ফিজিতে হিন্দু ধর্ম

ফিজিতে হিন্দু ধর্ম কিভাবে অন্যতম প্রধান ধর্ম হয়ে ওঠল!-সোজাসাপ্টা

ফিজিতে হিন্দু ধর্ম কিভাবে অন্যতম প্রধান ধর্ম হয়ে ওঠল! ফিজি যা আনুষ্ঠানিকভাবে ফিজি দ্বীপপুঞ্জ প্রজাতন্ত্র ফিজির দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের একটি দ্বীপ দেশ এটি নিউজিল্যান্ড থেকে প্রায় 2000 কিলোমিটার দূরে এবং বিশ্বের ১৫ তম বৃহত্তম দ্বীপ । এখানে প্রচুর ভারতীয় হিন্দি ভাষী মানুষ বাস করে। এর প্রতিবেশী দেশগুলির পশ্চিমে ভানুয়াতু , পূর্বে টঙ্গা এবং উত্তরে টুভালু অন্তর্ভুক্ত রয়েছেহু। ফিজি ১৭ ও ১৮ শতকের সময় ডাচ এবং ইংরেজি এক্সপ্লোরার দ্বারা আবিষ্কার করা হয়েছিল। 1970 এর মধ্যে, ফিজি ইংরেজি উপনিবেশ ছিল। ফিজি প্রচুর বন, খনিজ এবং জলজ উত্সের কারণে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের সর্বাধিক উন্নত দেশ। বর্তমানে, পর্যটন এবং চিনি রপ্তানি তার বৈদেশিক মুদ্রার বৃহত্তম উত্স এখানকার মুদ্রা ফিজি ডলার।

 

ফিজির বেশিরভাগ দ্বীপপুঞ্জ দেড় মিলিয়ন বছর আগে আগ্নেয়গিরির ক্রিয়াকলাপ দ্বারা গঠিত হয়েছিল। এই দেশেটি মোট 322 টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত, 106 টিকে মানুষ স্থায়ীভাবে বসবাস করে। এগুলি ছাড়াও প্রায় 500 টি ছোট ছোট দ্বীপ রয়েছে যা একত্রে 18,300 বর্গ কিমি আয়তনের আয়তন হবে। দ্বীপপুঞ্জের দুটি প্রধান দ্বীপ হলেন ভিটি লেবু এবং ভানুয়া লেভু , যা প্রায় ৮,৫০,০০০ হাজার মানুষ বাস করে যা দেশটির মোট জনসংখ্যার 87% ।

ফিজির হিন্দু ধর্মানুসারী মানুষ

সংস্কৃতি 

ফিজির সমৃদ্ধ সংস্কৃতি আদিবাসী, ভারতীয়, চীনা এবং ইউরোপীয় ঐতিহ্যের মিশ্রণ। সংস্কৃতি সামাজিক দিক, ঐতিহ্যে, ভাষা, খাদ্য, পোশাক, বিশ্বাস ব্যবস্থা, আর্কিটেকচার, শিল্প, কারুশিল্প, সংগীত, নৃত্য এবং ক্রীড়া ইত্যাদি সহ অনেক দিক দিয়ে সমৃদ্ধ ।বেশিরভাগ জনগোষ্ঠী আদিবাসী সংস্কৃতি দ্বারা অনুপ্রাণিত এবং তারা তাদের প্রতিদিনের জীবনে এটি বজায় রাখে। দেশীয় সংস্কৃতি ভারতীয় এবং চীনা সংস্কৃতির পাশাপাশি ইউরোপীয় সংস্কৃতিতে যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছে। সভ্যতার এই মিশ্রণ ফিজির সংস্কৃতিতে একটি অনন্য এবং জাতীয় পরিচয় এনেছে।

 

২০১৪ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী ১৮২৭৪ বর্গ কিলোমিটারের এই ক্ষুদ্র দেশের জনসংখ্যা প্রায় নয় লাখ তিন হাজার দুইশত সাতজন। এর মধ্যে ৫৬.৮ শতাংশ ফিজিয়ান বংশোদ্ভূত এবং ৪০ শতাংশ ভারতীয় বংশোদ্ভূত বাকি অন্যান। এই দেশের জনসংখ্যার ৬৪.৪ শতাংশ খ্রীষ্টান এবং ৩৭.৫ শতাংশ সনাতন হিন্দু ধর্মানুসারী। এছাড়া অল্প সংখ্যক ইসলাম ধর্মানুসারীও ফিজিতে বসবাস করেন।

