বাংলার বাঘ আশুতোষ মুখোপাধ্যায় সন্তান শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির অবদান-(৪র্থ পর্ব)

আহ্বান জানালেন, মহাত্মা গান্ধীর হত্যার পর।

বস্তুত বিভাজনের ফলে স্বাধীনতার আনন্দ ম্লান হয়ে গেল। যাঁরা দেশের জন্য প্রাণ দিয়ে গেল তাদের একাংশ পরদেশী হয়ে গেল। নদীয়া জেলার লােকেরা ভেবেছিল তারা পাকিস্তানের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। পরে ১৮ই আগষ্ট তারা জানতে পারে যে ভারতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। যাই হােক সকলে আশা করেছিল যে অংশ স্বাধীনতা পেয়েছে তাকে। সংঘবদ্ধ করে পুনর্গঠনের কাজ করবে এবং পাকিস্তান অন্তর্ভুক্ত প্রদেশে হিন্দুদের অমুসলমানদের স্বার্থ রক্ষায় সচেষ্ট থাকবে। কেননা ঐ অংশের জনগণ শ্যামাপ্রসাদকে তাদের অভিভাবক বলে মনে করত এবং তাদের জন্য তিনি মন্ত্রিসভায় যােগ দেন। হিন্দু মহাসভাকে রাজনৈতিক কার্যকলাপ থেকে দূরে থাকতে বলেছিলেন কিন্তু ১৯৪৮ সালে হিন্দু মহাসভা আবার রাজনৈতিক কার্যকলাপ শুরু করায় হিন্দু মহাসভার কার্যকরী সভা থেকে পদত্যাগ করেন। | দুদেশের স্বাধীন সরকার গঠন হওয়ার পর মােটামটি শান্তিতে কাটছিল। পূর্ব বাংলার হিন্দুরা ২৫ থেকে ২৮ শতাংশ সরকারী কমবেশি ছিল। বেসরকারী ক্ষেত্রে প্রায় ৫০ শতাংশ ছিল। এই অংশে থেকে হিন্দুরা বিতাড়িত হবে ও মুসলমানরা ওই স্থান দখল করবে এমন সম্ভাবনা ছিল না। মুসলমানদেরও হিন্দুদের তাড়িয়ে দেওয়ার মানসিকতা ছিল না। ১৯৫০ সালে সামান্য এক গুজব থেকে পূর্ব বাংলায় দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ল। ফজলুল সাহেব কলকাতা এসেছিল পুরােনাে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করতে এবং তার বিষয়

অবহেলিত ও বিস্মৃত নায়ক ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়  (পর্ব ১ম)

অবহেলিত ও বিস্মৃত নায়ক ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়-দ্বিতীয় পর্ব।

শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির অবদান, অবহেলিত ও বিস্মৃত নায়ক ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়-(তৃতীয় পর্ব)

অবহেলিত ও বিস্মৃত নায়ক ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়

২১

সম্পত্তি বিক্রির বন্দোবস্ত করতে। এই সময় বরিশাল ও অনান্য জায়গায় গুজব ছড়িয়ে পড়ল হক সাহেবকে নাকি হিন্দু গুণ্ডারা খুন করেছে। এই নিয়ে ১০ই ফেব্রুয়ারী বরিশাল থেকে শুরু করে বিভিন্ন জেলায় দাঙ্গা শুরু হয়ে গেল। এই কথা শুনে হক সাহেব তড়িঘড়ি করে পূর্ববাংলায় ফিরে গেলেন। তিনি বিভিন্ন জায়গায় সভা করে জানালেন যে ‘তােমরা দেইখ্যা যাও আমি মরি নাই। আগুনের লেলিহান শিখার মত এই দাঙ্গা ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবেড়িয়া, নােয়াখালি, শ্রীহট্ট, করিদাষুর, খুলনা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। ১৫ই ফেব্রুয়ারী থেকে পূর্ব বাংলার জেলাগুলিতে ভয়াবহ দাঙ্গা শুরু হল। এই দাঙ্গায় প্রায় ৩৫ লাখ হিন্দু এদেশে চলে এল। প্রতিহিত শুরু হল পশ্চিমবঙ্গে শিল্পাঞ্চলের জেলাগুলিতে। পশ্চিমবঙ্গের এক নূতন প্রজন্ম দেখা দিল যাদের জন্ম রেললাইনের পাশে জবর দখল কুঁড়ে-ঘরে। রেলগাড়ী পরিত্যক্ত কামরায়। কলিকাতার পতিতালয়ে বাংলা উচ্চারণের মেয়েদের কথাবার্তা শােনা গেল। | এই সময় একটা কথা না উল্লেখ করে থাকা যায় না। পূর্ব বাংলা জমি জায়গার উচ্চশ্রেণীর হিন্দুদের দখলে। চাকুরী বাকুরীও উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের দখলে। নিম্নশ্রেণীর হিন্দুরা ও মুসলামান চাষ, মজুরী ও অনান্য কাজকর্ম করে জীবিকা নির্বাহ করত। সুতরাং তপশীল নেতা যােগেন মন্ডল ঘােষণা করলেন তপশীলি জাতি ও মুসলমানরা শশাষিত বঞ্চিত। উচ্চবর্ণের হিন্দুরা শােষক। সুতরাং ওদের তাড়িয়ে দিয়ে আমরা ও মুসলমানরা সুখে থাকব, তাই তিনিও তার সম্প্রদায়কে হিন্দু বিতাড়নে সাহায্য করতে বললেন। ফলে যা হবার তাই হল। মাথা চলে গেল। তিনি পূর্ব পাকিস্তানে মুসলীমের সর কারে থেকে রাজত্বে শুরু করলেন।

