নামনামী অভেদ্য, নামই সব, একথা আমরা বিশ্বাস করি। কথাটা ভিত্তিহীন মিথ্যে বলেই ভাল লাগে। মনে মনে কিংবা প্রকাশ্যে নাম করেন না এদেশে এমন লােকের সংখ্যা খুবই কম। নাম যদি সত্যনিষ্ঠ নীতিপরায়ণ তেজস্বী ধার্মিক মানুষ তৈরী করতে পারত, তাহলে চারপাশে কিছু অন্ততঃ সেইসব লােককে আমরা দেখতে পেতাম যারা প্রতিটি অফিসে কারখানায় স্কুলে কলেজে দুর্নীতি ঘুষ কাজ ফাঁকি দেওয়ার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতাে। সর্বত্র যেসব ফাকিবাজ ঘুষখাের অফিসার বা অফিস কর্মী দেখি এদের বড় অংশটাই নামজপ কীর্তনাদি করে থাকেন। আচরণে নামের কোন প্রতিক্রিয়া থাকে না। নামনামী অভেদ্য হলে টাকা এবং টাকা শব্দটিও তাহলে এক। তাহলে একজন দরিদ্র ব্যক্তি সারাদিন টাকা টাকা করলে সন্ধ্যেবেলা কেন সে টাকার বস্তা পাবে না। এইজন্য পাবে না
প্রথম পর্ব ………….. উন্মুখ জাতি আজ দর্পনে মুখোমুখি শিথিল নড়বড়ে আত্মসমর্পণ।
দ্বীতিয় পর্ব ………….সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নামে বজ্জাতি, জাতি আজ দর্পনে মুখোমুখি।
তৃতীয় পর্ব আগে পড়ুন…..যে জাতি দুর্বলতাকে চাপা দেয় শাস্ত্র দিয়ে, ভগবান দিয়ে,সে জাতি কখনো দাসত্ব থেকে মুক্তি পায় না।
যে এগুলাে মিথ্যেকথা। সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের নাম পঞ্চাশ বছর জপ করলেও কোন মানুষ শিক্ষিত হবে না। তারজন্য একটা নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে। বিশ্বশ্রীদের নামকীর্তনে সুদেহী হওয়া যায় না, নিয়মিত ব্যায়াম করতে করতে হয়। আসলে আমরা চাই পরিশ্রমবিমুখতা বাস্তববিমুখতা অদৃশ্য নির্ভরতা। তাই ভক্তি বৈরাগ্য নামের কথা বলে আমরা পালাতে চাই পরিস্থিতি থেকে, বাস্তব অবস্থা থেকে। সশরক কত নামজপ করল দেখেন না। আচরণ দেখেন, কাজ দেখেন। খুব নাম করতে সুবল শ্রীদামেরা, কৃষ্ণ সেখানে যেতেনই না। আর
ডাকতেই চলে যেতেন ভীমার্জুনের কাছে। তারা কীর্তন করতাে না, নাম করতাে না, কাজ করতাে। ভগবানও কাজের লােক চান, ফালতু লােক নন। গীতায় কীর্তনের কথা নেই। ভক্তিতে গদগদ হয়ে বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে ফেলা, কীর্তন করতে করতে গড়াগড়ি দেওয়া তারপর অচৈতন্য হয়ে যাওয়া এইসব বাহাদুরীর কথা কৃষ্ণ গীতায় বলেনি। নামে সব হলে অর্জুনকে কৃষ্ণ যুদ্ধের পরামর্শ দিতেন,। বলতেন, কুরুক্ষেত্রে পাঁচভাইকে নিয়ে সতেরাে দিন ধরে অখন্ড নামসঙ্কীর্তন কর আর শেষদিনে মচ্ছব, তােমাদের জয় নিশ্চিত। যেখানে ধনুর্ধর পার্থ থাকে, যােগেশ্বর তুষ্ট থাকেন সেখানেই। কোন ভাল কীর্তনীয়া কিংবা দক্ষ খােল বাদকের কাছে থাকার কথা তিনি বলেননি। ঠাকুর দেখতে দেখতে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠা, কীর্তন করতে করতে মুছা যাওয়া-এগুলােকে ধর্মভাবের উচ্চ অবস্থা বলে মনে করি। এগুলাে চিত্তের অসংলগ্নতা, দুর্বলতা এবং ঘাের তামসিক ভাব থেকে উৎপন্ন এক ধরণের ব্যাধি।
যে ব্যাধি আজ সারাদেশ জুড়ে দেখা যাচ্ছে। যে দর্পণে মুখখামুখি ব্যাধির প্রাবল্যে হারিয়ে যাচ্ছে চক্রধারী রাষ্ট্রপুরুষ শ্রীকৃষ্ণ। ভেসে উঠছে নৌকাবিলাস আর রাসলীলার শ্রীকৃষ্ণ। হারিয়ে যাচ্ছে কাজীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানাে বীৰ্য্যবান গৌরাঙ্গ, যিনি বলে গেলেন “সঙ্ েশক্তি কলৌযুগে”। কলিযুগে সঙ্ঘবদ্ধ শক্তি চাই। সে গৌরাঙ্গ আমাদের পছন্দ নয়। দুহাত তুলে মেয়েলি ভঙ্গীতে দরবিগলিত ধারায় কীর্তন করা গৌরাঙ্গই আমাদের প্রিয়। এ ব্যাধি দেশের সর্বত্র। আর এর সবগুলির যােগফল ক্লীবতা । | অর্জুনকেও এই ব্যাধি একসময় আচ্ছন্ন করেছিল। তাই অর্জুন কৃষ্ণকে বলেছিল, সখা, আমি যুদ্ধ করবাে না, আমি দূর গ্রামে গিয়ে ভিক্ষে করে খাব। আত্মীয় হত্যা করে রাজ্যলাভ আমি চাই না। নিরুপদ্রব শান্ত জীবন চেয়েছিল অর্জুন। কৃষ্ণ একথা শুনে বলেননি, তােমার মধ্যে যথার্থ বৈরাগ্য এসেছে অর্জুন, এই নাও খঞ্জনি আর গেরুয়া। তুমি গ্রামে গিয়ে অহােরাত্র কীর্তন করে পাড়ার লােককে বিনিদ্র রেখে দাও, ভিক্ষান্নে জীবিকা নির্বাহ কর। ক্রুদ্ধ কৃষ্ণ এসব বলেননি। বলেছিলেন ক্লীব।
দেশের প্রতি ধর্মের প্রতি অনাচার দুঃখকষ্ট যাকে পীড়িত করে না, দেশের দুঃসময়ে যে ক্ষাত্ৰতেজ অবলম্বন না করে কীর্তন ভজনে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে চায় সে ক্লীব। হৃদয়ের দুর্বলতা থেকে ক্লীবতার উৎপত্তি। এই দুর্বলতা পরিত্যাগই ধর্ম। দুর্বলতা ত্যাগ করিয়ে অর্জুনকে যুদ্ধে প্রবৃত্ত করিয়েছেন শ্রীকৃষ্ণ। বৈষ্ণবরা অকারণে কাঁদে, শুধু বৈষ্ণব কেন, অনেক ধার্মিক লােক ভাব এলে কাঁদে। কৃষ্ণ অর্জুনকে পুত্রশােকেও কঁদতে দেননি। বলেছেন, অভিমন্যুকে