম ও তার আশপাশকে ঘিরে পঞ্চদশ শতক থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত এক সমৃদ্ধ জনজীবন ছিল। অনুপম স্থাপত্যশৈলীর, অপূর্ব নির্মাণশৈলী এবং এর নগর পরিকল্পনা দুর্ভদ্য ও সুরক্ষিত। সরু রাস্তার দুই ধারে গড়ে উঠেছিল অট্টালিকা, মন্দির, মঠ, ঠাকুরঘর, স্নাগার, কূপ, নাচঘর, খাজাঞ্চিখানা, টাকশাল, দরবার কক্ষ, গুপ্তপথ, প্রশস্থ দেয়াল, প্রমোদালয় ইত্যাদি যাহা খুবি দৃষ্টিনন্দন । রাস্তার দুই পাশে মোট ৫২টি পুরোনো দোতলা এবং একতলা বাড়ী এই ছোট শাহরের প্রধান আকর্ষণ। পানাম নগরীর মধ্য ভাগ দিয়ে ইংরেজি ওয়ার্ড S মতন দেখতে যে রাস্তা বয়ে গেছে এর দক্ষিণ পাশে আছে ২১টি দালান এবং উত্তর পাশে আছে ৩১ টি দালান । নগরীর মধ্য ভাগ দিয়ে চলে যায়া রাস্তার দুই পাশে একতলা, দোতলা ও তিনতলা বহু সংখ্যক ভবন রয়েছে । এলেকার মানুষের সাথে কথা বলে জানা যায় এই পানাম নগরীর অনেক অংশই দখল হয়ে গেছে।

কি জন্য প্রসিদ্ধ
পঙ্খীরাজ নামক একটি খাল পানামেরন গরীর পাশ দিয়ে বয়ে গেছে। ধারণা করা হয় নদী সাথে নগরীর সহজে যোগাযোগ করার জন্য এই খালটি খনন করা হয়। গুরুত্বপূর্ন ভবনগুলো ছুঁয়ে নগরীল পূর্বদিকে মেনিখালি নদ হয়ে এই খাল মেঘনা নদীতে পড়েছে। অনুমান করা হয় ১২৮১ সালে থেকে এ অঞ্চলে মুসলিম আধিপত্যের বৃদ্ধি পেতে শুরু করে । তাই নগরীর বেশির ভাগ বাসিন্দা হিন্দু হওয়ার পরেও মসলিনের শাড়ির বিশাল আড়ং গড়ে ওঠে। ইস্ট কোম্পানীর বাণিজ্যিক কার্যক্রম ও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে ইউরোপীয়দের সহযোগীতাই নতুন ঔপনিবেশিক স্থাপত্যরীতিতে গড়ে উঠে ঐ সময়ই পানামে । বাংলার যে বিখ্যাত চারুকারুকলাজাত শিল্পের খ্যাতি, তাহা ছড়িয়ে পড়েছিল এ উপমহাদেশ ছাড়িয়ে পাশ্চাত্যে। আর তার আতুর ঘর বিকশিত হয়েছিল এই পানাম নগরীতেই। জেমস টেলরের অভিমত, এই পানাম নগরীতেই ছিল আড়ংয়ের তাঁতখানা এবং মসলিন শিল্প ক্রয়-বিক্রয়ের এক প্রসিদ্ধ বাজার ছিল পানাম ।এটি মুলতঃ ছিল বঙ্গ অঞ্চলের তাঁত ব্যবসায়ীদের মূল কেন্দ্র বিন্দু ও আবাসস্থল।পানাম নগরীতে মূলত ব্যবসায়ি ও জমিদাররা বসবাস করতেন। এ স্থান হতে ব্যবসায়ীগণ দেশের বিভিন্ন স্থানে তাঁত ব্যবসা পরিচালনা করতেন। বাংলার মসলিনসহ অন্যান্য তাঁত শিল্পের প্রচার প্রসার ও ব্যবসায়ের তীর্থস্থান বলা হত এ নগরীকে। পরবর্তিতে এই পোশাক বাণিজ্যের স্থান দখল করে নেয় নীল বাণিজ্য। ইংরেজরা এখানে বসিয়েছিলেন নীলের বাণিজ্যকেন্দ্র।

পানাম নগরী ধ্বংস
১৯৬৫ সালে পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা যখান শুরু হয়। স্বাভাবিকভাবেই তখন হিন্দু ব্যবসায়ীদের এই বসত সস্থল ছিলো লুটেরাদের লক্ষ্যবস্তু। যার ফলে এ সময় লুটেরারা ভবন গুলো থেকে জানালা-দরজা পর্যন্ত লুটে করে নিয়ে যায়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধর সময় ঐ এলাকার হিন্দু ব্যবসায়ীর প্রাণভয়ে ভারতে পাড়ি জমালে ঐ জমজমাট নগরী প্রায় লোকশুন্য হয়ে পড়ে । এক জীবন্ত শহরের মৃত্যু সেই থেকে শুরু, তারপর আর জেগে উঠেনি । নগরীর বাসিন্দাদের অনুপস্থিতিতে ভবন গুলো অবহেলাই ক্ষয়ে, ক্ষয়ে যেতে থাকে। বাংলাদেশ যুদ্ধের পর বাড়িগুলোতে সরকারিভাবে মানুষের বাস করার জন্য অনুমতি দেওয়। সরাকার এই বাড়িগুলো ১০-১৫ বছরের ইজারা দেয়া এবং পরে নবায়নও করা হয়। ২০০৪ সালে সরাকার এর গুরুত্ব বুঝতে পেরে আর ইজারা নবায়ন না করে সংরক্ষণের চিন্তা করে। বর্তমানে অযত্ন আর অবহেলায় পানাম নগরের বাড়ি-ঘর গুলোতে শ্যাওলা ধরেছে,। ভবন গুলো ভিতরের দিকটা স্যাঁত,স্যাঁতে, গোমট। অনেক বাড়ি দেয়াল গুলোতে জন্ম নিয়েছে বিভিন্ন আগাছা এবং দেযালে ঢুকে গেছে গাছের শিকড়। যার ফলে যে কোন মুহুতে ভবনগুলোর ছাদ এবং দেয়ার ধ্বসে বা ভেঙ্গে পড়তে পারে।অনে ভবনের সিঁড়ি ও দেয়াল ইতি মধ্যে ধ্বসে পড়েছে। মানুষহীন এসব ভবনগুলো ইতিহাসের অংশ হলেও
কালের গহবরে হারাতে বসেছে শুধু যত্নের অভাবে তা ধ্বংসের দার প্রান্তে। সরজমিন ঘুরে জানা যায় ২০০৫ সালে দুটো বাড়ি সম্পূর্ণ ধ্বসে পড়ে। যে কয়টা বাড়ি বর্তমানে টিকে আছে তার বেশিভাগ এখন জুয়াড়ি আর নেশাখোরদের আড্ডা খানা।


Source:
https://bn.wikipedia.org/
https://www.google.com/
http://adarbepari.com/
http://www.narayanganj.gov.bd

[kkstarratings]