কিন্তু তিনিও ১৯৫০ সালের দাঙ্গায় সম্বিত ফিরে পান। তখন ক্ষতি যা হবার তা হয়ে গেছে। তিনি মন্ত্রী হয়েও হিন্দুদের কোনও প্রকার সাহায্য করতে পারলেন না উল্টে তার পরিবারের উপর অত্যাচার হবে এমন কথাও শুনতে হল। সমস্ত থানা পুলিশ মুসলমান কর্মচারী তাদের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে দাঙ্গা, লুট, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোেগ চলতে থাকল। সরকার কোনও প্রকার কড়া পদক্ষেপ নিল না। উল্টে হিন্দুদের সম্পত্তি ও নারীদের লুট করার প্রতিযােগিতা সরু হয়েগেল। তিনি নিজেও ভারতে চলে আসতে বাধ্য হলেন। মুসলমান সম্বন্ধে তার কী ধারণা হয়েছিল তার লেখা আলােচনা ও বক্তব্য থেকে জানতে পারবেন। ১৯৫০ সালের শেষভাগ থেকে হিন্দুদের আক্রমণের ঘটনা কমতে শুরু করল কিন্তু হিন্দুরা ভবিষ্যতের নিরাপত্তার কথা ভেবে আর ওই দেশে থাকতে রাজী হল না। তারা দলে দলে পশ্চিমবঙ্গে বা উত্তর পূর্বাঞ্চলে চলে যেতে শুরু করল। কেননা ১৯৫০ সালের দাঙ্গায় পরিকল্পিত ভাবে হিন্দুদের নিষ্ঠুরভাবে খুন বা হত্যা করা হয়েছিল। সরকারী হিসাবেই ৫০ হাজার মানুষ খুন, হাজার হাজার হিন্দু নারীদের লুণ্ঠন করা হয় এবং তাদের উপর অবর্ণনীয় অত্যাচার চলে। সামাজিক ভাবে সমস্ত সচেতন হিন্দুদেরই পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিতাড়ন করা হয়। পাকিস্তান তথা পূর্ব বাঙ্গলার সরকারের প্ররােচনাতেই এই সমস্ত