দাহ করে অস্ত্র ধারণ কর। আমাদের ধর্ম মিথ্যে অলীকতা আর অলৌকিকতার পিছনে ধাবমান। কৃষ্ণ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে প্রয়ােগ করেছেন বুদ্ধি ও কৌশল। অলৌকিক শক্তি নয়। আমরা বিপদ দেখলে নামজপ করি, মাদুলী তাবিজ নিই। জ্যোতিষীর কাছে গিয়ে গ্রহের অবস্থান জিজ্ঞাসা করি। শনি, সন্তোষীর পুজো করি। এগুলােই আমাদের ভক্তি, ধর্ম বিশ্বাস। অসংখ্য দেবতায় বিশ্বাস। পাথরে মাদুলীতে বিশ্বাস। খন্ড খন্ড বিশ্বাস যে বিশ্বাস নয়, সন্দেহ, একথা বােঝার মত শক্তি আর আমাদের নেই। কৃষ্ণ একদিনও অর্জুনকে বলেননি, আজ দ্রোণাচার্যের সঙ্গে যুদ্ধ, আজ একটা বড় আমড়ার আঁটি রূপাের খােলে
ধারণ করে নাও। অশ্বত্থামা হত ইতি গজ’ করে দ্রোণকে বধ করেছেন। ভীষ্মের সঙ্গে যুদ্ধের সময় শিখন্ডীকে খাড়া না করে করে কৃষ্ণ বলতে পারতেন অর্জুন, পিতামহ ভীষ্ম মহাবীর, আজ সকাল থেকে বেশ ভাল করে একটা শনিপূজা কর কিম্বা সত্যনারায়ণ দাও। আমরা কিন্তু এগুলােই করে থাকি। কৃষ্ণের অত্যন্ত প্রিয়জন ছিল পঞ্চপান্ডব এবং দ্ৰৌপদী। তাদের সারাটা জীবন কেটেছে দুঃখে, কষ্টে, যুদ্ধে, বনবাসে, অজ্ঞাতবাসে, পুত্রশােক আর আত্মীয়বিরােধে। শেষে একে একে হিমালয়ের পথে মহাপ্রস্থান। প্রকৃত কৃষ্ণেভক্তের এগুলােই পুরস্কার। এতে দারুণ কষ্ট, খুব যন্ত্রণা, অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। এগুলাে এড়াতে গেলে বলতেই হয় নামনামী এক অভেদ্য। কারণ কাজে ঝুঁকি থাকে, নামে কোন ঝুঁকি নেই। সবকিছু ফাকি দিয়ে ভক্ত সেজে নিজেকে ধার্মিক বলে চালানাে যায়। নামে কিছু হয় না। ফুপিয়ে কান্না ভক্তি নয়। তাই কৃষ্ণ এগুলাে করতে বলেননি। মিথ্যে বলে সহজ বলে আমরা কৃষ্ণকে বাদ দিয়ে গীতাকে বাদ দিয়ে তাঁর শুধু নামটা নিলাম।
অনেক শাস্ত্র জানলে পন্ডিত হয় এ ধাৰণা আমাদের বদ্ধমূল। কৃষ্ণ গীতায় বলেছেন যিনি জীবিত এবং মৃত কোন ব্যক্তির জন্য শােক করেন না, তিনিই পন্ডিত। গীতার আলােয় যদি একবার আমাদের পরিচিত পণ্ডিতদের দেখে নিই, কি দেখতে পাব? মানুষ দূরের কথা একটা সিকি হারিয়ে গেলে একবেলা খুঁজবেন, তিনমাস শােকস্মৃতি বহন করবেন। জনে জনে বলবেন চকচকে সিকিটা হারিয়ে গেল। আর কি আছে? শুচি অশুচি ছুম্মার্গ আর খাদ্য বিচার। খাদ্যের ওপর দিয়ে পিপড়ে ইঁদুর আরশােলা হৈটে চলে গেলে দোষ নেই, মাছি বােলত স্পর্শ করলেও চলবে। মানুষে ছুঁলেই অশুচি। যদি সেই মানুষটা তার বর্ণের না হয়। নােংরা কাপড় অস্নাত দেহ চরিত্রহীন ব্যক্তির দোকান থেকে মিষ্টি আনলে তা পবিত্র শুচি। তখন কোন বিচার নেই। চরিত্রবান মানুষ নিষ্ঠা সহকারে বাড়ীতে কিছু তৈরী করে দিলেই অশুদ্ধ। পরিচ্ছন্নতা, পবিত্রতা, খাদ্যবিচার নিশ্চয়ই দেখা উচিত। সেটা যখন যুক্তিহীনতার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে তখন তা সমালােচনার যােগ্য হয়। মহত্ত্ব, ত্যাগ এবং অন্যান্য
গুণাবলী থাকা সত্ত্বেও এই ধরণের পন্ডিতরা ব্যঙ্গ কটাক্ষের শিকার হন। সমাজের মধ্যে বিভেদ এবং দূরত্ব সৃষ্টি হয়। বেদনার হলেও সত্য এই ধরনের পন্ডিত এখনও আমাদের সমাজে কিছু আছে। অভিমান এবং অহঙ্কারসর্বস্ব। তি ছাড়া অন্য পন্ডিতগুলাে কিছুই জানে না এ ধারণা বহু পন্ডিত পােষণ করেন, প্রকাশ করেন। জগতের শ্রেষ্ঠ ভাষা সংস্কৃত। এই সংস্কৃত বহু ব্রাহ্মণ পন্ডিতদের অন্ন যােগায় এখনাে, সেই ভাষাকে মৰ্য্যাদার সঙ্গে প্রতিষ্ঠার জন্য একটা দেশব্যাপী আন্দোলন সৃষ্টি করতে পারেন না এঁরা। বৃহত্তর সমাজের সঙ্গে সম্পর্কশূন্য স্বরচিত জগতে বাস করা এই মানুষগুলােকে আমরা পন্ডিত বলে মনে করি। মিথ্যে বলেই করি। শােক তাপ যন্ত্রণা দুঃখকে প্রতিরােধ করার জন্য আমরা হােমযজ্ঞ মাদুলী কবচ বিপত্তারিণী কি না করি। শাস্ত্র কতরকম স্তোত্রের ব্যবস্থা করেছে। কৃষ্ণ গীতায় বলেছেন, যতই কর সুখদুঃখ শােক তাপ তােমাকে নিত্য সহ্য করতে হবে, হচ্ছেও। তবু আমরা এগুলাে করে চলেছি। কারণ আমাদের ভাবনাচিন্তার উৎস সত্য নয় ধর্ম নয়, অজ্ঞতা ভয় এবং ভন্ডামি। প্রসাদ সম্পর্কে আমাদের কি পবিত্র ধারণা। ভােগরান্না নৈবেদ্য সাজানাে ফল কাটা থেকে শুচিতার শুরু। পট্টবস্ত্র স্নান কতজনের স্পর্শ বাঁচিয়ে দেবতার দৃষ্টি দিয়ে তৈরী হয় প্রসাদ। কতবার মাথায় বুকে ঠেকিয়ে আমরা তা গ্রহণ করি। এতে নাকি বহু আধি ব্যাধি দূর হয়। এগুলাে আমাদের বিশ্বাস। যদিও বাসি পচা প্রসাদ আর আটা গােলা সিন্নি খেয়ে অকে মানুষ অসুস্থ হয় এটা ঘটনা। প্রসাদ খেয়ে মানুষ মারা গেছে এরকম সংবাদ আমরা খবরের কাগজেও পড়ি। প্রসাদ সম্পর্কে গীতার বক্তব্য কি? সম্পূর্ণ বিপরীত। গীতা বলছে এগুলাে প্রসাদ নয়, মন এবং ইন্দ্রিয়কে বশ করাটাই প্রসাদ গ্রহণ। আমরা সত্য এড়াতে