ভিকারুন্নিসার ছাত্রী, মৃত্যুর দায় কার? বাজি ধরে শিক্ষিত হবার থেকে অশিক্ষিত থাকা অনেক ভালো।

বর্তমান সময়ে শিক্ষা দান কোন পর্যায়ে পৌছিয়েছে তা আর এক বার প্রমাণ করল ভিকারুন্নিসার। শিক্ষাক এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাজ কী? এই প্রশ্নটা আজ বার বার ঘুরে ফিরে আসছে আমার মনে। বেশির ভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলো আজ ভালো রেজাল্টের সাইনবোর্ড লাগিয়ে কোমল মতি ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে জেলখানার আসামিদের মতো আচারণ করতে শুরু করেছে। এরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে আজ এমন একটা স্থানে নিয়ে নামিয়েছে যে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাত্র-ছাত্রী এবং তাদের অভিভাবকদের জন্য একটি হুমকি দানকারী প্রতিষ্ঠানের রূপ নিয়েছে। আজ মনে হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মানে, ছাত্র-ছাত্রী এবং তাদের অভিভাবকদের একহাত দেখে নিয়ার মতো ব্যাপার। দিনের আলোতে সন্ত্রাসীদের মতো ক্ষমতার প্রদর্শন করা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অভিভাবকদের মাথাই ভালোভাবে ঢকিয়ে দিয়া যে, আপনার সন্তানের ভবিষ্যৎ আমাদের হাতে।

আমি গ্রামের ছেলে তাই পড়া শুনো করেছি গ্রামে। সেখানে শিক্ষকরা ছাত্র-ছাত্রীদের বিভিন্ন সময় শাসন করে অর্থাৎ মারে কিন্তু সেই শাসনের মধ্যে একটা স্নেহপূর্ণ ভালোবাসা থাকে। শিক্ষকরা ছাত্র-ছাত্রীদের শাসন করে আবার আদর করে কাছে ডাকে এবং নিজের সন্তানের মত স্নেহ দিয়ে ভালোবাসেন। কংক্রিটের এই শহরে আসার পর আমার কাছে মনে হয়েছে, শহরের শিক্ষকদের কাছে সেই স্নেহ ভালোবাসার কোন লেশমাত্র নাই, যেটা আছে সেটা কমার্শিয়ালতা। এই কমার্শিয়ালতা আমাদের এই প্রজন্মের বাবা-মাদের জন্য খুবী কষ্টদায়ক বিষয়। শিক্ষক ছাত্র-ছাত্রীদের শাসন করবে, বকা ঝকা করবে, একটা শিক্ষাঙ্গনে প্রাণ। কিন্তু শাসন করার পরে যদি ঐ শিক্ষক তার স্টুডেন্টকে সন্তানের মতো আবার আদর করে না ডাকে, তবে ঐ প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার কোন প্রাণ থাকে না। যেটা থাকে, সেটা আর যা হক শিক্ষ ছাত্রর সম্পর্ক না। শিক্ষক যদি শাসন করার পর কোন স্টুডেন্টকে আবার আদর করে কাছে ডাকে তবে অন্যান্য স্টুডেন্টকে সেটা বেশ আন্দোলিত করে। কিন্তু বেশির ভাগই শহরের শিক্ষকদের এটা মাথায় থাকে না বলে আমার মনে হয়।