অবহেলিত ও বিস্মৃত নায়ক ভঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়

অমানবিক কাজ সংঘটিত হয়েছিল। তখন শ্যামাপ্রসাদজী বহু যুক্তি দ্বারা পূর্ববাংলার হিন্দুদের অত্যাচারে ব্যথিত হয়ে জওহরলালকে বােঝানাের চেষ্টা করেন, কিন্তু তার অমানবিক হৃদয় পরিবর্তন করতে ব্যর্থ হলেন, হিন্দুদের উপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে কোনওপ্রকার ব্যবস্থা গ্রহণ না করে তিনি পাক প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলির সঙ্গে এক চুক্তি করেন, যাহা নেহরু-লিয়াকত চুক্তি নামে প্রসিদ্ধ। মাইনরিটি কমিশনের ঘােষণা এবং মাইনরিটি অধিকার রক্ষা করার কথা ঘোষণা করা হল। পকিস্তান সরকার যে উদ্বাস্তু আগমন ও হিন্দুদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য দায়ী তা ঘােষণা করা হল না। পাকিস্তানের প্রতি নেহরু তােষণ নীতির ব্যাপারে মত পার্থক্য হওয়ার এবং হিন্দুদের ব্যাপারে সরকারের উদাসীনতায় তিনি মন্ত্রীসভা থেকে ৮ই এপ্রিল পদত্যাগ করেন এবং হিন্দু উদ্বাস্তুদের সেবায় আত্মনিয়ােগ করেন এবং তাদের সাহায্য ও পুনর্বাসনের জন্য সচেষ্ট হন। কেননা তিনি বুঝেছিলেন মন্ত্রীসভায় থেকে তিনি দেশের কোনও মঙ্গল করতে পারবেন না। তার এই পদত্যাগ অন্যান্য মন্ত্রীদের বিশেষ করে সর্দার প্যাটেলের ভাল লাগেনি। নেহরুও শ্যামাপ্রসাদজীকে পদত্যাগ পত্র প্রত্যাহার করতে অনুরােধ করেছিলেন কিন্তু তিনি নাম যশ মােহের প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে জনগণের প্রতি বিশেষ করে হিন্দুদের দুর্দশার কথা চিন্তা করে পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন।

তিনি পূর্ববঙ্গের সংখ্যা লঘুদের সমস্যা সমাধানে সারা ভারতের প্রতি যে আহ্বান জানাইয়াছিলেন তাহাতে কংগ্রেস ও কমুনিষ্ট ব্যাতিত সমস্ত রাজনৈতিক দল তাকে সমর্থন করিয়াছিলেন। কংগ্রেস ইহাকে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি বলে প্রচার শুরু করল। | এরপরে সর্দার প্যাটেলের মৃত্যুর পর নেহরুর বিরুদ্ধে কথা বলার মত কেউ ছিল না। এরপর শ্যামাপ্রসাদজী ১৯৫১ সালের জুন মাসে ‘জনসঘ’ বা পিপলস পার্টি নামে একটি দল গঠন করেন। এই দলের মূলনীতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলের মধ্যে মৈত্রী স্থাপন, উদ্ধাস্তু পুনর্বাসন, গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা, ভারতীয় কৃষ্টি ঐতিহ্যের প্রতিষ্ঠা করা এবং সরকারের পাকিস্থান তােষণের বিরােধিতা করা। তিনি এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। ঐ বছর অক্টোবর মাসে দিল্লীতে জনসঙ্ঘের প্রথম সম্মেলন হল। এই দলের অন্যান্য উল্লেখযােগ্য নেতারা হলেন লালা হংসরাজগুপ্ত, অধ্যাপক বলরাজ মাধাক, লালাবলরাজ ভাল্লা, শ্রী ধরমবীর, পণ্ডিত মৌলিচন্দ্র শর্মা, ভাই মহাবীর, চৌধরী শ্রীচন্দ্র। নতন দল গঠন করে তিনি বলেন এই দল সুসংগঠিত বিরােধী দলের কাজ করবে। বিরােধীতার অর্থ এই নয় যে সবসময় অর্থহীন বা ধ্বংসাত্মক বিরােধীতা করতে হবে। সব সমস্যার প্রতি গঠনমূলক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে এবং সত্যিকারের গণতান্ত্রিক কাঠামাে গড়ে তােলার ব্যাপার ব্রতী হবে। পাকিস্তানের ব্যাপার তার দৃষ্টিভঙ্গী ছিল-যে ভারতবিভাজন একটি মর্মন্তুদ মুখতার কাজ। ইহার দ্বারা কোনও উপকার তাে হয়নি অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাম্প্রদায়িক কোনও সমস্যার সমাধান হয়নি। আমরা পুনরায় অখণ্ড ভারতের লক্ষ্যে বিশ্বাস করি।