চাই তাই গীতােক্ত প্রসাদে আমাদের আগ্রহ নেই। অমৃত আমাদের জীবনে একটা মিথ। দেবাসুরের অমৃত নিয়ে লড়াই। অমৃতের পুত্র বলে আহ্বান, যে কোন স্বাদিষ্ট বস্তুকে অমৃতের সঙ্গে তুলনা । এই অমৃত লাভের জন্য কত কৃচ্ছসাধন, কত আয়ােজন। এটা তাে মিথ, গড়ে তােলা ধারণা। এর রিয়েলিটি কি? সত্য কি? গীতা বলছে যিনি সুখ
এবং দুঃখকে সমানভাবে গ্রহণ করতে পারেন, তিনিই অমৃত লাভ করেন। ফোটা, তিলক, দাড়ি নয়, জপ, অখন্ড নামযজ্ঞ নয়, সুখদুঃখকে সমানভাবে গ্রহণ করা। আমাদের অভ্যস্ত মিথ্যে ধারণার সঙ্গে এগুলাে মেলে না। কারণ, সত্য থেকে আমরা শত যােজন দূরে সরে এসেছি। শ্রেয়য়ালাভ বা শ্রেষ্ঠ মঙ্গল লাভের জন্য আমরা বারব্রত, মানসিক, একাদশী, অমাবস্যা পালন করি। গঙ্গায় পয়সা ফেলি, কোথাও ইট বেঁধে দিই, মাটির ঘােড়া দিই। এতে কোন মঙ্গল হয় গীতা কিন্তু বলেনি। গীতা বলছে একে অন্যের উপকার করলে মঙ্গল সাধিত হয়। অর্থাৎ সমাজ চেতনা অন্যের প্রতি সহানুভূতি, মমত্ববােধ, সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে আমরা পরের তরে -এই উপলব্ধি প্রকৃত কল্যাণ এর মধ্যেই নিহিত এটা কৃষ্ণের ধারণা। আমাদের ধারণা অপরের মঙ্গল করলে আমার কি মঙ্গল হ’ল? আমার মঙ্গল আগে চাই । তাতে অন্যের অমঙ্গল করতেও আপত্তি নেই। আমাদের অনেকের বিশ্বাস শরীরকে নিপীড়ন করলে কষ্ট করলে ধর্ম হয়। তার জন্য কেউ তিনবার স্নান করেন, একবার আহার করেন, উপবাস করেন। কেউ কোমড়ে কাঠের চাকা, বালিশের পরিবর্তে মাথায় ইট দিয়ে শুয়ে থাকেন। কৃষ্ণ গীতায় বলেছেন এগুলাে তামসিকতার তপস্যা। এতে মানুষ মূঢ়সতি অর্থাৎ জড়বুদ্ধি হয়। দেশজুড়ে বিপুল ধর্মচর্চার সঙ্গে যুগপৎ আমরা কি দেখতে পাচ্ছি। মূঢ়তার, স্থূলতার, পেশীর আস্ফালন। অর্থাৎ ঘােরতর তামসিকতা। পাড়ায় পাড়ায় অসুলিময় জড়বুদ্ধি যন্ডের কাছে সারা সমাজ আত্মসমর্পণ করেছে সমাজের বেশীরভাগ মানুষ ধার্মিক ভাল বা ভদ্র বলে নয়, ভন্ড বলে। ষন্ড এবং ভন্ডের সংঘাতে যশুরাই জেতে! আমরা ভন্ডেরা পালিয়ে যাই। পালিয়ে গিয়ে দেশ সমাজ রাজনৈতিক দল শিক্ষাব্যবস্থার শ্রাদ্ধ করি। আর আমরা ছােটবেলায় গােপাল অতি সুবােধ বালক ছিলাম, ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানিনা গােছের। স্মৃতিচারণ করি, এদের গুন্ডা-সমাজবিরােধী বলি। অবশ্যই নিরাপদ দূরত্বে থেকে। সামনাসামনি হয়ে গেলে বড় স্নেহের সঙ্গে বলি, আমার ছাত্র। ছাত্র হলেও বলি। রাজনৈতিক নেতা হলে বলি হীরের টুকরাে ছেলে সব।