এখনো গ্রামের শিক্ষদের স্টুডেন্টরা তাদের পিতার মতো শ্রদ্ধা করে। স্টুডেন্টরা যদি বাইরে থেকে গ্রামে যায়, তবে তাদের সেই শিক্ষকের খোঁজ খবর নেয়ার পাশাপাশি সম্মান জানাতে ভোলে না। কিন্তু আমরা শহরে সেই দৃশ্য কয়টি দেখতে পাই? এক বার হিসাব করে কেউ বলবেন কি? আমার মনে হয় সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। খোঁজ খবরের কথা না হয় বাদ দিলাম, সম্মানের কথায় যদি আসি, সেটা কতখানি আছে? এর একটাই কারণ শহরের শিক্ষকেরা ছাত্র-ছাত্রীদের তাদের বাবা স্থানে বসতে ব্যর্থ হচ্ছেন। যদি শিক্ষকেরা স্টুডেন্টদের বন্ধু বা বাবা হতে পারত, তবে আজ অরিত্রি মতো মেয়ে আত্মহত্যা নিয়ে আমাদের সোসাল মিডিয়া এতো লাফালাফি করতে হত না। আজ শহরের শিক্ষকদের এই নিম্নগামী মানসিকতা দেখে খুব কষ্ট হয়। কিন্তু সত্য কথা বলতে কি, এর থেকে মুক্তির আসু কোন আলো আমি দেখেছি না।

ভিকারুন্নেসা দেশের প্রথম সারি স্কুল এটা বলার অপেক্ষা রাখেনা। ভিকারুন্নেসা স্কুলের অরিত্রি অধিকারী নবম শ্রেণির ছাত্রী ছিল, তার বার্ষিক পরীক্ষা চলছিল। 2-1-18 তারিখে সে তার পরীক্ষা চলার সময় মোবাইল নিয়ে পরীক্ষা দিতে গিয়েছিল। যার করনে শিক্ষক তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে, তার মোবাইলে নকল আছে। তার দরুণ পরে দিন অরিত্রি অধিকারীর মা-বাবাকে প্রতিষ্ঠান তলব করে। পরের দিন সোমবার অরিত্রির বাবা দিলীপ অধিকারী এবং তার মা বিউটি অধিকারী অরিত্রিরকে নিয়ে স্কুলে যান। প্রথম ভাইস প্রিন্সিপালের কাছে গিয়ে মেয়ের বিষয়টি জন্য তারা ক্ষমা চান। তখন ভাইস প্রিন্সিপাল তাদের বলে যে, এই বিষয়ে তার কিছু বলার বা করার নাই, আপনারা প্রিন্সিপালের কাছে যান। প্রিন্সিপাল এর রুমে গিয়ে অরিত্রির বাবা, মা আবারো বিষয়টি জন্য ক্ষমা চান। প্রিন্সিপাল মহোদয় এতে সদয় না হলে অরিত্রি প্রিন্সিপালের পা ধরে ক্ষমা চাই। এর পরেও প্রিন্সিপাল তাঁর নীতিতে অনড় থাকে এবং পরে দিন এসে টিসি নিয়ে যাবার কথা বলে দিলীপ বাবুকে। দিলীপ বাবু তখন নিজেকে সামলাতে না পেরে মেয়ের সামনে কেঁদে ফেলেন, হয় তো অরিত্রি কাছে বাবা এই চোখের জল তার নিজের জীবনের থেকে বেশি মনে হয়েছিল। তাই হয়তো সেই পাগলিটা বাবার চোখের জলের মূল্য চুকাতেই নিজেকে শেষ করে দিয়েছে।

কি পাঠক, এতো সময় আপনার মনে হচ্ছিল যে আপনি কোন উপন্যাস পড়েছেন? এটা কোন উপন্যাস বা নাটক না, এটাই বর্তমান সময়ে কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের বুকে চাপা যন্ত্রনা। হ্যাঁ, অত্রি যে অপরাধ করেছে তার স্কুলে নিয়ম অনুযায়ী সে অপরাধী, তার জন্য তার বাবা-মা ডেকে এনে বিষয়টা জানান প্রতিষ্ঠানের কর্তব্য। কিন্তু তাই বলে সোজাসাপ্টা বলে দিলাম কাল এস টিসি নিয়ে যাবে! যেহেতু পরীক্ষা ছিল ফাইনাল তার জন্য শাস্তির মাত্র একটু বেশি হবে সেটা ঠিক, তাই বলে টিসি দিয়ে দিতে হবে? কিছু বলব নাই, শুধু বলব’ কোন উদ্দেশ্য আছে কি এই টিসি দিবার মধ্যে? সেটা আমাদের সকলে জিজ্ঞাসা। আমি বলছি না, এটা অত্রিরি অপরাধ না বা ভূল না, এমন কি তার মা-বাবাও, অবশ্যই ভুল বা অপরাধ করেছে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, “যখন কোন অপরাধের শাস্তি ঐ অপরাধ থেকে বড় হয়ে যায়, তখন ঐ বিচারক হয় অপরাধ” এ্টা মোবাইলে স্কুলে নেবার জন্য না, এটা আসলে ক্ষমতা প্রদর্শন ছাড়া আর কিছু নয়। হয়তো সে না মারা গেলে আমরা তার প্রতি এমন সহানুভূতি জানাতাম না। বরং  উল্টা আরো বোকা দিতাম। এমন কি বিষয়টা জানার সুযোগ নাও হতে পারতো। একটা চাপা ব্যাথা নিয়ে মেয়েটা আমাদের এই সমাজে অন্য কোথাও আবার হয়তো ভর্তি হত। কিন্তু মেয়েটা মরে আজ এ সমাজকে যে প্রশ্ন ছুড়ে দিল, তার উত্তর আমার কাছে নাই।