অবহেলিত ও বিস্মৃত নায়ক ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়

| ২৩

আমাদের দল দেশ বিভাগের পর সংখ্যালঘু ও উদ্বাস্তুদের সম্পত্তির উপর অধিক গুরুত্ব দিতে চায় যাহা কংগ্রেস সরকার সুপরিকল্পিত ভাবে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। অবশ্য আমাদের দৃষ্টিভঙ্গী সাম্প্রদায়িক নয়। এগুলি প্রধানত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা, যাহা দুই দেশের মধ্যে ন্যায়সঙ্গত ও সােজাসুজি ভাবে সমাধান করতে হবে। নেহরু তার ও দলের বিরুদ্ধে যে সাম্প্রদায়িকতার ধূয়া তােলেন তার অভিযােগ উত্তরে তিনি বলেন—মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার কাছে ভারতীয় রাষ্ট্রীয়তাকে বলি দিয়ে, দেশ বিভাগের পরেও পাকিস্তান সরকারের খামখেয়ালীপনা ও অন্যায়ের সামনে আত্মসমর্পন করার পর সাম্প্রদায়িকতার অভিযােগ তার মুখে মানায় না। তিনিও তার দল নির্বাচনে জয়ী হবার জন্য মুসলীম তােষণ চালিয়ে যাচ্ছেন তাহা ছাড়া আর কোন সাম্প্রদায়িকতার স্থান নেই। আজ আমাদের দেশের মধ্যে প্রাদেশিকতা জাত, পাতের নানা সমস্যা আছে। আসুন আমরা সবাই মিলে এই সমস্যা সমাধানে সচেষ্ট হই। সাম্প্রদায়িকতার ধূয়াতুলে নেহরু আসল সমস্যাগুলি এড়িয়ে যেতে চাইছেন। | শ্যামাপ্রসাদজী ও তাঁর দলের বিরুদ্ধে নেহরু কথায় কথায় সাম্প্রদায়িকতার ধূয়া তলতেন। ডঃ মুখার্জী মনে করতেন দেশে একটি দলই আছে যে সাম্প্রদায়িকতাকে জিইয়ে রেখেছে বা উস্কানি দিয়ে গেছে।

তিনি বলতেন, When I scan the whole course of Indian History, I do no find a single man who has done more harin to this country than Pandit Nehru. তারপর ১৯৫২ সালে যে প্রথম সাধারণ নির্বাচন হয় তাহাতে তিনি ও তার দল অংশগ্রহণ করেন। তিনি দক্ষিণ কলিকাতা থেকে কংগ্রেস ও কম্যুনিষ্ট প্রার্থীদের বিপুল ভােটে পরাজিত করে লােকসভায় নির্বাচিত হন। তিনি অন্যান্য জাতীয় দলের সদস্যদের নিয়ে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট নামে বিরােধী ব্লকের প্রতিষ্ঠা করেন এবং তিনি বিরােধী দলের অঘােষিত নেতা বলে বিবেচিত হন। বিরােধী নেতা হিসাবে তিনি সংসদের ভিতরে ও বাইরে পাকিস্তান সম্পর্কে দৃঢ় নীতি গ্রহণ করার জন্য সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করেন। এছাড়া তিনি ইউনিয়ন সিভিল কোড চালু করা, গাে হত্যা বন্ধ, কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদার বিরােধিতা করেন। এছাড়া তিনি কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা চালু করা এবং সেখ আবদুল্লার তিন জাতির বিরােধিতা করেন। ঐ বছরই ৭ই এপ্রিল রেলওয়ে পুনর্বিন্যাসের বিরুদ্ধ সাধারণ ধর্মঘট আহ্বান জানান। তার নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদের পরিচালনায় ভারতের সর্বত্র পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। ইহার পূর্বে কলিকাতা আর কোনও রাজনৈতিক দলকে সঙঘবদ্ধ ও শান্তিপর্ণ আন্দোলন করতে দেখে নাই। তার নেতৃত্বে। পূর্ববঙ্গ দিবস উদযাপিত হইয়াছিল। অন্যান্য কর্মসূচীর মধ্যে ছিল নভেম্বর মাসে সাঁচিতে বৌদ্ধ স্মারক চিহ্নগুলির সংরক্ষণ উৎসবে যােগদান। দক্ষিণ-পূর্ণ এশিয়ায় ব্রহ্মদেশ, কাম্বােডিয়ার । দেশ ভ্রমণ। কানপুরে ভারতীয় জন সঙ্খের সম্মেলনে সভাপতিত্ব এবং কটকে নিখিলবঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতিত্ব।

