১০
অবহেলিত ও বিস্মৃত নায়ক ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখােপাধ্যায়।
এগিয়ে এল না। শিক্ষাব্যবস্থায় সাম্প্রদায়িকতার ছাপ লাগানাের প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে তিনি জনমত জাগাতে শুরু করলেন এবং রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য হলেন। প্রথমেই তিনি শরৎচন্দ্র বসু ও সুভাষচন্দ্র বসুকে হিন্দুদের উপর অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ করতে অনুরােধ করলেন, স্বভাবতঃই ইহার মধ্যে কোনপ্রকার সাম্প্রদায়িকতার ছাপ ছিল না। বাংলায় তখন কংগ্রেস দ্বিধা বিভক্ত এবং সুভাষচন্দ্র গান্ধীজির বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হয়ে ফরওয়ার্ড ব্লক গঠন করেছেন। কোনও কংগ্রেস নেতাই হিন্দুদের স্বার্থরক্ষায় এগিয়ে এলেন না।
আগে প্রথম পর্ব পড়ে আসুন… এখান থেকে।
উপরন্তু সুভাষচন্দ্র কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র মুসলীম লীগের উপর তুলে দিলেন। এই সময় ১৯৩৯ সালে ব্রিটীশের পরােক্ষ সমর্থনে মুসলীম লীগ, ঢাকা, চট্টগ্রাম, পাবনা, কিশােরগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ বিরাট আকারে দাঙ্গা ঘটায় এবং হিন্দু মহিলাদের উপর পাশবিক অত্যাচার শুধু করে। যেহেতু হিন্দুরা ভারতের স্বাধীনতার জন্য জাতীয় আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিল তাই ব্রিটিশ সরকার তাদের একটু শিক্ষা দিতে চেয়েছিল। তাই এই নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে কোনও প্রকার শাস্তি প্রয়ােগ করল না উল্টে হিন্দু নিধনকারীদের সরকারী চাকুরীতে নিয়ােগ করে এবং স্থানীয় সংস্থাগুলিতে তাদের মনােনীত করে। শিক্ষাক্ষেত্রে তাদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করে। আর কংগ্রেস হিন্দুদের উপর নির্যাতন ও অবিচার মুখ বুজে সহ্য করে নিল, কোনপ্রকার আপত্তিও করল না, প্রতিবাদ করা তাে দূরের কথা। শুধুমাত্র মুসলমান ভােট হারানাের ভয়ে। | এদিকে ১৯৩৭ সালে বীর দামােদর বিনায়ক সাভারকর মুক্তি পান। ১৯১০ সালে তিনি বিপ্লবী নেতা হিসাবে শাস্তি পান। তাঁকে লন্ডনে ব্যারিষ্টার পড়ার সময় বন্দী করা হয়। ১৯০৯ সালে জুলাই মাসে মদনলাল ধিংরার গুলিতে ব্রিটেনের ভারত শাসন দপ্তরের প্রধান স্যার কার্জন উইলি নিহত হল। তিনি এই ব্যাপারে জড়িত ছিলেন ও অন্যান্য সন্ত্রাসবাদী কারণে তার গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯১১ সালে তিনি আন্দামানে সেলুলার জেলে দ্বীপান্তরিত হন। আন্দামানের সেলুলার জেলে কি অমানুষিক নির্যাতন চালানাে হত তা
অনেকেই হয়ত জানে না। ওখান থেকে কেউই ফিরে আসত না। মৃত্যুই একমাত্র ভবিতব্য থাকত। ওখানে তিনি প্রায় বার বছর অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করেন তারপর দেশের কারাবাস ভােগ করেন এবং শেষে অন্তরীণ অবস্থায় দিন কাটান। তারপর ১৯৩৭ সালে ২৭ বছর পর মুক্তি পান। জীবনের অমূল্য সময় তিনি কারান্তরালে কাটান। এতদিন কেউই কষ্ট সহ্য করে বাঁচতে পারে না। কিন্তু সাভারকর-বীর সাভারকর