নিউইয়র্কে প্রথম ইস্কনের “রাধা কৃষ্ণ মন্দির”

পরিত্যক্ত দোকান ঘরে কিভাবে তৈরী হলাে নিউইয়র্কে প্রথম ইস্কনের “রাধা কৃষ্ণ মন্দির”?-সোজাসাপ্টা

পরিত্যক্ত দোকান ঘরে কিভাবে তৈরী হলাে নিউইয়র্কে প্রথম ইস্কনের “রাধা কৃষ্ণ মন্দির”? ১৯৫৯ সালে তিনি সন্ন্যাস প্রাপ্ত হন এবং বৃন্দাবনে রাধা দামােদর” মন্দিরে বাস করতে থাকেন। তখন তার বয়স ৬৩ বছর। ১৯৬৫ সালে ৬৯ বছরের এই বৈষ্ণবধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে চলে গেলেন আমেরিকা। সিন্ধিয়া ষ্টীম নেভিগেশনের সেক্রেটারী সুমতি মােরারজীর আনুকূল্যে জলদূত নামে মালবাহী জাহাজে পেলেন একটি বিনামূল্যের টিকিট। 

আর সঙ্গে ছিল মাত্র আট ডলার, যার তখন ভারতীয় মূল্য চল্লিশ টাকা। মথুরার একব্যক্তির ছেলে থাকত নিউইয়র্কে। সে তার পিতার অনুরােধে একটি স্পনসর পাঠিয়েছিল। ফলে অভয়চরণ আমেরিকা পৌছে নিউইয়র্কে এই যুবকের বাড়ীতেই থাকতেন। সামান্য নিরামিষ রান্না তিনি নিজেই করে নিতেন। ভক্তিবেদান্ত যখন আমেরিকা গেলেন তখন সেখানকার সামাজিক জীবন আচ্ছন্ন হতাশা আর উজ্জ্বলতায়। 

 

কোকেন, এল. এস. ডি, চরস, হেরােইন, মারিজুয়ানার মত তীব্র মাদকে আর বিকৃত বীভৎস যৌনাচারে ডুবে যাচ্ছে আমেরিকার সমাজ। আর একদল শান্তির সন্ধানে ছড়িয়ে পড়ছে সারা পৃথিবীতে—হিপি বলে যারা পরিচিত। ভক্তিবেদান্তস্বামী হিপিদুনিয়ার হেড কোয়ার্টার টম্পকিন স্কোয়ার পার্কে প্রত্যেক দিন বিকেলে মৃদঙ্গ বাজিয়ে হরেকৃষ্ণ নামগান করতে লাগলেন। গৈরিক বসন পরিহিত প্রবীণ সন্ন্যাসীর সুরের আকষর্ণে এলাে হিপি তরুণ তরুনীরা। আসতেই থাকল, অনেক জিজ্ঞাসা নিয়ে। যুক্তিবাদী আমেরিকানরা অজানাকে জানতে চায়। প্রতিদিন কীর্তন শেষে শুরু হয় বৈদিক শাস্ত্রাদির ব্যাখ্যা, কখনও গান। 

 

প্রভুপাদ মাতৃভাষার মতই অনর্গল বলতে পারতেন ইংরেজী ও সংস্কৃত। আর ভারতীয় মার্গ সঙ্গীত জানতেন অপূর্ব। ক্রমশঃ হিপি অনুরাগীদের প্রচেষ্টায় নিউইয়র্কে এক পরিত্যক্ত দোকান ঘরে তৈরী হলাে প্রথম ইস্কনের “রাধা কৃষ্ণ মন্দির”। প্রভুপাদবিগ্রহ স্থাপন করলেন। দীক্ষা দিলেন শিষ্যদের, বৈষ্ণব পদ্ধতি পরম্পরা অনুযায়ী নিয়ম বেঁধে দিলেন। বৈষ্ণব যে দেশেরই হােক চলবেনা আমিষ আহার, নেশা, অবৈধ যৌনাচার আর জুয়া। জীবনকে সংযত করতে হবে। প্রথমদিকে এইসব নিয়মকানুন তার শিষ্যরা মন থেকে মেনে নিতে পারছিল না, আবার প্রভুপাদের দুর্বার আকর্ষণও কাটিয়ে উঠতে পারছিল না। 