২৪

| অবহেলিত ও বিস্মৃত নায়ক ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়

ভারতবর্ষ যখন স্বাধীনতা পেল তখন প্রায় ৫৫০ টি দেশীয় রাজ্য ছিল এবং তাদের রাজা বা নবাব ছিল। তারা ইংরাজের অধীনস্থ স্বাধীন ছিল। এখন ব্রিটীশ চলে গেলে তাদের কী হবে। ব্রিটীশ বললে তারা ইচ্ছা করলে স্বাধীন থাকতে পারে আবার ভারত বা পাকিস্তান যে কোন দেশের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। এই সময় সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল অক্লান্ত প্রচেষ্টা করে দেশীয় রাজাদের ভারতীয় ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত করাল। কিন্তু কাশ্মীরের রাজা হরি সিং ঘােষণা করলেন তিনি স্বাধীনভাবেই থাকবেন কোনও দেশের সঙ্গে যুক্ত হবে না। কাশ্মীরের বিশেষত্ব হচ্ছে অধিকাংশ প্রজা মুসলমান কিন্তু রাজা হিন্দু। সমস্ত দেশীয় রাজ্যগুলি ভারত বা পাকিস্তানে যুক্ত হয়েছে রাজাদের সম্মতিতে জনগণের সম্মতিতে নয়। যখন প্যাটেলজী সমস্ত রাজ্যগুলিকে ভারতের সঙ্গে যুক্ত করাতে সমর্থ হল তখন পাকিস্তান জোর করে কাশ্মীর দখলের চেষ্টা করল। মহারাজ হরিশ ২৬শে অক্টোবর ১৯৪৭ সালে ভারতে যুক্ত থাকার জন্য রাজী হলেন কিন্তু নানা রকম শর্ত ও যুক্তি খাড়া করতে লাগল। এদিকে রাজা হরি সিং ৩১শে জানুয়ারী ১৯৪৮ সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলকে চিঠি লিখে জানালেন ইতিমধ্যে মােঙ্গলা, আলিবেগ, গুরদ্বয়ারা, মিরপুর টাউন, ভীমপুর টাউন, রাজরী টাউন এবং ছাম্ব, নওশেরা, ঝানগড় এবং কোটলীর সন্নিহিত অঞ্চল পাকিস্তান দখল করে নিচ্ছে। ভারতীয় সেনা যেন অবিলম্বে ঐ শাসনকারী তথা পাকিস্তানীদের কাশ্মীর থেকে হটিয়ে দেয়। তখন ভারত সরকার সেনা পাঠিয়ে ঐ সমস্ত অঞ্চল দখলমুক্ত করার চেষ্টা করলেন এবং বহুলাংশে সফল হলেন। যখন হঠাৎ ভারত সরকার যুদ্ধ থামিয়ে দিলেন কাশ্মীরের অনেকাংশ দখল না করে। সেই অংশগুলি আজও পাকিস্তানে অবস্থিত যাহা আজাদ কাশ্মীর নামে পরিচিত। কাশ্মীরের মধ্যে তিনটি অংশ আছে তার মধ্যে কাশ্মীর সেখ আবদুল্লার ন্যাশনাল কনফারেন্সের ভাল প্রাধান্য আছে কিন্তু জম্মু ও লাক অঞ্চলে সেরকম প্রাধান্য নেই বরং কংগ্রেসের ভাল প্রাধান্য আছে এবং জন্ম অঞ্চলে হিন্দুদের সংখ্যাধিক্য।

কাশ্মীর প্রদেশ স্বাধীন ভারতের সঙ্গে যুক্ত হলেও কয়েকটি বিশেষ আইন ওই রাজ্যে প্রযােজ্য ছিল এবং আগেই বলেছি রাজ্যের বেশ খানিকটা অঞ্চল পাকিস্তান দখল করে রেখেছে। কিন্তু অন্য দেশীয় রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে এই নিয়ম প্রযােজ্য ছিল না। ওই রাজ্যে কোন ভারতীয় জমি কিনতে পারবে না। ওই রাজ্যে যেতে গেলে পারমিট লাগবে। ওই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে প্রধানমন্ত্রী বলা হত। ৩৭০ ধার আইন আছে ইত্যাদি..এদিকে ১৯৩৯ সালে সেখ আবদুল্লার নেতৃত্বে ন্যাশনাল কনফারেন্স পার্টি গঠিত হয়। উনি ১৯৪৬ সালে কাশ্মীর ছাড় আন্দোলন শুরু করেছিলেন রাজ্য হরি সিং-এর বিরুদ্ধে ভারতের বিরুদ্ধে নয়। ফলে সেখ আবদুল্লাকে রাজা হরি সিং জেলে পাঠান তারপর ১৯৪৭ নেহরু পরামর্শে কে জেল থেকে ছেড়ে দেন। সেখ আবদুল্লা ২৬শে সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ তে লেখেন-অতীতে যাই ঘটুক না কেন আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি আপনার প্রতি আমার আনুগত্য শ্রদ্ধা