সমাজবিরােধী কিম্বা গুণ্ডারা একটি সত্যকে সংগ্রহ করেছে সেটা হচ্ছে শক্তি, আর তারা ভন্ড নয়। তাদের সাহস আছে ঝুঁকি নিতে পারে। আর আমরা! আমাদের চোপ বলবারও দরকার নেই, তার আগেই গলবস্ত্র। শক্তি ছাড়া কোন বস্তুর মূল্য নেই। এই কথাটা আমরা ভুলে গেছি। মনে করিয়ে দিলেও বিশ্বাস হচ্ছে না। ঠিক এই কারণেই আমরা বাইরের সমাজের কাছে আক্রান্ত হচ্ছি। নিজের সমাজের গলিত অংশটাই আমাদের ওপর প্রভুত্ব করছে। যারা এদেশে শিক্ষিত ভদ্র ধার্মিকরূপে পরিচিত, তারা কিছুতেই শক্তি সংগ্রহ করতে চান না, সংগঠিত হতে চান না। তাই যিনি যত ভদ্র তিনি তত ভীরু অসহায়। এই সত্যকে অস্বীকার করা, আত্মপ্রবঞ্চনা করা।
যে দেবতারা আমাদের উপাস্য, যাদের গুণের শেষ নেই, তারা যখন সমাজ সম্পর্কে চেতনা হারাল, সংগঠন হারাল, বর্বর অসুররা তাদের মেরে করে দিল স্বর্গচ্যুত। দেবতারা ব্যাপারটা বুঝে সংগঠিত হয়ে আবার স্বর্গের কর্তৃত্ব ফিরে পেল। দেবী দশভূজা সেই সংগঠিত দেবসমাজের প্রতীক। দুর্গাপূজায় আমরা ভক্তি আনন্দ ঠিকই করি, শুধু এই ইঙ্গিতটা বােঝার চেষ্টা নেই। অনেক মানুষের ধারণা, আমি সৎলােক কারও ক্ষতি করি না, ভগবান আছেন মাথার ওপর, আমার কে কি করবে। এরাও একধরণের আত্মঘাতী মানুষ। পুরাণ কিম্বা ইতিহাস থেকে এরা কিছু শিখতে চায় না। দেবতারা কার ক্ষতি করেছিল, যার জন্যে বারবার অসুরদের দ্বারা আক্রান্ত হত? হিন্দুরা কবে কোন ধর্মকে আঘাত করেছে, কার মসজিদ ভেঙ্গেছে, গীর্জা ভেঙ্গেছে, নারীহরণ করেছে, গায়ের জোরে ধর্মান্তরিত করেছে? এসব তাে করেইনি, বরং আশ্রয় প্রার্থী ইহুদী, পাশী, আক্রমণকারী মােগল পাঠানকে সমানভাবে গ্রহণ করেছে। তাতে আমাদের প্রতি কেউ সদয় ব্যবহার করেছে, ইতিহাস সে সাক্ষ্য দেয় না। আমরা এইসব ঘটনা আড়ম্বরের সঙ্গে গল্প করে প্রমাণ করতে চাই আমাদের ঔদার্য্য। আসলে এগুলাে দুর্বলতা। ইহুদীরা জন্মভূমিতে ফিরে গেছে। সামান্য সংখ্যক পাশী ছিল আমাদের সমাজে মিশে গেছে। বাকীরা আরাে উৎসাহ নিয়ে আমাদের সমাজকে আত্মসাৎ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। দেশব্যাপী খৃষ্টানী চক্রান্ত মুসলিম ষড়যন্ত্র আজ
