অভিবাদন জানানোর জন্য ভারতীয় উপমহাদেশে এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অনেক দেশে এই রীতিটি নমস্কার নামেই পরিচিত। তবে এই রীতিটিকে অনেক ক্ষেত্রে প্রণাম বলা হয়। আসাম এবং ওডিয়াতে (নমস্কাৰ) এবং (ନମସ୍କାର) “নমস্কার” কথাটিই বলা হয়। হিন্দি ও নেপালিতে “নমস্তে” (नमस्ते) এবং “নমস্কার” (नमस्कार) বলা হয় হয়ে থাকে। সাধারণত নমস্কার শব্দটি গুরুজনদের শ্রদ্ধা জানাতে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
কন্নড়ে একজন ব্যক্তিকে “নমস্কারা” (ನಮಸ್ಕಾರ) আর একাধিক ব্যক্তিকে “নমস্কারাগলু” (ನಮಸ್ಕಾರಗಳು) বলে সম্ভাষণ জানানো হয়। তেলুগুতে একজনের জন্য “দণ্ডমু” (దండము) বা “নমস্কারম্” (నమస్కారం) এবং একের বেশিজনের ক্ষেত্রে “দণ্ডালু” বা “নমস্কারালু” বলা হয়। এছাড়াও আনুষ্ঠানিক “প্রণামমু” (ప్రణామము) প্রচলিত। তামিলে নমস্কারকে বলা হয় ভানাক্কম বা “বণক্কম” (வணக்கம்), এর উৎপত্তি “বণঙ্গু” (வணங்கு) শব্দ থেকে, যার অর্থ সম্ভাষণ। মলয়ালম ভাষায় নমস্কারম্ (നമസ്കാരം) শব্দটি ব্যবহৃত হয়।
কেন বিশ্বজুড়ে করমর্দন নয় অঞ্জলি মুদ্রায় প্রণাম শুরু হয়েছে?
সাধারণত মানুষের শরীরে বহু রোগ প্রবেশ করে শুধু শরীরের স্পর্শ দ্বারা। এই স্পর্শ কে সংস্কৃত ভাষায় বলা হয়ে থাকে রোনারো স্মৃতি । ভারতীয় সভ্যতায় অধিক রোনারো স্মৃতি থেকে সবসময় সতর্ক থাকার কথা বলা হয়েছে। রোনারো স্মৃতি শুধু শারীরিক নয় মানসিক ক্ষতি করে থাকে। কারণ সাধারণত আমরা অনেক কিছু ভূলে যায়, কিন্তু আমাদের শরীর ভলে না।
তাই এই অধিক স্মৃতি থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য আমাদের সমাজে একের অধিক শরীরিক সম্পর্ক থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। শুধু শরীরিক সম্পর্ক নয় যে কোন ধরনে সংস্পর্শ এই রোনারো স্মৃতি তৈরি করে থাকে। যদি লক্ষ্য করি দেখব, আমাদের অনেক মা বা ঠাকুমারা হাতে, হাতে জিনিস নিতেন না। তার কারণ এই রোনারো স্মৃতি যত কম রাখা যায়। যার যত রোনারো স্মৃতি বেশি তার জীবনে শিক্ষা, আর্থিক বা সম্মান বেশি থাকলেও মানসিক শান্তি থাকে না। এই কারণে আমাদের সমাজে একের অধিক শারীরিক সম্পর্কে যেমন নিষিদ্ধ করেছে, তেমনি বহু জিনিস হাতে, হাতে নিয়া থেকে বিরত থাকতে বলেছে। এর মধ্যে লবণ, মাটি ইত্যাদি অন্যতম।
আধুনিক বিজ্ঞান বলছে আমাদের শরীরের বেশির ভাগ রোগ আসে অন্যের সংস্পর্শে এলে। সেই কারণেই করমর্দন ও কোলাকুলি সবসময় শরীরে রোগ প্রবেশের জন্য অনেক অংশে ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। এই কারণে আমাদের পূর্ব পুরুষেরা অঞ্জলি মুদ্রায় নমস্কার মতন বিজ্ঞান সম্মত ব্যবস্থা করেছিলেন। অঞ্জলি মুদ্রায় নমস্কার বা প্রণাম জানালে শরীরের স্পর্শ হয় না, আবার শ্রদ্ধা জানানো যায়। তাই শ্রদ্ধা জানানোর জন্য সবচেয়ে বিজ্ঞান সম্মত পদ্ধতি হল অঞ্জলি মুদ্রায় নমস্কার বা প্রণাম। পৃথিবী জুড়ে আমরা যখন করোনা ভাইরাস সহ বহু ভাইরাসে দিশেহারা তখন আলোর পথ দেখাছে আমাদের পূর্ব পুরুষের রেখে যাওয়া এই সনাতনি প্রথা।
আমাদের মুনি ঋষিদের দূরদর্শিতার কতটা ছিল তা এই প্রথা সাক্ষ্য দেয় । করোনা মতো ভয়ংকর ভাইরাস বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে সেই আশঙ্কা থেকে করমর্দন ও আলিঙ্গন বিশ্বজুড়ে বর্জন শুরু হয়েছে। জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মের্কেল তাঁর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হোর্স্ট সিহোফার এর সঙ্গে হাত মেলাতে অস্বীকার করেছেন। লন্ডনের মেয়র সাদিক খান মুসলমানদের ঐতিহ্যবাহী অভিবাদন রীতি আলিঙ্গন বিরত থাকতে বলেছে। নরেন্দ্র মোদীও ঘোষণা দিয়েছে এখন থেকে বিশ্ব নেতাদের সাথে অভিবাদন জানাতে করমর্দন ও আলিঙ্গন বদলে অঞ্জলি মুদ্রায় বা প্রণাম জানাবেন। আমাদের পূর্ব পুরুষের রেখে যাওয়া এই প্রথা একটি নিখুঁত শুভেচ্ছা বিনিময় পদ্ধতি।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ থেকে বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই আভিবাদ পদ্ধতিটি প্রশংসা করেছে। নিউইয়র্ক টাইমসের কলাম লেখক মাউরিন দউড স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, তিনি যখন ট্রাম্পের সাক্ষাত্কার নিতে গিয়েছিলেন তখন তিনি ট্রাম্পের টেবিলে বড় একটি জীবাণুনাশক বোতল দেখেছিলেন। করমর্দনের পর তিনি এটা দিয়ে হাত পরিষ্কার করে নিয়েছিলেন।
এই কারণে আমাদের পূর্ব পুরুষের রেখে যাওয়া এই অভিবাদন পদ্ধতি বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে যাচ্ছে। এটা এখন আর শুধু সনাতনি অভিবাদন পদ্ধতি নয় বিশ্বের সকলের । মানুষকে তার মূলে ফিরতেই হবে আজ অথবা কাল।