অবহেলিত ও বিস্মৃত নায়ক ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়

২৫

যথাযথই আছে এবং আমি, বিশ্বাস করি আপনার নেতৃত্বেই কাশ্মীর শান্তি ও উন্নতি সম্ভব। পরে নেহরুজী শেখ আবদুল্লার সঙ্গে ‘মাখামাখি করে রাজার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন। যদিও ভারতভুক্তির ব্যাপারে রাজার কথাই শেষ কথা জনগণের মতামতের কোন মূল্য ছিল না ইন্ডিয়ান ইনডিপেনডেন্স অ্যাক্ট ১৯৪৭ এবং গভর্ণমেন্ট অব ইন্ডিয়া অ্যাক্ট ১৯৩৫ অনুসারে, তবুও ওই রাজ্যের মুসলিম জনগণ কাশ্মীরের ভারত ভুক্তির। ব্যাপারে কোনও প্রকার আপত্তি ছিল না। আগেই বলেছি জম্মুতে ও লাদাখে অমুসলমানদের আধিক্য ছিল এবং তারা সেখ আবদুল্লার পক্ষে ছিল না এমনকী রডােরী, পুঞ্চ ও অন্যান্য মুসলিম সংখ্যাধিক্য অঞ্চলের মুসলিম জনগণ সেখের প্রতি আনুগত্য ছিল না। এখন ১৯৫৩ সালে কাশ্মীরের জন্য কিছু বিশেষ আইনের পরও জম্মুর প্রজা পরিষদ আন্দোলনের ফলে সরকারের সঙ্গে সংঘর্ষ শুরু হয়। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কাশ্মীর সরকারের নানা নির্যাতন ইত্যাদির সংবাদ দিল্লীতে আসে। এই নিয়ে শ্যামাপ্রসাদজীর সঙ্গে সেখ আবদুল্লা ও নেহরুর চিঠির আদান প্রদান হয় এবং তাতে উভয়পক্ষের মধ্যে মতান্তর হয়। দিল্লীর চাদনী চকে শােভাযাত্রার উপর নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার জন্য তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। এবং হেবিয়াস কর্পাস আবেদনে মুক্তি লাভ করেন। তারপর শ্যামাপ্রসাদজী ৮-৫-১৯৫৩ সালে সেখ আবদুল্লাকে টেলিগ্রাম করে জানালেন তিনি কাশ্মীর নিয়ে পরিস্থিতি দেখার এবং সম্ভব হলে শান্তি স্থাপনের উদ্দেশ্যে কাশ্মীর রওনা হয়ে আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান।

পণ্ডিতজীকেও তিনি ইহার কপি পাঠান তারপর ৯ই মে যাত্রা শুরু করার পর শেখ আবদুল্লার উত্তর পান এবং তিনি কাশ্মীরে আসতে নিষেধ করেন নি শুধু বলেছিলেন। আপনার আসাটা সময়ােপযােগী বা কার্যকরী হবে না এবং নেহরুজী এ ব্যাপারে কোনও মতামত জানান নি। তা সত্ত্বেও তিনি রওনা হলেন। তিনি আশা করেছিলেন যে ভারত সরকার হয়ত পারমিট প্রথা না দেওয়ার কাশ্মীরে ঢুকতে দেবে না। এই জন্য সবাই । ভেবেছিলেন যে পারমিট প্রথা না মানায় শ্যামাপ্রসাদজীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু ব্যাপারটা অন্য। ভারত সরকারের আইন অমান্য করলে ভারত সরকারের আইন অনুযায়ী বিচার হবে। কিন্তু তিনি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন কাশ্মীর সরকারের হাতে, তঁাকে কাশ্মীর সরকারের Public Security Act অনুযায়ী গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, সেখানে পারমিট প্রথা অমান্য করার কোন প্রকার উল্লেখই ছিল না এবং তাঁকে কাশ্মীর প্রবেশে অযাচিত সাহায্য করা হয়েছিল। তার সহযাত্রী গুরুদত্ত বৈদ্যর বিবরণ অনুযায়ী জানা যায় ১১ মে তিনি পাঠানকোটে পৌঁছান। তারপর কাশ্মীর রওনা হলে গুরুদাসপুরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জানান নির্দেশ আছে ‘পারমিট না থাকলেও তাকে কাশ্মীরে যেতে দেওয়া হবে। এজন্য তিনি যানবাহনের ব্যবস্থা করে কয়েকজন সঙ্গীকে নিয়ে মাধেপর চেকপােষ্ট পর্যন্ত গেলেন। তারপরে সকলে তাকে বিদায় সম্ভাষণ জানান। এখানে উল্লেখ্য প্রত্যেক জায়গাতেই শ্যামাপ্রসাদজীকে হাজার হাজার মানুষ অভ্যর্থনা জানাতে লাগলেন এবং তিনি তাদের