১৮ শতকে ইংরেজদের মাধ্যমেই ফিজিতে ভারতীয় হিন্দুদের প্রবেশ ঘটে। সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজরা যখন ফিজিতে তাদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে, তখন লক্ষ করে যে এখানকার আদিবাসীরা চাষাবাদে একেবারে অজ্ঞ-অনভিজ্ঞ। ইংরেজ গভর্নর তখন চিন্তা করল- ভারতীয় অভিজ্ঞ চাষীদের এখানে নিয়ে এলে ভালো হবে। ভারতও তখন তাদের সাম্রাজ্যবাদী উপনিবেশ। যেই ভাবনা সেই কাজ। মাদ্রাজ, কেরালা, বাঙ্গাল ও উত্তরপ্রদেশের অসংখ্য দরিদ্র কৃষকদের, অল্প পরিশ্রমে বেশি উপার্জনের প্রলোভন দেখিয়ে নিয়ে আসা হয় হাজার হাজার মাইল দূরে অবস্থিত ফিজিতে। অতঃপর তাদের মাথায় পরানো হয় দাসত্বের শিকল। অবশ্য পরবর্তী সময়ে তাদের এ দাসত্বের রাত কেটে সম্ভাবনার সূর্য উঁকি দিয়েছে। যা দেখে ভারতীয় অঞ্চল থেকে আরো বহু মানুষ সেখানে ছুটে গেছে- জীবিকার তাগিদে। এভাবেই ভারতীয় বংশোদ্ভূতরা হয়ে উঠেছে ফিজির ২য় বৃহত্তম জাতি গোষ্ঠী।

 

 

ফিজির দেশের সৌন্দর্য এবং প্রাকৃতিক 

হিন্দিতে ফিজি সম্পর্কিত আকর্ষণীয় তথ্য এবং আশ্চর্যজনক তথ্য

১. ফিজির মোট আয়তন ১৮ হাজার ২4৪ বর্গকিলোমিটার এবং জনসংখ্যা প্রায় ৯ লক্ষ।

২. ফিজির মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশই ভারতীয় বংশোদ্ভূত , বাকী জনসংখ্যা স্থানীয়,  চীন ও ইউরোপের লোকনিয়ে গঠিত।

৩. ফিজিতে বসবাসকারী ভারতীয় বংশোদ্ভূত লোকদের মধ্যে প্রায় ৮৪ শতাংশ হিন্দু, ১৪ শতাংশ মুসলমান এবং বাকী শিখ ও খ্রিস্টান।

৪. ফিজির রাজধানী সুভা এবং বৃহত্তম শহর নাসিনু।

৫. ফিজির জাতীয় ভাষা হ’ল ইংরেজি, হিন্দি এবং ফিজিয়ান। আপনি যতি এই জায়গায় যান, আপনির ভারতে থাকার অনুভূতি হবে।

৬. ফিজির মুদ্রা, ফিজি ডলার, যার ১ ডলার মূল্য প্রায় তেইশ ভারতীয় রুপি.

Fijian Hindus: Ethnicity and Culture - The Analyst

৭. কাভা নামে একটি পানীয় ফিজিতে খুব জনপ্রিয়, এই পানীয়টি ফিজির জাতীয় পানীয় এবং প্রতিটি কার্যক্রমে ব্যবহার হয়।

৮. ফিজির লোকেরা রাগবি খেলা খুব পছন্দ করে এবং রাগবি এখানে জাতীয় খেলা।

9. ফিজি সম্পূর্ণরূপে মনোরম দৃশ্যে পূর্ণ, এখানে প্রচুর হ্রদ, অনেক দ্বীপপুঞ্জ এবং বিভিন্ন ধরণের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য রয়েছে যা প্রতি বছর কয়েক মিলিয়ন লোক দেখেন। পর্যটকরাও ফিজির আয়ের প্রধান উত্স।

১০. ফিজি পর্যটকদের ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, নিউজিল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়াকে পিছনে ফেলেছে ।

১১. ফিজিতে প্রায় ৪০ শতাংশ ভারতীয় ভারতীয়, বেশিরভাগ লোকেরা খ্রিস্টান ও হিন্দু ধর্ম অনুসরণ করেন।

নাদি, ফিজি, ১৯৯ 1996 শ্রী শিব সুব্রামণিয়া মন্দির, ফিজির বেশ কয়েকটি হিন্দু মন্দিরের একটি

১২. ফিজিতে প্রচুর সংখ্যক হিন্দু মন্দির উপস্থিত রয়েছে। এই স্থানের নন্দী এলাকার মোজুদ শ্রী শিব সুব্রহ্মণ্য মন্দির এই দেশের বৃহত্তম হিন্দু মন্দির।

