হায় নােয়াখালি। তােমার উপরেই হয়েছিল পাকিস্তান তৈরীর প্রথম পরীক্ষা। না, ভুল বললাম। প্রথম সফল পরীক্ষা। কারণ, প্রথম পরীক্ষা হয়েছিল কলকাতায়। কিন্তু সে পরীক্ষা ব্যর্থ হয়ে যায়। তখন বেছে নেওয়া হয়েছিল তােমাকে। সেদিন ঘাতকের হাত থেকে তােমাকে আমরা বাঁচাতে পারিনি। না। আমরা কেউ পারিনি। প্রগতিশীলরা পারিনি, অহিংসবাদীরা পারিনি, বিপ্লবীরা পারিনি, মার্কসবাদীরা পারিনি, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা পারিনি, সর্বধর্ম সমন্বয়কারীরা পারিনি, জড়বাদীরা পারিনি, এমনকি হিন্দুত্ববাদীরাও পারিনি। আমাদের সকলের সমস্ত তত্ত্ব সবকিছু চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে তােমার উপর দিয়ে সফল হয়ে গেল পাকিস্তান তৈরীর পরীক্ষা। | কলকাতায় ঘাতকেরা ব্যর্থ হওয়ার পর নােয়াখালি তােমাকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। শ্যামলা বাংলার সবুজ প্রকৃতির কোলে, কলকাতা থেকে অনেক দূরে, এতদূরে যে তােমার আর্তনাদ, তােমার কান্নার শব্দ কলকাতা আর দিল্লীতে পৌঁছতে যেন অনেক দেরী লাগে, পদ্মা মেঘনার সঙ্গমে, নদী নালার বেষ্টনে, সুপারিনারকেলের নিবিড় ছায়া ঘেরা তুমি নােয়াখালি। কিন্তু শুধু তােমাকেই বেছে নেওয়া হল কেন?
কিন্তু ইতিহাসের ছাত্র, যে কোন ছাত্র, যদি তার চোখে কোন রঙীন চশমা পরা থাকে, তাহলে সে বলবে যে তােমার একটাই অপরাধ ছিল। তা হল, মাত্র আঠারাে শতাংশ হিন্দু ছিল তােমার বুকে। বাকী সব? হিন্দুনয়। তাই তােমাকে বেছে নেওয়া হয়েছিল রহম আলি, ইকবাল আর জিন্নার তত্ত্বের পরীক্ষাগার হিসাবে। শব ব্যবচ্ছেদকারী ডাক্তারি ছাত্রের গিনিপিগ হিসাবে। মাটি যাদের কাছে মা নয়, মা যাদের কাছে জমিমাত্র, সম্পত্তি মাত্র, তাই জমিকে ভাগ করার মত মাকেও ভাগ করা যায়-এই তত্ত্বেরই উদগাতা ছিলেন ঐ এয়ী। আর জড়বাদ বস্তুবাদের দোহাই পেড়ে ঐ তত্ত্বকে নিঃসংকোচ নির্লজ্জ সমর্থন জানিয়েছিল কমিউনিস্টরা যারা পদ্মা-মেঘনা যেখানে সাগরের সঙ্গে মিশেছে, সেইখানে সেই নােয়াখালি এখনও আছে। আজও সেখানে নদী নালার উপর নারকেল সুপারির ঘন ছায়া পড়ে। কিন্তু আজ আর সেখানে মন্দিরে মন্দিরে বাজেনা ঘন্টাধ্বনি।সন্ধ্যাবেলায় গলায় আঁচলহয় না দোল-দুর্গোৎসব। শােনা যায় না মৃদঙ্গের মধুর ছন্দে কীর্তন। বসে না সংক্রান্তি গাজনের মেলা। কিন্তু কেন?
কারণ, এগুলি আমরা ধরে দিয়েছি আমাদের প্রগতিশীলতা আর আমাদের অহিংসার মূল স্বরূপ। কিন্তু তাতেও আমাদের শিক্ষা হয়নি। আমাদের প্রগতিশীলতা আর অহিংসার যূপকাষ্ঠে তারপর আমরা বলি দিয়েছি সমগ্র পূর্ব বাংলাকে, পাঞ্জাবকে, বালুচিস্তানকে, উঃপঃ সীমান্ত প্রদেশকে। আর হ্যা, বলি দিয়েছি সেই সিন্ধুকেও যেখানে উচ্চারিত হয়েছিল প্রথম বেদমন্ত্র। যে সিন্ধুনদের তীরেউচ্চারিত হয়েছিল “অসদো মা সঙ্গময় তমসাে মা জ্যোতির্গময়’ সেখানে আজ শুধু আজানের ধ্বনিই ওঠে, আর সবধর্ম সমন্বয়ের স্বর ফোটে সেই সিন্ধু থেকে অনেক দূরে শুধু গঙ্গার ধারে। আমাদের সর্বধর্ম সমন্বয় দিয়ে সিন্ধুকে আমরা বাঁচাতে পারিনি। আমাদের ছােটবেলার প্রিয় আব্দুল চাচা পদ্মাকেও আমরা বাঁচাতে পারিনি। হায়! তবু আমাদের শিক্ষা হয় নি। ঐ চশমাগুলাে আমরা এখনও খুলিনি। যে চশমাগুলাে পরে পথ চললে পথ পরিস্কারভাবে দেখা যায় না। রাস্তায় হোঁচট খেতে হয়, খানাখন্দে পড়তে হয়। এমনকি গভীর-গহুরকাশ্মীর। জ্বলন্ত রক্তঝরা কাশ্মীর। ভারতের সেই ভূস্বর্গে হিমালয়ের শুভ্র বরফে আজ রক্তের দাগ। শিক্ষা আমাদের হয়নি, তাই শুধু সিন্ধু আর পদ্মাই নয়, এইবার আমরা ঝিলমকেও বিসর্জন দিতে বসেছি। শিক্ষাআমাদের হয়নি, তাই ঝিলম্ তীর নিবাসী আড়াই লক্ষ হিন্দু আজ নিজভূমে পরবাসী, উদ্বাস্তু। এরপর কী?
পদ্মা যাদেরকে ঠাই দিতে পারে নি, গঙ্গা তাদেরকে ঠাই দিয়েছে। সিন্ধু যাদেরকে অনেক দুঃখে কোলছাড়া করেছে, তাদেরকে ঠাই দিয়েছে যমুনা। ঝিলমও যাদেরকে স্থান দিতে পারল না, তাদেরও স্থান হলযমুনার ধারে। কিন্তু যমুনা নর্মদা গােদাবরী কাবেরী সব চলে গেলে? তাই আজ আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। সে শিক্ষা দিতে পারে সিন্ধু পদ্মা আর ঝিলম্। কিন্তু সিন্ধু আর ঝিলম্ অনেক দূরে। আমরা বাংলার কতিপয় ছাত্র, না ভুল বল্লাম, পশ্চিমবাংলার কতিপয় ছাত্র,আমরা কান পেতেছি পদ্মার বুকে। পদ্মার সে কলকল ধ্বনি কি আমাদেরকে কিছু শােনাবে?পদ্মা, তুমি কি এর আগেও কিছু বলার চেষ্টা করেছিলে আমাদেরকে?বুকের রক্ত মােক্ষণ করতে করতে, গলা ছিড়ে রক্ত বের করতে করতে চিৎকার করছিল যে শ্যামাপ্রসাদ, তার কণ্ঠ দিয়ে?কিন্তু আমরা, প্রগতিশীল বাঙালীরা কান বন্ধ করে রেখেছিলাম, চোখ ঘুরিয়ে রেখেছিলাম। আমাদের সেই বধিরতা আর আমাদের সেই অন্ধত্বের মূল্য আমাদের আগের প্রজন্ম দিয়েছে। আর, তার ফল ভােগ করছি আমরা।
তাই আজ আমরা কিছু শুনতে চাই, কিছু বুঝতে চাই। আমরা চাই কিছু শিক্ষা নিতে, পদ্ম তােমার কাছ থেকে। আর নােয়াখালি, তােমার কাছ থেকে। জানতে চাই তােমার সেই ছেচল্লিশ সাতচল্লিশের রক্তঝরাদিনগুলাের কথা। যে দিনগুলাে থেকে আমাদের দৃষ্টি ঘুরিয়ে রেখেছে বাঙালী বুদ্ধিজীবীরা, প্রগতিশীলরা, দেশ বিদেশের পুরস্কার প্রাপ্ত শিল্পী সাহিত্যিকেরা। নােয়াখালি, তােমার সে কান্নার কথা তারা আমাদের জানতে দেয়নি।পাঞ্জাব ভাগের উপর রচিত হয়েছে অনেক তমস্’। কিন্তু বাংলাভাগ নিয়ে রচিত হয়নি কোন তমস্ বাংলার দুর্ভাগ্যের সে প্রদোষকালের কথা আজকের প্রজন্মের কাছে তমসাচ্ছন্ন।। আমরা, এই বাংলার গুটিকয় ছাত্র চাই সে তমকে ভেদ করতে। আবরণ উন্মােচন করতে চাই আমাদের সে দুর্ভাগ্যের ইতিহাসের। সে ইতিহাস তাে দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে! কারণ, লেখা নেই কোথাও। আর ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী, ভুক্তভােগী মানুষগুলােও তাে কালের অমােঘ নিয়মে একে একে বিদায় নিচ্ছে এ পৃথিবী থেকে। তাই, আমাদের বড় তাড়া, গােটা বাংলা ভাগের তত্ত্বকে
নয়, তথ্যকে ধরে রাখতে। মুক্তবুদ্ধির আগামী প্রজন্ম সে তথ্যকে বিশ্লেষণ করে নিজেরাই খুঁজে বের করে নেবে তত্ত্বকে। | আমাদের সেই প্রচেষ্টারই অঙ্গ এই নােয়াখালি নিযে এই লেখাটি । বাঙালী পাঠকবর্গের আশীর্বাদ পেলে আমরা শীঘ্রই সম্পূর্ণ করতে পারব আমাদের প্রচেষ্টাকে। রচিত হবে বাংলার অসম্পূর্ণ ইতিহাস।
বিস্তারীত জানতে এই ই-বুকটি পড়ুন