আর্য্যদের ভারত আক্রমন

আর্য্যদের ভারত আক্রমন তত্ব এবং বৈদিক সভ্যতা।

“আর্য্যদের ভারত আক্রমন তত্ব এবং বৈদিক সভ্যতা”  প্রচলিত বিদেশী এবং ভারতীয় বামপন্থী ঐতিহাসিকেরা একটি বেশ ভালো তত্ব খাড়া করেছেন। সেটি অনেকের মতো আমিও ছোট বেলায় আমাদের ইতিহাসে পড়েছি, পরীক্ষার খাতায় লিখেছি। 

সেই তত্ব মতে, “আজ থেকে মোটা মুটি ৩৫০০ বছর আগে, ‘আর্য্য’ নামে একটি জাতি ভারত আক্রমন করে। তারা ছিলো যাযাবর, পশু চরিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতো। তাদের আদি বাস স্থান ছিলো বর্তমান ‘ভোলগা নদীর তীরে’ ,ককেশাস পর্বত মালার কাছাকাছি অঞ্চলে। তারা হিন্দুকুশ পার হলো, ভারতে এসেই এখানকার আদিবাসিন্দা দের মেরে কেটে শেষ করে দিলো। স্থাপন করলো “আর্য্য ভুমি, তৈরী করলো বেদ”। ঐতিহাসিক মর্টিমার হুইলার এই তত্ব খাড়া করলেন, রাহুল সাংকৃত্যায়ন লিখলেন “ভোলগা থেকে গঙ্গা”।“
 বইটা প্রচুর বিক্রি হলো। সেই তত্ব রোমিলা থাপার, ইরফান হাবিব জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের কাছে পরিবেশন করলো। আমার মতো অনেকেই সেই তত্ব জেনে বুঝে বুদ্ধু বনে বসে রইলাম সারা জীবন, গলাধকরন করলাম, কিন্তু বদ হজম হলো না। 
এরা আরো বললেন, হরপ্পা এবং মহেঞ্জদারো তে যে প্রাচীন সভ্যতা খুজে পাওয়া গেছে, তা এই ‘বহিরাগত আর্য্যরা ধংস করেছে’। বাঃ বেশ। হরপ্পা শেষ হলো ৫৫০০ বছর আগে, আর্য্যরা এলো ৩৫০০ বছর আগে। তাহলে তারা কি করে হরপ্পা শেষ করলো???? পড়লাম, শুনলাম, বুঝলাম বুদ্ধু হয়ে বসে রইলাম।
আর যারা বলে “বৈদিক সভ্যতা প্রায় ১২০০০ বছরের প্রাচীন, তাদের নামে গালাগাল দিলাম। যারা সেদিন এলো, আমাদের দেশ ধ্বংস করলো, তাদের মাথায় তুলে ধেই ধেই করে নাচলাম। 
এই সব দেশ বিরোধীরা, নিজেদের পায়ে নিজেদের কুড়ুল মারা লোক গুলো জানলো না, আমাদের ভারতবাসীর এক সুপ্রাচীন সভ্যতা আছে, যার উত্তরসুরী আমরা  আজ সব ভুলে ‘উদ্ভ্রান্তের মতো” ‘বোল সর্ব ধর্ম সমন্বয় বোল’ “বোল মিশ্র সভ্যতা বোল” বলে কীর্তন করে চললাম। আরে, বিজেতা আর বিজীত, উপনিবেশ আর নিজ দেশ, দখলীকৃত আর দখলদারী, নিজের মত, ধর্ম আর বৈদেশিক মত ও ধর্ম, প্রভু আর গোলাম, শাসক আর শাসিত, মালিক আর দাস কি কোনোদিন এক হতে পারে???? না হয়???? 
‘আর্য্যদের নিয়ে আগেও লিখেছি। শুধু এখন এই টুকু বলতে চাই, দিল্লী থেকে ১৬০ কিমি দূরে বর্তমান হরিয়ানায় “রাক্ষিগড়ি” নামে একটি গ্রামে প্রায় ২০ টি কঙ্কাল খুজে পাওয়া গেছে মাটির নীচে। তাদের ডি এন এ টেষ্ট করা হয়েছে। সেই টেষ্ট বলছে, এই কঙ্কাল গুলো ৫৫০০ বছরের পুরানো এবং হরপ্পা মহেঞ্জোদাড়োর সমসাময়িক। বাহারে!!!!!! কোথায় সিন্ধু নদীর তীরে হরপ্পা এবং মহেঞ্জোদাড়ো আর কোথায় হরিয়ানা। 
বোলান নদীর তীরে “মেহেরগড়” এর কথা আগেই বলেছি। সেই সভ্যতা নাকি ৮৫০০ বছরের পুরানো। সেটাও নাকি বৈদেশিক নয়। উত্তর পশ্চিমের ‘ভুমিপুত্র’ যাদের আমরা বলছি ‘বৈদিক সনাতনী’ তাদের সভ্যতা। এই রকম গুজরাটের ‘লোথাল’ এবং শুকিয়ে যাওয়া সরস্বতী নদী, পাকিস্তানের সিন্ধু নদী, গাঙ্গেয় অববাহিকা, এই সব অঞ্চলে আজ অনেক প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন খুজে পাওয়া যাচ্ছে। দক্ষিন ভারত আরবী তুর্কিদের হাত থেকে অনেকটা বেচে গেছে একমাত্র ‘হাম্পি’ বাদ দিয়ে। সেখানে আজো বৈদিক সভ্যতার নিদর্শন মাটির ওপরেই আছে। 
ছোট বেলায় স্নান করার আগে একটি মন্ত্র উচ্চারন করতে শিখিয়েছিলেন আমার ঠাকুরমা। সেটা হলো— “ঔং, সরস্বতী, গঙ্গা, যমুনা, সিন্ধু নর্মদা, কাবেরী সন্নিধং কুরু”। এই বলে হাতের কোষে এক কোষ জল নিয়ে সেটাকে মাথায় ঠেকিয়ে নিয়ে তারপর জলে ডুব দিতে হতো। জানি না এই মন্ত্র কবেকার। আজো সেই অভ্যাস রয়ে গেছে। সরস্বতী, সিন্ধু, গঙ্গা যমুন্‌ কাবেরী,নর্মদা, কাবেরী কে মাথায় নিয়ে চলি। হৃদয়ে স্থাপনা করে চলি, ভারত আমার দেশ, ভারতের প্রাচীন ধর্ম আমার ধর্ম, ভারতের সভ্যতা আমার সভ্যতা, ভারতের ভাষা আমার ভাষা। 