অদম্য মনােবল নিয়ে ফিরে আসতে পেরেছিলেন। তিনিও একজন কৃতী ছাত্র ছিলেন। জীবনে শিক্ষাক্ষেত্রে শীর্ষস্থান অধিকার করতেন। যখন তিনি সাজা পান তখন দাদারও. আন্দামানে দ্বীপান্তর হয়েছে ছােটভাইও কারান্তরালে। বাড়ীতে শিশুপুত্র যুবতী বৌদি। মাথার উপর কোনওপ্রকার অভিভাবক ছিল না। কি অসাধারণ স্বার্থত্যাগ এই সাভারকর পরিবারের। খুব কম লােকই তার নাম জানে। তিনি এত বড় বিপ্লবী ছিলেন যে লন্ডন থেকে হাতে পায়ে বেড়ি পরিয়ে
অবহেলিত ও বিস্তৃত নায়ক ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখােপাধ্যায়।
১১
জাহাজে করে আনা হয়েছিল। তারমধ্যেও তিনি বাথরুম যাবার নাম করে পায়খানার প্যানের ভিতর দিয়ে সমুদ্রে ঝাপ দিয়েছিলেন এবং সাঁতার কেটে ফরাসী বন্দরে উঠেছিলেন। তখন ইঙ্গ-ফরাসী চির প্রতিদ্বন্দ্বী। নিয়ম অনুযায়ী ইংরাজদের কোনও বন্দী ফরাসী দেশে থাকলে তার বিচার ইংরাজ করতে পারবে না। তাই দেখে অনেক বিপ্লবী চন্দননগরে এসে আশ্রয় নিত। এই চিন্তাধারা নিয়ে তিনি সমুদ্রে সাঁতার কেটে ফরাসী দেশে উঠেছিলেন। কিন্তু তার দুর্ভাগ্য আমাদের দুর্ভাগ্য ফরাসী সরকার তাঁকে বৃটিশদের হাতে তুলে দিলেন। আগেই বলেছি বিচারের প্রহসনে তার দ্বীপান্তর হয়। তিনি কিন্তু বিপ্লবী হিসাবেই বন্দী হয়েছিলেন এবং ২৭ বছর কারান্তরালে ছিলেন। ভারতের জেলে থাকার সময় বা অন্তরীন থাকার সময় থেকেই তিনি মুসলিম তােষণকারী, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রভাব লক্ষ্য করেছিলেন। তাই তিনি হিন্দুত্বের পক্ষে যে দল গঠিত হয়েছিল যাহা ১৯১৪ সালে অমৃতসরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মদনমােহন মালব্য ছিলেন সেই দলে যােগদান করলেন এবং সেই দলের সভাপতি নির্বাচিত হলেন।
১৯৩৯ সালে বীর সাভারকরের নেতৃত্বে কলিকাতায় হিন্দু মহাসভার অধিবেশন হয়। উপায়ান্তর না পেয়ে শ্যামাপ্রসাদ ঐ সম্মেলনে যােগদান করেন। তারপর তিনি ১৯৪০ সালে হিন্দু মহাভার কার্যকরী সভাপতি নির্বাচিত হন এবং ১৯৪০-৪৪ বঙ্গীয় হিন্দু মহাসভার সভাপতি পদে আসীন হন। শ্যামাপ্রসাদ বুঝেছিলেন যে শুধু ব্রিটিশ বিরােধীতা করে জাতীয়তাবােধ জাগানাে যাবে না একমাত্র দেশাত্মবােধ ও রাষ্ট্রীয় চেতনা মানুষের মনে জাগ্রত করতে হবে। তাই তিনি কংগ্রেসীদের দেশ নিয়ে ছেলেখেলার বিরুদ্ধে বিরুদ্ধাচরণ করে হিন্দু মহাসভায় যােগ দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। এই সিদ্ধান্ত গ্রহণে তিনি ডঃ কেশৰ বলিরাম হেডগেওয়ারের আদর্শে অনুপ্রাণিত হন, যিনি একজন দেশপ্রেমিক এবং ১৯২৫ সালে হিন্দুত্বের জাগরণের জন্য অরাজনৈতিক সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (R.S.S) গঠন করেন।