প্রকাশ্য ব্যাপার। এই চক্রান্ত সফল করার জন্য সারা পৃথিবীর মুসলিম রাষ্ট্র খৃষ্টান রাষ্ট্রগুলাে ঢেলে টাকা দিচ্ছে। আমাদের ঔদার্য্য তাদের চোখে দুর্বলতা। দুর্বলকে কেউ শ্রদ্ধা করে না, হয় করুণা নয় ঘৃণা করে। দুর্বলতা কাপুরুষতা পাপ। সম্প্রসারণই জীবন, সঙ্কোচনই মৃত্যু। আমরা সব জেনেশুনে পাপের চাষ করে চলেছি। মৃত্যুর ফসল ফলছে। মানুষ চলে যাচ্ছে অন্য ধর্মে, মেয়েরা চলে যাচ্ছে অন্য সমাজে। দেশের জমি নিয়ে নিচ্ছে অন্য রাষ্ট্র। আজ আমাদের দেশের সীমা, হৃদয়বত্ত সব সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। দুর্বলতা পাপ বলে দেবতারাও দুর্বলের প্রতি উদাসীন। দেবতারা একবার এক আলােচনায় বসলেন। বিষয়, আমাদের পুজোয় আমিষযুক্ত করা দরকার, বলির দরকার। সংস্কৃতে শ্লোক আছে, “অশ্বং নৈব গজ নৈব ব্যাঘ্ৰং নৈব নৈব চ, অজাপুত্র বলিং দদ্যাৎ দেব দুর্বল ঘাতকা” অস্যার্থ, ঘােড়া চলবে না কোথায় চাট মারবে ঠিক নেই, হাতি এককোপে কাটা যাবে না অতএব বাদ। বাঘ তাে কখনই নয়, বাঘ ধরবে কে? বাঘ বলির ব্যবস্থা করালে মানষ পূজোই তুলে দেবে। অনেক বিচার বিবেচনার পর দয়ালু দেবতারা ঠিক করলেন ছাগলকে বলির পশু নির্ধারণ করা হ’ল। ছাগলের অপরাধ সে কাউকে আক্রমণ করতে পারে না। তার শিংএ ধার নেই, দাঁতে বিষ নেই, নিরামিষভােজী নিরীহ। এককোপে কাটা যায়, শুধু দুর্বল বলেই ছাগল পশুত্বের প্রতীক হয়ে গেল, কামনা বাসনার প্রতীক হয়ে গেল। বাঘ সিংহ হিংস্র নরখাদক, তাদের পশুত্বের প্রতীক বলতে পারলাম না, বীরত্বের প্রতীক বললাম। কেউ সাহস-শক্তির পরিচয় দিলে তাকে আমরা সিংহশিশু, বাঘের বাচ্চা বলি। দুর্বল ভীরু মানুষদের লজিকই আলাদা। সে বলরানের পদলেহন করবে, আর তারচেয়ে কেউ দুর্বল হলে তাকে পদদলিত করবে। বিবেকানন্দ বলেছেন একথা, আমার কথাও তাই। একটা আংটি কিংবা কিছু টাকা চুরি করলে তাকে আমরা চোর বলি, শাস্তি দিই। একটা রাজ্য চুরি করলে তাকে আমরা রাজা বলি। মুখ বর্বর দস্যু লুণ্ঠকদের আমরা বাদশা বলেই একদা মেনে নিয়েছিলাম, শুধু আমাদের সংগঠিত ভাবে প্রতিরােধের শক্তি ছিল বলে। একটা খুন করলে তাকে আমরা খুনী বলি, দেশের আইন তাকে ফঁাসী
দর্পণে মুখখামুখি
