গাছ,পশু, নদীর পূজা এই ধর্মীয় রীতি কুসংস্কার না বিজ্ঞান?-সোজাসাপ্টা

কতটা মূর্খ হলে মানুষ গাছকে পূজা করে, পশু পাখিকে পূজা করে, নদীকে পূজা করে, সূর্যকে পূজা করে, মাটিকে পূজা করে? এ ধরনের প্রশ্ন শুনতে শুনতে  ছোট থেকে বড় হয়েছি। কখনো কখনো নিজের মনের ভিতর প্রশ্ন উঁকি দিয়েছে কিন্তু উত্তর খুঁজে পাইনি। ঠাকুমা কে  দেখেছি  বটগাছের নিচেই   কালী পিড়িতে পূজা দিতে। কী মূর্খ, কী মূর্খ ! ছোটবেলায় দেখেছি পৌষ সংক্রান্তি ছাড়াও কিছু বিশেষ দিনে আমার নিরক্ষর ঠাকুমা চাপাচাপিতে নিম হলুদ এর রস খেতে দিত। 

 

যাকে আমাদের এখানের আঞ্চলিক ভাষায় ‘হাড় বিষু’ বলা হয়।  গ্রাম অঞ্চলে গাসির দিনটায় তেতুল পুড়িয়ে খাওয়া এবং গায়ে মাখা ইত্যাদি কী মূর্খতা !উনুনের কয়লা দিয়ে দাঁত মাজা, সর্দি কাশি হলে তুলসী পাতা বাসক পাতার রস খাওয়া। ছিঃ ছিঃ কি মূর্খতা! বাইরে থেকে এসে হাত পা না ধুয়ে ঘরেই ঢুকতে দিতো না ঠাকুমা বুড়ি।  শ্মশান থেকে, মরা বাড়ি থেকে এমনকি হসপিটাল থেকে আসলে স্নান না করে ঘরে ঢুকতে দিত না  বুড়ি। 

 

কিন্তু এখন কেন জানি সব গুলিয়ে যায় – আমার নিরক্ষর মূর্খ ঠাকুমার কিছু না জেনেই পরম্পরা গত ভাবে মেনে আসা ঐ ‘মূর্খতা’ গুলি আসলে কী ছিলো? আর বিচার না করেই সেগুলিকে অস্বীকার করে উড়িয়ে দেওয়ার নামই কি আধুনিকতা, প্রগতিশীলতা, বিজ্ঞান মনষ্কতা? হলুদ বা নীমের যতো গুণই থাকুক, আধুনিক বিজ্ঞানও নানা ভাবে পরীক্ষা করে সেটা স্বীকার করুক  – এইসব ভেষজের উপকারিতা আজ আমাকে অস্বীকার করতেই হবে – কারণ এগুলি প্রাচীন হিন্দু শাস্ত্র আয়ুর্বেদ এর আবিষ্কার। যতোই সারা বিশ্ব স্বীকৃতি দিক, যোগা যেহেতু প্রাচীন হিন্দু সংস্কৃতির অংশ, তার উপর আবার মোদী এর প্রচার করছে – এর বিরোধিতা করতেই হবে, এর উপযোগীতাকে অস্বীকার করতেই হবে। 

 

মেডিটেশান খুব ভালো জিনিস, কিন্তু যোগা ভীষণ খারাপ ! শরীর মন দুটোকেই সুস্থ রাখতে ভীষণ উপযোগী আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্য যোগা ধ্যানকে আমরা এতোদিন পাত্তাই দিই নি। কিন্তু যেই না বিলেত থেকে ‘মেডিটেশান’ নাম নিয়ে আমাদেরই জিনিস আমাদের কাছে এলো – গলিতে গলিতে মেডিটেশান ক্লাব! ছ্যা ছ্যা, ঘৃতকুমারী আবার কী জিনিস, অ্যালোভেরা খুব ভালো। ভেষজ শব্দটার মধ্যেই কেমন যেন ঘাস ঘাস গন্ধ। কিন্তু হার্বাল শব্দটা কী কিউট! ‘কবিরাজী ওষুধ’ নামটার মধ্যেই কেমন একটা বোঁটকা গন্ধ! নিজেদের এতো উন্নত প্রাচীন আয়ুর্বেদ চিকিৎসাকে পাত্তাই দিই নি আমরা, অথচ সেই একই কবিরাজী ওষুধ বিদেশ থেকে স্বীকৃতি নিয়ে এলে আয়ুর্বেদ নিয়ে আমরা পাগল। 