 

সেই জন্য একদিন এক বিদেশী প্রধানমন্ত্রীকে বলেছিলাম “ আমার চারজন মা। আমার জন্মদাত্রী, আমার দেশ, আমার ভাষা, যার মেয়েকে বিয়ে করেছি”। আর চারজন বাবা। যার ঔরসে জন্মেছি, যার মেয়েকে বিয়ে করেছি, যার কাছে দীক্ষা নিয়েছি, আর যার স্মরন রোজ করি সেই সৃষ্টি কর্তা”। লোকে হাসে, মজা কুড়ায়।  কিন্তু এর গভীরে যাওয়ার ক্ষমতা নাই।

আজকের দিনে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া হিন্দু তরুন তরুনীরা তাদের নিজ ধর্ম, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির বিষয়ে আলোচনা করার ক্ষেত্রে চরম উদাসীন থাকেন।

এবিষয়ে মোটেও আলাপ আলোচনা আগ্রহ দেখায় না। অত্যন্ত দুঃখ ভরা মন নিয়ে বলতে হয়, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত আধুনিক এসব হিন্দু ছাত্র তরুন বন্ধুদের সাথে সনাতন তথা প্রাচীন বৈদিক সভ্যতা ও হিন্দুধর্ম বিষয়ে কথা বলতে গেলে কোন এক অজানা কারণে এরা এড়িয়ে যায়।

হতে পারে তাদের নিজধর্ম বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাব, আবার হতে পারে আমাদের চারপাশের প্রচলিত ধর্মমত গুলির দৃশ্যমান উন্মাদনায় ভীতশ্রদ্ধবোধ ও হতাশা থেকে, কিংবা হতে পারে অন্য কোন অজানা কারণ। এই ভীতি থেকে বের হতে সবার আগে আমাদের কে যেটা করতে হবে তা হল আমাদের অনুসন্ধান করতে হবে মূল শিখড়ের।

“আর্য্যদের ভারত আক্রমন তত্ব এবং বৈদিক সভ্যতা”
ডাঃ মৃনাল কান্তি দেবনাথ