১৯৪০ সালে লাহােরে মুসলীম লীগ সম্মেলনে পাকিস্তান প্রস্তাব পাশ হয়ে গেল। মহঃ আলি জিন্না যিনি লীগের সভাপতি ছিলেন তিনি বললেন হিন্দু ও মুসলমান দুটি আলাদা ধর্মই নয় আলাদা জাতি। তারা সংখ্যালঘুই নয়, তাদের নিজস্ব বাসভূমির অধিকার আছে যাহা হিন্দু বন্ধুরা ঠিক বুঝতে পারছে না। কমিউনিস্টরা জিন্নার বক্তব্যকে সমর্থন করল-তারা বলল “The Pakistan is a just Progressive, and national demand”। তাদের আলাদা রাষ্ট্রের ব্যবস্থা থাকা দরকার। শ্যামাপ্রসাদ হিন্দু মহাসভার তরফ থেকে দেশ বিভাগের বিরােধীতা শুরু করলেন এবং তিনি মুসলীম লীগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও কাপুরুষ কংগ্রেসের প্রতিবাদ না করার বিরুদ্ধে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ডাক দিলেন এবং ঘােষণা করলেন হিন্দু মহাসভা সর্বশক্তি দিয়ে তা রুখে দাঁড়াবে। এই সময় হয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। কংগ্রেস নেতারা ব্রিটিশের অসহযােগিতা করা হবে জানালেন। যুদ্ধের জন্য সেনার প্রয়ােজন, কিন্তু কংগ্রেসী নেতারা যুব সমাজকে যুদ্ধে যােগ
১২।
অবহেলিত ও বিস্মৃত নায়ক ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখােপাধ্যায়
দেওয়ার আহ্বান জানালেন। কিন্তু শ্যামাপ্রসাদজী যুবকদের সেনা বাহিনীতে যােগ দিতে বললেন। ঐ সময় ভারতীয় তথা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে হিন্দুদের সংখ্যা খুবই কম ছিল, বেশীর ভাগ সেনাই মুসলমান। দেশ গঠনে সেনাবাহিনীর কথা চিন্তা করে তিনি ভারতীয় তথা হিন্দুদের সেনাবাহিনীতে যােগ দিতে বললেন। যুদ্ধের শেষে দেখা গেল হিন্দু তথা ভারতীয় সেনার আধিক্য যাহা স্বাধীন ভারতে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা নিয়েছিল।
হলে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে মুসলমানদের আধিক্য থাকত এবং সেটা ভারতীয় সেনাবাহিনীর পক্ষে খুব একটা স্বস্তিদায়ক হত না। ১৯৪১ সালে তিনি একথাও বলেছিলেন ইংরাজ দায়ে পরে সামরিক শিক্ষা দিচ্ছে। এই শিক্ষা নিয়েই আমাদের ছেলেরা সমরবিদ্যায় আধুনিক হয়ে উঠবে এবং পরাধীনতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। সুভাষ বােস পরে এই সত্য প্রমাণ করেছিলেন। সুতরাং কংগ্রেসের যুদ্ধনীতি যে ভুল ছিল প্রমাণিত হয়ে গেল।
১৯৪১ সালে মুসলীম লীগ সরকারের স্থায়ীত্ব নিয়ে সংকট দেখা দিল। ফজলুল হকের সঙ্গে মি. জিন্নার মনােমালিন্য শুরু হল। মি. জিন্নার দলের লােকেরাও তাঁর উদ্ধত্য ও স্বেচ্ছাচারিতায় বিরক্ত হয়ে ফজলুল হকের সঙ্গে যােগ দিল। ফজলুল হক সাহেব ও হিন্দু সদস্যদের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠনের আহ্বান জানালেন হিন্দু নেতাদের। ডঃ মুখার্জী এই আহ্বানে সাড়া দিলেন মুসলীম লীগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে ঠেকানাের জন্য। তিনি মন্ত্রীসভায় যােগ দিলেন এবং অর্থদপ্তরের ভার নিলেন এবং প্রায় একবছর সরকারে ছিলেন।
১৯৪২ সালে আগষ্ট মাসে কংগ্রেস ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলন শুরু করে এবং ব্রিটিশ কোনও প্রকার ঘােষণা ছাড়াই নেতাদের গ্রেপ্তার করে। এর ফলে দেশ জুড়ে বিক্ষোভ আন্দোলন শুরু হয়। মেদিনীপুরে সমান্তরাল জাতীয় সরকার গঠিত হয়। ব্রিটীশ সরকার মেদিনীপুরের জনগণের উপর খুবই ক্ষিপ্ত ছিল কেননা মেদিনীপুর বহু বিপ্লবীদের জন্ম দিয়েছিল। এবং বিপ্লবীদের হাতে তিন জন ম্যাজিস্টেট ঐ জেলায় প্রাণ দিয়েছিলেন এবং কোনও ম্যাজিস্টেট ওখানে নিয়ােগ করতে পারছিলেন না। সেজন্য ব্রিটিশ সরকার ওই আন্দোলন দমন করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন।