 

রবীন্দ্রনাথকেও কেউ পাত্তা দেয় নি, বিলেত থেকে নোবেল পাওয়ার পর, বিলাত স্বীকৃতি দেবার পর মাথায় তুলে সে কী নাচানাচি! বড় বড় কোম্পানির টুথপেস্টের বিজ্ঞাপনে অ্যাক্টিভ কোল, অ্যাক্টিভ সল্টের চমক দেখে মনে পড়ে যায় আমার নিরক্ষর সেই ঠাকুমার কথা। অনেক আগে এদেশে গাছের সঙ্গে,পশুর সাথে মেয়েদের বিয়েও দেওয়া হত অনুষ্ঠান করে। কি কুসংস্কার বলুন তো ! তাই উঠে গেছে। এখন আবার মেক্সিকো, জাপান সহ বিভিন্ন দেশে দেখতে পাচ্ছি, এখন এটা পরিবেশ প্রেম ! আগে আমরা গাছ পুঁতে জন্ম দিন পালন করতাম, কি প্রকৃতি ও সংস্কার বাদী চিন্তা! আবার ছোট ইলিশ যাতে ধরা না পড়ে, বংশ না শেষ হয়, তাই সরস্বতী পূজার আগে ইলিশ খাওয়া ছিল বারণ।

 

এখনও বট গাছ কেউ কাটতে চায় না, সরকারি কাজের জন্য কাটতে হলে অন্য সম্প্রদায়ের লোক দিয়ে কাটাতে হয়। কী প্ৰকৃতি বাদী চিন্তা ! আইন করতে হয় নি, ‘পাপ’ শব্দটা দিয়ে সংস্কার হিসাবে মনে গেঁথে দেওয়া হয়েছে। আমার ঠাকুমাকে দেখতাম পিঠা করলে প্রথম পিঠাটা পাখিদের জন্য চালের উপর ছিটিয়ে দিতেন। পাখি বা পরিবেশ প্রেম ট্রেম কিছু নয়, এটা নাকি নিয়ম। এটা পরম্পরা গত চলে আসা সংস্কার! পরিবেশ প্রেম, মানবিকতা সব ধর্মের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার! হ্যাঁ, হিন্দুরা গাছকে লাল শালু জড়িয়ে পূজো করে, পূজো করে গরুকে, এমনকি নদীকেও। 

 

কিন্তু কেন করে, সেটা বুঝতে গেলে যে উপলব্ধির দরকার, যে উন্নত দর্শন দরকার, সেটা সবার থাকে না। বিশেষ করে যাদের মধ্যে বিন্দুমাত্র কৃতজ্ঞতা বোধ নেই, তাদের এবং তাদের রক্ত সম্পর্কিত বস্তুবাদী তুতুভাইদের সেটা বোঝার কথাই নয়। তাদের কাছে প্রকৃতি হোল ধর্ষণ যোগ্য, ‘মাল ই গণিমত’ ! কন্যা সন্তানের সম্প্রদান অর্থাৎ বিয়ে না দিলে পিতার হাত শুদ্ধ হয় না – গোঁড়ামি.. , কুসংস্কার..? নাকি কন্যা সন্তানের জন্মে উৎসাহ দান? আর একই গোত্রের মধ্যে বিয়ের নিষেধাজ্ঞা..? ধর্মই আইন, আইনই ধর্ম ! 

ও হ্যাঁ, বিজ্ঞান দিয়ে ধর্ম ! আমার ঠাম্মা একেবারেই নিরক্ষর, কালো রং তাপ শোষক জানারই কথা নয়। কিন্তু ছোটবেলায় দেখতাম ভাতের হাঁড়ির নিচে মাটি দিয়ে প্রলেপ দিতে। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলে উত্তর পেতাম এতে রান্না তাড়াতাড়ি হয়। কয়েক দিন পর কাঁচা উনুনের আগুনে হাঁড়ির নিচের দিকটা কালো হয়ে যেত। হিন্দুদের প্রত্যেক আচার অনুষ্ঠানে হলুদ নিম অপরিহার্য অঙ্গ। বংশ পরম্পরায় এগুলি চলে এসেছে, যুক্তি পূর্ণ হয়েও কোন যুক্তি তর্কের দরকার পড়ে নি। বিজ্ঞান দিয়ে বুঝতে পারবে না বলেই কি ধর্ম বা সংস্কারের প্রচলন? 

 

বিজ্ঞান হজম হবে না বলেই কি ধর্ম ভীরুতাকে কাজে লাগিয়ে ধর্ম মিশিয়ে দেওয়া? কে জানে…! এই ঠাকুমাকেই দেখতাম, একাদশীর উপোসের পরের দিন খুব সহজ পাচ্য খেতেন, এই দিনটারও একটা নাম ছিলো – যতটুকু মনে পড়ে আমরা ‘পারণা’ বলতাম। আমরা সেদিন মুখিয়ে থাকতাম সাগুর খিচুড়ি আর মিষ্টি আলু সেদ্ধ বা পোড়া খাওয়ার জন্য। বড় হয়ে শুনলাম, চিকিৎসা বিজ্ঞান বলে যে উপোসের পর ভারী খাওয়া ঠিক নয়। আমার ঠাকুমা কিন্তু পড়াশোনা জানতেন না। বুড়ি কপালে দুই ভ্রূর মাঝখানে তিলক কাটতো, আমরা বলতাম বগার ইয়ে।

 

কিন্তু দুই ভ্রূর মাঝখানে আঙুল ঘোরালে শিরশিরে অনুভূতি, দুই ভ্রূর মাঝখানে মনোযোগ এনে ধ্যান, প্রাচীন কাল থেকে সনাতন ধর্মে কপালে ফোঁটা, তিলক বা মহিলাদের সিঁদুর, হিন্দু দেবদেবী দের ত্রিনয়ন বা তৃতীয় চোখ – এখন শুনি বিজ্ঞান বলছে এসবই রহস্যময় পাইনাল(Pineal) গ্ল্যান্ডের কারসাজি। নিখুঁত তিথি অনুযায়ী অমাবস্যা, পূর্ণিমা, জোয়ার ভাটা চন্দ্র গ্রহণ, সূর্য গ্রহণ! পৌষ বা মকর সংক্রান্তি সূর্যের উত্তরায়ন, কৃষি নির্ভর দেশে ফসলের বীজ রোপণ সব একাকার। ধর্ম, প্রকৃতি জীবন বিধান সব একাকার।

 

যুগে যুগে এই পৃথিবী কম তো মহামারী দেখে নি। জন্মলগ্ন থেকেই হয়তো সঙ্গী, সঙ্গী সাবধানতাও। ‘আধুনিক’ ‘সভ্য’ দের মতো নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট স্থানে জড়ো হয়ে সবাই প্রার্থনা করার বাধ্যবাধকতা যে প্রাচীন ‘কুসংস্কারাচ্ছন্ন’ হিন্দুদের নেই, বহু যুগ ধরে নিজের নিজের ঘরেই ব্যবস্থা  – সেটা কি এজন্যই ? কী জানি বাবা – হাত না মিলিয়ে নমস্কার, মাটি চাপা না দিয়ে মৃতদেহ দাহ, মৃতদেহের সঙ্গে মৃতের ব্যবহার করা বিছানা পোড়ানো, দাহ করে বা হাসপাতাল থেকে এসে কাপড় ছেড়ে স্নান, মৃতের পরিবারকে আলাদা রাখতে অশৌচ পালন।

 

অশৌচের সময় যাতে বাজার করতে বাইরে বেরোতে না হয় – তার জন্য জ্ঞাতি বা আত্মীয়দের পক্ষ থেকে হবিষ্যির জিনিস এনে দেওয়া এবং মৃতের বাড়ি থেকে ফিরে চান করে বাড়ি ঢোকা, ক্ষৌর কর্ম থেকে সংক্রমণ ছড়াতে পারে বলে অশৌচের সময় চুল দাড়ি না কাটা, বাইরে বেরোলে অপরিচিতরা যাতে ছুঁয়ে না দেয় বা ছোঁয়া লেগে গেলেও যাতে চান করে – তার জন্য ঐ সময় আলাদা ড্রেস কোড। সবই কুসংস্কার…? ঘরে ঢোকার আগে হাত পা ধোয়া, খাদ্যাভাস, যোগা, খাদ্যে অ্যান্টিবায়োটিক নিম হলুদ মেথী কালো জিরে – সবই তো নাকি কুসংস্কার। কিন্তু এখন দেখছি অতি সভ্য জগৎ আরো বেশি কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে। এমনকি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা WHO পর্যন্ত! ছিঃ ছিঃ!