অবহেলিত ও বিস্মৃত নায়ক ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখােপাধ্যায় অভ্যর্থনা নিয়েই রাভি নদীর তীরে জম্মু কাশ্মীরের সীমানা মাধেপুর চেক পােষ্টে পৌঁছান। তারপর রাভি নদীর সেতু পেরিয়ে ওই রাজ্যে প্রবেশ করলেন। নদী পেরােনার আগেই কাশ্মীরের চীফ সেক্রেটারী ও পুলিশের আই. জি তাকে আগে থেকে সই করিয়ে আনা দুটি অর্ডার দেখিয়ে গ্রেপ্তার করেন। প্রথম অর্ডারটির তারিখ ছিল ১০ই মে তাতে বলা হয়েছিল তিনি যেন কাশ্মীর প্রবেশ না করেন। ২য় অর্ডারটি ১১ মের তারিখের হলেও আগে থেকেই সই করিয়ে রাখা ছিল যাতে করে সঙ্গে সঙ্গেই গ্রেপ্তার করা যায়। কেননা যে সময়ে ওই চিঠি বা অর্ডারগুলি সই করানাে হয় তখন অর্ডারের বিষয়বস্তুর অস্তিত্বই ছিল না এবং স্বাক্ষরকারী অফিসারগণ ঐ সময় উপস্থিত ছিল না। সেই অর্ডারে লেখা ছিল জম্মু-কাশ্মীরের শান্তি ও নিরাপত্তার কারণে লিপ্ত এবং তাহা প্রতিরােধেই শ্যামাপ্রসাদজীকে গ্রেপ্তার করা হল। এবং ওই অর্ডারে আরও লেখা ছিল তাঁকে যেন শ্রীনগরের সেন্ট্রাল কারাগারে দু-মাস বন্দী করে রাখা হয়। এইভাবেই নেহরু তথা ভারত সরকারের চক্রান্তে কাশ্মীর সরকারের হাতে শ্যামাপ্রসাদজী বন্দী হলেন। শ্যামাপ্রসাদকে বন্দী করার পর সেখ আবদুল্লা বেতার ভাষণ দেন এবং বলেন পারমিট আইন অমান্য করে কাশ্মীর প্রবেশের জন্য তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।