ঠিক এই সময় মেদিনীপুরে প্রলয়ঙ্কর ঘূর্ণীঝড় ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় শুরু হয়, যার ফলে ওখানে জনগণ প্রভূত দুঃখ দুর্দশায় পড়ে। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার এই সমস্ত খবর যাতে না পোঁছায় তার ব্যবস্থা করেন। শ্যামাপ্রসাদ বেসরকারী সূত্রে খবর পেয়ে ওখানে ছুটে গেলেন এবং জনগণের দুঃখ দুর্দশা প্রত্যক্ষ করলেন এবং সরকারের কোনও প্রকার সাহায্যের . ব্যাপারে উদাসীনতাও লক্ষ্য করলেন। সরকারে থেকে কিছু করতে না পারার বেদনায় তিনি ২৩ শে নভেম্বর মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করলেন। কয়েকমাস বাদে ব্রিটীশ সরকার ফজলুল হক সরকারকে বরখাস্ত করে পুনরায় মুসলীম লীগকে ক্ষমতায় বসালেন।
অবহেলিত ও বিস্মৃত নায়ক ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখােপাধ্যায়
মেদিনীপুরের এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে প্রায় ১০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। এক লক্ষ ঘর বাড়ী ধ্বংস হয় এবং প্রায় শতকরা ৭৫ ভাগের মত গবাদি পশুর প্রাণহানি ঘটে। সরকার ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে এগিয়ে এল না তাে বটেই জেলা শাসক অমানবিক মন্তব্য করেছিলেন— রাজনৈতিক দুষ্কৃতিকারীদের সাহায্য তাে বন্ধ করা উচিই এমন কি কোন বেসরকারী প্রতিষ্ঠানকেও ত্রাণকার্য করতে দেওয়া উচিৎ নয়। শ্যামাপ্রসাদ তখন ‘সাইক্লোন রিলিফ কমিটি’ গড়ে তােলেন। তিনি এই কমিটির সভাপতি, উঃ বিধানচন্দ্র রায় কোষাধ্যক্ষ এবং সতীশচন্দ্র ঘােষ সম্পাদক নিযুক্ত হলেন। এছাড়া বিপ্লবীদের সাহায্যের জন্য পলিটিক্যাল সাফারার রিলিফ কমিটি গঠন করেন।
ফজলুল হক মন্ত্রিসভাকে বরখাস্ত করার পর ব্রিটিশ খাজা নিজামুদ্দিনের নেতৃত্বে মুসলীম লীগ সরকারকে শাসন ক্ষমতায় বসালেন। ঐ বছর এক দুর্ভিক্ষ হয় যাহা বাংলায় ‘পঞ্চাশের মন্বন্তর’ নামে বিখ্যাত। এই দুর্ভিক্ষকে মনুষ্য সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ বলা হয় এবং মনুষ্য সৃষ্ট মন্বন্তর বলা হয়। প্রায় ৫০ লক্ষ লােক এ দুর্ভিক্ষের বলি হয়। মানুষ কুকুর শেয়ালের মত মরতে লাগল কিন্তু মুসলীম লীগ নির্বিকার এবং সংবাদপত্র যেন এই ব্যাপারে কোন প্রকার সংবাদ পরিবেশন না করতে পারে তার কড়া নির্দেশ দিয়েছিল। শ্যামাপ্রসাদ একটি মাসিক পত্রিকায় এই মর্মান্তিক সংবাদ পরিবেশন করেন যা দেখে সারা দেশ মুহ্যমান ও স্তম্ভিত হয়ে যায়। এর জন্য ঐ পত্রিকা ও শ্যামাপ্রসাদ তিরস্কৃত হন। সে সবের তােয়াক্কা না করে তিনি তার কর্তব্যচ্যুত হলেন না। তিনি শ্রেণী, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে ত্রাণকার্যে অংশ নিলেন। কিন্তু মুসলীম সরকার তখন সাম্প্রদায়িক রাজনীতি শুরু করলেন। জনমতের চাপে ত্রাণকার্যে এগিয়ে এলেন এবং ক্ষতিগ্রস্থ মুসলীম জনগণের ত্রাণকার্যে পাশে দাঁড়ালেন। এই দুঃসময়েও কংগ্রেসও নিজস্ব রাজনৈতিক স্বার্থ বিসর্জন দিতে প্রস্তুত হল না। কংগ্রেস নেতা জি.ডি. বিড়লা মুসলীম লীগ তহবিলে প্রচুর অর্থ দিলেন যাহা কেবলমাত্র মুসলীম জনগণের সাহায্যে ব্যবহৃত হতে লাগল। ত্রাণ কার্য নিয়ে নানা রকম দুর্নীতিও শুরু হল। খাকসার পার্টিও অন্যান্য সাহায্যকারী প্রতিষ্ঠান সাহায্যের নামে হিন্দু বালক বালিকাদের ধর্মান্তকরণ