 

গো মূত্রে ক্যান্সার সারে – তাই বলে ঐ কথাকে ব্যঙ্গ করতে গিয়ে নিম হলুদের গুণ কেও অস্বীকার করতে হবে। অস্বীকার করতে হবে সুশ্রুত, চরককে! এই ধরনের অন্ধ বিরোধিতাও এক ধরনের মৌলবাদ! গণেশের দুধ খাওয়া দিয়ে ঢেকে দেওয়া হবে আর্যভট্ট বরাহমিহির, ব্রহ্ম গুপ্ত বা ভাষ্করাচার্য্যদের। সব ‘বিগ্যান’ এর আধার এক কিতাবের যে অনুসারীরা মাত্র চৌদ্দশো বছর আগেও শৌচাগারের ব্যবহার না জানায় খেজুর বাগানে খোলা আকাশের নিচে নারী পুরুষ মিলে শৌচকর্ম করতো – তা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হবে হাজার বছর আগে আবিষ্কার করা নির্ভুল গাণিতিক ফর্মূলা এবং পরিমাপ সংক্রান্ত ‘সূর্য সিদ্ধান্ত’ বা ‘সিদ্ধান্ত শিরোমণি’ র মতো অঙ্ক শাস্ত্র গুলিকে। 

 

ঢেকে দিতে হবে হাজার হাজার বছর আগে শৌচাগার থেকে শুরু করে পয়ঃপ্রনালীর ব্যবহার জানা হরপ্পা মহেঞ্জোদারোর সিন্ধু সভ্যতাকে। ধর্মের নামে প্রবর্তিত এক সাম্রাজ্যবাদী রাজনৈতিক বর্বর মতাদর্শের সঙ্গে মানব কল্যাণের উদ্দেশ্যে মানুষের ধর্ম ভীরুতাকে কাজে লাগিয়ে ধর্মের নামেই প্রবর্তিত আরেক উন্নত জীবন বিধানকে এক করে গুলিয়ে দেওয়া যে হচ্ছে – তা নয়, প্রথমটাকে প্রসারের সুযোগ করে দিতে ধর্মের বিরুদ্ধে লড়াই এর নামে, ধর্মহীন উন্নত সমাজের নামে দ্বিতীয়টাকে মুছে দেওয়ার ষড়যন্ত্র চলছে।

 

 

আমাদের পূর্বপুরুষরা এই পৃথিবীর প্রতিটি ধূলিকণা কে যাতে আমরা শ্রদ্ধা করি, তার জন্য হয়তোবা বিজ্ঞানের কাজ হবেনা তাই ধর্মের রং লাগিয়ে আমাদের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে। আবার এমনও হতে পারে যাকে আজ আমরা ধর্ম বলছি সেটাই হয়তোবা ওই সময় বিজ্ঞান ছিল। এমনভাবে আমাদের মস্তিষ্কে গাছ, পশুপাখি, নদী, মাটির প্রতি শ্রদ্ধা ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে, যে আমরা এখন আর অপ্রযোজনে এই  প্রাকৃতিক উপাদান গুলোকে ক্ষতি করতে পারিনা। সেটা হয়তোবা আজ আমাদের সমাজে পাপ বোধ বলা হয়, যাকে আপনারা আধুনিক সভ্যতায় বলছেন পরিবেশপ্রেমী। শুধু বিরোধিতার স্বার্থে বিরোধিতা করবেন না দয়া করে, আমাদের পূর্বপুরুষেরা যেগুলো আমাদেরকে পরমরায় দিয়ে গেছে তার পিছনে কিন্তু না খুঁজে মূর্খ বলে সবকিছু উড়িয়ে দেবেন না।  কে জানে আজকে আপনার যেটা  অজানা সেটা হয়তোবা  আপনারই  মূর্খতা। 

ভালো লাগলে লাইক শেয়ার………..

 

 লেখক-অভিরূপ বন্দোপাধ্যায়।