 

নিউইয়র্কে প্রথম “রাধা কৃষ্ণ মন্দির
নিউইয়র্কে প্রথম রাধা কৃষ্ণ মন্দির

আমেরিকার মত একটি দেশে যেখানে অবাধ যৌনাচার, মাদক আর আমিষ আহারে মানুষ অভ্যস্ত সেখানে শ্রীচৈতন্যের স্মৃতিশাস্ত্র লােকে মানবে কেন? আশ্চর্যের কথা এর জন্য প্রভুপাদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের হয়ে গেল। তার বিরুদ্ধে অভিযােগ, তিনি আমেরিকার জনগণকে বিপথে পরিচালিত করছেন তার নিজস্ব দর্শনের দ্বারা। আদালত তাকে লিখিতভাবে কারণ দর্শাতে বললেন। প্রভূপাদ লিখিত স্টেটমেন্ট | হিসাবে তার নিজের লেখা ভাগবতের ভাষ্যগুলি পেশ করলেন। 

 

বললেন, জড় মায়াচ্ছন্ন মানুষ যদি প্রকাশ্যে মদ্য মাংস নারীদেহের বিজ্ঞাপন দিয়ে মানুষকে মােহগ্রস্ত করতে পারে, তাহলে আমিই বা মানুষকে ভারতীয় দর্শন গ্রন্থের প্রচারের মাধ্যমে ভক্তিমার্গে টেনে আনতে পারব না কেন? আদালত তার লেখা ভাগবত গ্রন্থ পাঠ করে যে রায় দিলেন তাতে মামলা খারিজ হয়ে গেল। এ নিয়ে কাগজপত্রে যথেষ্ট সােরগােল হয়ে গেল। ফলে এবার দলে দলে এগিয়ে এলাে মেয়েরা। 

এত স্নিগ্ধ মধুর, পবিত্র জীবনের কথা। এর আগে তারা শোনেনি। তাদের অভিযােগ ভারতবর্ষের অধ্যাত্মবাদ কি শুধু পুরুষদের জন্য? আমদের জন্য নয়? আমরাও এই কুরুচিকর জীবন থেকে মুক্তি পেতে চাই, আমাদের দীক্ষা দিন। পূর্ববর্তী আচাৰ্যরা যা করেননি তিনিতাই করলেন, মেয়েদের দীক্ষা দিতে শুরু করলেন, তাঁর বক্তব্য স্মৃতির সংবিধান মানুষের জন্য। মানুষের প্রয়ােজনে নিয়মের বাঁধন বদলাতে পারে। মার্কিন সমাজ মনে মনে ইস্কনকে স্বাগত জানাল। কারণ, যেভাবে যুবশক্তি অপচয় হচ্ছিল তা থেকে অন্ততঃ বাঁচবার একটা রাস্তা তারা দেখতে পেয়েছে। মার্কিন সরকার বা অন্যান্য দেশের গভর্ণমেন্ট কিন্তু হিন্দুধর্মের অগ্রগতিকে খুব ভালাে চোখে দেখে না।

 

জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক আদালত আর মানবাধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক কমিটি,দুটোই নেদারল্যান্ডের হেগ আর ইউট্রেক শহরে অবস্থিত। বিশ্বের বহু জটিল আন্তর্জাতিক বিবাদগুলির নিষ্পত্তি হয় এই আদালতে। এদের নিয়ােজিত একটি কমিটি চার বছর ধরে ইস্কন সম্বন্ধে তদন্ত করে ৩২০ পাতার একটা রিপাের্ট দিয়েছে। তাতে এক জায়গায় বলা হয়েছে : “হরেকৃষ্ণ আন্দোলনের যে ছবিটি আমরা দেখতে পেয়েছি তা হলাে এটি একটি বিশুদ্ধ এবং খাঁটি বৈদিক আন্দোলন। পশ্চিমী ধারণার সঙ্গে কোনরকম আপােষ এখানে করা হয়নি।