শুরু করে। শ্যামাপ্রসাদ এই সংবাদ শােনার পর ঐ সমস্ত সংস্থাকে অনাথ হিন্দু বালক
- বালিকাদের হিন্দু মহাসভা বা অন্যান্য সংগঠনের হাতে তুলে দিতে বলেন। শেষ পর্যন্ত
শ্যামাপ্রসাদের চাপে সরকার ঐ দাবী মানতে বাধ্য হন।
| আর একটা কথা এখানে উল্লেখ করা দরকার ১৯৪২ সালে ভারত ছাড়’ আন্দোলন শুরু হবার পূর্বেই কংগ্রেসী নেতাদের জেলে বন্দী করা হয়েছিল। হিন্দু মহাসভা সব শক্তি দিয়ে এই ব্যাপারে সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে এসেছে। কংগ্রেস নেতাদের মুক্তির দাবী জানিয়ে এসেছে, বিপদে আপদে দেশকে এগিয়ে নিয়ে তথা সেবা করার চেষ্টা করে গেছে। ব্রিটিশ মুসলীম লীগের মিলিত প্রচেষ্টায় হিন্দু অত্যাচারিত হয়েছে তাকে রক্ষা করার জন্য এগিয়ে এসেছে।
অবহেলিত ও বিস্মৃত নায়ক ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়
আর একটা কথা এখানে বলা দরকার মুসলীম লীগের প্রতিপত্তি শুধু ইংরাজের সহায়তায় বাড়েনি, কংগ্রেসি নেতৃত্ববৃন্দ লীগের অনেক আবদার সহ্য করেছেন জিন্নার পায়ের তলায় গান্ধীজি প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা লুটিয়ে পড়েছিল। এই তােষণ নীতির ফলে লীগের শক্তি উত্তরােত্তর বৃদ্ধি পেয়েছিল। আর একথা স্বীকার করতেই হবে যতই লীগকে অপছন্দ করা হােক না কেন মুসলীম জনসমাজের লীগের প্রতি এক অভূতপূর্ব প্রাণের সঞ্চার হয়েছিল। তারা ভাবত কী করে মুসলমান গরিষ্ঠ প্রদেশে মুসলিম রাজ প্রতিষ্ঠিত হবে, তাদের জাতীয় শক্তি ও কৃষ্টি সমৃদ্ধ হবে এই চিন্তা করত। কিন্তু হিন্দু হিসাবে হিন্দু সমাজ এই চিন্তা করত না। কংগ্রেস ভারতে জনসাধারণ মধ্যে স্বাধীনতার চেতনা জাগিয়েছে ঠিকই, কিন্তু মুসলমানদের মধ্যে পাকিস্তান রূপ নিয়ে যে রাষ্ট্রীয় চেতনা জাগ্রত হয়েছে তার বিরুদ্ধে হিন্দুকে রক্ষা করার কোন শক্তি দান করতে পারে নি যাহা হিন্দু মহাসভা বহুলাংশে করতে সমর্থ হয়েছিল। ভারতে শতকরা ৭৫ ভাগ হিন্দু, যদি ভারতে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় কাঠামাে গড়ে ওঠে সেখানে হিন্দুদের প্রভাব বেশী থাকবে আর ভারতকে ভাগ করার কোনও প্রস্তাবই হিন্দু মহাসভা মানতে রাজী ছিল না।
কিন্তু ১৯৪৪ সালে দেখা গেল কংগ্রেস প্রকারান্তরে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ বাংলা সহ পাকিস্তানের প্রস্তাব দিয়াছেন এবং গান্ধীজি ইহা সমর্থন করেছেন, ইহার ফলে কংগ্রেস এক প্রকার পাকিস্তানের প্রস্তাব মেনে নিয়েছেন-প্রমাণিত হল। লীগও বুঝল কংগ্রেস তাদের দাবীর কাছে নতিস্বীকার করেছে। শ্যামাপ্রসাদজী বিষয়টা বুঝলেন এবং আসন্ন সংকটের কথা চিন্তা করে সমস্ত জাতীয়তাবাদী শক্তিকে কংগ্রেসের আত্মসমর্পণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে বললেন। জেল থেকে বেরিয়েই গান্ধীজি জিন্নার সঙ্গে আলােচনায় বসবেন বলে স্থির করলেন। দুর্ভিক্ষ ও মন্বন্তরের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলায় মুসলীম লীগ জনসমর্থন কমে গিয়েছিল। শ্যামাপ্রসাদজী গান্ধীজিকে ভালই বুঝতেই যে তিনি জিন্নার কাছে আত্মসমর্পন করবেন। তাই তিনি গান্ধীজিকে অনুরােধ করলেন তিনি যেন মুসলীম লীগের দুরাবস্থার সময় অক্সিজেন না যােগান আরও জানাতে ভুললেন না এ ব্যাপারে তিনি জনমত গঠন করতে সক্রিয় ভূমিকা নেবেন। তিনি গান্ধীজিকে ইহাও স্মরণ করিয়ে দিলেন যে তিনি একসময় বলেছিলেন Vivisect me befor you vivisect India”।শ্যামাপ্রসাদ চিঠি লিখে গান্ধীজিকে জানালেন—“আমরা আপনাকে কংগ্রেস থেকে আলাদা মনে করি আপনার এই পদক্ষেপ আমাদের এক অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। আপনি নিশ্চয়ই বুঝেছেন জিন্না কোন সমস্যা সমাধানে আগ্রহী নন, বস্তুত তিনি নিজেকে ভারতীয় বলেই মনে করেন না। স্বাধীনতার জন্য আমাদের পূর্বসুরীরা যে আত্মাহুতি দিয়ে চলেছে তাতে জিন্নার কোন আগ্রহ নেই। বাংলা তথা ভারত বিভাগের আমরা তীব্র বিরােধীতা করি। কেননা আপনিই কিছু দিন পূর্বে লিখেছিলেন দেশবিভাগের চিন্তা ভাবনা আমাদের।
শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির অবদান, অবহেলিত ও বিস্মৃত নায়ক ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়-(তৃতীয় পর্ব)
প্রথম পর্ব … এখান থেকে।
বাংলার দুই মহান সন্তান, কৃতী সন্তান, একজনের নাম নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, অপরজন ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখােপাধ্যায়। দুজনেই ভদ্র বংশজাত, দেশহিতৈষী, রাজনীতিবিদ, . নিঃস্বার্থভাবে দেশের সেবা করে গেছেন, কিছু পাওয়ার প্রত্যাশা না করে। একজনকে ষড়যন্ত্র করে সূদুর কাশ্মীরে হত্যা করা হয়েছিল আর একজনকে তাে নিরুদ্দেশই করে দেওয়া হয়েছিল, তিনি জীবিত না মৃত, মৃত হলেও কবে সেটা সংঘটিত হয়েছিল কেউ জানে না। এত প্রচার সত্ত্বেও নেতাজী প্রত্যেকটি ভারতবাসীর হৃদয়ে স্থান করে নিতে পেরেছেন কিন্তু শ্যামাপ্রসাদজী, তাকে লােকে ভুলতে বসেছে। আজকের জনগণ অনেকে তাঁর নামই জানে না, কি তাঁর অবদান তাইই জানে না, সেই দুঃখে ও বেদনায় মন ভারাক্রান্ত হয়ে এই ক্ষুদ্র লেখার উদ্দেশ্য। জনগণের কাছে শ্যামাপ্রসাদজীর পরিচিতি, জনগণের হৃদয়ে তার স্থান করে দেওয়ার মুখ্য উদ্দেশ্য নিয়ে সহজবােধ্য এই লেখা। যদি জনসাধারণ তার অবদানের কথা মনে রাখে বা তঁাকে হৃদয়ে স্থান দেয় তবে আমার এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা সার্থক হবে। এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টায় যদি কেউ আঘাত বা ক্ষুব্ধ হয়ে থাকেন তামার ভাবাবেগের কথা স্মরণ করে তাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
কৃতিত্ব
লেখক-কমল মুখার্জী
তারিখ -২১/১০/২০১৪ কুঁচুড়া
লেখাটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে পর্ব আকারে পরবর্তী পর্ব পড়ার জন্য এখানে চোখ রাখুন।