১৩. ফিজিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি ঐতিহ্য ছিল, যেখানে মহিলাদের স্বামীদের মৃত্যুর সাথে মৃত্যু বরণ করতে হত, যার অর্থ স্বামীর মৃত্যুর পরে তার স্ত্রীকেও মারা যেতে হত, যেটা এক সময ভারতে সর্তী দাহ বলা হয়।  এখন এই রীতি বন্ধ হয়ে গেছে।

১৪. ফিজির তাবুয়া ঐতিহ্য অনুসারে, একটি ছেলের মেয়েকে বিয়ে করার জন্য মেয়ের বাবার কাছে তিমি মাছের দাঁত দিতে হয়। এই ঐতিহ্য আজও অব্যাহত রয়েছে।

15. ফিজির আয়ের দ্বিতীয় উত্সটি মাছ , চিনি এবং সিরিয়াল রফতানি থেকে আসে।

১৬. ফিজিতে, জাইদার দ্বীপে একটি আগ্নেয়গিরি রয়েছে ।

১৭. ফিজির মোট জনসংখ্যার প্রায় 87 শতাংশ ভিটি লিউ দ্বীপ এবং ভানুয়া লিউ দ্বীপে বসবাস করে

১৯. ফিজির রাজধানী সুভা সর্বাধিক পরিমাণে বৃষ্টিপাত হয়, সপ্তাহে কমপক্ষে 2 দিন বৃষ্টি হয়। এ কারণে এখানে মানুষের ভিড় বেশি।

 

২০. ফিজির প্রায় 60 শতাংশের বিদ্যুত রয়েছে ।

২১. ফিজিতে ভারতীয়, চীনা এবং ইউরোপীয় সংস্কৃতির মিশ্রণ দেখা যায়। এখানকার নাচ আফ্রিকার আদিবাসীদের নাচের সাথে খুব মিল।

 

 

ভারতীয় হিন্দুদের আগমনের পর থেকেই প্রার্থনার জন্য ফিজিতে মন্দির গড়ে উঠেছে। ফিজির অধিকাংশ মন্দির উত্তর ও দক্ষিণ ভারতীয় স্থাপত্যরীতিতে গড়ে উঠেছে। ১৯১০ সালে নির্মিত শিউ হিন্দু মন্দির এর প্রকৃত উদাহরণ। ফিজির নাদিতে অবস্থিত শ্রী শিব সুব্রমাণিয়া হিন্দু মন্দির ফিজির বৃহত্তম মন্দির। এছাড়া ফিজির হিন্দু মন্দিরগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, মাউনিভাতু সনাতন ধরম রাম মন্দির, নাগ মন্দির, লক্ষ্মী নারায়ণ মন্দির, শ্রী রাজ মহা মারিয়াম্মান মন্দির, সনাতন ধরম বিষ্ণু মন্দির, ইসকন হরেকৃষ্ণ মন্দির, শ্রী ভেঙ্কাটেশ পারমাল মারিয়াম্মান মন্দির প্রভৃতি। মন্দিরের পাশাপাশি হিন্দুরা এখানে গড়ে তুলেছেন অসংখ্য স্কুল ও কমিউনিটি সেন্টার। এই প্রতিষ্ঠানগুলো ফিজির আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করছে।

ফিজির হিন্দু মন্দির
ফিজির বৃহত্তম মন্দির শ্রী শিব সুব্রমাণিয়া মন্দির

বর্তমানে ফিজিতে বসবাসরত হিন্দুরা উচ্চতর সামাজিক অবস্থানে রয়েছেন। ফিজির বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব দিচ্ছেন হিন্দু ধর্মের লোকেরা। প্রায় ৫০০০ হিন্দু ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অংশ হিসেবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেয়। ফিজিয়ান হিন্দুরা যেসব ধর্মীয় উৎসব পালন করেন তাঁর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, রামনবমী, হোলি এবং দিওয়ালী। একসময় হোলি, ফিজির হিন্দুদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব হলেও বর্তমানে দিওয়ালী প্রধান ধর্মীয় উৎসব। এদিনটি ফিজিতে সরকারী ছুটির দিন।

১৯৭০ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার সময় ফিজির প্রায় ৫০ শতাংশ জনসংখ্যা ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বী। কিন্তু কম সন্তান উৎপাদন মনস্কতা এবং আরো উন্নত জীবনের প্রত্যাশায় ইউরোপ-আমেরিকায় পাড়ি জমানোর কারণে বর্তমানে হিন্দু সংখ্যা ৩৭.৫ শতাংশ নেমে এসেছে।

 

লেখক-অভিরুপ বন্দ্যোপাধায়

কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়