দেয়। হাজার হাজার খুন করতে পারলে তাকে আমরা বীর বলি, সম্রাট বলে বন্দনা করি। পরাজিত দুর্বল দাস মানসিকতার মানুষদের এটাই লজিক। মানুষ দুর্বল হলে জাতি দুর্বল হলে সে কারাে না কারাে হাতে অত্যাচারিত হবেই, মরবেই! মরবার আগে সে যত পরিমাণে পারবে মিথ্যেকে জড়িয়ে ধরবে, কৌশল অবলম্বন করে শেষে বড় অমৰ্য্যাদার সঙ্গে মৃত্যুবরণ করে নেবে। ভারতের মূল সমাজ হিন্দুসমাজের গােটা পরম্পরায় এক দৃশ্য এক ছবি— শক্তিহীনতার ছবি, মিথ্যের ছবি।। আমরা অনেকেই বলে থাকি শব্দ ব্ৰহ্ম। বহু পন্ডিতও বলে থাকেন। আমরাও বিশ্বাস করি, মিথ্যে বলেই বিশ্বাসটা দৃঢ় হয়। কিন্তু ভেবে দেখিনা, ব্ৰহ্ম সৃষ্টি করা যায় না, শব্দ সৃষ্টি করা যায়। ব্রহ্ম নিজেই একটি গােলমেলে জিনিষ, তার ওপর শব্দ ব্ৰহ্ম বলে আর এক গােলমাল পাকিয়ে তুলি। আসলে দুটোই বুঝিনা। আর আমাদের জাতীয় বৈশিষ্ট্য যে ব্যাপারগুলাে আমরা মােটেই বুঝিনা তা নিয়েও ঘন্টার পর ঘন্টা আলােচনা চালিয়ে যেতে পারি। বিশেষভাবে অজ্ঞ ব্যক্তিরাই এদেশে এক একজন বিশেষজ্ঞ। অনেক পন্ডিতকে প্রশ্ন করতে দেখেছি, শব্দ ব্রহ্ম নয়? শব্দের প্রতিক্রিয়া নেই? যদি আপনাকে শূয়ােরের বাচ্চা বলি আপনি গরম হয়ে যাবেন কিনা বলুন? আমাকেই বলেছিলেন এক পন্ডিতম্মন্য ব্যক্তি। আমি বলেছিলাম, নিশ্চই ক্রুদ্ধ হ’ব। কিন্তু আপনি যদি বলেন তুমি পবিত্র হও, চরিত্রবান হও, আমি হচ্ছি না। তাহলে কি সিদ্ধান্তে আসতে হবে, শব্দ ব্রহ্মের প্রতিক্রিয়া শুধু “শূয়ােরের বাচ্চা” শব্দের মধ্যেই সীমাবদ্ধ? এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না। কারণ আমরা এইসব কথার সত্যাসত্য নিয়ে তলিয়ে ভাবি না। ভেবে দেখি না, ছেলেমেয়েদের মা ও বাবারা ছােট্ট বয়েস থেকে যত ভাল ভাল কথা বলেন, যত সদুপদেশ দেন, শব্দ ব্ৰহ্ম হলে এবং তার কোন প্রতিক্রিয়া থাকলে প্রত্যেকটি ছেলেমেয়ে বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দ, সারদামণি, নিবেদিতা হওয়া উচিত ছিল। হয় না, কারণ তারা দেখে শেখে। উপদেশের উপযােগী বাবা মায়ের চরিত্র দেখলে, আচরণ দেখলে, ব্যক্তিত্ব দেখলে তারা খানিকটা শােখে!
প্রথম পর্ব ………….. উন্মুখ জাতি আজ দর্পনে মুখোমুখি শিথিল নড়বড়ে আত্মসমর্পণ।
দ্বীতিয় পর্ব ………….সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নামে বজ্জাতি, জাতি আজ দর্পনে মুখোমুখি।
তৃতীয় পর্ব আগে পড়ুন…..যে জাতি দুর্বলতাকে চাপা দেয় শাস্ত্র দিয়ে, ভগবান দিয়ে,সে জাতি কখনো দাসত্ব থেকে মুক্তি পায় না।