এবার দেখি মোবাইল নেওয়া তার অপরাধ ছিল কি না? এই ঘটনার, এই একটা জাগায় সকল মানুষ বলবে এটা তার অপরাধ ছিল। বর্তমান সময় একটা মেয়ে বা ছেলে মোবাইল ছাড়া কোথায় যাবে ভাবা যায় না। আমরা শহর জীবনে আজ এতোটাই ব্যস্ত যে, আগের দিনের মত ছেলে-মেয়েদের স্কুলে নিয়ে গিয়ে বসে থাকবো তাও আবার নবম শ্রেণীর স্টুডেন্ট জন্য, সে সময় কই? তাই বাবা-মায়ের একমাত্র ভরসা থাকে মোবাইলে উপরে। মেয়েটি স্কুলে গেলে তার দেখভাল না হয় প্রতিষ্ঠান রাখে, কিন্তু সে যখন রাস্তায় বের হয়, তখন সে যে কোন ধরনের সমস্যা সম্মুখীন হতে পারে, আর তখন সে মোবাইল ব্যবহার করে পুলিশের অথবা পরিবারের সাহায্য দিতে পারবে। এতো ব্যস্ত জীবন তার উপর ঢাকা শহরের যানজট, বাবা মারা ছেলে-মেয়েদের বাসায় ফিরতে বা কোথায় যেতে দেরি হলে একটা ফোন দিয়ে খোঁজ নিতে পারে। এবার যদি তাদের কাছে ফোন না থাকে তবে পরিবারের লোকেরা কি ভাবে খোজ নিবে? আরে ভাই, এটা ২০১৮ সাল, আপনারা যে চিন্তা নিয়ে বসে আছেন তা আজ থেকে ৩০ বছর আগের। ফোন এখন আর শখের জিনিস না, এটা আমাদের জীবনের সাথে জটিল ভাবে জড়িয়ে গেছে। তাই মোবাইল সাথে রাখা বন্ধ না করে, তার বিকল্প ভাবুন। বিকল্প অনেক পথ আছে। ঢাকার শহরে যোগাযোগের জন্য মোবাইল কতটা প্রযোজনীয় তা বোধাই বলার দরকার নাই। এবার বোধাই পাঠক মোবাইল রাখাটা বিরাট অপরাধ মনে হবে না। প্রযোজনে পরীক্ষার সময় ফোন বন্ধ করে একটা নিদিষ্ট স্থানে রেখে দিয়া যেতে পারে, আবার পরীক্ষক কাছে জমা দিতে পারে।

 

 

ভিকারুন্নেসা সাম্প্রতিক বছর গুলোতে নিয়মিত আলোচনার শিরোনাম হয়ে চলেছে। কিছু বছর আগে এই ভিকারুন্নেসাতে এক মানবরুপী জানোয়ারের কথা শোনা গিয়েছিল,

অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস

মনে আছে? হ্যা, পাঠক আমি পরিমালের কথা বলছি, পরিমল ধর। সেই নরপশুকে রক্ষা করেছিল ভিকারুন্নেসার প্রিন্সিপাল সে কথা সবার কম বেশি জানা। সে বিষয়ে আজ আলোচনা করব না, আমরা জানব ভিকারুন্নেসা নামটা কিভাবে এলো । যারা ইতিহাস একটু আকটু পড়াশোন করেছেন তারা হয় তো জানবেন, ফিরোজ খান নূনের স্ত্রী ভিকারুন্নেসা নূন, ফিরোজ খান ছিলো  পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। দু:খের বিষয় সেই দম্পতি বাঙালী মুসলমাদের সম্পর্কে বলেছিলেন, বাঙালি মুসলমান হল হ্যাপ মুসলিম, হ্যাপ হিন্দু। তার সেই কথার জবাব দিয়েছিল মাওলানা ভাসানী, ঠিক এ ভাবে “লুঙ্গী উঁচাইয়া দেখাইতে হইবে যে আমরা মুসলমান কি না?” মাওলানা ভাসানী হয় তো সেদিন খান দম্পতি কথাতে নিজেকে বাঙালী থেকেও মুসলমা প্রমাণ করতে বেশি ব্যস্তা ছিলেন। সেটা ঐ সময়ে ব্যপার বা মাওলানা ভাসানী ব্যপার ছিল। কিন্তু সেই ফিরোজ খানের স্ত্রী ভিকারুন্নেসা নামে স্বাধীনতার এতো বছর পরে যদি বাংলাদেশে কোন প্রতিষ্ঠানে নাম থাকে তবে সেখানে ভিকারুন্নেসা মতো আদশের মানুষ থাকবে না, সেটা কি করে হয়? সেই বাঙালী বিদ্বেষীর নামে যদি কোন প্রতিষ্ঠান আজও বাংলাদেশে টিকে থাকে এবং সেটা যদি দেশের এক নাম্বার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হয়, তবে তার থেকে এমনটা হওয়া দোষের কিছু না ।

এই মৃত্যুর দায় কোন ভাবেই অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস এড়াতে পারেন কি? মোবাইলে নকল ছিল কিনা তা প্রমাণের বিষয়, পা ধরে ক্ষমা চাওয়ার পরে টিসি দেয়, মা-বাবাকে অপমান করা এই গুলো কি সত্যিকারের কোন শিক্ষকের কাছ থেকে আশা করা যায়? একজন সাধারণ মানুষ হিসাবে বলব, অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌসকে অত্রিরি আত্মহত্যার প্ররোচনার ‍দিয়ার দায়ে তাকে অবিলম্বে আইনের আওতায় আনা হোক। অভিভাবকদের বলতে চাই আগে সন্তান জীব তার পর সার্টিফিকেট। মনে রাখবেন “বাজি ধরে শিক্ষিত হবার থেকে অশিক্ষিত থাকা অনেক ভালো” সন্তানকে মানুষ করার জন্য কোন ফালতু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠাবে না। সন্তানকে মানুষ করার জন্য অনেক দৌড় দিয়েছেন, আর নয়, এবার একটু দাড়ান ভিকারুন্নেসা, হলিক্রস, আদমজী বাইরেও কিন্তু দেশে সুশিক্ষিত মানুষ তৈরি হচ্ছে। আপনাদের এই মানুসিকতাই ঐ প্রতিষ্ঠান গুলো প্রধান অস্ত্র, আপনার স্ট্যাটাস ধরে রাখতে গিয়ে সন্তানেকে মৃত্যু মুখে ঠেলে দিবেন না। ভূলে যাবে না আপরনা সামাজিক স্টেটাস থেকেও আপনার সন্তানের জীবনের মূল্য অনেক বেশি।

[kkstarratings]

আমাদের লেখা নিয়মিত পেতে ডান থেকে ফেজবুকে  পেজে লাইক দিয়ে রাখুন, পূর্ববতী পোস্ট করা মাত্রই যাতে আপনি পেয়ে যান। ধন্যবাদ-