প্রথম দিকে এই আন্দোলন হিপিদের একটা ছােট গােষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। ফলে এদের ভাবমূর্তি ছিল ভিন্ন। পত্রপত্রিকাগুলি পৃথিবী জুড়ে বাস্তবকে বিকৃত করে তুলে ধরেছে। এটা বিশুদ্ধ বৈদিক আন্দোলনকে প্রতিহত করার চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। হরেকৃষ্ণ আন্দোলনের একটি স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি আমাদের কাছে ধরা পড়েছে। এটা যদি আমাদের কৃষ্ণ চেতনাকে বিস্তৃত নাও করে তবুও এই আন্দোলন সম্পর্কে অন্ধকারাচ্ছন্ন ধারণার অবসান ঘটেছে বলতে হবে।”

 

ক্যাসিয়াস ক্রে যিনি অতি উৎসাহে ইসলাম গ্রহণ করে মহম্মদ আলি নাম নিয়েছিলেন, তার ক্রমেইইসলাম সম্পর্কে আগ্রহ কমছে, উৎসাহ বাড়ছে হিন্দুধর্মের প্রতি। কলকাতায় এসে তিনি কালীঘাটে কালীমূৰ্ত্তি দর্শন করতে গিয়েছিলেন যা ঘোরতর ইসলাম বিরােধী। তিনি কিছুকাল আগে নাইজিরিয়ার লেগােস শহরে একটা আফ্রিকান সঙ্গীত অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। তিনি ইস্কনের ভক্তদের সঙ্গে যােগাযােগ করেন।

লেগােসের ইকোয়ি হােটেলে তিনি ভাষণে বলেন—বিশ্বজুড়ে মায়াচ্ছন্ন জগতে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ইস্কনের প্রয়ােজন জরুরী! বছর কয়েক আগে কানাডার ভ্যাঙ্কুভারে রাষ্ট্রসঘের বৈঠকে ১৩৫ টি দেশের ৪৫০০ প্রতিনিধি মানবাধিকার কমিশনের উদ্যোগে মিলিত হয়েছিলেন—এই বৈঠক হ্যাবিটাট নামে পরিচিত। রাষ্ট্রসঘের ইতিহাসে সরকারী এবং বেসরকারী মানব কল্যাণমূলক সংস্থার যৌথ উদ্যোগে এধরণের বৈঠক এই প্রথম।

 

এই বৈঠকে ইস্কন আমন্ত্রিত হয় এবং কৃষ্ণভক্তদের বক্তব্য মৰ্য্যাদার সঙ্গে গৃহীত হয়। ইউরােপ আমেরিকায় এখন আর একটা শহরও নেই যেখানে ইস্কনের মন্দির অথবা ভক্ত নেই। উচ্চ শিক্ষিত মানুষ কম আছেন যিনি “ভগবদ্গীতা এ্যাজ ইট ইজ” বইটি পড়েননি। এই ভারতে বহু বাড়ীতে গীতা আছে—কেউ পড়ে না, কিন্তু ভক্তিভরে ফুল, ফল, জল দেয় রােজ। ফলে অচিরে ফুলে ফেঁপে ওঠে।

গৃহস্বামী মারা গেলে গীতাটি তার সঙ্গে চিতায় দিয়ে দেওয়া হয়। মহা তমােগুণের এটাই বৈশিষ্ট্য না পড়েই সব জানা। ইউরােপ আমেরিকায় হিন্দুধর্মের প্রচার প্রসার যে কতভাবে আর কত স্থানে চলছে তা বলা অসম্ভব। বর্তমানে সানফ্রান্সিস্কোয়, লস এঞ্জেলসে রথযাত্রা, ফ্রাঙ্কফুর্ট কিম্বা বার্লিনে দোলপূর্ণিমা, দানিউব কিম্বা টেমস নদীতে নৌকাবিলাস, লন্ডন কিম্বা ব্রুসেলসে অষ্টপ্রহর কীৰ্ত্তন এখন অত্যন্ত সহজলভ্য দৃশ্য।

আমাদের পাশে থাকতে একটি লাইক দিয়ে রাখুন।-ধন্যবাদ

আরো পড়ুন………………..