শ্যামাপ্রসাদের গ্রেপ্তারের পর কাশ্মীর সরকার অর্ডিনান্স জারী করে পারমিট’ আইন করেন। সুতরাং কাশ্মীরের প্রবেশের সময় কাশ্মীর সরকারের কোন পারমিটের প্রয়ােজন ছিল না। সুতরাং এই ব্যাপারে সেখ আবদুল্লা অসত্য কথা বলেছিলেন। কিন্তু ভারত সরকারের পারমিট অনুযায়ী তাকে গ্রেপ্তার করা হল না কেন বরং তাকে কাশ্মীরে প্রবেশের জন্য অযাচিত সাহায্য করা হল কেন? কারণটা আর কিছুই নয় কাশ্মীর রাজ্য সুপ্রিম কোর্টের আওতার বাইরে। ভারতের সরকারের আইনে গ্রেপ্তার করলে তাকে দিল্লীতে ফেরৎ পাঠাতে হয় বিচারের জন্য। কেননা কয়েকদিন আগে শ্যামাপ্রসাদকে দিল্লী গ্রেপ্তার করা হয় কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের আদেশে তিনি মুক্তিলাভ করেন। তাছাড়া নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গের অভিযােগে তাঁর বিরুদ্ধে একটা মামলা চলছিল। সুতরাং সেই বিচারের সময় তার উপস্থিতির জন্য দিল্লীতে থাকা দরকার ছিল। সুতরাং তিনি অবঞ্ছিত মনে করলে কাশ্মীর সরকারের তাকে বার করে দেওয়ার একটা সুবর্ণ সুযােগ দিল। কিন্তু তা না করে তাকে দু মাস বন্দী করে রাখার অর্ডার দেওয়া হল কেন? তাছাড়া দিল্লীর বিচারক কাশ্মীরের চীফ সেক্রেটারীকে জানান ফৌজদারী মামলার জবাববন্দী গ্রহণ করার জন্য শ্যামাপ্রসাদের উপস্থিতির প্রয়ােজন। সুতরাং তঁাকে যেন অতি শীঘ্র ছেড়ে দেওয়া হয়। কাশ্মীর সরকার এ ব্যাপারে গড়িমসি করতে লাগলেন এবং শেষে ম্যাজিস্ট্রেটকে জানালেন যে তাঁকে ১৩ই জুলাই-এর আগে অর্থাৎ দু মাস বন্দী করে রাখা হয়েছে। আসলে নেহরু দু মাস ইংল্যান্ডের রানীর রাজ্য অভিষেকে ইংল্যান্ডে যাবেন এবং দু’মাস বাদে ফিরবেন। নেহরু ফিরলেই তাকে ফেরত পাঠানাে হবে। শেখ আবদুল্লা শ্যামাপ্রসাদের মৃত্যুর পরবর্তী বিবৃতিতে একথা স্বীকার করে বলেছিলেন নেহরু ফিরলেই তাকে ভারতে ফেরৎ পাঠানাে হত।

শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির মৃত্যু রহস্য,অবহেলিত ও বিস্মৃত নায়ক ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়- (শেষ পর্ব)

অবহেলিত ও বিস্মৃত নায়ক ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়  (পর্ব ১ম)

অবহেলিত ও বিস্মৃত নায়ক ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়-দ্বিতীয় পর্ব।

শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির অবদান, অবহেলিত ও বিস্মৃত নায়ক ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়-(তৃতীয় পর্ব)

 

শ্যামাপ্রসাদ মুখােপাধ্যায়। দুজনেই ভদ্র বংশজাত, দেশহিতৈষী, রাজনীতিবিদ, . নিঃস্বার্থভাবে দেশের সেবা করে গেছেন, কিছু পাওয়ার প্রত্যাশা না করে। একজনকে ষড়যন্ত্র করে সূদুর কাশ্মীরে হত্যা করা হয়েছিল আর একজনকে তাে নিরুদ্দেশই করে দেওয়া হয়েছিল, তিনি জীবিত না মৃত, মৃত হলেও কবে সেটা সংঘটিত হয়েছিল কেউ জানে না। এত প্রচার সত্ত্বেও নেতাজী প্রত্যেকটি ভারতবাসীর হৃদয়ে স্থান করে নিতে পেরেছেন কিন্তু শ্যামাপ্রসাদজী, তাকে লােকে ভুলতে বসেছে। আজকের জনগণ অনেকে তাঁর নামই জানে না, কি তাঁর অবদান তাইই জানে না, সেই দুঃখে ও বেদনায় মন ভারাক্রান্ত হয়ে এই ক্ষুদ্র লেখার উদ্দেশ্য। জনগণের কাছে শ্যামাপ্রসাদজীর পরিচিতি, জনগণের হৃদয়ে তার স্থান করে দেওয়ার মুখ্য উদ্দেশ্য নিয়ে সহজবােধ্য এই লেখা। যদি জনসাধারণ তার অবদানের কথা মনে রাখে বা তঁাকে হৃদয়ে স্থান দেয় তবে আমার এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা সার্থক হবে। এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টায় যদি কেউ আঘাত বা ক্ষুব্ধ হয়ে থাকেন তামার ভাবাবেগের কথা স্মরণ করে তাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।

কমল মুখার্জী

তারিখ -২১/১০/০১৪ কুঁচুড়া